রামাদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো কুরআন তিলওয়াত। বিগত খুতবায় আমরা এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। রামাদানে দুভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে: প্রথমত কুরআন কারীম দেখে দেখে দিবসে ও রাতে তিলাওয়াত করতে হবে। সাহাবী-তাবিয়ীগণ রামাদানে এভাবে তিলাওয়াত করে কেউ তিন দিনে, কেউ ৭ দিনে বা কেউ ১০ দিনে কুরআন খতম করতেন। আমাদের সকলকেই চেষ্টা করতে হবে রামাদানে কয়েক খতম কুরআন তিলাওয়াতেরর। তিলাওয়াতের সাথে তা বুঝার জন্য অর্থ পাঠ করতে হবে।

কুরআনের অর্থ বুঝা,

চিন্তা করা ও আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যার জন্য অতিরিক্ত সাওয়াব, বরকত ও ঈমান বৃদ্ধির কথা কুরআন ও হাদীসে বলা হয়েছে। সম্ভব হলে অর্থসহ অন্তত একখতম কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে। যারা তিলাওয়াত করতে পারেন না তারা আল্লাহর ওয়াস্তে রামাদানে তিলাওয়াত শিখতে শুরু করুন। অবসর সময়ে তিলাওয়াতের বা অর্থসহ তিলাওয়াতের ক্যাসেটে শুনুন। কুরআন তিলাওয়াতে যেমন সাওয়াব, তা শ্রবণেও তেমনি সাওয়াব। 

কুরআনের দ্বিতীয় আসর হলো কিয়ামুল্লাইল।

সালাতুল ইশার পর থেকে সুবহে সাদেক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে কোনো সময়ে নফল সালাত আদায় করাকে কিয়ামুল্লাইল, সালাতুল্লাইল বা রাতের সালাত বলা হয়। তাহাজ্জুদও কিয়ামুল্লাইল। একটু ঘুমিয়ে উঠে কিয়ামুল্লাইল আদায় করলে তাকে তাহাজ্জুদ বলা হয়। সারা বৎসরই কিয়ামুল্লাইল করা দরকার। রামাদানের কিয়ামের বিষযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: 

مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

“যে ব্যক্তি খাটি ঈমান ও ইখলাসের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাওয়াবের উদ্দেশ্যে রামাদানে কিয়ামুল্লাইল আদায় করবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।” 1বুখারী, আস-সহীহ ১/২২, ২/৭০৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫২৩।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

রামাদান ও গাইর রামাদান সর্বদা প্রতি রাতে মধ্য রাত থেকে শেষ রাত পর্যন্ত ৪/৫ ঘন্টা ধরে কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন। তিনি এত লম্বা কিরাআত ও দীর্ঘ রুকু সাজদা করতেন যে, অনেক সময় ২ বা ৪ রাকাতেই এ দীর্ঘ ৪/৫ ঘন্টা শেষ হতো। সাধারণত তিনি ৪/৫ ঘন্টা ধরে ৮ বা ১০ রাকাত সালাতুল্লাইল এবং ৩ রাকাত বিতর আদায় করতেন। রামাদানে সাহাবীগণ তাঁর সাথে জামাতে কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদ আদায় করতে আগ্রহী ছিলেন।

কিন্তু কিয়ামুল্লাইল ফরয হওয়ার ভয়ে তিনি জামাতে আদায় না করে ঘরে পড়তে উপদেশ দেন। সে সময়ে অধিকাংশ সাহাবীই কুরআনের পূর্ণ বা আংশিক হাফিয ছিলেন। এজন্য তারা প্রত্যেকে যার যার মত ঘরে, বিশেষত শেষ রাতে রামাদানের কিয়াম আদায় করতেন। উমার (রা)-এর সময়ে দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরা কুরআনের হাফিয না হওয়াতে হাফিযদের পিছনে কিয়াম করতে চেষ্টা করতেন। এজন্য মসজিদে নববীতে সালাতুল ইশার পরে ছোট ছোট জামাত শুরু হতো।

এ দেখে উমার (রা) উবাই ইবনু কাব (রা)-কে বলেন, মানুষেরা দিবসে রোযা রাখে, কিন্তু তারা কুরআনের হাফেয না হওয়াতে রাতের কিয়াম ভালভাবে আদায় করতে পারে না। এজন্য আপনি তাদেরকে নিয়ে সালাতুল ইশার পরে জামাতে কিয়াম বা তারাবীহ আদায় করেন। এছাড়া তিনি সুলাইমান ইবনু আবী হাসমাকে নির্দেশ দেন মহিলাদের নিয়ে পৃথক তারাবীহের জামাত করতে। উসমান (রা) ও আলী (রা)-এর সময়েও এভাবে জামাতে তারাবীহ আদায় করা হতো এবং মহিলাদের জন্য পৃথক তারাবীহের জামাত কায়েম করা হতো।2বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা, ২/৪৯৩।

উমার (রা)-এর সময়ে

৮ ও ২০ রাকআাত তারাবীহ পড়া হতো বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, সাহাবী-তাবিয়ীদের সময়ে ইশার পর থেকে মধ্য রাত বা শেষ রাত পর্যন্ত তারাবীহের জামাত চলত এবং তাঁরা প্রত্যেক রাকআতে ১/২ পারা কুরআন পাঠ করতেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, প্রথম দিকে ৮ রাকাত তারাবীহ আদায় করা হতো। প্রত্যেক রাকাতে তারা ১/২ পারা কুরআন পাঠ করতেন এবং ইশার পর থেকে শেষ রাত পর্যন্ত প্রায় ৫/৬ ঘন্টা তারা এভাবে সালাত আদায় করতেন। প্রতি রাকাতে আধা ঘন্টা বা তার বেশি দাঁড়াতে কষ্ট বেশি। এজন্য পরে তারা এরূপ ৫/৬ ঘন্টা ধরে ২০ রাকাত পাঠ করতেন। রাকআাতের সংখ্যা বাড়াতে দাঁড়ানো কষ্ট কিছুটা কম হতো।

তাহলে, কিয়ামুল্লাইলের মূল সুন্নাত হলো নামাযে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত করা। বর্তমানে আমরা কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের চেয়ে সংখ্যা গণনা করা ও তাড়াতাড়ি শেষ করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। অনেকে আবার ৮/১০ রাকাত পড়েই চলে যান। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: 

مَنْ قَامَ مَعَ الإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ

“যদি কেউ ইমামের সাথে শেষ পর্যন্ত কিয়ামুল্লাইল আদায় করে তবে সে সারারাত কিয়ামুল্লাইলের সাওয়াব লাভ করবে।”3তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৯; নাসাঈ, আস-সুনান ৩/২০২। তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।

পূর্ববর্তী যামানার

মানুষেরা প্রায় একঘন্টা ধরে ৪ রাকআত তারাবীহ আদায় করে এরপর কিছু সময় বিশ্রাম করতেন। আমরা ৮/১০ মিনিটে ৪ রাকাত আদায় করেই বিশ্রাম করি। এ সময়ে নীরবে বিশ্রাম করা যায়, বা কুরআন পাঠ, যিকর, দরুদ পাঠ বা অন্য যে কোনো আমল করা যায়। এ বিশ্রামের সময়ে আমাদের সমাজে যে দুআ ও ম্নুাজাত প্রচলিত আছে তা কোনো হাদীসে বা পূর্ববর্তী ফিকহের গ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায় না।

পরবর্তী আলিমগণ দুআ ও মুনাজাতটি বানিয়েছেন। এর অর্থে কোনো দোষ নেই। তবে অনেকে মনে করেন যে, দুআ ও মুনাজাতটি বোধহয় তারাবীর অংশ বা তা না হলে তারাবীহের সাওয়াব কম হবে। এমনকি অনেকে দুআ-মুনাজাত না জানার কারণে তারাবীহ পড়েন না। এগুলি সবই ভিত্তিহীন ধারণা। এ সময়ে তাসবীহ, তাহলীল, মাসনূন দুআ-যিকর অথবা দরুদ পাঠ করাই উত্তম।

সাহাবী-তাবিয়ীগণ

প্রতি তিন দিন বা দশ দিনে তারাবীহের জামাতে কুরআন খতম করেতন। আর আমরা পুরো রামাদানে এক খতম করতেও কষ্ট পাই। তাঁরা ৫/৬ ঘন্টা ধরে তারাবীহ পড়তেন। আমরা এক ঘন্টাও দাঁড়াতে চাই না। হাফেয সাহেব একটু সহীহ তারতীলের সাথে পড়লে আমরা রাগ করি। কুরআনের সাথে এর চেয়ে বেশি বেয়াদবি আর কি হতে পারে। কুরআন শ্রবণের আগ্রহ নিয়ে ইমামের সাথে শেষ পর্যন্ত তারাবীহ আদায় করুন। ইমামের সাথে সাথেই নিয়্যাত করুন এবং পুরো কুরআন মহব্বতের সাথে শুনুন। সময় তো চলেই যাবে ভাই। হয়ত এভাবে কুরআন শোনার সময় আর পাব না। আল্লাহ আমাদের সিয়াম ও কিয়াম কবুল করুন। আমীন। 

পিতামাতার দায়িত্ব হলো, সাত বছর থেকে ছেলেমেয়েদের নামায, রোযা, তারাবীহ ইত্যাদিতে অভ্যস্থ করা। তাদের বয়স দশ বৎসর হলে এ বিষয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা ফরয। নিজের নামায রোযা যেমন ফরয, ছেলেমেয়েদের নামায রোযা আদায় করানোও তেমনি ফরয। ছেলেমেয়েরা নামায পড়লে, রোযা রাখলে, তারাবীহতে শরীক হলে তারা যেমন সাওয়াব বরকত লাভ করবে, তেমনি তাদের পিতামাতাও সাওয়াব ও বরকত লাভ করবেন।

এছাড়া ছেলেমেয়েরা আজীবন যত নামায,

রোযা, তারাবীহ, কুরআন, যিক্র, দান ও অন্যান্য ইবাদত করবে সকল ইবাদতের সমপরিমাণ সাওয়াব পিতামাতা লাভ করবেন। পক্ষান্তরে পিতামাতার অবহেলার কারণে যদি ছেলেমেয়েরা বেনামাযী বা বে-রোযাদার হয় তবে তাদের গোনাহের সমপরিমাণ গোনাহ তারা লাভ করবেন। হাযেরীন, ছেলেমেয়েরা আমাদের হৃদয়ের শান্তি। আসুন রামাদানের বরকতে তাদের শরীক করি। তাদেরকে রোযা রাখতে উৎসাহিত করি। ৭ বৎসর বা তার বেশি বয়সের ছেলেদেরকে তারাবীহের জামাতে সাথে করে নিয়ে যাই। তাদেরকে নেককার রূপে গড়ে তুলি। তাহলে তারা দুনিয়াতে যেমন আমাদের হৃদয়ের শান্তি হবে, জান্নাতেও তেমনি আমাদের হৃদয়ের শান্তি হবে। আল্লাহ কবুল করুন। আমীন।

বই : রাহে বেলায়াত

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ।