ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, প্রতিষ্ঠাতা: আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
(১) চাঁদ দেখার দুআ:
আমরা সাধারনত রমাদান ও শাওয়ালের চাঁদ দেথে থাকি। মুসলমান হিসেবে চাঁদ দেখে প্রতি আরবী মাসের হিসাব রাখা আমাদের কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সা. হেলাল বা নতুন চাঁদ দেখলে নিম্নের দু‘আ টি বলতেন। রমযান ও সকল মাসের নতুন চাঁদ দেখে এ দু‘আ পাঠ করা সুন্নাত:
اَللهُ أَكْبَرُ اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ [بِالْيُمْنِ] وَالْإِيْمَانِ وَالسَّلاَمَةِ وَالْإِسْلاَمِ وَالتَّوْفِيقِ لِمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى رَبُّنَا [رَبِّيْ] وَرَبُّكَ اللهُ
উচ্চারণ: আল্লা-হু আকবার। আল্লা-হুম্মা, আহিল্লাহু ‘আলাইনা- বিল আম্নি ওয়াল ঈমান, ওয়াস সালা-মাতি ওয়াল ইসলা-ম। {ওয়াততাওফীক্বি লিমা- ইউ‘িহব্বু রাব্বুনা- ওয়া ইয়ারদ্বা-।} রাব্বুনা- ওয়া রাব্বুকাল্লা-হু।1তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ্দাআওয়াত, ৫১-বাব..রুইয়াতুল হিলাল) ৫/৪৭০ (ভারতীয় ২/১৮৩); সুনানুদ দারিমী ২/৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩৯; আলবানী, সাহীহাহ: মুখতাসারা ৪/৪৩০
অর্থ: আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। হে আল্লাহ, আপনি এ নতুন চাঁদের (নতুন মাসের) সূচনা করুন কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ঈমানের সাথে, শান্তি ও ইসলামের সাথে {এবং আমাদের প্রভু যা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন তা পালনের তাওফীকসহ।} (হে নতুন চাঁদ), আমাদের ও তোমার প্রভু আল্লাহ।
(২) সিয়াম শুরুর দু‘আ
সিয়ামের শুরুতে কোনো মাসনূন যিক্র নেই। তবে সিয়াম শুরুর পূর্বেই-রাতেই- সিয়ামের জন্য ‘নিয়্যাত’ করা জরুরী। মনের মধ্যে জাগরুক উদ্দেশ্যকে নিয়্যাত বলে। সিয়ামের পূর্বে রাতে শয়নের আগে বা সাহরির সময় মুমিনের মনের মধ্যে সিয়াম পালনের যে ইচ্ছা এটিই নিয়্যাত। “নাওয়াইতুআন” বলে বা অন্য কোনোভাবে মুখে নিয়্যত করা খেলাফে সুন্নাত। বিশেষত আমাদের সমাজে প্রচলিত ‘নিয়্যাত’ (নাওয়াইতু আন আসূমা গাদান মিন শাহরি রামাদান…) বাক্যটি দ্বারা রামাদানের সিয়াম শুদ্ধ হয় না। এ নিয়্যাতের বাংলা অর্থ হলো: আমি আগামীকাল রোজা রাখার নিয়্যাত করছি। আগের দিন নিয়্যাত করলে রোজ হয় না। রোজার দিন ‘আজ’ রোজা রাখব এ কথাটি মনে থাকলে সিয়াম শুদ্ধ হয়। এজন্য যারা আগামী কাল রোজা রাখার নিয়্যত করেন তাদের সে দিনের রোজ হয় না; কারণ তারা সে দিনের রোজা রাখার নিয়্যাত করেন নি। আবার আগামী কালের নিয়্যাতের কারণে আগামী কালের রোজাও হয় না; কারণ রোজার নিয়্যাত অগ্রীম হয় না।
হাদীস শরীফে ইফতারের বেশ কয়েকটি দু‘আ বর্ণিত হয়েছে। নিচে সেগুলো দেয়া হল:
(৩) ইফতারের দু’আ-১
ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ
উচ্চারণ : যাহাবায যামাউ, ওয়াবতাল্লাতিল ‘উরূক্বু, ওয়া সাবাতাল আজরু, ইন শা-আল্লা-হ।
অর্থ: পিপাসা চলে গেল, শিরা উপশিরা আর্দ্র হলো এবং মহান আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কার নিশ্চিত (পাওনা) হলো।” হাদীসটি হাসান।2আবূ দাউদ (কিতাবুস সাওম, বাবুল কাওলি ইনদাল ইফতার) ২/৩১৬, নং ২৩৫৭ (ভা ১/৩২১)।
(৪) ইফতারের দুআ-২
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الَّتِيْ وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ أَنْ تَغْفِرَ لِيْ
উচ্চারণ : “আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আসআলূকা বিরা‘হমাতিকাল্লাতী ওয়াসি‘আত কুল্লা শাইয়িন আন তাগফিরালী।
অর্থ : “হে আল্লাহ, আপনার সর্বব্যাপী রহমতের ওসীলা দিয়ে আমি আপনার কাছে চাইছি যে, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রা) ইফতারের সময় এ দুআ বলতেন।3ইবনু মাজাহ (৭-কিতাবুস সিয়াম, ৪৮-বাব ফিস সায়িমি লা তুরাদ্দু) ১/৫৫৭, নং ১৭৫৩ (ভারতীয় ১/১২৫); বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ২/৮১। বূসীরী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
(৫) ইফতারের দু‘আ-৩
اللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَعَلَى رِزْقِكَ أَفْطَرْتُ [فَتَقَبَّلْ مِنِّيْ إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ]
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনার জন্যই আমি সিয়াম পালন করেছি এবং আপনার রিযক দ্বারা ইফতার করেছি। অতএব আপনি আমার কর্ম কবুল করুন নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ।” দুআটি একাধিক যয়ীফ সনদে বর্ণিত।4আবূ দাউদ (কিতাবুস সাওম, বাবুল কাওলি ইনদাল ইফতার) ২/৩১৬, নং ২৩৫৮ (ভারতীয় ১/৩২২); হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৫৬; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৭-৩৯।
(৬) খাদ্য গ্রহণের পূর্বের দুআ
রামাদানে সাহরী, ইফতার সহ সকল সময়েই খাদ্যগ্রহণের পূর্বে এ দুআ পাঠ করা সুন্নাত:
بِسْمِ اللهِ، بِسْمِ اللهِ فِيْ أَوَّلِهِ وَآخِرِهِ
(বিসমিল্লা-হ), অর্থাৎ “আল্লাহর নামে”। শুরুতে আল্লাহর নাম বলতে ভুলে গেলে বলবে: (বিসমিল্লা-হি ফী আউআলিহী ওয়া আ-খিরিহী), অর্থাৎ “আল্লাহর নামে এর প্রথমে এবং এর শেষে”।5হাদীসটি সহীহ। তিরমিযী (২৬-কিতাবুল আতয়িমা, ৪৭-বাব..তাসমিয়া) ৪/২৫৪, নং ১৮৫৮ (ভারতীয় ২/৭)।
খাবারের পরের যিকির-১
রামাদানে এবং অন্য সকল সমহে খাবারের পর এই দু‘আ সমূহ পাঠ করা সুন্নত:
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ أَطْعَمَنِيْ هَذَا وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلاَ قُوَّةٍ
উচ্চারণ: আল‘হামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত‘আমানী হা-যা ওয়া রাযাক্বানীহি মিন গাইরি ‘হাওলিম মিন্নী ওয়ালা- ক্বুওয়াহ।
অর্থ: সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এ খাদ্য খাইয়েছেন এবং আমাকে তা প্রদান করেছেন আমার কোনো অবলম্বন ও ক্ষমতা ছাড়াই।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যদি কেউ খাদ্য গ্রহণ করে এ কথাগুলো বলে তাহলে তার পূর্বাপর গোনাহ ক্ষমা করা হবে।”6হাদীসটি হাসান। তিরমিযী (২৬-কিতাবুল আতয়িমা, ৪৭-বাব..তাসমিয়া) ৪/২৫৪, নং ১৮৫৮ (ভারতীয় ২/৭)।
খাবারের পরের যিকির-২
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْهِ وَأَطْعِمْنَا خَيْرًا مِنْهُ. اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِيهِ وَزِدْنَا مِنْهُ.
উচ্চারণ: (১) আল্লা-হুম্মা বা-রিক লানা ফীহি ওয়া আত্ব্‘িয়মনা খাইরান মিন্হু। (২) আল্লা-হুম্মা বা-রিক লানা ফীহি ওয়া যিদ্না- মিন্হু।
অর্থ: (১) হে আল্লাহ আপনি এতে বরকত প্রদান করুন এবং আমাদেরকে এর চেয়ে উত্তম কিছু খাওয়ান। (২) হে আল্লাহ, আপনি এতে বরকত প্রদান করুন এবং আমাদেরকে এটি আরো অধিক পরিমাণ প্রদান করুন।
ইবন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমরা কোনো খাদ্য গ্রহণ করলে বলবে (১ম বাক্যটি)। আর যদি কেউ দুধ পান কর তবে বলবে: (২য় বাক্যটি)।”7হাদীসটি হাসান। তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ্দাআওয়াত, ৫৫-বাব..ইযা আকালা তাআমান) ৫/৪৭৪ (ভারতীয় ২/১৮৩)।
হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. মানুষকে খাবার খাওয়ানোর জন্য ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছেন। সেই সাথে অতিথিকে গৃহকর্তার জন্য দু’আ করতে বলেছেন এবং কয়েকটি দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন। রামাদান মাসে সাহরী করালে, ইফতারী করালে বিশেষ সওয়াবের কথা হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে ।
গৃহকর্তার জন্য অতিথির দু‘আ-১
اللَّهُمَّ أَطْعِمْ مَنْ أَطْعَمَنِيْ وَاسْقِ مَنْ سَقَانِي (وَأَسْقِ مَنْ أَسْقَانِي)
উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, আত্ব‘ইম মান আত্ব‘আমানী, ওয়াসক্বি মান সাক্বা-নী।
অর্থ: হে আল্লাহ, যে আমাকে খাইয়েছে তাকে আপনি খাদ্য প্রদান করুন এবং যে আমাকে পান করিয়েছে তাকে আপনি পানীয় প্রদান করুন।8মুসলিম (৩৬-কিতাবুল আতয়িমা, ৩২-বাব ইকরামিদ দাইফ) ৩/১৬২৫, নং ২০৫৫ (ভা ২/১৮৪)।
গৃহকর্তার জন্য অতিথির দু‘আ-২
أَفْطَرَ عِنْدَكُمُ الصَّائِمُوْنَ وَأَكَلَ طَعَامَكُمُ الأَبْرَارُ وَصَلَّتْ عَلَيْكُمُ الْمَلائِكَةُ
উচ্চারণ: আফত্বারা ‘ইনদাকুমুস স্বা-ইমূন, ওয়া আকালা ত্বা‘আ-মাকুমুল আবরা-র, ওয়া স্বাল্লাত ‘আলাইকুমুল মালা-ইকাহ।
অর্থ: তোমাদের কাছে রোযাদারগণ ইফতার করুন, তোমাদের খাদ্য নেককারগণ ভক্ষণ করুন এবং তোমাদের জন্য ফিরিশতাগণ দু‘আ করুন।
কেউ রাসূলুল্লাহ সা.-কে ইফতার করালে বা সিয়াম ছাড়া অন্য সময়ে কোনো খাদ্য খাওয়ালে তিনি এ কথা বলে তার জন্য দু‘আ করতেন।9আবূ দাউদ (কিতাবুল আতয়িমা, বাব…দুআ লিরাব্বিত তাআম) ৩/৩৬৬ (ভারতীয় ২/৫৩৮); সহীহ ইবন হিব্বান ১২/১০৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৩৪; আলবানী, সহীহুল জামি ১/২৫৩, নং ১১৩৭ ।
গৃহকর্তার জন্য অতিথির দু‘আ-৩
اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُمْ فِيْ مَا رَزَقْتَهُمْ وَاغْفِرْ لَهُمْ وَارْحَمْهُمْ
অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি এদের যে রিয্ক প্রদান করেছেন তাতে বরকত প্রদান করুন, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাদেরকে রহমত করুন।”
আব্দুল্লাহ্ বিনু বিশ্র বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমার পিতার বাড়িতে আগমন করেন। তিনি কিছু খাদ্য পেশ করেন। তিনি তা থেকে কিছু খাদ্য গ্রহণ করেন। আমার পিতা তাঁর কাছে দু‘আ চান। তখন তিনি এ কথাগুলো বলেন।10মুসলিম (৩৬-কিতাবুল আশরিবা, ২২-বাব ইসতিহবাব ওয়াদয়িন্নাওয়া) ৩/১৬১৫ (ভারতীয় ২/১৮০)।
রামাদান মাসে সাদাকাহ, কুরআনের দ্বিতীয় আসর হলো কিয়ামুল্লাইল, সিয়াম, ইফতার, পানাহার ও মেহমান সম্পর্কিত কিছু দু‘আ
- 1তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ্দাআওয়াত, ৫১-বাব..রুইয়াতুল হিলাল) ৫/৪৭০ (ভারতীয় ২/১৮৩); সুনানুদ দারিমী ২/৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩৯; আলবানী, সাহীহাহ: মুখতাসারা ৪/৪৩০
- 2আবূ দাউদ (কিতাবুস সাওম, বাবুল কাওলি ইনদাল ইফতার) ২/৩১৬, নং ২৩৫৭ (ভা ১/৩২১)।
- 3ইবনু মাজাহ (৭-কিতাবুস সিয়াম, ৪৮-বাব ফিস সায়িমি লা তুরাদ্দু) ১/৫৫৭, নং ১৭৫৩ (ভারতীয় ১/১২৫); বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ২/৮১। বূসীরী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
- 4আবূ দাউদ (কিতাবুস সাওম, বাবুল কাওলি ইনদাল ইফতার) ২/৩১৬, নং ২৩৫৮ (ভারতীয় ১/৩২২); হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৫৬; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৭-৩৯।
- 5হাদীসটি সহীহ। তিরমিযী (২৬-কিতাবুল আতয়িমা, ৪৭-বাব..তাসমিয়া) ৪/২৫৪, নং ১৮৫৮ (ভারতীয় ২/৭)।
- 6হাদীসটি হাসান। তিরমিযী (২৬-কিতাবুল আতয়িমা, ৪৭-বাব..তাসমিয়া) ৪/২৫৪, নং ১৮৫৮ (ভারতীয় ২/৭)।
- 7হাদীসটি হাসান। তিরমিযী (৪৯-কিতাবুদ্দাআওয়াত, ৫৫-বাব..ইযা আকালা তাআমান) ৫/৪৭৪ (ভারতীয় ২/১৮৩)।
- 8মুসলিম (৩৬-কিতাবুল আতয়িমা, ৩২-বাব ইকরামিদ দাইফ) ৩/১৬২৫, নং ২০৫৫ (ভা ২/১৮৪)।
- 9আবূ দাউদ (কিতাবুল আতয়িমা, বাব…দুআ লিরাব্বিত তাআম) ৩/৩৬৬ (ভারতীয় ২/৫৩৮); সহীহ ইবন হিব্বান ১২/১০৭; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/৩৪; আলবানী, সহীহুল জামি ১/২৫৩, নং ১১৩৭ ।
- 10মুসলিম (৩৬-কিতাবুল আশরিবা, ২২-বাব ইসতিহবাব ওয়াদয়িন্নাওয়া) ৩/১৬১৫ (ভারতীয় ২/১৮০)।
একটি রেসপন্স
جزاك الله خيرا كثيرا