অসুস্থতার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব চিকিৎসার চেষ্টা করা। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বারবার চিকিৎসার নির্দেশ ও উৎসাহ প্রদান করেছেন, ঝাড়ফুঁক অনুমোদন করেছেন এবং তাবিয-তাগা ইত্যাদি নিষেধ করেছেন। এক হাদীসে উসামা ইবনু শারীক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
»يَا عِبَادَ اللهِ تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللهَ لَمْ يَضَعْ دَاءً إِلَّا وَضَعَ لَهُ شِفَاءً أَوْ قَالَ دَوَاءً إِلَّا دَاءً وَاحِدًا… الْهَرَمُ«
“হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা ঔষধ ব্যবহার কর। আল্লাহ যত রোগ সৃষ্টি করেছেন সকল রোগেরই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন, একটিমাত্র ব্যধি ছাড়া… সেটি বার্ধক্য। হাদীসটি হাসান সহীহ।1তিরমিযী, আস-সুনান (২৯-কিতাবুত তিব্ব, ২-বাব মা জাআ ফিদ দাওয়) ৪/৩৩৫ (ভা ২/২৪)।

অন্য হাদীসে

জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءٌ فَإِذَا أُصِيبَ دَوَاءُ الدَّاءِ بَرَأَ بِإِذْنِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ
“প্রত্যেক রোগেরই ঔষধ বিদ্যমান। যদি কোনো রোগের সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তবে আল্লাহর অনুমতিতে রোগমুক্তি লাভ হয়।”2মুসলিম, (৩৯-কিতাবুস সালাম, ২৬- বাব লিকুল্লি দায়িন দাওয়া) ৪/১৭২৯ (ভা ২/২২৫)।

এ অর্থে

আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবূ খুযামা রাদিয়াল্লাহু আনহু, কাইস ইবন মুসলিম রাদিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু, আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে অনেকগুলো হাদীস বর্ণিত।

চিকিৎসা গ্রহণ ও প্রদানের

পাশাপাশি তিনি নিজে মাঝে মাঝে ঝাড়-ফুঁক প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যবহৃত বা অনুমোদিত কিছু দু‘আ আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে উল্লেখ করব, ইন্শা আল্লাহ। এছাড়া তিনি শিরকমুক্ত সকল দু‘আ ও ঝাড়ফুঁক অনুমোদন করেছেন। আউফ ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা জাহিলী যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম।

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এ সকল ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে আপনার মত কী? তিনি বলেন
اعْرِضُوا عَلَيَّ رُقَاكُمْ لَا بَأْسَ بِالرُّقَى مَا لَمْ يَكُنْ فِيهِ شِرْكٌ
“তোমাদের ঝাড়ফুঁকগুলো আমার সামনে পেশ কর। যতক্ষণ না কোনো ঝাড়ফুঁকের মধ্যে শিরক থাকবে ততক্ষণ তাতে কোনো অসুবিধা নেই।”3মুসলিম, (৩৯-কিতাবুস সালাম, ২২-বাব লা বাসা র্বিরুকা) ৪/১৭২৭ (ভা ২/২২৪)।

জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:

لَدَغَتْ رَجُلًا مِنَّا عَقْرَبٌ وَنَحْنُ جُلُوسٌ مَعَ رَسُولِ اللهِ ﷺ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ أَرْقِي قَالَ مَنْ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يَنْفَعَ أَخَاهُ فَلْيَفْعَلْ
“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তিকে একটি বিচ্ছু (scorpion) কামড় দেয়। তখন এক ব্যক্তি বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি একে ঝাড়ফুঁক প্রদান করব? তিনি বলেন: তোমাদের কেউ যদি তার ভাইয়ের উপকার করতে পারে তবে সে যেন তা করে।”4মুসলিম, (৩৯-কিতাবুস সালাম, ২১- বাব ইসতিহবাবির রুকইয়াতি..) ৪/১৭২৬ (ভা ২/৪১৭)।

অন্য হাদীসে

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ঘরে প্রবেশ করেন। এ সময় একজন মহিলা তাঁকে ঝাড়ফুঁক করছিলেন। তখন তিনি বলেন:
عَالِجِيهَا بِكِتَابِ الله
“তাকে কুরআন দিয়ে চিকিৎসা-ঝাড়ফুঁক কর।” হাদীসটি সহীহ।5ইবন হিব্বান, আস-সহীহ ১৩/৪৬৪; আলবানী, সাহীহাহ ৪/৪৩০।

উপরের হাদীসগুলোর আলোকে

আমরা দেখছি যে, ঝাড়ফুঁকের দুটি পর্যায় রয়েছে: মাসনূন ও জায়েয বা মুবাহ। আমরা ইতোপূর্বে সুন্নাত ও জায়েযের পার্থক্য জেনেছি। ঝাড়ফুঁক একদিকে দু‘আ হিসেবে ইবাদত; অন্যদিকে চিকিৎসা হিসেবে জাগতিক কর্ম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসকল দু‘আ ব্যবহার করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তা মাসনূন ঝাড়ফুঁঁক হিসেবে গণ্য। এছাড়া যে কোনো ভাষার শিরক-মুক্ত যে কোনো বাক্য বা কথা দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেওয়া বৈধ বলে তাঁর নির্দেশনা থেকে আমরা জানতে পারি।

মাসনূন ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে

সর্বদা “ফুঁক” দেওয়া প্রমাণিত নয় এবং জরুরীও নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্ম ও অনুমোদন থেকে আমরা দেখি যে, তিনি ঝাড়ফুঁক-এর ক্ষেত্রে কখনো শুধু মুখে দু‘আটি পাঠ করেছেন, ফুঁক দেন নি। কখনো তিনি দু‘আ পাঠ করে ফুঁক দিয়েছেন, কখনো লালা মিশ্রিত ফুঁক দিয়েছেন, কখনো ফুঁক দেওয়া ছাড়াই রোগীর গায়ে হাত দিয়ে দু‘আ পাঠ করেছেন, অথবা দু‘আ পাঠের সময়ে বা দু‘আ পাঠের পরে রোগীর গায়ে বা ব্যাথ্যার স্থানে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন এবং কখনো ব্যাথা বা ক্ষতের স্থানে মুখের লালা বা মাটি মিশ্রিত লালা লাগিয়ে দু‘আ পাঠ করেছেন, অথবা তিনি এরূপ করতে শিক্ষা দিয়েছেন।

সকল ক্ষেত্রে তিনি সশব্দে দু‘আ পাঠ করতেন বলেই প্রতীয়মান হয়। এজন্য ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে দু‘আটি জোরে বা সশব্দে পাঠ করাই সুন্নাত। ঝাড়ফুঁকের আয়াত বা দু‘আ সশব্দে পাঠের মাধ্যমে সুন্নাত পালন ছাড়াও অন্যান্য কল্যাণ বিদ্যমান। মনে মনে পড়লে অনেক সময় দ্রুততার আগ্রহে দু‘আর বাক্যগুলো বিশুদ্ধভাবে পড়া হয় না, আর সশব্দে পড়লে পাঠের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত হয়। এছাড়া রোগী ও উপস্থিত মানুষেরা আয়াত বা দু‘আ শ্রবণের বরকত লাভ করেন এবং তা নিজেরা শিখতে পারেন। আল্লাহর যিকর শ্রবণের মাধ্যমে রোগীর হৃদয়ের প্রশান্তি বাড়ে। সর্বোপরি শিরকযুক্ত বা দুর্বোধ্য-অবোধ্য দু‘আ পাঠের প্রবণতা রোধ হয়।

কুরআনের আয়াত বা দু‘আ লিখে

তা ধুয়ে পানি পান করার বিষয়ে সহীহ বা গ্রহণযোগ্য কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। তবে সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগ থেকে অনেক আলিম তা করেছেন। অধিকাংশ ফকীহ এরূপ করা “জায়েয” বলে গণ্য করেছেন। তবে শর্ত হলো পবিত্র কালি দিয়ে পবিত্র দ্রব্যে এরূপ আয়াত বা দু‘আ লিখে তা পানি দিয়ে ধুয়ে পান করা। গোসলের বিষয়ে অনেকে আপত্তি করেছেন। অনেকে মূল বিষয়টিকেই নাজায়েয বলে গণ্য করেছেন।

পানি পড়া, তেল পড়া ইত্যাদি বিষয় সুন্নাতে পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোগীকে ফুঁক দিয়েছেন বা রোগীর সামনে দু‘আ পাঠ করেছেন। দু‘আ পড়ে পানি, তেল, কালজিরা, মধু বা অন্য কিছুতে ফুঁক দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করার কোনো নমুনা আমরা হাদীসে পাই না। তবে কোনো কোনো সাহাবী থেকে এরূপ কর্ম বর্ণিত। তাবিয়ীগণের যুগেও তা বহুল প্রচলিত ছিল। এজন্য প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফকীহগণ-সহ প্রায় সকল আলিম ও ফকীহ তা বৈধ বলেছেন।

বই: রাহে বেলায়াত

লেখক: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ

সালাত: গুরুত্ব, ফযীলত, জীবিত ব্যক্তির ওসীলা দিয়ে দোয়া করার বিধান, তাওহীদুল ঈমান (৫), সিয়াম, ইফতার, পানাহার ও মেহমান সম্পর্কিত কিছু দু‘আমীলাদুন্নবী (সা.)