ইসলামে পর্দা বলতে কী বুঝায়

এবং পর্দার গুরুত্ব কী তা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। পর্দা বলতে অনেকে অবরোধ বুঝেন। তাঁরা ভাবেন যে, পর্দা করার অর্থ মুসলিম মহিলা নিজেকে গৃহের মধ্যে আটকে রাখবেন, কোনো প্রয়োজনে তিনি বাইরে বেরোতে পারবেন না, পরিবারের বা সমাজের কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।

অপরদিকে কেউ কেউ মনে করেন যে, পর্দা নিজের কাছে বা নিজের মনে, পর্দার জন্য বিশেষ কোনো বিধান বা বিশেষ কোনো পোশাক নেই। এ বিষয়ে আলিম বা প্রচারকদের মতামতকে তাঁরা ধর্মান্ধতা বা বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন। কেউ বা মনে করেন যে, পর্দা করা ভাল, তবে বেপর্দা চলাফেরা কোনো পাপ বা অপরাধ নয় বা কঠিন কোনো অপরাধ নয়।

পর্দা ফার্সী শব্দ।

আরবী ‘হিজাব’ শব্দের অনুবাদে ফার্সী পর্দা শব্দটিই বাংলায় প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ। হিজাব অর্থ আড়াল বা আবরণ। ইসলামী পরিভাষায় হিজাব অর্থ শুধু পোশাকের আবরণই নয়, বরং সামগ্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা, যাতে নারী-পুরুষের মধ্যে অপবিত্র ও অবৈধ সম্পর্ক এবং নারীর প্রতি পুরুষের অত্যাচারী আচরণ রোধের বিভিন্ন ব্যবস্থা রয়েছে।

নারী ও পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ মানব জীবনে আল্লাহর দেওয়া অন্যতম নিয়ামত। ক্ষুধা, পিপাসা, সম্পদের লোভ, সন্তানের স্নেহ ইত্যাদির মতই আল্লাহর দেওয়া একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় এ আকর্ষণ। একে অবহেলা করা যেমন প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কঠিন অন্যায়, তেমনি প্রকৃতি-বিরুদ্ধ কঠিন অন্যায় একে অনবরত সুড়সুড়ি দিয়ে মানবীয় জীবনকে এ আকর্ষণ কেন্দ্রিক করে তোলা। খাদ্য ও পানীয়ের লোভকে সুড়সুড়ি দিয়ে বাড়িয়ে সার্বক্ষণিক করে তুললে যেমন মানুষ পানাহার সর্বস্ব স্থুল জীবে পরিণত হয়, তেমনি এ আকর্ষণকে সুড়সুড়ি দিয়ে বাড়িয়ে সার্বক্ষণিক করলে মানুষ মানবতাহীন পশুতে পরিণত হয়।

উপরন্তু এরূপ মানুষ

পরিবার গঠনের আগ্রহ হারায় বা পরিবার গঠন করলেও তা বিনষ্ট হয়। বস্তুত নারী-পুরুষের আকর্ষণই পরিবার গঠনের মূল চালিকা শক্তি। পারিবারিক জীবনের মধ্যে অনেক ত্যাগ, কষ্ট ও দায়িত্বশীলতা রয়েছে। এ আকর্ষণই এরূপ ত্যাগ ও কষ্টের প্রেরণা যুগায়। মানুষ যখন দাম্পত্য জীবনের বাইরে এ আকর্ষণ মেটানোর সুযোগ পায় তখন পরিবার গঠন তার কাছে গৌণ হয়ে যায়। আর এজন্যই পাশ্চাত্যের অগণিত নরনারী পরিবার গঠন থেকে বিরত থাকে।

এ বিষয়টিকে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক খাতে প্রবাহিত করা এবং অস্বাভাবিকতা থেকে রক্ষা করার জন্যই পর্দা-ব্যবস্থা। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, পর্দা ইসলামে ব্যাপক অর্থ বহন করে। পবিত্র সামাজিক পরিবেশে সুন্দর আন্তরিক স্নেহ-মমতা-ভালবাসাপূর্ণ পরিবার গঠনে ইসলামের বিভিন্ন বিধানাবলির সমষ্টিকেই মূলত এককথায় ‘পর্দা-ব্যবস্থা’ বলা হয়।

যেন স্বামী-স্ত্রী উভয়ে দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে পরিপূর্ণ তৃপ্ত ও আনন্দিত থাকেন। তাঁদের মনে দাম্পত্য সম্পর্ক বহির্ভূত কোনো সম্পর্কের চিন্তা, কামনা বা আগ্রহ না জন্মে। তাঁরা একে অপরের প্রেম ও আবেগ পরিপূর্ণ উপভোগ করেন এবং তাঁদের সন্তানগণ পিতা ও মাতার পরিপূর্ণ স্নেহমমতা উপভোগ করে লালিত-পালিত হয়। এরূপ পরিবারই একটি বৃহৎ কল্যাণময় সমাজের ভিত্তি।

এ ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক রয়েছে, যেমন:

১. সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটতে পারে এরূপ সকল কথা বা কর্ম থেকে বিরত থাকা।

২. অশ্লীলতার প্রচার বা প্রসারমূলক কাজে লিপ্তদেরকে শাস্তি প্রদান।

৩. সন্তানদেরকে পবিত্রতা ও সততার উপর প্রতিপালন করা এবং অশ্লীলতার প্ররোচক বা অহেতুক সুড়সুড়ি মূলক সকল কর্ম, কথা বা দৃশ্য থেকে তাদেরকে দূরে রাখা।

৪. কারো আবাসগৃহে বা বাড়ীতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি গ্রহণের ব্যবস্থা এবং বিনা অনুমতিতে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা।

৫. দৃষ্টি সংযত রাখা।

৬. নারী ও পুরুষের শালীনতাপূর্ণ পোশাক পরিধান করা।

৭. নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা।

৮. সঠিক সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদেরকে বিবাহ দেওয়া। বিধবা ও বিপত্নীক ব্যক্তিদের প্রয়োজনে বিবাহের উৎসাহ দেওয়া।

৯. দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতা বজায় রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এ সকল বিষয়ে কুরআন-হাদীসে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বিশেষ করে সূরা নূর ও সূরা আহযাব-এ পর্দার বিষয়গুলি আলোচিত হয়েছে। আমি সকল পাঠক পাঠিকাকে অনুরোধ করব সূরা দুটি অধ্যয়ন করার জন্য। প্রয়োজনে কুরআন করীমের কোনো অনুবাদ বা তফসীরের সাহায্য গ্রহণ করুন।

এ পুস্তকের পরিসরে আমরা সকল বিষয় আলোচনা করতে পারব না, তাই এখানে পোশাক ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশাবলী আলোচনা করব।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, বই: পোশাক, পর্দা ও দেহ-সজ্জা, পৃ. ২৫৩-২৫৫।