আজ …… হিজরী সালের রবিউল আউয়াল মাসের ৪র্থ জুমুআ। আজ আমরা শিরকের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। কিন্তু তার আগে আমরা এ সপ্তাহের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলির বিষয়ে সংক্ষেপ আলোকপাত করি।

কুরআন ও হাদীসে বর্ণনা থেকে আমরা দেখি যে,

মুশরিকগণের শিরকী বিশ্বাস ও কর্মের অন্যতম ছিল আল্লাহর ক্ষমতায় শিরক। মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ জাগতিক উপকরণাদি ছাড়া নিজের ইচ্ছায় অলৌকিকভাবে কারো মঙ্গল-অমঙ্গল করতে পারে, জীবন, মৃত্যু, সচ্ছলতা, অসচ্ছলতা, সুস্থতা, অসুস্থতা, রিয্ক ইত্যাদি বিষয়ে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে বিশ্বাস করা হলো আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের শিরক। বিভ্রান্ত খৃস্টানগণ ঈসা (আ)-এর বিষয়ে এরূপ বিশ্বাস পোষণ করে। আরবের মুশরিকগণও তাদের উপাস্যদের বিষয়ে এরূপ বিশ্বাস পোষণ করত।

তারা মহান আল্লাহকে একমাত্র সর্বশক্তিমান প্রতিপালক হিসেবে বিশ্বাস করত। তবে তারা মনে করত যে, আল্লাহ তার মাহবূব বান্দাদেরকে দয়া করে কিছ অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছেন। এ ক্ষমতাবলে তারা বিশ্বের পরিচালনায় বা মানুষের ভালমন্দে প্রভাব রাখতে পারেন। মূলত মুজিযা, কারামত, ফিরিশতাগণের দায়িত্ব, দুআ কবুল ইত্যাদিকে তারা তাদের দলিল হিসেবে গ্রহণ করত। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে আরবের মুশরিকগণ হজ্জ-উমরার তালবিয়ায় বলত:

لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ إِلا شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ
“লাব্বাইকা, আপনার কোনো শরীক নেই, তবে আপনি নিজে যাকে আপনার শরীক বানিয়েছেন সে ছাড়া। এরূপ শরীকও আপনারই মালিকানাধীন। সে ও তার সকল কর্তৃত্ব ও রাজত্ব আপনারই অধীন।”1মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৪৩; তাবারী, তাফসীর ১৩/৭৮-৭৯।

কুরআনে বিভিন্ন আয়াতে বারংবার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ কাউকে কোনোরূপ অলৌকিক বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা, মালিকানা বা অংশীদারিত্ব দেন নি। দুএকটি আয়াত উল্লে­খ করছি:
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلا فِي الأَرْضِ وَمَا لَهُمْ فِيهِمَا مِنْ شِرْكٍ وَمَا لَهُ مِنْهُمْ مِنْ ظَهِيرٍ

“বল, ‘তোমরা আহ্বান কর তাদেরকে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (ইলাহ) মনে করতে, তারা আকাশ-মণ্ডলী এবং পৃথিবীতে অণুপরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং এতদুভয়ে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ মহান আল্লাহর সহায়কও নয়।”2সূরা (৩৪) সাবা: ২২ আয়াত।

এ বিষয়টি সকল

মুশরিকের সকল উপাস্যের বিষয়েই প্রযোজ্য। মুর্তি, প্রতিমা, তারকা, ফিরিশতাগণ, নবীগণ, ওলীগণ, জিন্নগণ বা অন্য যাদেরই ইবাদত করত মুশরিকগণ সকলের ক্ষেত্রেই একই উত্তর প্রযোজ্য। তাঁরা কেউই আসমানের বা যমিনের সামান্যতম মালিকানা রাখেন না, আসমান-যমিনের কোথাও তাদের কোনো অংশীদারিত্ব নেই এবং মহান আল্লাহ তাদের কারো সহযোগিতার প্রত্যাশী নন, কেউ তাকে কোনোরূপে সহযোগিতা করেন না। আল্লাহ আরো বলেন:

مَا يَفْتَحِ اللَّهُ لِلنَّاسِ مِنْ رَحْمَةٍ فَلا مُمْسِكَ لَهَا وَمَا يُمْسِكْ فَلا مُرْسِلَ لَهُ مِنْ بَعْدِهِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“আল্লাহ মানুষের প্রতি কোনো অনুগ্রহ অবারিত করলে কেউ তা নিবারণ করতে পারে না এবং তিনি কিছু নিরুদ্ধ করতে চাইলে তা উন্মুক্ত করার মতও কেউ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”3সূরা (৩৫) ফাতির: ২ আয়াত।

এ বিষয়ে আরো অনেক আয়াত আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলিতে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

শিরকের একটি প্রকার হলো

আল্লাহর ইলমে শরীক করা। আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের অন্যতম দিক তাঁর অনন্ত-অসীম অতুলনীয় ও সামগ্রিক ইলম বা জ্ঞান। তাঁর অন্যতম সিফাত হলো ‘আলিমুল গাইব’। আরবের মুশরিকরা বিশ্বাস করত যে, গণকগণ গাইব জানেন। খৃস্টানগণ বিশ্বাস করত যে, ঈসা (আ) আল্লাহর সকল ইলুম গাইবের জ্ঞান রাখেন। কুরআনে বারংবার এরূপ শিরকের প্রতিবাদ করা হয়েছে। বারংবার উল্লে­খ করা হয়েছে যে, গাইবের জ্ঞানই আল্লাহ ছাড়া কারো নেই। একস্থানে আল্লাহ বলেন:

قُلْ لا يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ الْغَيْبَ إِلا اللَّهُ
“বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গাইব বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”4সূরা (২৭) নাম্ল: ৬৫ আয়াত।

মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে গাইবের জ্ঞান তাঁর নবী-রাসূলদের প্রদান করেন। কিন্তু এ জ্ঞান গাইবের সামগ্রিক জ্ঞান নয়। এজন্য কিয়ামতের দিন সকল রাসূল একত্রে বলবেন যে, তাদের কোনো গাইবের ইলম নেই, মহান আল্লাহই একমাত্র আলিমুল গাইব। আল্লাহ বলেন:
يَوْمَ يَجْمَعُ اللَّهُ الرُّسُلَ فَيَقُولُ مَاذَا أُجِبْتُمْ قَالُوا لا عِلْمَ لَنَا إِنَّكَ أَنْتَ عَلامُ الْغُيُوبِ
“যে দিন আল্লাহ রাসূলদেরকে একত্র করবেন এবং বলবেন, তোমারা কী উত্তর পেয়েছিলে? তারা বলবে, আমাদের তো কোনো জ্ঞান নেই, তুমিই তো অদৃশ্য সম্মন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।”5সূরা (৫) মায়িদা: ১০৯ আয়াত।

কুরআনে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল মুহাম্মাদ ৎ-কে নির্দেশ দিয়েছেন মানুষদের জানিয়ে দিতে যে, তাঁর নিকট গাইবী ক্ষমতা বা ইলম নেই। এক আয়াতে আল্লাহ বলেন:
قُلْ لا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلا ضَرًّا إِلا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘‘বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের কোনো মঙ্গল বা অমঙ্গল করার ক্ষমতাও আমার নেই। আমি যদি গাইব (গোপন জ্ঞান) জানতাম তাহলে প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম, আর কোনো অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমি তো কেবলমাত্র ভয়পপ্রদর্শনকারী এবং সুসংবাদদাতা বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য।”6সূরা (৭) আ‘রাফ: ১৮৮ আয়াত।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও কেউ কেউ নবী-ওলীগণের বিষয়ে এরূপ ক্ষমতা ও ইলম বিষয়ক শিরকে নিপতিত হয়। মূলত শীয়া সম্প্রদায়ের অপপ্রচার, মিথ্যাচার ও অপব্যাখ্যাই এগুলি ছড়িয়েছে। শীয়ারা দাবি করেন যে, তাদের ইমামগণ বিশ্বপরিচালনার গায়েবী ক্ষমতার ও ইলমের অধিকারী। আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ক্ষমতা মূলত তাদের হাতে। আর ইমামদের জন্য এরূপ ক্ষমতা দাবি করতে হলে তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বাদ দেওয়া যায় না। এজন্য তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিষয়েও এরূপ দাবি করে।

আমরা দেখেছি যে,

মহান আল্লাহ বারংবার জানিয়েছেন যে, গাইবের জ্ঞান তিনি ছাড়া কেউ জানে না। এর বিপরীতে কুরআন-হাদীসে কোথাও সুস্পষ্টত বলেন নি যে, তিনি গাইবের জ্ঞান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা তাঁর বংশের ইমামদেরকে দিয়েছেন। কিন্তু শীয়ারা ইমামগণ ও ওলীগণের নামে অনেক উদ্ভট কল্পকাহিনী বর্ণনা করেছে যেগুলিই মূলত তাদের দলীল। শীয়াদের প্রভাবে সুন্নী সমাজেও এরূপ বিশ্বাস প্রসার লাভ করেছে। মোল্লা আলী কারী বলেন: “জেনে রাখ, নবীগণ (আ) অদৃশ্য বা গাইবী বিষয়াদির বিষয়ে আল্লাহ কখনো কখনো যা জানিয়েছেন তা ছাড়া কিছুই জানতেন না। হানাফী মাযহাবের আলিমগণ সুস্পষ্টভাবে উল্লে­খ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাইব জানতেন বলে আকীদা পোষণ করা কুফরী।”7মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৩।

মুশরিকদের আরেক প্রকার শিরক গাইরুল্লাহকে ডাকা বা গাইবী সাহায্য চাওয়া। কুরআনে বারংবার আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকতে নিষেধ করা হয়েছে এবং একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গাইরুল্লাহকে ডাকার অসারতা প্রমাণ করে একস্থানে আল্লাহ বলেন:
قُلْ أَرَأَيْتُمْ شُرَكَاءَكُمُ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ أَمْ آَتَيْنَاهُمْ كِتَابًا فَهُمْ عَلَى بَيِّنَةٍ مِنْهُ بَلْ إِنْ يَعِدُ الظَّالِمُونَ بَعْضُهُمْ بَعْضًا إِلا غُرُورًا
‘‘বল, তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক বানিয়ে আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তাদের বিষয়ে ভেবে দেখেছ কি? তারা পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করে থাকলে তা আমাকে দেখাও, অথবা আকাশমণ্ডলীতে তাদের কোনো অংশ আছে কি? না কি আমি তাদেরকে কোনো কিতাব দিয়েছি (ওহীর জ্ঞান দান করেছি) যার প্রমাণের উপর তারা নির্ভর করে? বস্তুত জালিমরা একে অপরকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।’’8সূরা (৩৫) ফাতির: ৪০ আয়াত।

কুরআনের যুক্তি সুস্পষ্ট। বিবেক ও যুক্তির দাবি এই যে, যিনি স্রষ্টা তিনিই মাবুদ এবং একমাত্র তাকেই ডাকতে হবে। তারপরও তিনি যদি ওহীর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে বলে দেন যে, আমার ইবাদতের প্রয়োজন নেই, বা আমার কাছে সরাসরি চেয় না, আমাকে সরাসরি ডেক না, বরং অমুক বা তমুককে ডাক, তবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকার বৈধতা প্রমাণিত হতো। কিন্তু কখনোই মুশরিকগণ এরূপ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে নি। সকল আসমানী কিতাবইে আল্লাহ বলেছেন যে, একমাত্র আমাকেই ডাকবে এবং আমি ছাড়া কেউই বিপদ দিতে বা কাটাতে পারে না।

উপরের আয়াতে

সবশেষে তাদের শিরকের প্রকৃত অবস্থা আল্লাহ জানিয়েছেন। বস্তুত মুশরিকগণ একে অপরকে তাদের মিথ্যা কল্পনা-প্রসূত প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। আল্লাহর অমুক কথার ব্যাখ্যা, অমুক যুক্তি বা অমুক ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এদের ডাকলে আল্লাহ খুশি হন, এরা তোমাদের ত্রাণ করবে, আখিরাতে মুক্তি দেবে, “অমুক ব্যক্তি বিপদে পড়ে অমুক বাবা, মা বা সেন্টকে ডেকেছিল, অমনি সে তাকে উদ্ধার করে দিয়েছে” ইত্যাদি কাল্পনিক মিথ্যা প্রতিশ্রুতিই তাদের একমাত্র সম্বল।

মুসলিম সমাজেও অনেকে অনুরূপ মিথ্যা কাহিনী, জনশ্র“তি ইত্যাদির উপর নির্ভর করে বিপদে আপদে জীবিত বা মৃত পীর-ওলীগণকে ডাকে এবং তাদের কাছে গাইবী সাহায্য চায়। অথচ আল্লাহর কাছে আমরা প্রতিদিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছি যে, তাঁর কাছে ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য চাব না:
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
“আমরা শুধু তোমরই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি।”9সূরা (১) ফাতিহা: ৪ আয়াত।

আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে ভালবাসতে হবে,

তাঁদের জন্য দুআ করতে হবে, জীবিতদের সাহচার্য গ্রহণ করতে হবে, দুআ চাওয়া যাবে, মৃতদের যিয়ারত করে তাদেরকে সালাম দিতে হবে এবং দুআ করতে হবে। কিন্তু তাদের কোনো অলৌকিক সাহায্য করার ক্ষমতা আছে, অথবা তারা দূর থেকে ডাকলে শুনতে পান বলে বিশ্বাস করা যেমন শিরক, তেমনি তাদেরকে এভাবে ডাকাও শিরক। অনেক সময় আমরা কারামতের কাহিনী শুনে বিভ্রান্ত হই। অমুক বুজুর্গের একজন খাদেম সমূদ্রে বা জঙ্গলে বিপদে পড়লে তিনি তাকে সাহায্য করেন। এ কথা শুনে আমরা মনে করি অমুক বুজুর্গ বা সকল বুজুর্গ এরূপ ক্ষমতা রাখেন।

এ সকল গল্প অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন। কখনো শয়তান মানুষকে শিরকের মধ্যে নিপতিত করতে বুজুর্গদের আকৃতি ধরে বিভ্রান্ত করে। কখনো বা সত্যই আল্লাহ কোনো বুজুর্গকে কারামত দিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি যে, মুজিযা কারামতকে ক্ষমতা মনে করেই পূর্ববর্তী উম্মাতেরা শিরক করেছিল এবং আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, মুজিযা-কারামত নবী-ওলীদের ক্ষমতা নয়, একান্তই আল্লাহর ইচ্ছাধীন।

একটি উদাহরণ দেখুন।

খলীফা উমার (রা) একদিন মদীনার মসজিদে নববীতে খুতবা দানকালে চিৎকার করে বলেন, ইয়া সারিয়া, আল-জাবাল, ‘হে সারিয়া, পাহাড়!’ ঐ সময়ে সারিয়া ইবনু যুনাইম একটি সেনাবাহিনী নিয়ে ইরাকে যুদ্ধরত ছিলেন। তিনি প্রায় পরাজিত হয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময়ে উমার (রা)-এর এ চিৎকার তিনি শুনতে পান। তখন তিনি পাহাড়ের আশ্রয় নিয়ে পাহাড়কে পিছনে রেখে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করেন এবং বিজয় লাভ করেন।10ইসাবাহ /৩৬, তাহযীবুল আসমা ২/৩৩০, তারিখ ইবন কাসীর ৫/২১০ এর কয়েকমাস পর ২৩ হিজরীর জিলহাজ্জ মাসের ২৬ তারিখ উমার (রা) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতে ইমামতি করতে শুরু করেন।

এমতাবস্থায় আবু লুলুআ নামক এক কাফির ক্রীতদাস পিছন থেকে একটি ছুরি দিয়ে তাকে বারংবার আঘাত করে। উমার (রা) আঘাতের ফলে অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফেরার পরে তিনি প্রশ্ন করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাকে বলা হয় কাফির আবু লুলুআ। তিনি বলেন, আল-হামদু লিল্লাহ, কোনো ঈমানের দাবীদারের হাতে আমার মৃত্যু নির্ধারণ করেন নি। তিনদিন পরে তিনি ইন্তেকাল করেন।11তারিখ ইবন কাসীর ৫/২১৭-২১৮

যে উমার (রা) শতশত মাইল

দূরের যুদ্ধের ময়দানের অবস্থা জানতে পারলেন, তিনিই কয়েক হাতের মধ্যে অবস্থানরত শত্রুর কথা জানতে পারলেন না। এতে বুঝা গেল যে, কারামত কারো স্থায়ী ক্ষমতা নয়। কারামত অর্থ আল্লাহ বিশেষ মুহূর্তে তাকে সম্মান করে একটি অলৌকিক কর্ম দিয়েছিলেন। এর অর্থ এ নয় যে, তিনি সর্বদা এরূপ ক্ষমতার অধিকারী বা ইচ্ছা করলেই এরূপ করতে পারেন।

ইহূদী-খৃস্টানদের এক প্রকার শিরক ছিল আলিম ও বুজুর্গগণের অতিভক্তি ও অতি আনুগত্য করা। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لا إِلَهَ إِلا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
“তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিতগণকে এবং সংসার-বিরাগীগণকে রব্ব-প্রতিপালক রূপে গ্রহণ করেছে, এবং মরিয়ম তনয় মাসীহকেও। কিন্তু তারা শুধু এক ইলাহের ইবাদত করার জন্য আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তারা যা শরিক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র!”12সূরা তাওবা, ৩১ আয়াত।

ইহূদী-খৃস্টানগণ দুভাবে আলিম ও ওলীগণকে ‘রাব্ব’ বানাতো। প্রথমত তারা বিশ্বাস করত যে, আলিম ও বুজুর্গগণ অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। বিশেষত মৃত্যুর পরে তারা অলৌকিক কল্যাণ, অকল্যাণ ও বিশ্ব পরিচালনার ক্ষমতা লাভ করেন। এজন্য তারা তাদের মুর্তি বা কবরে মানত, নযর বা ভেট প্রদান করত, তাদের কবরের নিকট ইবাদতগাহ তৈরি করত এবং তাদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান থেকে ‘বরকত’ লাভের জন্য সচেষ্ট থাকত। ইতিহাস ও হাদীস থেকে এ সকল বিষয় জানা যায়।

দ্বিতীয়ত,

তারা পোপ-পাদরিগণ ও সাধুদের ‘ইসমাত’ বা অভ্রান্ততায় (infallibility) বিশ্বাস করত। তারা বিশ্বাস করত ও করে যে, পবিত্র আত্মার প্রেরণায় তারা কাশফ, ইলহাম ও ইলমু লাদুন্নী লাভ করেন। সেগুলির আলোকে তারা ধর্মের যে বিধান প্রদান করেন তাই চূড়ান্ত। তাদের সিদ্ধান্ত ভুল হতে পারে না। সাধারণ মানুষদের জন্য ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন বা ধর্মীয় বিধান জানা সম্ভব নয়। ‘বাইবেলে’ কি আছে বা নেই তা বড় কথা নয়। পোপ বা ধর্মগুরুগণ কি ব্যাখ্যা বা নির্দেশ দিলেন তাই বড় কথা।

আলিম, উলামা, পীর ও ওলীগণের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু তাঁদেরকে কখনোই আল্লাহর স্থানে বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্থানে বসানো যাবে না।

আল্লাহ ছাড়া কারো উপর তাওয়াক্কুল করা শিরক। তাওয়াক্কুল অর্থ কাউকে উকিলরূপে গ্রহণ করা এবং তার উপর নির্ভর করা। এরূপ মনে করা যে, অমুক আমার দিকে দৃষ্টি রেখেছেন, বিপদে আপদে আমাকে তরাবেন। এভাবে কারো উপর তাওয়াক্কুল করা বা তার নাম নিয়ে যাত্রা বা কর্ম শুরু করা শিরক। কুরআন কারীমে আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, একমাত্র আল্লাহর উপরেই তাওয়াক্কুল করতে হবে এবং উকিল হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। একস্থানে আল্লাহ বলেন:
وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
“তোমরা যদি মুমিন হও তবে কেবলমাত্র আল্লাহর উপরেই তাওয়াক্কুল কর।”13সূরা মায়িদা: ২৩ আয়াত।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে

নযর, মানত, উৎসর্গ বা জবাই করা শিরক। যারা কবরে-মাযারে মানত বা জবাই করেন তাদের অনেকে মনে করেন যে, আমরা তো একমাত্র আল্লাহর নাম নিয়েই জবাই করছি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যেই মানত করছি, কেবলমাত্র পশুটাকে ওলীর মাযারে এনে জবাই করছি, যেন তিনি সাওয়াব পান। এখানে প্রশ্ন হলো, যদি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই মানত বা জবাই করা হয় তাহলে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে জবাই করেই তো নিয়্যাত করা যেত যে, আল্লাহ এ সাদকার সাওয়াবটি অমুককে পৌঁছে দিন, এত কষ্ট করে পশুটি মাযারে নিয়ে যাওয়া হলো কেন? স্পষ্টতই এর কারণ হলো এ মানতের মাধ্যমে আল্লাহ এবং মৃত বুজুর্গ উভয়েরই সন্তুষ্টি লাভ করা।

এভাবে আল্লাহর সাথে মানতের ইবাদতে অন্যকে শরীক করা হয়। আল্লাহ বলেন:
قُلْ إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ،
‘‘বল, নিশ্চয় আমার সালাত, আমার উৎসর্গ, আমার জীবন, আমার মৃত্যু আল্লাহরই নিমিত্ত।’’14সূরা (৬) আনআম ঃ ১৬২-১৬৩ আয়াত।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করা শিরক।

মুশরিকগণ চাঁদ, সূর্য, প্রতিমা ইত্যাদির জন্য সাজদা করত। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্যকে সাজদা করতে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন:
لا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
“তোমরা সূর্যকে সাজদা করো না, চন্দ্রকেও নয়, সাজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলি সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর।”15সূরা (৪১) ফুস্সিলাত: ৩৭ আয়াত।

পারস্য ও রোমের মানুষের রাজা, বাদশাহ আলিম ও বুজুর্গদেরকে সম্মান করে সাজদা করত। সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে এভাবে সম্মানমূলক সাজদা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি কঠিনভাবে নিষেধ করেন এবং বলেন আল্লাহ ছাড়া কাউকে সাজদা করা কোনোভাবে বৈধ নয়।16বিস্তারিত দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্ল­াহ জাহাঙ্গীর, কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা: ৩৫৩-৫২২।

নবী, ওলী ও ফিরিশতাদেরকে ভালবাসা ও মর্যাদা প্রদান করা মুমিনের দায়িত্ব। আবার এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হলে তা শিরকে পরিণত হয়। শিরক থেকে বাঁচার অন্যতম উপায় হলো, সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। সাহাবীগণ যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ও অন্যান্য নবী-ওলীদের ভক্তি করেছেন সেভাবেই আমাদেরকে বুজর্গদেরকে ভক্তি করতে হবে। সুন্নাতের বাইরে গেলেই বিপদ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যারা তাঁর ও তাঁর সাহাবীগণের মত ও কর্মের উপর থাকবে তাঁরাই নাজাত পাবে।

তিনি শিক্ষা দিয়েছেন,

নবী-ওলীদের ভালবাসতে ও সম্মান করতে। কিন্তু বিপদে আপদে কখনোই তাদের কাছে সাহায্য চান নি বা চাইতে শিক্ষা দেন নি। বরং সর্বদা সকল পরিস্থিতিতে একমাত্র আল্লাহকে ডাকতে ও তাঁর সাহায্য চাইতে শিক্ষা দিয়েছেন। সাহাবী-তাবিয়ীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সর্বোচ্চ ভক্তি করেছেন, ভালবেসেছেন, তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর কাছে দুআ চেয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর রাওযা শরীফ যিয়ারত করেছেন, সালাম দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর কাছে দুআ চান নি বা বলেন নি যে, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি রাওযা থেকে আমাদের জন্য দুআ করুন। এমনকি আল্লাহর কাছে দুআ চাওয়ার জন্যও তাঁরা রাওযা শরীফে সমবেত হন নি। কখনোই তাঁকে বা তাঁর কবরকে সাজদা করেন নি, তাঁর নামে মানত করেন নি, বিপদে আপদে রাওযার পাশে দাঁড়িয়ে বা দূর থেকে তাকে ডাকেন নি বা বিপদ কাটিয়ে দেওয়ার আবদার করেন নি।

কোনো বার, তিথি, গ্রহ, রাশি, তারিখ, মাস, পাখী, পশু, দিক, দ্রব্য ইত্যাদি অশুভ বা অযাত্রা বলে বিশ্বাস করা, অষ্টধাতুর মাদুলি ইত্যাদিতে বিশ্বাস করা শিরক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ
“অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা র্শিক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা র্শিক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা র্শিক।((তিরমিযী, ৪/১৬০; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১৩/৪৯১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৪; তিরমিযী, ইবনু হিব্বান, হাকিম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।))

শয়তান চায়

মুমিনকে চিরস্থায়ী জাহান্নামী করতে। এজন্য শয়তানের সবচয়ে বড় অস্ত্র শিরক। আমরা দেখেছি যে, সকল পাপের ক্ষমা আছে, সকল পাপীরই জান্নাতের আশা আছে, কিন্তু ব্যতিক্রম হলো শিরক। শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি ক্ষমারও আশা নেই জান্নাতেরও আশা নেই। হাযেরীন, সব হারানো যায়, কিন্তু ঈমান হারানো যায় না। ঈমান বাঁচাতে আমাদের প্রত্যেককে বেশি বেশি কুরআন কারীম বুঝে পড়তে হবে। সহীহ হাদীসের গ্রন্থগুলি বারংবার বুঝে বুঝে পড়তে হবে। আরবী না বুঝলে অনুবাদ পড়তে হবে। এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণের সুন্নাত সহীহভাব জানতে হবে এবং সুদৃঢ়ভাবে আাঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের ঈমান হিফাযত। আমীন।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহিমাহুল্লাহ, বই: খুতবাতুল ইসলাম, পৃ. ১১৯-১২৬।

তাওহীদের ঈমান (১), তাওহীদের ঈমান (৪), তাওহীদের-ইমান-৬, আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ, ইসলামী আকীদার উৎস ও ভিত্তি ওহীর ইলম