রামাদান মাসের শেষ জুমুআ। আজ আমরা ঈদের আহকাম ও রামাদানের বিদায় সম্পর্কে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। কিন্তু তার আগে আমরা এ সপ্তাহের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলির বিষয়ে সংক্ষেপ আলোকপাত করি। আজ ইংরেজী …. মাসের …. তারিখ। এ সপ্তাহের দিবসগুলির মধ্যে রয়েছে …।
সামনে আমাদের ঈদুল ফিতর। হাদীস শরীফে ‘চাঁদ দেখে সিয়াম শুরু করার ও শেষ করার’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, যে কেউ যেখানে ইচ্ছা চাঁদ দেখলেই ঈদ করা যাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সাক্ষ্য গৃহিত হলে বা চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলেই শুধু ঈদ করা যাবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সমাজের সিদ্ধান্তের উপরেই আমাদের ঈদ পালন করতে নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
الْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ النَّاسُ وَالْأَضْحَى يَوْمَ يُضَحِّي النَّاسُ
“যে দিন সকল মানুষ ঈদুল ফিত্র পালন করবে সেই দিনই ঈদুল ফিত্র-এর দিন এবং যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করবে সেই দিনই ঈদুল আযহার দিন।”1তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৫। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।
প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাসরূক বলেন,
আমি একবার আরাফার দিনে, অর্থাৎ যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখে আয়েশা (রা)-এর নিকট গমন করি। তিনি বলেন, মাসরূককে ছাতু খাওয়াও এবং তাতে মিষ্টি বেশি করে দাও। মাসরূক বলেন, আমি বললাম, আরাফার দিন হিসাবে আজ তো রোযা রাখা দরকার ছিল, তবে আমি একটিমাত্র কারণে রোযা রাখিনি, তা হলো, চাঁদ দেখার বিষয়ে মতভেদ থাকার কারণে আমার ভয় হচ্ছিল যে, আজ হয়ত চাঁদের দশ তারিখ বা কুরবানীর দিন হবে। তখন আয়েশা (রা) বলেন,
اَلنَّحْرُ يَوْمَ يَنْحَرُ الإِمَامُ وَالْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ الإِمَامُ
যেদিন ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান কুরবানীর দিন হিসাবে পালন করবেন সেই দিনই হলো কুরবানীর দিন। আর যেদিন রাষ্ট্রপ্রধান ঈদুল ফিতর হিসেবে পালন করবে সেই দিনই হলো ঈদের দিন।”2বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১৭৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৯০; মুনযিরী, তারগীব ২/৬৮। মুনযিরী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
মুমিনের জন্য নিজ দেশের
সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ট জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈদ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ। অন্য দেশের খবর তো দূরের কথা যদি কেউ নিজে চাঁদ দেখেন কিন্তু রাষ্ট্র তার সাক্ষ্য গ্রহণ না করে তাহলে তিনিও একাকী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপরীতে ঈদ করতে পারবেন না।
সকল মাসের ন্যায় শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখে চাঁদ দেখার মাসনূন দোয়া করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেলাল বা নতুন চাঁদ দেখলে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করতেন:
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ [باليمن] وَالإِيمَانِ وَالسَّلامَةِ وَالإِسْلامِ وَالتَّوْفِيقِ لِمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى رَبُّنَا [ربي] وَرَبُّكَ اللَّهُ
“আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। হে আল্লাহ, আপনি এই নতুন চাঁদের (নতুন মাসের) সূচনা করুন কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ঈমানের সাথে, শান্তি ও ইসলামরে সাথে {এবং আমাদের প্রভু যা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন তা পালনের তাওফীকসহ।} (হে নতুন চাঁদ), আমাদের ও তোমার প্রভু আল্লাহ।”3তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫০৪, নং ৩৪৫১, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৩১৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩৯। হাদীসটি হাসান।
এরপর থেকে তাকবীর বলতে হয়।
ঈদুল আযহার সময় পাঠের প্রসিদ্ধ ‘তাকবীর’ প্রত্যেকে নিজের মত মনে মনে বা মৃদু শব্দে তাকবীর বলতে হবে। সালাতুল ঈদ পর্যন্ত তাকবীর বলতে হয়।
রামাদানের সিয়ামের হুকুম দিয়ে আল্লাহ বলেন:
وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“যেন তোমরা (রামাদানের সিয়ামের) সংখ্যা পূরণ কর, এবং আল্লাহর তাকবীর ঘোষণা কর; কারণ তিনি তেমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”4সূরা বাকারা ১৮৫ আয়াত।
ঈদুল ফিতরের অন্যতম
ইবাদত যাকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা। যদি ইতোপূর্বে ফিতরা আদায় করা না হয় তবে অবশ্যই ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সালাতুল ঈদের আগেই তা আদায় করতে হবে। ঈদের দিনে সকালে গোসল করা, নতুন বা সুন্দর পোশাক পরা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত নির্দেশিত আদব। ঈদুল ফিতরের দিনে সালাতুল ঈদে গমনের পূর্বে কিছু খাদ্য গ্রহণ করা সুন্নাত। বুখারী সংকলিত হাদসে আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকটি খেজুর না খেয়ে ঈদুল ফিতরের জন্য বের হতে না। … আর তিনি বেজোড় সংখ্যায় খেজুর খেতেন।”5হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪৩৩; তিরমিযী, আস-সুনান ২/৪২৬। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
অন্য হাদীসে বুরাইদা (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিনে খাদ্য গ্রহণ না করে বের হতেন না। আর তিনি ঈদুল আযহার দিনে ফিরে আসার আগে কিছুই খেতেন না। ফিরে এসে তার কুরবানীর পশুর গোশত থেকে ভক্ষণ করতেন।”
সালাতুল ঈদের অন্যতম সুন্নাত হলো,
প্রশস্ত মাঠে তা আদায় করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বদা মাঠে যেয়ে সালাতুল ঈদ আদায় করতেন। মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করার ফযীলত অনেক বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনো মসজিদের নববীতে সালাতুল ঈদ আদায় করতেন না। শধু একবার বৃষ্টির কারণে তিনি মসজিদে নববীতে সালাতুল ঈদ আদায় করেন। মদীনায় আরো অনেক মসজিদ ছিল যেগুলিতে জুমুআর সালাত আদায় করা হতো, কিন্তু তিনি সেগুলিতে ঈদের সালাত আদায় করার অনুমতি দেন নি। একই শহরে অনেক জুমআ মসজিদ থাকলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে, সাহাবীগণের যুগে ও ইসলামের সোনালী যুগে সালাতুল ঈদ একাধিক স্থানে আদায় করতে অনুমতি দেওয়া হতো না। একই শহরে বা একই এলাকায় একাধিক স্থানে ঈদের সালাত আদায় করলে তা আদায় হবে কি না সে বিষয়ে ফকীহদের মতভেদ রয়েছে। আজকাল শহরগুলিতে বিশেষ করে প্রত্যেক মহল্লার মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করা হয়। এ কাজটি ইসলামী চেতনার পরিপন্থী, সুন্নাতের খেলাফ এবং মাকরূহ। ওযর ছাড়া মসজিদে সালাতুল ঈদ আদায় করা মাকরূহ বলে ফকীহগণ উল্লেখ করেছেন।
সালাতুল ঈদ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব,
ঐক্য ও ভালবাসার প্রতীক। এই সালাতে শহরের বা গ্রামের সকল মানুষ একটি বড় মাঠে একত্রিত হয়ে সালাত আদায় করবেন। সারা শহরের বা এলাকার সকলেই একস্থানে সমবেত হবেন, দেখা সাক্ষাত, সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। সারা বৎসর যাদের সাথে সাক্ষাত হয় না তাদের সাথেও এই উপলক্ষ্যে সাক্ষাত হবে। ছোটবড় সকলেই আনন্দ ও প্রাণচাঞ্চল্যে উদ্বেলিত হবেন। আর এই সব উৎসব, আনন্দ ও প্রাণচাঞ্চল্যের মূল কেন্দ্র হবে ঈদের মাঠ ও সালাতুল ঈদ আদায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণের যুগে ও মুসলিম উম্মাহর সোনালী দিনগুলিতে এই অবস্থায় ছিল। আধুনিক সভ্যতার স্বার্থপর মানসিকতার প্রভাবিত হয়ে আমরা ঈদের এই তাৎপর্যটি হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। এখন আমরা অন্যান্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মতই ‘ঈদের সালাত’ আদায় করি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক!
ঈদের মাঠে হেঁটে যাওয়া সুন্নাত। এছাড়া এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া ও অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা সুন্নাত। কারণ এতে সকলের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়, সাম্য ও ভালবাসা প্রকাশ পায়।
সূর্য পুরোপুরি উদিত হওয়ার প্রায় আধ ঘন্টা
পর থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত ঈদুল ফিত্র-এর সালাত আদায় করা যায়। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বুঝতে পরি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য উদিত হওয়ার ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ঈদুল ফিতর এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যে ঈদুল আযহার সালাত আদায় করতেন। সালাতুল ঈদ আদায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত ছিল ঈদের মাঠে পৌঁছে প্রথমে ঈদের সালাত আদায় করা। এরপর তিনি সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে খুতবা বা বক্তৃতা প্রদান করতেন। মহিলা মুসল্লীগণ যেহেতু মাঠের শেষ প্রান্তে বসতেন এজন্য সাধারণ খুতবার পর তিনি মহিলা মুসল্লীদের কাছে যেয়ে পৃথকভাবে তাদেরকে কিছু নসীহত করতেন। এরপর তিনি ঈদের মাঠ ত্যাগ করতেন।
বিভিন্ন হাদীসে ঈদের দিনে
শরীরচর্চা ও বিনোদনের জন্য খেলাধুলা ও আনন্দে উৎসাহ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। বর্তমানে শরীরচর্চামূলক খেলাধুলার স্থান দখল করছে অলস বিনোদন। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, ঈদের দিনে এবং অন্যান্য সময়ে বিনোদনের নামে, খেলাধুলার নামে বেহায়াপনা, বেল্লেলপনা ও অশ্লীলতা সমাজকে গ্রাস করছে। ঈদ উপলক্ষ্যে বেড়ানোর নামে আমাদের মেয়েরা অর্ধ উলঙ্গ হয়ে দেহ, পোশাক ও অলঙ্কার প্রদর্শন করে বেড়ায়। মেয়েদের জন্য বাইরে বোরোতে পুরো দেহ আবৃত করা আল্লাহ কুরআনে ফরয করেছেন। একজন মহিলার জন্য মাথা, চুল, কান, ঘাঢ়, গলা, বা দেহের যে কোনে অংশ অনাবৃত করে বাইরে যাওয়ার অর্থ প্রতি মুহূর্তে ব্যভিচারের মত একটি কঠিন কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া। এরূপ মহিলাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ দেওয়া হয় বলে হাদীসে বলা হয়েছে। ঈদের দিনে যারা এভাবে বের হয় তাদের অনেকেই রামাদানে কষ্ট করে রোযা রেখেছে। এদের অধিকাংশের পিতামাতা রোযাদার মুসলমান। কিভাবে তারা এরূপ ভয়ঙ্কর পাপে লিপ্ত হন তা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা যদি সত্যিই আল্লাহকে ভয় করি এবং আল্লাহর গযব থেকে বাঁচতে চাই তাহলে আমাদের সন্তানদেরকে এরূপ পাপ থেকে বাঁচাতে হবে।
জুমুআতুল বিদার মাধ্যমে
আমরা রামাদানকে বিদায় জানাতে চলেছি। কিন্তু কিভাবে? বিশ্বাসঘাতকতার সাথে না বিশ্বস্ততার সাথে। রামাদান এসেছিল কুরআন, সিয়াম, কিয়াম ও তাকওয়া উপহার নিয়ে। আমরা কি রামাদানের সাথে এগুলিকেও বিদায় করে দেব? তাহলে রামাদানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো। হাযেরীন, রামাদানের হাদিয়া ভালবেসে গ্রহণ করুন। কুরআন ছাড়বেন না। কত কষ্ট করে সারা মাস তারাবীহে কুরআন শুনলেন। যদি বুঝতে পারতেন তাহলে এ শোনার আনন্দ, তৃপ্তি ও সাওয়াব আরো অনেক বেশি হতো। কুরআনের নূরে হৃদয় আলোকিত হতো। আসুন সকলেই নিয়্যাত করি, আগামি রামাদানের আগে একবার অন্তত পূর্ণ কুরআন অর্থ সহ পাঠ করব। যেন আগামী রামাদানে তারাবীহের সময় কুরআন শোনার সময় অন্তত কিছু বুঝতে পারি।
সিয়াম ছাড়বেন না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে বলেছেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি, রহমত, বরকত ও রূহানিয়্যাত অর্জনের জন্য নফল সিয়াম অতুলনীয় ইবাদত। প্রতি মাসে তিন দিন, বিশেষত প্রতি আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে সিয়াম পালন করা, প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার, যুলহাজ্জ মাসের প্রথম ৯ দিন, বিশেষত আরাফার দিন, আশূরার দিন এবং তার আগে বা পরে এক দিন সিয়াম পালন করার অসীম ফযীলত ও সাওয়াবের কথা বিভিন্ন হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি। রামাদানের পরেই শাওয়াল মাস। ১লা শাওয়াল আমরা ঈদুল ফিতর আদায় করি। ঈদের পরদিন থেকে পরবর্তী ২৮/২৯ দিনের মধ্যে ৬টি রোযা রাখার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمَّ أَتْبَعَهُ سِتًّا مِنْ شَوَّالٍ كَانَ كَصِيَامِ الدَّهْرِ
“যে ব্যক্তি রামাদান মাসের সিয়াম পালন করবে। এরপর সে শাওয়াল মাসে ৬টি সিয়াম পালন করবে, তার সারা বৎসর সিয়াম পালনের মত হবে।”6মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২২।
কিয়াম ছাড়বেন না।
কিয়ামুল্লাইলের সাওয়াব ও ফযীলত শুধু কুরআন ও সহীহ হাদীস থেকে জমা করলেও একটি বড় বই হয়ে যাবে। যদি শেষ রাত্রে না পারেন তবে অন্তত প্রথম রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, দু চার রাকাত সালাত আদায় করবেন। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, প্রতি রাতে, রাতের প্রথম তৃতীয়াংশ বা ৪ ঘন্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পরে, রাত ১০/১১ টা থেকে দুআয় কবুলের ও রহমত-বরকতের সময় শুরু হয়। সারাদিন যে ভাবেই কাটান না কেন, অন্তত ঘুমাতে যাওয়ার আগে দু-চার রাকাআত কিয়ামুল্লাইল আদায় করে সামান্য সময় আল্লাহর যিক্র ও দরুদ পাঠ করে আল্লাহর দরবারে সারাদিনের গোনাহের ক্ষমা চেয়ে ও নিজের সকল আবেগ আল্লাহকে জানিয়ে ঘুমাতে যাবেন।
তাকওয়া ছেড়ে দেবেন না।
রামাদানের পরে ইবাদত বন্দেগী কিছু কমে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে মুমিন ইচ্ছাকৃতভাবে পাপের পথে ফিরে যেতে পারেন না। তাহলে তো রামাদানের সকল পরিশ্রম বাতিল করে দেওয়া হলো। আর নিজের কষ্টে অর্জিত কর্ম নষ্ট করার মত পাগলামী আর কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ বলেন:
وَلا تَكُونُوا كَالَّتِي نَقَضَتْ غَزْلَهَا مِنْ بَعْدِ قُوَّةٍ أَنْكَاثًا
“তোমরা সে (উন্মাদিনী) মহিলার মত হয়ো না যে তার সুতা মযবুত করে পাকানোর পর পাক খুলে নষ্ট করে ফেলে।”7সূরা (১৬) নাহল: ৯২ আয়াত।
কষ্টের আমল রক্ষা করতে
আমাদের রামাদানের তাকওয়া রক্ষা করার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া কিছু বিষয় আছে যা মুমিনের জীবনের সকল আমল ধ্বংস করে দেয়। তার অন্যতম হলো শিরক ও কুফর। আল্লাহর কোনো ক্ষমতায়, গুণে বা ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক করা হলো শিরক। আল্লাহ ছাড়া কোনো নবী, ওলী, ফিরিশতা, জিন বা অন্য কারো কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে, ইচ্ছ করলেই তারা কোনো মানুষের মনের কথা জানতে পারেন, উপকার বা ক্ষতি করতে পারেন এরূপ বিশ্বাস করা শিরক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করা, গায়েবী সাহায্য চাওয়া, গায়েবী ভাবে নির্ভর করা, কারো নাম নিয়ে কাজ শুরু করা, মানত করা ইত্যাদি শিরক। শিরকের মতই মহাপাপ কুফর। যেমন, আল্লাহর দীনের কোনো বিধান অচল মনে করা, উপহাস করা, ইসলামের কোনো বিধান অমান্য করা কারো জন্য বৈধ হতে পারে বলে মনে করা ইত্যাদি। আমরা যত পাপই করি না কেন, সকল পাপের ক্ষমার আশা আছে। কিন্তু শিরক-কুফর পাপের কোনো ক্ষমার আশা নেই। আর শিরক ও কুফরের কারণে পূর্ববর্তী সকল নেক আমর বিনষ্ট হয়ে যায়। একজন মানুষ যদি নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদত পালন করে এবং পাশাপাশি মদ, সিনেমা বা অন্যান্য পাপে লিপ্ত হয়, তবে পাপের কারণে নামায বাতিল হবে না। পাপ ও পুন্য উভয়ই জমা হবে। কিন্তু যদি কেউ শিরক করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল ইবাদত বাতিল হবে। তাকে পুনরায় হজ্জ ও অন্যান্য ইবাদত আদায় করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহী করা হয়েছে যে, ‘তুমি আল্লাহর শরীক স্থির করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত’।”((সূরা (১৬) নাহল: ৯২ আয়াত।)) আল্লাহ আরো বলেন:
وَمَنْ يَكْفُرْ بِالإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
“কেউ ঈমানের সাথে কুফরী করলে তার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”8সূরা (৫) মায়িদা: ৫ আয়াত।
যুগে যুগে শিরক হয় মূলত নবী,
ওলী, ফিরিশত বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের নিয়ে। যারা শিরক করে তারা মনে করে এ সকল নবী, ওলী বা ফিরিশতা তাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবেন এবং তাদের পারের কাণ্ডারী হবেন। আল্লাহ বলেছেন যে, নবী, ওলী ও ফিরিশতাগণ আল্লাহর অনুমতিতে সুপারিশ করবেন ঠিকই, তবে শিরক-কুফরমুক্ত তাওহীদ ও ঈমান নিয়ে মরবেন শুধু তাদের জন্যই সুপারিশ করবেন। যারা শিরকে লিপ্ত হবে তাদের জন্য কেউ সুপারিশ করবে না। আল্লাহ বলেন:
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
“কেউ আল্লাহর শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত নিষিদ্ধ করবেন ও তার আবাস জাহান্নাম; জালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।”9সূরা (৫) মায়িদা: ৭২ আয়াত।
আমরা রামাদানে প্রতি দিন প্রায় ৭০ বার
এবং সারামাসে প্রায় ২ হাজার বার সূরা ফাতেহার মধ্যে আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি: “শুধু তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই কাছে সাহায্য চাই”। এর পরও কি আমরা বিপদে আপদে কোনো দরগা, মাযার, জিন্ন, নবী, ওলী বা অন্য কাউকে ডাকব বা তাদের কাছে বিপদ ত্রাণের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করব? মুমিন কি তা করতে পারে? মাযারে যাবেন মাযরস্থ ব্যক্তিকে যিরারত করতে, তাকে সালাম দিতে ও তার জন্য দুআ করতে। আলিমদের কাছে যাবেন দীন শিখতে। পীরের কাছে যাবেন আল্লাহর পথে চলার ও বেলায়াত অর্জনের পথ শিখতে। কিন্তু চাওয়া, পাওয়া, বিপদ, সাহায্য, ত্রাণ উদ্ধার এগুলি সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য। কোথায় দৌড়াচ্ছেন দুআ করতে? আল্লাহ তো আপনার কাছে রয়েছেন। তিনি কখনোই বলেন নি, বান্দা আমার কাছে দুআ করতে তোমাকে কোথাও যেতে হবে। তিনি বলেছেন, বান্দা যেখানেই তুমি থাক না কেন, আমি তোমার কাছেই আছি। তুমি ডাকলেই আমি সাড়া দিব। রামাদান উপলক্ষ্যে আল্লাহ আমাদেরকে এ কথা বিশেষ করে শিখিয়েছেন। রামাদানের রোযার বিধান দিয়েই পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ
“আর আমার বান্দারা যখন আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আমি তো নিকটেই। যখনই কোনো আহ্বানকারী আমাকে ডাকে আমি তার ডাকে সাড়া প্রদান করি। কাজেই তারা আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার উপর বিশ্বাস রাখুক, তাহলে তারা ঠিক পথে থাকতে পারবে।”10সূরা বাকারা: ১৮৬ আয়াত।
মুমিন পাপী হতে পারে,
তবে হৃদয়ের গভীরে আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপর নির্ভরতা থাকতে পারে না। বিপদে আপদে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে যাওয়ার প্রশ্নই মনে আসে না। বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসকে কি শিক্ষা দিয়েছেন শুনুন:
يَا غُلامُ إِنِّي أُعَلِّمُكَ كَلِمَاتٍ احْفَظْ اللَّهَ يَحْفَظْكَ احْفَظْ اللَّهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلْ اللَّهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَاعْلَمْ أَنَّ الأُمَّةَ لَوْ اجْتَمَعَتْ عَلَى أَنْ يَنْفَعُوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَنْفَعُوكَ إِلا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ لَكَ وَلَوْ اجْتَمَعُوا عَلَى أَنْ يَضُرُّوكَ بِشَيْءٍ لَمْ يَضُرُّوكَ إِلا بِشَيْءٍ قَدْ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَيْكَ رُفِعَتْ الأقْلامُ وَجَفَّتْ الصُّحُفُ
“হে বালক,
আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিক্ষা দিচ্ছি। তুমি আল্লাহকে হেফাযত করবে, তাহলে তিনি তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহকে (তোমার অন্তরে সদা জাগরুকু ও) সংরক্ষিত রাখবে, তাহলে তাঁকে সর্বদা তোমার সামনে পাবে। যখন চাইবে বা প্রার্থনা করবে তখন শুধু আল্লাহর কাছেই চাইবে। যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, তখন শুধু আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইবে। জেনে রাখ, যদি সকল মানুষ তোমার কোনো কল্যাণ করতে সম্মিলিত হয়, তাহলে তারা তোমার শুধুমাত্র ততটুকুই কল্যাণ করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন। আর যদি তারা সবাই তোমার অকল্যাণ করতে একজোট হয়, তাহলে তারা তোমার শুধুমাত্র ততটুকুই অকল্যাণ করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার বিরুদ্ধে নির্ধারণ করেছেন। কলমগুলি উঠে গেছে এবং পৃষ্ঠাগুলি শুকিয়ে গিয়েছে।”১১তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৬৭, নং ২৫১৬, মুসতাদরাক হাকিম ৩/৬২৩, ৬২৪। হাদীসটি সহীহ।
রামাদানের আমল বরবাদ হওয়ার আরেকটি বিষয় সালাত।
অনেকেই রামাদানে রোযা রাখেন এবং নামায পড়েন, কিন্ত রামাদানের পরে আর ফরয নামায পড়েন না। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে। কুরআন ও হাদীসে নামায পরিত্যাগ করাকে কুফরী বলা হয়েছে। সাহাবী-তাবিয়ীগণ অনেকেই এক ওয়াক্ত সালাত পরিত্যাগ করাকেই কুফরী বলে গণ্য করতেন। অন্যরা বলেছেন যে, নামায ত্যাগ করা কুফরী না হলেও কুফরী গোনাহ। অর্থাৎ মদপান, শুকরের মাংশ ভক্ষণ ও অন্য সকল পাপের চেয়েও মহাপাপ হলো এক ওয়াক্ত নামায পরিত্যাগ করা। আর যদি কেউ মনে করে যে, নামায না পড়েও ভাল মুসলমান থাকা যায় তবে সে নিঃসন্দেহে কাফির হয়ে যায়।
আমরা চেষ্টা করব,
সকল সুন্নাত-মুস্তাহাব পালন করে পরিপুর্ণভাবে সালাত আদায় করতে। কিন্তু অসুবিধা হলে যতটুকু সম্ভব হাযিরা দিতে হবে। ওযূ না করতে পারলে তায়াম্মুম করে, পবিত্র কাপড় না থাকলে নাপাক কাপড়ে, কাপড় না থাকলে উলঙ্গ হয়ে, কিবলামুখি হতে না পারলে যে দিকে মুখ করে সম্ভব, দাঁড়াতে না পারলে বসে, শুয়ে যেভাবে সম্ভব, সূরা কিরাআত বা দুআ না জানলে শুধু আল্লাহু আকবার বা সুবহানাল্লøাহ পড়ে সালাত আদায় করতে হবে। এতেই সালাত আদায় হয়ে যাবে। তবে কোনো অবস্থাতেই জ্ঞান থাকা অবস্থায় সালাত কাযা করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
ফরয সালাত কাযা করার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
لاَ تَتْرُكْ صَلاَةً مَكْتُوْبَةً مُتَعَمِّداً فَمَنْ تَرَكَهَا مُتَعَمِّداً فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ الذِّمَّةُ (ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُوْلِهِ)
“ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাতও পরিত্যাগ করবে না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাত পরিত্যাগ করবে, সে আল্লাহর যিম্মা ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যিম্মা থেকে বহিস্কৃত হবে।”12হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৪৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২৯৫; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১৩৮-১৩৯। হাদীসটি সহীহ।
এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? নাম কাটা যাওয়ার পরে তো আর উম্মাত হিসেবে কোনো দাবিই থাকে না। ক্ষমা লাভ বা শাফাআত লাভের আশাও থাকে না। আল্লাহ আমদেরকে রামাদানের তাকওয়া, সালাত, সিয়াম, কিয়াম ও সকল আমল হিফাযত করার তাওফীক দিন। আমীন।
বই: খুতবাতুল ইসলাম
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.।