প্রসঙ্গ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সাধু ভ্যালেন্টাইন ডে’

১৪ ফেব্রুয়ারি সাধু ভ্যালেন্টাইন ডে1সেন্ট ভ্যালেন্টািইন্স ডে-এর উৎপত্তি ও ইতিহাস: http://bn.m.wikipedia.org/wiki/Valentines-Day বা বসন্ত বরণ। আমরা অনেক সময় বুঝি না, তবে এ দুটো মূলত একই জিনিস। প্রতি বছর এই দিন আসলে অনেক মুসলিম (এমনকি ধার্মিক মুসলিমদের মধ্যেও কেউ কেউ) ‘ভালোবাসা দিবসে’র শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। উপহার আদান-প্রদান করেন, দোকান সাজান, অনুষ্ঠান করেন। মূলত দীন সম্পর্কে অবহেলা অথবা এ দিবস সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। তারা এ দিনটিকে এভাবে পালন করে থাকেন।

কথিত ‘ভালোবাসা দিবস’: একটি প্রতারণা

প্রথম কথা হল, ‘ভালোবাসা দিবস’ কথাটা একটা প্রতারণা। ‘ভালোবাসা দিবসে’র ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘love day’,। আর ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে’র ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘world love day’ বা ‘international love day’। পৃথিবীতে ‘world love day’ বা ‘international love day’ নামে কোনো স্বীকৃত পরিভাষা নেই।2মে মাসের ১ তারিখে global love day’ নামে একটা দিবস সীমিত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে পালিত হয়। (উইকিপিডিয়া: global love day)। তবে এটার সাথে প্রচলিত ‘ভালোবাসা দিবস’ বা ভ্যালেন্টাইন দিবসের কোনো সম্পর্ক নেই।

বরং এটা এদেশেরই কিছু মানুষ ‘ভালোবাসা দিবস’ নামে নামকরণ করেছে।3১৯৯৩ সালে সাংবাদিক শফিক রেহমান বাংলাদেশে এ দিবসটির প্রচলন ঘটান। (দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭। শিরোনাম: ‘বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের সূচনা শফিক রেহমানের’)। তাদের উদ্দেশ্য ভালো ছিল না, আর এর পরিণতি আরও খারাপ হয়েছে।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে: নির্দিষ্ট ধর্মের একটি ধর্মীয় দিবস

এই দিনটার সঠিক নাম, যেটা সবাই আমরা জানি। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সাধু বা বাবা ভ্যালেন্টাইন দিবস। স্বভাবতই এটা একটা নির্দিষ্ট ধর্মের ধর্মীয় দিবস।4৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস প্রাচীন রোমানদের উৎসব ‘লুপারক্যালিয়া উৎসব’কে ‘সাধুভ্যালেন্টাইন দিবস’ ঘোষণা করেন। (ব্রিটানিকা) (…At the end of 5th century, Pope Gelasius 1 replaced Lupercalia with st. Valentine’s Day …  www.britannica.com/topic/Valentines-Day). প্রসঙ্গত, খ্রিস্টান জগতে সাধু-পাদরিদের স্মরণে এ ধরনের আরও দিবস প্রচলিত আছে। যেমন: ২৩ এপ্রিল-সেন্ট জজ ডে। ১১ নভেম্বর-সেন্ট মার্টিন ডে। ২৪ আগস্ট-সেন্ট বার্থোলোমিজম ডে। ১ নভেম্বর-সেন্ট আল সেইন্টম ডে, ১৭ মার্চ-সেন্ট প্যাট্রিক ডে। আবার সাধু ভ্যালেন্টাইন দিবসটা যে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে। এটা ক্যাথলিক গির্জা কর্তৃক নির্ধারিত। অন্যদিকে অর্থোডক্স গির্জা কর্তৃক নির্দিষ্ট দিনটি হল ৭ জুলাই। (উইকিপিডিয়া।

এটা কোনো সেকুলার আনন্দের দিবস না। পহেলা বৈশাখের মতো কোনো সেকুলার দিবস না এটা। এটা দুর্গা পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কালি পূজা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, এই ধরনেরই। হিন্দু-মুসলিমদের যেমন বিভিন্ন দিবস আছে। এটা ওই ধরনেরই খ্রিস্টধর্মের একটা ধর্মীয় দিবস।

‘ভিন্ন ধর্মীয় দিবস’ মুসলিমদের উদযাপন করার কোনো সুযোগ নেই:

বড় কষ্ট লাগে, আমরা মুসলিমরা বর্তমানে নামায-রোযা, হজ্জ-যাকাতসহ ধর্মটাকে শুধু অমান্যই করছি না, বরং ধর্মকে অবমূল্যায়ন করে ধীরে ধীরে ঈমানহারা হয়ে যাচ্ছি। অবমূল্যায়নটা কীভাবে! অনেক সময় আমরা বুঝতে পারি না। আপনি বলতে পারেন, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঠিক আছে, ধরে নিলাম, ধর্মপালন আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আপনার বিশ্বাস কতটা গভীর। সেটা আপনার কর্ম থেকেই বোঝা যায়।

আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেকেরই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম থাকে। রাজনৈতিক ধর্ম আছে, ধর্মীয় ধর্ম আছে, ভাষাকেন্দ্রিক (চেতনা আছে), প্রত্যেকেরই বিশ্বাস আছে। বর্তমানে আমরা এক ধরনের রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা দেখতে পাই। একদল আরেক দলের সাথে সব সময় সংঘাতময়। আগে এতটা ছিল না। মূলত রাজনীতি হল একটা পাওয়ার গেম। রাজনীতিতে দেশের মানুষ প্রতিযোগিতা করে। এই দল একবার জেতে, ওই দল একবার জেতে।

প্রত্যেকেই পাওয়ার গেমের

মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের এজেন্ডার মাধ্যমে দেশের সেবার চেষ্টা করে। কিন্তু এই পাওয়ার গেমটা এখন কমিউনালিজমে (communalism) পরিণত হয়েছে। একদল আরেক দলকে দেখতে পারবে না। গ্রামে-গঞ্জে হানাহানি, মারামারি, একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে গেছে। যেটা দুনিয়ার একটা জাগতিক বিষয়, এটাতেও আমাদের বিশ্বাস এমন হয়েছে যে। এক রাজনৈতিক দলের মানুষ আরেক রাজনৈতিক দলের বিয়ের দাওয়াতে পর্যন্ত যাবে না। অথচ ধর্মটা আমাদের কাছে এত হালকা হয়ে গিয়েছে যে। এক ধর্মের পূজারি আরেক ধর্মের পূজায় শরীক হয়ে যাবে। এরপরও আমরা মনে করছি যে, আমরা হয়তো ধার্মিকই রয়ে গেছি!

এটা ঠিক যে,

একজন ধার্মিক অন্য ধর্মের লোককে তার ধর্ম পালনের সুযোগ দেবেন। কিন্তু তিনি তার ধর্মের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না। যদি দেন, তাহলে বুঝতে হবে, নিজ ধর্মের প্রতি তার যথাযথ বিশ্বাস নেই। কারণ, প্রত্যেক ধর্মই বলে, অন্য ধর্মের ওই কাজটা খারাপ। হিন্দু ধর্ম বলছে যে, গরু জবাই করা খারাপ, গরুর গোশত খাওয়া খারাপ। কাজেই হিন্দুধর্মের প্রতি যিনি শ্রদ্ধাশীল। তিনি কুরবানির ঈদে আপনাকে শুভেচ্ছা দিতে আসবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

হ্যাঁ, কুরবানির ঈদ, মুসলমানদের ঈদ, মুসলমানরা করবে, এটাতে বাঁধা দেবেন না তিনি। কিন্তু তিনি এতে শরীক হতে আসবেন, এটা সাধারণত ঘটে না। যদি তার ভেতরে ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকে। ঠিক তেমনই একজন মুসলিম অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানের এভাবে স্বীকৃতি দেবেন যে, তাদের ধর্ম তারা পালন করুক। কিন্তু তিনি নিজে ওই ধর্মের অনুষ্ঠান পালন করতে পারেন না। করলে আর তিনি মুসলিম থাকেন না। কারণ, তার ধর্মে বলছে যে, ওটা শিরক। ঠিক তেমনই একটা দিবস ভ্যালেন্টাইন দিবস।

ভ্যালেন্টাইন দিবস: সমস্যা নিরূপণ ও আমাদের করণীয়

ভ্যালেন্টাইন দিবসের দুটো সমস্যা। একটা হল, এটা একটা ভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় দিবস। আরেকটা হল, ওই ভিন্ন ধর্ম যে উপলক্ষে এটা করেছে, এটা ইসলামের সবচেয়ে নিন্দিত ব্যাপার। এমনকি ওই খ্রিস্ট ধর্মেও নিন্দিত ব্যাপার। কেন করেছে, এ বিষয়টা আমি একটু পরে আলোচনা করব।

প্রথম বিষয় হল, ভ্যালেন্টাইন দিবস নিছকই খ্রিস্টানদের একটা ধর্মীয় দিবস। সরস্বতী পূজার দিবসটাকে যদি কেউ বিশ্ব শিক্ষা দিবস নাম দিয়ে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। সবার ভেতরে এই দিবস উদ্যাপনের ব্যবস্থা করে। অথবা কুরবানির ঈদের দিনটাকে বিশ্ব খাদ্য-উৎসব নাম দিয়ে  হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। সবাইকে নিয়ে এই দিবসে গরুর গোশত খাওয়ানোর উৎসব করে- এটা যেমন একটা অমার্জনীয় কাজ।

ঠিক তেমনই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে, এই ধর্মীয় দিবসটাকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস নাম দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষদেরকে কৌশলে এই দিবস পালন করানোর ব্যবস্থা করাটাও একই রকম অমার্জনীয় কাজ। অনেক মানুষই না বুঝে এটা করে ফেলছে। কিন্তু যারা এই বিকৃত অনুবাদটা করে এবং এই প্রচারণাটা করে এই ব্যবস্থা করেছেন, আমরা তাদের কাজের নিন্দা করি, তাদের এই কর্মটাকে ঘৃণা করি।

দ্বিতীয় বিষয় হল যে,

আমরা এই দিবস পালন করলে কী হয়? আমরা তো মুসলমান, নামায-কালাম পড়ছি। যিশুখ্রিস্টের মূর্তিতে একটু সিজদা করলে কী আর এমন হয়! একটু সরস্বতী পূজায় গেলাম, শিক্ষার জন্যই তো! আমরা সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে একটু আনন্দ করে আসলাম, এতে কী সমস্যা?!

এ বিষয়টা আগেই বলেছি যে, একজন মুসলিম অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি দেবেন, কিন্তু অংশ নেবেন না। অংশ নেওয়াটা ইসলামের পরিভাষায় শিরক বা কুফর। এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কাজেই আপনি যদি শুয়োরের গোশত খান, মদ খান, ব্যভিচার করেন, তাহলে এগুলো যেমন মহা হারাম কাজ। ভ্যালেন্টাইন দিবসের মতো একটা ভিন্ন ধর্মীয় দিবসকে পালন করা এর চেয়েও বড় একটা হারাম কাজ।

এখানে ঈমানের প্রশ্ন। ওগুলো তো হারাম, আপনি জানেন ওগুলো গোনাহ। তাওবা করলে আল্লাহ মাফ করতে পারেন। আর এখানে ঈমানের প্রশ্ন। এটা অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এটা পালন করা মানে হল, আপনি তার ধর্মকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। তার শিরকের স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তার অশালীনতাকে আপনি উৎসব হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। এজন্য আমি আশা করব, আমরা আমাদের ঈমানগুলোকে উজ্জীবিত করি।

ভালোবাসা দিবস

নামের এই দিবসটা বাস্তবেই মুসলিমদের কোনো দিবস নয়। আমরা অন্য ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারি না। যদি কেউ মনে করেন, ‘না! আমি এই ইসলাম ধর্মও মানি, খ্রিস্টান ধর্মও খানিকটা মানি, অল্প মানি, ইসলাম বেশি মানি!’ এটা তার ব্যাপার। কিন্তু আমরা মনে করি, ধর্মের ক্ষেত্রে এ রকম হয় না। বরং একটা ধর্মই মানতে হয়। অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে, সর্বোচ্চ তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে সম্মান করা যায়। এছাড়া ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের ধর্মীয় আনুভূতিতে আঘাত দেয়া হারাম। কিন্তু অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে আমরা যোগ দিতে পারি না। এটা তো গেল সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করা আমাদের জন্য বৈধ কি না, এ বিষয়টা।

আমি আশা করব, আমরা অল্প মানুষ যারা মসজিদে বসে কথাগুলো শুনছি। ঈমানের দায়িত্বে, আমার নামায-রোযা ও অন্যান্য বিষয় যেমন ঈমানের অংশ। ঈমানের দাবি, ঠিক তেমনই এই ভিন্ন ধর্মীয় দিবসটা ধর্মের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার যে অপচেষ্টা। এটার ব্যাপারে সচেতন থাকা, মানুষদেরকে আদবের সাথে বলা, এটাও আমাদের ঈমানি দায়িত্ব।

‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎপত্তি: শিকড়ের সন্ধানে

এরপরে আরেকটা জরুরি বিষয় এখানে আছে। সেটা হল, সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স দিবসটা আসলে কী? এটার উৎপত্তিই বা কোথা থেকে? সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ। আপনারা জানেন কি না, আমাদের বাংলা মাসগুলো ইংরেজি মাসের ১৩/১৪ তারিখ থেকেই হয়। আমাদের পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল, পহেলা চৈত্র ১৪ মার্চ, তাহলে ১৪ ফেব্রুয়ারি কী? পহেলা ফাল্গুন। তাহলে আপনারা বুঝতে পারছেন যে, এখানে আরেকটা বিষয় আছে। সেটা হল বসন্ত। উত্তর গোলার্ধে বসন্ত আসে এই সময়, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফাল্গুনের শুরুতে বসন্ত আসে।

প্রাচীন যুগ থেকে মানুষেরা প্রকৃতি পূজা করত, যখন মানুষ মূর্খ ছিল। প্রকৃতিকেই দেবতা মনে করত। আপনাদের অনেকবার উদাহরণ দিয়েছি। আমাদের দেশেও ছিল। যখন বৃষ্টি না হত, তখন ‘কাদাখেল’ করত, মানুষেরা কাদা মেখে পানি ঢেলে বৃষ্টি প্রার্থনা করত। এটা হল প্রকৃতি পূজার একটা অংশ। মানুষ মনে করত যে, আমরা যখন এ রকম কাদা খেলব। প্রকৃতিও আমাদের জমিকে ভিজিয়ে কাদা করে দেবে।

বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম আদিম যুগের চিন্তাকে লালন করা:

বর্তমানে আমরা বিজ্ঞানমনস্কতার অনেক কথাই বলতে শুনি। আমাদের এখানে বিজ্ঞানমনস্কতা মানে, ‘বিজ্ঞান চর্চা বা বিজ্ঞান গবেষণা নয়’, বরং বিজ্ঞানের নামে নাস্তিকতার কথা বলা, ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি করা।

যারা বিজ্ঞানমনস্কতার নামে ধর্মের বিরোধিতা করেন। এদের অধিকাংশকেই দেখবেন, তারা বিজ্ঞানও বোঝেন না, ধর্মও বোঝেন না। পড়ে কী? দর্শনে, পলিটিক্যাল সাইন্সে, ইসলামের ইতিহাসে অথবা বাংলায়- অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তারা বিজ্ঞানমনস্কতার নামে, বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে নাস্তিকতার কথা বলে।

আপনারা যদি

ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে যান, সেখানে তেমন কোনো নাস্তিকতা দেখতে পাবেন না,  বরং উল্লেখযোগ্য হারে দাড়ি-টুপি পরা ও নামায-রোযা পালন করা মানুষ দেখতে পাবেন। যারা বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে তারা বিজ্ঞান বিষয়ক বইপত্র পড়ে। তারা বিজ্ঞানমনস্ক নয়, তারা বিজ্ঞানী। বিশ্বের যারা বড় বড় বিজ্ঞানী, তারা হয়তো ধর্ম পালন করেন না। কিন্তু তাদের অধিকাংশই সাধারণত ধর্মবিদ্বেষী নয়, নাস্তিক নয়।

যাই হোক। বিজ্ঞানমনস্কতার নামে আমরা অনেক সময় ধর্মের বিরুদ্ধে বলতে শুনি, নামাযের বিরুদ্ধে। পর্দার বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলতে শুনি, ইত্যাদি। কিন্তু এই বিজ্ঞানমনস্কতার নামে তারা যে একেবারে সেই প্যাগান যুগের মানুষ হচ্ছে, এটা কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না।

লুপারক্যালিয়া উৎসব থেকে ‘সাধু ভ্যালেন্টাইন দিবসে’র উৎপত্তি

মানুষ যখন একেবারেই প্রিমিটিভ (Primitive)((আদিম, সেকেলে ও প্রাচীন)) ছিল, তখন তারা প্রকৃতি পূজা করত। ১৩, ১৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ফাল্গুনে উত্তর গোলার্ধে, বিশেষ করে ইউরোপে। এবং আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেও বসন্ত বরণ হত। বসন্তের আগমন, নতুন ফুল ফুটবে,  নতুন যৌবন আসবে। তাহলে আমরা যদি বসন্তের শুরুতে গান-বাজনা, ফুর্তি। যৌবনের কাজ করি, তাহলে আমাদের যৌবন এবং ফুর্তি নিটুট থাকবে। প্রকৃতি আমাদের এটা দিয়ে দেবে। এই ধরনের একটা চেতনায় প্যাগান যুগের, প্রিমিটিভ যুগের, প্রাচীন যুগের অসভ্য মানুষেরা এ সময়ে প্রকৃতি পূজা করত।

এ রকম ইউরোপে একটা ছিল,

ফিস্ট অব লুপারক্যালিয়া (feast of lupercalia)।((এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যানুযায়ী ‘সাধু ভ্যালেন্টাইন দিবসে’র উৎপত্তি ঘটেছে ‘লুপারক্যালিয়া উৎসব’ থেকে। ‘লুপারক্যালিয়া’ উৎসব প্রাচীন রোমানদের একটি উৎসব, যা ফেব্রুয়ারিতে বসন্তের আগমনে পালন করা হত।… Valentine’s Day, holiday (February 14). The holiday has origins in the Roman festival of Lupercalia, held in mid-February. The festival, which celebrated the coming of spring. www.britannica.com/topic/Valentines-Day & www.britannica.com/topic/Lupercalia)) লুপারক্যালিয়া উৎসব। ভারতে ‘বসন্ত বরণ’। পরবর্তীতে এগুলো খ্রিস্টানাইজ্ড করা হয়।

খ্রিস্টধর্মের বিকৃতি: মধ্যযুগীয় বর্বরতার সূচনা

খ্রিস্টধর্মের দুইটা দিক আছে। একদিকে খ্রিস্টধর্মকে ঈসা (আ.) এর নামে বলা হয়, তবে ঈসা (আ.) যা বলেছেন বর্তমানে খ্রিস্টধর্মে তার তেমন কিছুই বিদ্যমান নেই। ঈসা (আ.) বলেছেন, ‘নামায পড়তে হবে, রোযা রাখতে হবে, বিশ্বাস ঠিক রাখতে হবে। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকা যাবে না, সৎ থাকতে হবে। শরীআহ পালন করতে হবে, ইত্যাদি অনেক কিছুই তিনি বলেছেন। এমনকি তিনি বলেছেন, সংসার ছেড়ে দিতে হবে, বাপ-মা ছেড়ে দিতে হবে। টাকা-পয়সা থাকলে দান করে দিতে হবে। কোনো মেয়ে মানুষের দিকে তাকালে চোখ তুলে নিতে হবে। অনেক কিছুই বলেছেন।

পরবর্তীতে সাধু পল নামে

একব্যক্তি ঈসা (আ.) এর পরে আসলেন। তিনি বললেন, ‘না, এগুলোর কিছুই লাগবে না। তুমি বিশ্বাস করো, তোমার যদি বিশ্বাস ঠিক থাকে, তাহলে তুমি যত গোনাহ কর। কোনো সমস্যা নেই, ঈসা মসীহ তোমার গোনাহ নিয়ে চলে যাবেন।’5সাধু পল কর্তৃক খ্রিস্টধর্মকে বিকৃত করার নমুনা দেখুন- ‘কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম’, (লেখক: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.), পৃষ্ঠা: ২১-২৭।

তো বিশ্বাসটা কী? কোন বিশ্বাসে এই মুক্তিটা হবে, বিশ্বাস ঠিক করতে পারলেন না। এই বিশ্বাসের নামে, কর্ম না! বরং বিশ্বাস ঠিক আছে কি না। এই জন্য খ্রিস্টান ধর্মে বিগত দুই হাজার বছরে প্রায় দুই কোটি মানুষকে খুন করা হয়েছে। আগুনে পোড়ানো হয়েছে! খ্রিস্টধর্মের শাস্তি হল আগুনে পোড়াতে হবে। একে বলে ‘ইনকুইজিশন’।6ইনকুইজিশন সম্পর্কে দেখুন -উইকিপিডিয়া: http://bn.m.wikipedia.org/wiki/Inquisition, বিটানিকা: www.britannica.com/topic/inquisition. আগুনে পোড়ানো হয়েছে। কেন?!

জিজ্ঞাসা করা হয়েছে,

তুমি মানো? ‘হ্যাঁ, যিশুখ্রিস্টকে মানি’। কী মানো? ‘তিনের এক’ মানি। তিনের এক কেমন? এ রকম যদি কোনো এক জায়গায় একটু ভুল হয়েছে। তাহলে ধরে বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ রকম অনেক ঘটনা আছে। আপনারা ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়া, এনকার্টা অথবা যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়ায়। ইনকুইজিশন, ক্রিশ্চিয়ানাইজেশন, রিলিজিয়াস সাবমিশন, ডেমোলিশ দেম (demolish them)।এগুলো লিখে সার্চ দিলে অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন।

ইনকুইজিশনের দৃষ্টান্ত: জোয়ান অফ আর্ককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা

জোয়ান অফ আর্কের ঘটনা আপনাদের জানা আছে কি না! ফ্রান্সের একজন কিশোরী মেয়ে। ইংল্যান্ডের সাথে ফ্রান্সের যখন যুদ্ধ হয়। তখন ফ্রেন্স বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিল এই মেয়েটা। ফ্রেন্স বাহিনী হেরে যাচ্ছিল, ওই মেয়েটা নেতৃত্ব দিয়ে ফ্রেন্সদেরকে অনেকটা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসে। এক পর্যায়ে বৃটিশ বাহিনীর কাছে সে ধরা পড়ে। জেলে দেওয়া হয়। জেলে মেয়েটা পুরুষের পোশাক পরে, প্যান্ট পরে। জেল থেকে পাদরিদের কাছে খবরটা চলে গেল।

পাদরিরা এসে তার বিচারকার্য শুরু করলেন। পাদরিরা প্রশ্ন করল, ‘তুমি কেন প্যান্ট পরেছ?’ মেয়েটা বলল, ‘কী করব! আমরা যদি মেয়েলি পোশাক পরে থাকি, তো আমাদের উপরে নির্যাতন হয়। প্যান্ট পরলে সহজে জেলাররা ও পুলিশরা আমাদের উপর জুলুম করতে পারে না। এজন্য এভাবে নিজেকে রক্ষার চেষ্টায় এটা করি।’ এভাবে অনেক কিছু বলল মেয়েটা।

কিন্তু পাদরিরা মানল না!

তারা বলল, ‘তুমি শরীআহ লঙ্ঘন করেছ, বাইবেলের নির্দেশ লঙ্ঘন করেছ। কাজেই তোমার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। তোমার শাস্তি হবে।’ সেটা কী? আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। তাকে গাছের সাথে বেঁধে নিচে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হল। পোড়ানোর পরে সেই ছাইগুলো আবার পুড়িয়ে ফেলা হল!!7জোয়ান অফ আর্ক। শতবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধে (১৩৩৭-১৪৫৩) ফরাসি সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। ১৪৩১ সালে ‘ডাইনি’ আখ্যায়িত করে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। (উইকিপিডিয়া।) এটার নাম ইনকুইজিশন।

তো বিশ্বাসটা কী? এটা এত দুর্বোধ্য হয়ে যায় যে, বিশ্বাসের নামে তারা প্রায় দুই কোটি মানুষ হত্যা করেছে, ঠাণ্ড মাথায়। এর একটা বড় অংশ আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে।

খ্রিস্টধর্মে যেভাবে ভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের প্রবেশ ঘটে:

বিশ্বাসকে কঠিন করার পাশাপাশি তারা কর্মকে সহজ করার চেষ্টা করেছেন, যাতে বেশি মানুষ খ্রিস্টান হয়। এজন্য যুগেযুগে যে দেশে গিয়েছেন। সেই দেশের বিষয়গুলোকে তারা ধর্মের ভেতরে ঢুকানোর চেষ্টা করেছেন। যেমন, আপনারা জানেন, বড়দিন, ২৫ ডিসেম্বর, খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসবকে ‘বড়দিন’ বলা হয়। কেন বলা হয়? এটা যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন হিসেবে বলা হয়।

অথচ খ্রিস্টান সকল গবেষক শতভাগ একমত যে ২৫ ডিসেম্বর যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন নয়। পোপ ফ্রান্সিসের আগে ‘বেনিডিক্ট ১৬’ (Benedict XVI) নামে একজন পোপ ছিলেন। তিনি পদত্যাগ করেছিলেন, যদিও পোপরা সাধারণত পদত্যাগ করেন না। ওই পোপের একটা বই((বইটির নাম: ”Jesus of Nazareth: The Infence Narratives”)) আছে, যিশুখ্রিস্টের জন্ম বিষয়ে। সেখানেও তিনি লিখেছেন, ২৫ ডিসেম্বর  যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন নয়।

তাহলে কেন

২৫ ডিসেম্বর উৎসবটা হল? এটার কারণ, এই একই ধরনের, বসন্ত বরণের মতোই। ২৫ ডিসেম্বর উত্তর গোলার্ধের শীতের শেষে গরমের শুরু, দিন ছোট হতে হতে এইবার থামল, বড় হবে। এইজন্য, প্রাচীন যুগ থেকে ইউরোপে রোমান প্যাগানেরা, গ্রিক প্যাগানেরা, শীতসংক্রান্তি পালন করতে।

খ্রিস্টান পাদরিরা দেখলেন, আমরা যদি এই দিনটাকে একটু আমাদের ধর্মীয় রূপ দিয়ে দিই। তাহলে ওরা সহজেই আমাদের সাথে মিশে যেতে পারবে। তারা বললেন, এই দিনটাই আমাদের বড়দিন। যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন। ওরা তো আগে থেকেই এটা করত। বাহ! এখন আরও সহজ হয়ে গেল। এটা আমি বানিয়ে বলছি না। আপনারা ইন্টারনেটে সার্চ করলে এটা পাবেন। বড়দিন, ক্রিসমাস ব্যাপারে সার্চ করলে পাবেন।8ক্রিসমাস: উৎপত্তি ও ইতিহাস: www.britannica.com/topic/Chrismas

প্যাগান উৎসব থেকে লুপারক্যালিয়া উৎসব, সেখান থেকে ভ্যালেন্টাইন উৎসবের সূচনা:

ঠিক তেমনই এই লুপারক্যালিয়া উৎসবটা বসন্তের শুরুতে প্রাচীন প্যাগান যুগে ছিল। পাদরিরা দেখলেন, এটাকে যদি একটা ধর্মীয় রূপ দিয়ে আমরা করে দিই। তাহলে ধর্মটা সহজ হয়, সহজেই ওরা আমাদের ধর্মে এসে যাবে। এইজন্য ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নামে ১৪ ফেব্রুয়ারির এই দিবসের প্রচলন ঘটানো হল।

কিন্তু এই ভ্যালেন্টাইন কোন ভ্যালেন্টাইন, এটা দেখার জন্য আপনারা ইন্টারনেটে যাবেন, উইকিপিডিয়ায় যাবেন। দেখবেন, কোনো ঠিক নেই। এটা মূলত লুপারক্যালিয়া দিবসটাকে খ্রিস্টানাইজ্ড করা।9Lupercalia- www.britannica.com/topic/Valentines-Day&www.britannica.com/topic/Lupercalia

লুপারক্যালিয়া মূলতই

একটা প্যাগান উৎসব, প্রকৃতি পূজার উৎসব। এটা পুরোটাই কুসংস্কার। প্রকৃতি পূজারিদের বিশ্বাস অনুযায়ী বসন্তের শুরুতে উৎসব করলে সারা বছর বসন্তের অনুভূতি বজায় থাকবে! বৈশাখের শুরুতে ‘এসো হে বৈশাখ’ বললে বৈশাখ শুভময় হবে! মূলত প্যাগান যুগের লোকেরা করত এই ধরনের বিশ্বাস। তারা প্রকৃতিকেই ‘বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে পারে’ বলে বিশ্বাস করত। এ বিশ্বাসের প্রভাব আধুনিক যুগেও বিভিন্ন সমাজে বিদ্যমান রয়েছে।

যেমন এখনো আমাদের দেশে কোনো কোনো মানুষ মনে করে। শনি গ্রহ, মঙ্গল গ্রহ, শুক্র গ্রহ বা যে কোনো গ্রহের জাতক হলে মানুষের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে! এই ধরনের শিরকি-কুফরি কুসংস্কার এখনো মুসলমানদের ভেতরে মাঝেমাঝে দেখা যায়। বিশেষ করে, ফেরিঘাটে যখন অষ্ট ধাতুর মাদুলি কিনতে মুসলমানদের দেখি। তখন মনে হয়, অনেক মুসলমান এখনো আগের মতো হিন্দু বিশ্বাসেই আছে।

যেটা বলছিলাম, তাহলে এই যে প্যাগান উৎসব, এটাকে খ্রিস্টানরা প্রথমে খ্রিস্টানাইজ করলেন। এরপরে এটাকে এখন কিছু মানুষ সেকুলারাইজ্ড করে। সকল ধর্মের মানুষের মাঝে কথিত ‘ভালোবাসা দিবস’ নামে প্রচার করছে, এটা আরেকটা অপরাধ।

প্রকৃত ভালোবাসা কোনটা?

তৃতীয় বিষয় হল, এই দিনে আমরা কোন ভালোবাসাকে প্রমোট করি? ভালোবাসা তো অনেক রকমের আছে। মাকে ভালোবাসা, বাবাকে ভালোবাসা, ছেলে-মেয়েকে ভালোবাসা, দেশকে ভালোবাসা, দরিদ্রদেরকে ভালোবাসা, আল্লাহকে ভালোবাসা। তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ভালোবাসা, ইত্যাদি অনেক রকমের ভালোবাসা আছে। সবই ভালোবাসা।

কিন্তু এই লুপারক্যালিয়া উৎসবে, বসন্ত বরণ উৎসবে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন দিবসে শুধুমাত্র নারী-পুরুষের জৈবিক ভালোবাসাকে প্রমোট করা হয়। আর এটা শুধু ইসলামের দৃষ্টিতে না, সকল ধর্মের দৃষ্টিতে মহাপাপ। পাপ কাকে বলে? ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ ওই বিষয়, ওই কর্ম, ওই বিশ্বাস। যা ব্যক্তির, সমাজের অথবা মহাবিশ্বের ক্ষতি করে। এর বাইরে সাধারণত কোনো পাপ নেই। মদ পাপ, জুয়া পাপ, কারণ এগুলো ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ

বই: মিম্বারের আহ্বান-১

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহি এর ছেলের মুখে বাবার মজার ঘটনা!, আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস, গণশিক্ষা ও গণসচেতনা প্রকল্প, সকল ধর্মই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, প্রমাণের উপায় কী? ভ্যালেন্ডাইন ডে, খ্রিষ্টীয় ধর্মের উৎসব,