সালাত: গুরুত্ব, ফযীলত

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

সালাত: গুরুত্ব, ফযীলত: ঈমানের পরে প্রত্যেক মুমিন নর ও নারীর উপরে সবচেয়ে বড় ফরয ইবাদত হলো, পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত বা নামায সময়মত আদায় করা। আরবী ভাষায় সালাত অর্থ প্রার্থনা বা দোয়া করা। ইসলামের পরিভাষায় সালাত অর্থ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো নির্ধারিত পদ্ধতিতে রুকু সাজদার মাধ্যমে আল্লাহর যিকর ও দোয়া করা। কুরআন ও হাদীসে এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব আর কোনো ইবাদতকে দেওয়া হয় নি। কুরআন মজীদে প্রায় ৭০ স্থানে আল্লাহ সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, যা থেকে আমরা এর গুরুত্ব বুঝতে পারি। অসংখ্য হাদীসে সালাতের গুরুত্ব বোঝান হয়েছে।

ইসলামের দ্বিতীয় ভিত্তি বা রোকন হলো সালাত। ইবনে উমর বলেছেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেন :
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ- وفي رواية: شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وفي رواية ثالثة: أَنْ يُوَحَّدَ اللَّهُ، وفي أخرى: أَنْ يُعْبَدَ اللَّهُ وَيُكْفَرَ بِمَا دُونَهُ- وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَانَ، وفي رواية: صيام رمضان والحج (متفق عليه)

“ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তা হলো: বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা (দাস) ও রাসুল বা প্রেরিত বার্তাবাহক (অন্য বর্ণনায়: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে হবে, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু (উপাস্য) আছে সবকিছুকে অবিশ্বাস করতে হবে), সালাত (নামায) কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রমযান মাসের সিয়াম (রোজা) পালন করা, বাইতুল্লাহর হজ্জ আদায় করা।” (বুখারী ও মুসলিম)

সালাত এমন একটি ফরয ইবাদত যার কোনো বিকল্প নেই। ইসলামে সকল বিধান সহজ করে দেওয়া হয়েছে। একজন অসুস্থ মানুষ রোযা কাযা করতে পারেন এবং পরে রাখতে পারেন। একেবারে অক্ষম মানুষ ফিদইয়া- কাফ্ফারা দিতে পারেন। কিন্তু সালাতের ক্ষেত্রে সেই বিধান নেই। সালাতকে অন্যভাবে সহজ করা হয়েছে। তা হলো মুমিন যেভাবে পারেন তা আদায় করবেন। সম্ভব হলে পূর্ণ নিয়মানুসারে। না হলে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে, যানবাহনে আরোহণ রত অবস্থায়, পোশাক পরিধান করে, উলঙ্গ হয়ে… যে ভাবে সম্ভব মুমিন তাঁর প্রভুর দরবারে হাযিরা দেবেন। কোনো সূরা, কিরাআত বা দোয়া না জানা থাকলে শুধুমাত্র আল্লাহু আকবার বলে বলে বা তাসবীহ-তাহলীল-এর মাধ্যমে সালাত আদায় করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সময় মত হাযিরা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের যতক্ষণ হুশ রয়েছে, ততক্ষণ তার দায়িত্ব হলো সময় মত সালাত আদায় করা। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:

حافظوا على الصلوات والصلاة الوسطى وقوموا لله قانتين. فإن خفتم فرجالا أو ركبانا فإذا أمنتم فاذكروا الله كما علمكم ما لم تكونوا تعلمون.
“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষত মধ্যবর্তী সালাতের, এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। যদি তোমরা আশংকিত থাক তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায়, আর যখন নিরাপদ বোধ করবে তখন যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।” ((সূরা বাকারা (২৩৮-২৩৯))

সালাতকে আমরা দায়িত্ব মনে করি। আসলে সালাত দায়িত্ব নয় সুযোগ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুযোগ দিয়েছেন, দিনের মধ্যে পাঁচবার তাঁর সাথে কথা বলে, মনের সকল আবেগ তাঁকে জানিয়ে, তাঁর রহমত, বরকত লাভ করে আমরা ধন্য হব। কুরআনের আলোকে জানা যায় যে সালাতই হল সকল সফলতার চাবিকাঠি। কুরআন কারীমে মহান আল্লাহ বলেছেন:

قد أفلح المؤمنون. الذين هم في صلاتهم خاشعون [ المؤمنون ১-২ ]
“মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগিতার সাথে সালাত আদায় করেন।”
قد أفلح من تزكى وذكر اسم ربه فصلى (الأعلى ১৪-১৫)

অন্যত্র এরশাদ করা হয়েছে: “সেই ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করতে পারে, যে নিজেকে পবিত্র করে এবং নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করে।”
সালাত হলো, মানুষের পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার একমাত্র পথ। সালাতই মানুষকে পরিশীলিত করে এবং মানবতার পূর্ণতার শিখরে তুলে দেয়। সালাতের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানসিক দৃঢ়তা ও ভারসাম্য অর্জন করেন এবং মানবীয় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন। কুরআন কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:

إن الإنسان خلق هلوعا إذا مسه الشر جزوعا وإذا مسه الخير منوعا إلا المصلين الذين هم على صلاتهم دائمون
“নিশ্চয় মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই অস্থিরচিত্ত ও ধৈর্যহারা। বিপদে পড়লে সে অধৈর্য ও হতাশ হয়ে পড়ে। আর কল্যাণ বা সম্পদ লাভ করলে সে কৃপণ হয়ে পড়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম সালাত আদায়কারীগণ (তারা এই মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন।) যারা সর্বদা (নিয়মিতভাবে) সালাত আদায় করেন।” ((মাআরিজ ১৯-২২))

সালাত গোনাহ মার্জনার অন্যতম উপায়। আবূ উমামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
من توضأ فأسبغ الوضوء … ثم قام إلى الصلاة المفروضة غفر الله له في ذلك اليوم ما مشت إليه رجله وقبضت عليه يداه وسمعت إليه أذناه ونظرت إليه عيناه وحدث به نفسه من سوء. (أحمد والطبراني بسند قوي)
যে ব্যক্তি ওযু করবে এবং পূর্ণরূপে তা সম্পন্ন করবে… অতঃপর সে ফরয সালাতে দাঁড়াবে, আল্লাহর তার সেই দিনে তার দুই পা যা চলেছে, তার দুই হাত যা ধরেছে, তার দুই কান যা শুনেছে, তার দুই চোখ যা দেখেছে এবং তার মনে যা কিছু খারাপ কল্পনা করেছে ক্ষমা করে দেবেন। (আহমদ, তাবারানী)

অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
أرأيتم لو أن نهرا بباب أحدكم يغتسل منه كل يوم خمس مرات هل يبقى من درنه شيء قالوا لا يبقى من درنه شيء قال فذلك مثل الصلوات الخمس يمحو الله بهن الخطايا (متفق عليه)
“যদি তোমাদের কারো বাড়ির দরজায় একটি নদী থাকে, যেখানে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তবে তার দেহে কি ধুলি ময়লা কিছু অবশিষ্ট থাকবে? সাহাবীগণ বলেন: না। তার ধুলিময়লা কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাতও অনুরূপ। এগুলির মাধ্যমে আল্লাহ পাপরাশি ক্ষমা করেন।” ((বুখারী ও মুসলিম))

নামায মুমিন ও কাফিরের মধ্যে মাপকাঠি। নামায ত্যাগ করলে মানুষ কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
بين الرجل وبين الشرك والكفر ترك الصلاة (مسلم)
“একজন মানুষ ও কুফরী-শিরকের মধ্যে রয়েছে নামায ত্যাগ করা।” ((মুসলিম))

তিনি আরো বলেন:
من ترك الصلاة فقد كفر (صحيح ابن حبان)
“যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিল সে কাফির হয়ে গেল।” ((ইবনু হিব্বান))
কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার আলোকে একথা নিশ্চিত যে, নামায মূসলিমের মূল পরিচয়। নামায ছাড়া মুসলিমের অস্তিত্ব কল্পনাতীত। নামায পরিত্যাগকারী কখনোই মুসলিম বলে গণ্য হতে পারেন না।

যে ব্যক্তি মনে করেন যে, নামায না পড়লেও ভাল মুসলমান থাকা যায় সেই ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে কাফির ও অমুসলিম। আর যিনি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন যে, নামায কাযা করলে কঠিনতম গোনাহ হয়, দিনরাত শূকরের গোশত ভক্ষণ করা, মদপান করা, রক্তপান করা ইত্যাদি সকল ভয়ঙ্কর গোনাহের চেয়েও বেশী গোনাহ হলো ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত নামায কাযা করা, সেই ব্যক্তি যদি ইচ্ছা করে কোন নামায ত্যাগ করেন তাহলে তাকে মুসলমান বলে গণ্য করা হবে কিনা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগে এই প্রকারের মানুষকেও কাফির বা অমুসলিম বলে গণ্য করা হত। সহীহ হাদীসে তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু শাকীক বলেন
كان أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم لا يرون شيئا من الأعمال تركه كفر غير الصلاة (الترمذي)
“মুহাম্মাদ (সা.)-সাহাবীগণ সালাত ছাড়া অন্য কোনো (ফরয) কর্ম ত্যাগ করাকে কুফ্রী মনে করতেন না।” ((তিরমিযী))

চার ইমামের মধ্যে ইমাম আহমদ ও আরো অনেক ফকীহ এই মত পোষণ করেন। এদের মতে মুসলিম কোন পাপকে পাপ জেনে পাপে লিপ্ত হলে কাফির বলে গণ্য হবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম নামায ত্যাগ করা। যদি কেউ নামায ত্যাগ করাকে কঠিনতম পাপ জেনেও এক ওয়াক্ত ফরয নামায ইচ্ছা পূর্বক ত্যাগ করেন তাহলে তিনি কাফির ও মুরতাদ বলে গণ্য হবেন। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফিয়ী প্রমুখ ইমাম বলেন যে, এই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সরাসরি কাফির বলা যাবে না, তবে তাকে নামায ত্যাগ্যের শাস্তি স্বরূপ জেল ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।

এক ওয়াক্ত ফরয সালাত ইচ্ছাকৃতভাবে কাযা করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) যিম্মাদারী থেকে তার নাম কাটা যাবে বলে সহীহ হাদীসে উলে­খ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
لا تترك صلاة مكتوبة متعمدا فمن تركها متعمدا فقد برئت منه الذمة (ذمة الله وذمة رسوله)
“ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাতও পরিত্যাগ করবে না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাত পরিত্যাগ করবে, সে আল্লাহর যিম্মা ও তাঁর রাসূলের (সা.) যিম্মা থেকে বহিস্কৃত হবে।” ((ইবনু মাজাহ, বাইহাকী, তাবারানী, আহমদ, সহীহুত তারগীব))

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
أول ما يحاسب العبد يوم القيامة الصلاة فإن صلحت صلح سائر عمله وإن فسدت فسد سائر عمله
“কেয়ামতের দিন বান্দাকে সর্বপ্রথম তার সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। যদি সালাত সঠিক হয়, তবে তার অন্য সকল আমল টিকে যাবে। আর সালাতই যদি নষ্ট হয় তবে তার অন্য সকল আমল নষ্ট হয়ে যাবে।” ((তিরমিযী, মুখতারাহ))

ফরয সালাত যেমন মুমিন জীবনের শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, তেমনি নফল সালাতও সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায়। ফরযের অতিরিক্ত কর্মকে “নফল” বলা হয়। কিছু সময়ে কিছু পরিমাণ “নফল” সালাত পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উৎসাহ দিয়েছেন, বা তিনি নিজে তা পালন করেছেন। এগুলিকে “সুন্নাত” ও বলা হয়। যে সকল নফল সালাতের বিষয়ে তিনি বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন সেগুলিকে “সন্নাতে মুয়াক্কাদাহ” ও অন্যগুলিকে সুন্নাতে গাইর মুয়াক্কাদাহ বলা হয়। এ ধরণের কিছু সুন্নাত সালাত সম্পর্কে হাদীসে বেশি গুরুত্ব প্রদানের ফলে কোন ইমাম ও ফকীহ তাকে ওয়াজিব বলেছেন।

আল্লাহর কাছে অধিকতর নৈকট্য, পুরস্কার, মর্যাদা ও সম্মান অর্জনের মাধ্যমই হলো নফল ইবাদত। আমরা অনেক সময় ‘নফল’ নামাযে অবহেলা করি। নফলের গুরুত্বও প্রদান করতে চাই না। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনে আমরা দেখতে পাই সকল প্রকার নফল ইবাদতের প্রতি সীমাহীন গুরুত্ব ও আগ্রহ। নফল সালাত, নফল সিয়াম, নফল তিলাওয়া, নফল যিক্র, নফল দান ইত্যাদির জন্য তাঁরা ছিলেন সদা উদগ্রীব ও ব্যস্ত। প্রতিদিন নিয়মিত তাঁরা এ সকল ইবাদত আদায় করতেন। বিশেষত নফল সালাতের ক্ষেত্রে তাঁদের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি।

কুরআন কারীমে নফল সালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বারংবার মুমিনদেরকে রাত্রিতে কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অগণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মাতকে বেশি বেশি নফল-সুন্নাত সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে সাধারণভাবে যত বেশি পারা যায় নফল সালাত আদায়ের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এক সাহাবী প্রশ্ন করেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কর্ম কী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:

عليك بكثرة السجود لله فإنك لا تسجد لله سجدة إلا رفعك الله بها درجة وحط عنك بها خطيئة (مسلم)
“তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সাজদা করবে (বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করবে); কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সাজদা কর, তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার একটি পাপ মোচন করেন।” ((মুসলিম))

অন্য এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট আবেদন করেন যে, তিনি জান্নাতে তাঁর সাহচর্য চান। তিনি বলেন:
فأعنى على نفسك بكثرة السجود (مسلم)
“তাহলে বেশি বেশি সাজদা করে (নফল সালাত আদায় করে) তুমি আমাকে তোমার বিষয়ে সাহায্য কর।” ((মুসলিম))

অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
الصلاة خير موضوع فمن استطاع أن يستكثر فليستكثر (الطبراني، صحيح الترغيب)
“সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়, কাজেই যার পক্ষে সম্ভব হবে সে যেন যত বেশি পারে সালাত আদায় করে।” হাদীসটি হাসান। ((তাবারানী, সহীহুত তারগীব))

আমরা কত সময় নষ্ট করি অকারণে। সামান্য অপ্রয়োজনী পার্থিব লাভ বা স্বার্থের জন্য কত সময় ব্যয় করি। অথচ এগুলির চেয়ে দুই রাক‘আত নফল নামাযের মূল্য বেশি। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই কবরটি কার? তাঁকে বলা হলো, এটি অমুকের কবর। তখন তিনি বলেন:
وعن أبي هريرة أن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر بقبر فقال من صاحب هذا القبر فقالوا فلان فقال ركعتان أحب إلى هذا من بقية دنياكم (الطبراني في الأوسط ورجاله ثقات، وحسنه الألباني)
“দুই রাক‘আত সালাত এই লোকটির কাছে তোমাদের দুনিয়ার বাকি সকল কিছুর থেকে বেশি প্রিয়।” ((তাবারানী))

সাধারণভাবে নফল সালাত ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বা স্থানে বিশেষ সালাতের বিশেষ মর্যাদা বা ফযীলতের কথাও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হলো রাতে তাহাজ্জুদ বা কিয়ামুল্লাইল এবং সূর্যোদয়ের পরে দ্বিপ্রহরের আগে যোহা বা চাশতের নামায। কিয়ামুল্লাইলের বিষয়ে কুরআন কারীমে বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদকে মুমিনের মূল পরিচয় হিসাবে উলে­খ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবীগণও কখনোই তাহাজ্জুদ ছাড়তে বা অবহেলা করতে রাজি ছিলেন না। আয়েশা (রা) বলেন
لا تدع قيام الليل فإن رسول الله  كان لا يدعه وكان إذا مرض أو كسل صلى قاعدا (أبو داود، صحيح الترغيب)

“কখনো তাহাজ্জুদের নামায ত্যাগ করবে না ; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো তাহাজ্জুদ ত্যাগ করতেন না। যদি কখনো অসুস্থ থাকতেন অথবা কিছুটা ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করতেন তাহলে তিনি বসে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন।” ((আবূ দাউদ, সহীহুত তারগীব))

অনেক হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো সাহাবী তাহাজ্জুদ পালনে সামান্য অবহেলা করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপত্তি করেছেন।
চাশতের বা যোহার সালাতের বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
من صلى الصبح في جماعة ثم قعد يذكر الله حتى تطلع الشمس ثم صلى ركعتين كانت له كأجر حجة وعمرة … تامة تامة تامة (الترمذي، وصحيح الترغيب وحسنه)

“যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামা’আতে আদায় করে বসে বসে আল্লাহর যিকির করবে সূর্যোদয় পর্যন্ত, এরপর দুই রাক’আত নামায আদায় করবে, সে একটি হজ্ব ও একটি ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে : পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ (হজ্ব ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে।)” ((তিরমিযী, সহীহুত তারগীব))

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
من صلى صلاة الصبح في جماعة ثم ثبت حتى يسبح لله سبحة الضحى كان له كأجر حاج ومعتمر تاما له حجه وعمرته (صحيح الترغيب، وحسنه الألباني والمنذري)
“যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাতে আদায় করে বসে থাকবে দোহার (চাশ্তের) নামায আদায় করা পর্যন্ত, সে একটি পূর্ণ হজ্ব ও একটি পূর্ণ ওমরার মতো সাওয়াব পাবে।” ((সহীহুত তারগীব))
এছাড়া ওযুর পরেই অন্তত দুই রাকআত তাহিয়্যাতুল ওযূ, মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে দুই অন্তত রাক‘আত দুখুলুল মাসজিদ বা তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সালাত নিয়মিত আদায় করার বিশেষ ফযীলত বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করুন।