ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
তাওহীদের প্রকারভেদ (২)
পূর্ববর্তী প্রবন্ধে আমরা তাওহীদের প্রকারভেদ আলোচনা করতে গিয়ে তাওহীদকে দুই ভাগে ভাগকরেছিলাম। জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ এবং কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ। জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদ নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। এই প্রবন্ধে আমরা তার বাকী অংশ এবং কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ বা ইবাদতের একত্ব নিয়ে আলোচনা করবো।
নাম ও গুনাবলির একত্ব
‘তাওহীদুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত’ (توحيد الأسماء والصفات) বা ‘নাম ও গুনাবলীর তাওহীদ’ অর্থ: দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর বিভিন্ন নাম ও বিশেষণের উল্লেখ করেছেন।
এ সকল নাম ও বিশেষণের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সকল প্রকার বিকৃতি, অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর কোনো কর্ম, গুণ বা বিশেষণ কোনো সৃষ্টজীবের কর্ম, গুণ বা বিশেষণের মত নয়, তুলনীয় নয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এ পর্যায়ের তাওহীদে কাফিরদের কিছু আপত্তি ছিল
মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলি গাইবী বিষয়। মানুষ যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের বাস্তবতা অনুভব করতে পারে, কিন্তু যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে তাঁর সত্তা ও গুণাবলির খুটিনাটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এ বিষয়ে দর্শন, যুক্তি ও মানবীয় পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে বিভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হয়েছে।
বিভিন্ন যুক্তিতর্কের ভিত্তিকে কেউ বলেছেন, আল্লাহর কোনো গুণ বা বিশেষণ থাকতে পারে না। কেউ বলেছেন, তাঁর অমুক গুণ থাকতে পারে, কিন্তু তমুক গুণ থাকতে পারে না বা অমুক নামে তাঁকে ডাকা যায় না। কুরআন কারীমে কাফিরদের এরূপ কিছু বিভ্রান্তির উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কার কাফিরগণ আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা ও প্রাতিপালক হিসেবে বিশ্বাস করলেও তাকে ‘রাহমান’ বা করুণাময় বলে বিশ্বাস করতে বা এ নামে ডাকতে অস্বীকার করত।
এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اسْجُدُوا لِلرَّحْمَنِ قَالُوا وَمَا الرَّحْمَنُ أَنَسْجُدُ لِمَا تَأْمُرُنَا وَزَادَهُمْ نُفُورًا
“যখন তাদেরকে বলা হয় ‘সাজ্দাবনত হও রাহ্মান-এর প্রতি’, তখন তারা বলে, ‘রাহমান আবার কি? তুমি কাউকে সাজদা করতে বললেই কি আমরা তাকে সাজদা করব?’ এতে তাদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।”1সূরা (২৫) ফুরকান: ৬০ আয়াত।
এ বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় এ বিষয়ে ওহীর উপরে পরিপূর্ণ নির্ভর করা। কুরআন কারীমে বা সহীহ হাদীসে আল্লাহর বিষয়ে যে সকল বিশেষণ বা কর্মের গুণ আরোপ করা হয়েছে সেগুলিকে কোনোরূপ বিকৃতি, ব্যাখ্যা, তুলনা বা পরিবর্তন ছাড়াই বিশ্বাস করা।
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন:
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘এবং আল্লাহরই নিমিত্ত উত্তম নামসমূহ, তোমরা তাঁকে সে সকল নামেই ডাকবে। যারা তাঁর নামসমূহ বিকৃত করে বা নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করে তাদেরকে তোমরা বর্জন করবে। শীঘ্রই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হবে।”2সূরা (৭) আরাফ: ১৮০ আয়াত।
قُلِ ادْعُوا اللَّهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
“বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে আহ্বান কর বা ‘রহমান’ নামে আহ্বান কর, তোমরা যে নামেই আহ্বান কর সকল সুন্দর নামই তো তাঁর।”3সূরা (১৭) বানী ইসরাঈল: ১১০ আয়াত।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন:
اللَّهُ لا إِلَهَ إِلا هُوَ لَهُ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى
‘‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, সমস্ত উত্তম নাম তাঁরই।”4সূরা (২০) তাহা: ৮ আয়াত।
অন্য আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়, তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।”5সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:
فَلَا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহর জন্য উপমা বা তুলনা স্থাপন করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।’’6সূরা (১৬) নাহল: ৭৪ আয়াত।
নাম ও গুণাবলির তাওহীদের বিভিন্ন ফিরকার বিভ্রান্তি
তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত বা মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলির একত্বের বিষয়ে দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভিন্ন বিভ্রান্তির উদ্ভব ঘটে। এ বিষয়ে একমাত্র ওহীর উপর নির্ভর না করে মানবীয় পছন্দ, যুক্তি, দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন মতবাদ প্রচার করা হয়। ইফতিরাক অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব।
কর্ম পর্যায়ের একত্ব বা ইবাদতের একত্ব
আরবীতে একে ‘তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ্’ (توحيد الألوهية) অর্থাৎ ‘ইবাদত বা উপাসনার একত্ব’ বা ‘আত-তাওহীদুল ইরাদী আত-তালাবী’ (التوحيد الإرادي الطلبي) অর্থাৎ ‘ইচ্ছাধীন নির্দেশিত একত্ব’ বলা হয়।7মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১৫।
ইবাদতের পরিচয় ও সংজ্ঞা
ইবাদত শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে ‘উবূদিয়্যাত’ ও ‘ইবাদত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবূদিয়্যাত ব্যবহৃত হয় লৌকিক বা জাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। আর ‘ইবাদত’ বুঝানো হয় অলৌকিক, অজাগতিক বা অপার্থিব দাসত্বের ক্ষেত্রে। সকল যুগে সকল দেশের মানুষই জীবন, মৃত্যু ইত্যাদি অতিপরিচিত শব্দের মতই ‘ইবাদত’, উপাসনা, worship, veneration ইত্যাদি শব্দের অর্থ স্বাভাবিকভাবেই বুঝে।
মানুষ অন্য মানুষের দাস হতে পারে বা দাসত্ব করতে পারে, তবে সে অন্য যে কোনো সত্তার ‘ইবাদত’ বা উপাসনা করে না। শুধু মাত্র যার মধ্যে অলৌকিক বা অপার্থিব ক্ষমতা আছে, ইচ্ছা করলেই মঙ্গল করার বা অমঙ্গল করার বা তা রোধ করার অলৌকিক শক্তি বা অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে তারই ‘ইবাদত’ করে।
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ রাগিব ইস্পাহানী হুসাইন ইবনু মুহাম্মাদ (৫০২ হি) বলেন:
العبودية إظهار التذلل والعبادة أبلغ منها لأنها غاية التذلل ولا يستحقها إلا من له غاية الأفعال (الإفضال)
“‘উবূদিয়াত’ (slavery, serfdom, bondage) হলো বিনয়-ভক্তি প্রকাশ করা। আর ‘ইবাদত’ (worship, veneration) এর চেয়েও অধিক গভীর অর্থজ্ঞাপক। কারণ ইবাদত হলো চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি-অসহায়ত্ব প্রকাশ, যিনি চূড়ান্ত কর্ম-ক্ষমতা ও দয়ার মালিক তিনি ছাড়া কেউ এই চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না।”8রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত, পৃ. ৩১৯।
অন্যান্য আলিমও অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের ভাষায়:
العبادة على المعنى اللغوي غاية التذلل والافتقار والاستكانة
“ইবাদতের আভিধানিক অর্থ হলো, চূড়ান্ত বিনয়-ভক্তি, অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিত্ব।”9আযীম আবাদী, আউনুল মা’বূদ ৪/২৪৭; মুবারকপূরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৯/২২০; মুনাবী, আব্দুর রাউফ, ফাইদুল কাদীর ৩/৫৪০।
আল্লামা ইবনু কাসীর (৭৭৪ হি) বলেন:
والعبادة في اللغة من الذلة … وفي الشرع عبارة عما يجمع كمال المحبة والخضوع والخوف
“আভিধানিকভাবে ইবাদত অর্থ ভক্তি-বিনয় বা অসহায়ত্ব।… আর শরীয়তের পরিভাষায় পরিপূর্ণ ভালবাসা, ভক্তি, বিনয় ও ভীতির সমন্বিত অবস্থাকে ইবাদত বলা হয়।”10ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/২৬।
এভাবে আমরা দেখছি যে, পরিপূর্ণ ভালবাসা ও ভীতিময় চূড়ান্ত ভক্তিই ইবাদত। আর চূড়ান্ত বিনয়, অসহায়ত্ব ভক্তি প্রকাশ করে চূড়ান্ত ক্ষমতা ও করুণার অধিকারীর জন্য যে কর্ম করা হয় তা বিভিন্ন পর্যায়ের। তার কাছে যেমন প্রার্থনা করা হয় তেমনি তার প্রশংসাও করা হয়। সবই ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মানুষ যা কিছু করে সবই ইবাদত বলে গণ্য।
এজন্য ইবাদতের ব্যাখ্যায় বলা হয়:
اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة
“আল্লাহ ভালবাসেন এরূপ সকল কথা, বাহ্যিক কর্ম ও হার্দিক বা মানসিক কর্ম সব কিছুই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত।”১১উসাইমীন, মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ, আল-কাওলুল মুফীদ ১/১৬।
ইবাদতের প্রকারভেদ
তবে সব কর্ম এক পর্যায়ের নয়। কিছু কর্ম আছে যা সাধারণভাবে মানুষ ‘ইবাদত’ হিসেবেই করে। যে সত্তার এরূপ অলৌকিক ক্ষমতা ও আধিপত্য আছে তাকেই তা প্রদান করে। সকল সমাজের সকল ভাষার মানুষই এগুলি জানেন। পূজা, অর্চনা, বলি, কুরবানী, মানত, প্রার্থনা ইত্যাদি এই জাতীয় কর্ম। পাশাপাশি কিছু কর্ম আছে যা মানুষ ইবাদত হিসেবে করে, আবার জাগতিকভাবেও করে।
যেমন প্রশংসা করা, ভয় করা, আনুগত্য করা ইত্যাদি। এগুলি মানুষ মানুষ হিসেবে জাগতিকভাবে অন্য মানুষের জন্য করে। আবার ‘মা’বূদ’ বা পূজিত সত্তার জন্যও করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম প্রকারের কর্ম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করাই শিরক। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মানত, বলি, উৎসর্গ, জবাই ইত্যাদি করা। এগুলি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ কারো ভিতরে ঈশ্বরত্ব (divinity, holiness, sacredness, sanctity) ঐশ্বরিক ক্ষমতা, চূড়ান্ত আধিপত্য, অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, অলৌকিক শক্তি ইত্যাদি কল্পনা না করলে কেউ তার জন্য এরূপ কর্ম করে না। এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রাহ) বলেন:
اعلم أن العبادة هي التذلل الأقصى. وكون التذلل أقصى من غيره لا يخلو إما أن يكون بالصورة، مثل كون هذا قياماً وذلك سجوداً، أو بالنية بأن نوى بهذا الفعل تعظيم العباد لمولاهم، وبذلك تعظيم الرعية للملوك، أو التلامذة للأستاذ، لا ثالث لهما.
“জেনে রাখ, ইবাদত হলো চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয়। কোন্ ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত এবং কোন্টি চূড়ান্ত নয় তা দুভাবে জানা যায়:
(১) ভক্তি-বিনয়ের প্রকার থেকে, যেমন দাঁড়িয়ে ভক্তি করা চূড়ান্ত ভক্তি নয় তবে সাজদা করা চূড়ান্ত ভক্তি এবং
(২) নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য থেকে, যেমন বান্দা হিসেবে তার মাবূদকে ভক্তি করার উদ্দেশে যে ভক্তি বা বিনয় প্রকাশ করা হয় তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং প্রজা হিসেবে রাজার বা ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের ভক্তির নিয়েতে যা করা হয় তা চূড়ান্ত ভক্তি নয় বলে গণ্য। ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত পর্যায়ের কি না তা জানার তৃতীয় কোনো পথ নেই।”12শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৯।
তাওহীদুল ইবাদাতের অর্থ
তাওহীদুল ইবাদাতের অর্থ সকল প্রকার ইবাদাত, যেমন প্রার্থনা, সাজদা, জবাই, উৎসর্গ, মানত, তাওয়াক্কুল-নির্ভরতা ইত্যাদি- একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য বলে বিশ্বাস করা।
কেউ যদি আল্লাহর ইবাদাত করেন এবং সাথে সাথে অন্য কারো ইবাদাত করেন তাহলে তিনি আল্লাহর ইবাদাতকারী বলে গণ্য হবেন না, কারণ তিনি ইবাদাতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বা অংশীদার করেছেন এবং শিরকে লিপ্ত হয়েছেন। আল্লাহর ইবাদাতের অর্থ বিশুদ্ধভাবে, একনিষ্ঠভাবে, নিষ্কলুষভাবে বা শিরকের কলুষতা থেকে মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদত করা।
অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা এবং কোনো প্রকার ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য না করা। কুরআন কারীমে অসংখ্য স্থানে আল্লাহ নির্দেশ দান করেছেন বিশুদ্ধভাবে ইবাদাত করতে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করতে। এ হলো (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)-র অর্থ ও নির্দেশ। মহান আল্লাহ বলেন:
هُوَ الْحَيُّ لا إِلَهَ إِلا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ
‘‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ (উপাস্য বা মাবুদ) নেই, সুতরাং সার্বিক আনুগত্য ও একনিষ্ঠার সাথে বিশুদ্ধভাবে তাঁকেই ডাক।’’13সূরা (৪০) মুমিন (গাফির): ৬৫ আয়াত
وَمَا أُمِرُوا إِلا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ
‘‘তাদেরকে তো কেবলমাত্র এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা বিশুদ্ধ চিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত প্রদান করবে, আর এটাই সঠিক ধর্ম।”14সূরা (৯৮) বাইয়েনা: ৫ আয়াত।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
“হে মানব জাতি, তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।”15সূরা (২) বাকারা: ২১ আয়াত।
অন্যত্র আল্লাহ একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করার এবং শিরক থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন:
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا
‘‘এবং তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরীক বানিও না।’’16সুরা (৪) নিসা: ৩৬ আয়াত।
মহান আল্লাহ বলেন,
لا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“দীন সম্পর্কে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগূতকে অস্বীকার (অবিশ্বাস) করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙ্গবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা প্রজ্ঞাময়।”১৭সূরা (২) বাকারা, ২৫৬ আয়াত।
অন্যত্র বলা হয়েছে:
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
“আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।”18সূরা (১৬) নাহল, ৩৬ আয়াত।
এখানে তাগুতকে বর্জন করা বলতে তাগুতের ইবাদত বর্জন করা বুঝানো হয়েছে।
এ বিষয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ
“যারা তাগূতের ইবাদত বর্জন করে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে।”19সূরা যুমার, ১৭ আয়াত।
তাগূত শব্দটি আরবী ‘তুগইয়ান’ শব্দ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ সীমা লঙ্ঘন করা।
অবাধ্যতা, জুলুম বা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনকারীকে ‘তাগী’ (الطاغي) বা সীমালঙ্ঘনকারী বলা হয়। অত্যধিক সীমলঙ্ঘনকারীকে ‘তাগিয়াহ’ (الطاغية) বলা হয়। কঠিনতম সীমালঙ্ঘণকারী বা মহা-অবাধ্যকে ‘তাগূত’ (الطاغوت) বলা হয়। এভাবে আমরা দেখছি যে, আভিধানিকভাবে ‘তাগূত’ অর্থ মহা-সীমালঙ্ঘনকারী।20যাইনুদ্দীন রাযী, মুখতারুস সিহাহ, পৃ. ১৬৫।
আভিধানিকভাবে সকল সীমা-লঙ্ঘনকারীকে তাগূত বলা যায়। তবে কুরআনের পরিভাষায় ‘তাগূত’ অর্থ শয়তান। এছাড়া আল্লাহকে ছাড়া যা কিছুর ইবাদত, পূজা বা উপাসনা করা হয় তাকে ‘তাগূত’ বলা হয়।21সূরা (২) বাকারা: ২৫৭ আয়াত; সূরা (৪) নিসা: ৭৬ আয়াত; বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৭৩; তাবারী, তাফসীর ৩/১৮-১৯।
এভাবে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য স্থানে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, একমাত্র তাঁরই উপাসনা ইবাদাত করতে এবং অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর ইবাদত-উপাসনা সর্বতোভাবে বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এ হলো তাওহীদুল ঊলুহীয়্যাহ্ অর্থাৎ ইবাদাতের একত্ব বা কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ।
তাওহীদুল ঈমান-৬, তাওহীদুল ঈমান-৫, তাওহীদুল ঈমান-৪, তাওহীদুল ঈমান-২, তাওহীদুল ঈমান-১