আজ …… হিজরী সালের রবিউস সানী মাসের ৪র্থ জুমুআ। আজ আমরা সালাতের আহকাম ও ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। কিন্তু তার আগে আমরা এ সপ্তাহের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলির বিষয়ে সংক্ষেপ আলোকপাত করি।

সালাতের অনেক আহকাম রয়েছে,

যেগুলি বিস্তারিতভাবে আমাদেরক শিখতে হবে। আজকের খুতবায় আমরা সালাতের অল্প কিছু বিধান আলোচনা করব যেগুলি অনেক নিয়মিত মুসল্লীয় ভুল করেন। কারণ সালাত আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ইবাদত। আমরা প্রতিদিন, ১৭ রাক‘আত ফরয সালাত। ১২ রাক‘আত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা সালাত। তিন রাক‘আত বিতর মোট ৩২ রাকআত। সালাত ছাড়াও আরো অন্তত ১০/১২ রাকআত সালাত আদায় করি। যদি প্রত্যেক রাক‘আতে আমরা কিছু ভুল করি। তবে মোট ভুলের পরিমাণ অনেক বেশি হয়ে যায়। আর এ সকল ভুলের ফলে সাওয়াব কমতে পারে। গোনাহ হতে পারে, এমনকি সালাত নষ্টও হতে পারে। এ সকল আহকামের অন্যতম হলো সালাতের মনোযোগ, একাগ্রতা ও বিনয়। সালাতের মূল উদ্দেশ্য ‘আল্লাহর যিকর’। আল্লাহ বলেছেন:

وَأَقِمِ الصَّلاةَ لِذِكْرِي
“আমার যিকর বা স্মরণের জন্য সালাত প্রতিষ্ঠা কর।”1সূরা তাহা: ১৪ আয়াত।

সালাতের মধ্যে কখন কোন্ কথা বলে আল্লাহর যিকর করতে হবে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন। মুমিনের কাজ হলো মনোযোগের সাথে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে এগুলি বলে যিকর করা। আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لا تَقْرَبُوا الصَّلاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা যা বল তা বুঝতে পারছ। এরূপ অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না।”2সূরা নিসা: ৪৩ আয়াত।

বড় পরিতাপের বিষয় যে,

আমরা অনেকেই নেশাগ্রস্তের মতই না বুঝে সালাত আদায় করি। পুরো সালাতে কি বলেছি কিছুই মনে করতে পারি না বা খেয়াল করি না।

সালাতের মধ্যে অমানোযোগী থাকা মুনাফিকদের অভ্যাস ও রীতি। আল্লাহ বলেন:
وَإِذَا قَامُوا إِلَى الصَّلاةِ قَامُوا كُسَالَى يُرَاءُونَ النَّاسَ وَلا يَذْكُرُونَ اللَّهَ إِلاَّ قَلِيلا
“আর মুনাফিকরা যখন সালাতে দাঁড়ায় তখন তারা আলসেমীর সাথে দাঁড়ায়। তারা মানুষদেরকে দেখায় এবং খুব কমই আল্লাহর যিকর করে।”3সূরা নিযা: ১৪২ আয়াত।

আমরা জানি,

আমরা যে অবস্থায় থাকি না কেন, যেভাবেই নামায আদায় করি না কেন, যে যিকির বা কিরাআতই পাঠ করি না কেন, নামাযের মধ্যে পঠিত দোয়া। যিকির বা কিরাআতের অর্থের দিকে মন দিয়ে অন্তরের আবেগ দিয়ে নামায আদায়ের চেষ্টা করতে পারি। মনোযোগ নষ্ট হলে আবারো মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে পারি।

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা নামাযের অন্যান্য প্রয়োজনীয়, অল্পপ্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে অতি সচেতন হলেও মনোযোগ, আবেগ ও ভক্তির বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখাই না। আরো দু:খজনক বিষয় হলো, অনেক ধার্মিক মুসলিম দ্রুত নামায আদায়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। ধীর ও শান্তভাবে পরিপূর্ণ আবেগ ও মনোযোগ সহকারে নামায আদায় করাই আল্লাহর নির্দেশ। আল্লাহ বলেন:

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاتِهِمْ خَاشِعُونَ
“মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সালাত আদায় করেন।”4সূরা মুমিনূন: ১-২ আয়াত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

ও সাহাবীগণ সর্বদা অত্যন্ত বিনয়ের সাাথে, ধীরে ধীরে সালাত আদায় করতেন। দ্রুত বা ব্যস্ততার সাথে সালাত আদায়ের কঠিন নিন্দা করা হয়েছে হাদীস শরীফে। সাহাবীগণ সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন সালাতের মধ্যে মনোযোগ রক্ষা করার জন্য। মনোযোগের অসুবিধা হলে তাঁরা অস্থির হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে প্রশ্ন করতেন। উসমান ইবনু আবীল আস (রা) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, শয়তান আমার ও আমার নামাযের মধ্যে বাধ সাধে এবং আমার কিরাআত এলোমেলো করে দেয়।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ঐ শয়তানের নাম : খিনযিব। যখন এরূপ অনুভব করবে তখন (আঊযু বিল্ল­াহি মিনাশ শাইতানির রাজীম) বলে তোমার বাম দিকে থুথু ফেলবে। তিনবার করবে। উসমান (রা.) বলেন : আমি এরূপ করলাম, ফলে আল্লাহ উক্ত শয়তানকে আমার থেকে দূর করে দিলেন।5সহীহ মুসলিম ৪/১৭২৮, নং ২২০৩।

সালাতের একটি বড় ফরয হলো সতর আবৃত করা।

পুরুষের জন্য নাভী থেকে হাটুর নিম্ন পর্যন্ত আবৃত রাখা ফরয। এর মধ্য থেকে কোনো অংশ অনাবৃত হলে বা টাইট পোশাকের কারণে অনাবৃতের মত হলে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। যদি অল্প সময়ের জন্যও তা অনাবৃত হয় তবুও সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। প্যান্ট-গেঞ্জি বা প্যান্ট-শার্ট পরে রুকুু করলে অনেকেরই কোমরের কাছে অনাবৃত হয়ে সালাত নষ্ট হয়ে যায়। মহিলাদের জন্য মাথার চুল সহ সমস্ত শরীর সালাতের মধ্যে আবৃত করে রাখা ফরয। শুধু মুখম-ল ও কব্জি পর্যন্ত দুই হাত বাদে পুরো শরীর আবৃত করতে হবে।

কেউ দেখুক অথবা না দেখুক, সালাতের মধ্যে যদি কোন মহিলার কান, চুল, মাথা, গলা, কাঁধ, পেট, পায়ের নলা ইত্যাদি অনাবৃত হয়ে যায় তাহলে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। সাধারণভাবে শাড়ী মুসলিম মহিলার জন্য অসুবিধাজনক পোষাক। ঢিলেঢালা পুরো হাতা সেলোয়ার-কামিজ বা ম্যাক্সি মুসলিম মহিলার জন্য উত্তম ও আদর্শ পোশাক। সর্বাবস্থায় সাধারণ পোশাকের উপর অতিরিক্ত বড় চাদর দিয়ে ভালভাবে নিজেকে আবৃত করে সালাত আদায় করতে হবে। মাথার চুল, কান গলা ইত্যাদি ভালভাবে আবৃত রাখার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সালাতে দাঁড়ানোর সময়

সামনে আড়াল বা সুতরা রেখে দাঁড়ানো হাদীসের নির্দেশ। দেয়াল, খুঁটি, পিলার বা যে কোন কিছুকে সামনে আড়াল হিসাবে রাখুন। না হলে অন্তত একহাত বা আধাহাত লম্বা গরু কোন লাঠি, কাঠ ইত্যাদি সামনে রাখলেও সুতরার সুন্নাত আদায় হবে। সুতরার যথাসম্ভব কাছে দাঁড়াতে হবে, যেন সাজদা করলে সুতরার নিকটে হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুতরার তিনহাতের মধ্যে দাঁড়াতেন। তিনি বলেন:

لاَ تُصَلِّ إِلاَّ إِلَى سُتْرَةٍ وَلاَ تَدَعْ أَحَداً يَمُرُّ بَيْنَ يَدَيْكَ فَإِنْ أَبَى فَلْتُقَاتِلْهُ فَإِنَّ مَعَهُ الْقَرِيْنَ
“আড়াল বা সুতরা ছাড়া সালাত আদায় করবে না, আর কাউকে তোমার সামনে দিয়ে (সুতরার ভিতর দিয়ে ) যেতে দিবে না। যদি সে জোর করে তাহলে তার সঙ্গে মারামারি করবে, কারণ তার সাথে শয়তান রয়েছে।”6ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ২/৯; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৬/১২৬, ১৩৩; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৩৮১। হাদীসটি সহীহ।

إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيُصَلِّ إِلَى سُتْرَةٍ وَلْيَدْنُ مِنْهَا
“যখন তোমাদের কেউ সালাত আদায় করবে সে যেন সুতরা বা আড়াল সামনে রেখে সালাত আদায় করে এবং সুতরার নিকটবর্তী হয়ে দাঁড়ায়।”7আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/১৮৫-১৮৬; নাসাঈ, আস-সুনান ২/৬২; আলবানী, সাহীহাহ ৩/৪৬০। হাদীসটি সহীহ।

জামাতে মুক্তাদির জন্য পৃথক সুতরা লাগে না। ইমামের সুতরাই যথেষ্ট। তবে জামাতে সালাতের আগে ও পরে সুন্নাত-নফল সালাত আদায়ের সময় বা বাড়িতে, মসজিদে, মাঠে যে কোনো স্থানে আমাদের এই সুন্নাতে নববী পালনের চেষ্টা করতে হবে। অনেকেই জামাতে সালাতের আগে ও পরে মসজিদের মধ্যে সুতরা ছাড়া সালাতে দাঁড়িয়ে অন্যান্য মুসল্লীর অসুবিধার সৃষ্টি করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই নির্দেশটি পালন করলে আমরা সাওয়াব পাব, গোনাহ থেকে বাঁচতে পারব ও অন্যদেরও বাঁচাতে পারব।

সালাতের মধ্যে ধীরে ধীরে

শান্তভাবে প্রত্যেক আয়াতে থেমে থেমে সূরা ফাতিহা ও অন্য সূরা পাঠ করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মু সালামাহকে (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কিরাআত পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন :

إِنَّ النَّبِيَّ رسول صلى الله عليه وسلم كَانَ كَانَ يُقَطِّعُ قِرَاءَتَهُ آيَةً آيَةً، (الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ)، ثُمَّ يَقِفُ، (ثُمَّ يَقُوْلُ) (الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ) ثُمَّ يَقِفُ (ثُمَّ يَقُوْلُ): مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ ….
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক আয়াতে থেমে থেকে কুরআন পাঠ কতেন। তিনি পড়তেন: ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’। এরপর থামতেন। এরপর বলতেন: ‘আর-রাহমানির রাহীম’। এরপর থামতেন। এরপর বলতেন: মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’। এরপর থামতেন। এভাবেই শেষ পর্যন্ত।8তিরমিযী, আস-সুনান ৫/১৮২, ১৮৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/৩৭; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/২৫৩। হাদীসটি সহীহ।

হাফসা (রা)-কে রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কিরাআত পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন: “তোমরা তাঁর মতো তিলাওয়াত করতে পারবে না।” প্রশ্নকারীরা তবুও একটু শোনাতে অনুরোধ করেন। তখন তিনি খুব ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করেন।9মুসনাদে আহমদ ৬/২৮৮, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/১০৮।)) আনাস (রা)-কে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিলাওয়াত পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন : (كانت مدا) “তাঁর কিরাআত ছিল টেনে টেনে।”((সহীহ বুখারী ৪/১৯২৫, নং ৪৭৫৯।

শান্তভাবে রুকুু ও সাজদা করা

সালাতের অন্যতম ফরয ও ওয়াজিব দায়িত্ব। শান্তভাবে রুকুতে যেতে থাকতে হবে। রুকুু থেকে উঠে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। শান্তভাবে সাজদায় যেয়ে থাকতে হবে। দুই সাজদার মাঝে পরিপূর্ণ শান্তভাবে বসতে হবে। তা না হলে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। একব্যক্তিকে তাড়াহুড়ো করে সালাত আদায় করতে দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন:

ارْجِعْ فَصَلِّ فَإِنَّكَ لَمْ تُصَلِّ
“তুমি যেয়ে আবার সালাত আদায় কর, তোমার সালাত হয় নি।”10বুখারী, আস-সহীহ ১/২৬৩; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৯৮।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে দেখেন যে, সে তাড়াহুড়ো করে রুকুু-সাজদা করছে। তিনি বলেন:
لَوْ مَاتَ عَلَى حَالِهِ هَذِهِ مَاتَ عَلَى غَيْرِ مِلَّةِ مُحَمَّدٍ رسول صلى الله عليه وسلم
“যদি এ লোকটি এইরূপ অবস্থায় মারা যায় তবে সে মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ধর্মের বাইরে মৃত্যু বরণ করবে।”11হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/১২১। হাদীসটির সনদ হাসান।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

বলেন: “মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট চোর ঐ ব্যক্তি যে নিজের সালাতে চুরি করে। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, কিভাবে মানুষ নিজের সালাত চুরি করে? তিনি বলেন,
لاَ يُتِمُّ رُكُوْعَهَا وَلاَ سُجُوْدَهَا
“সালাতের রুকুু ও সাজাদ পুর্ণ করে না।”12হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/১২০-১২১। হাদীসটি সহীহ।

রুকুুর মধ্যে পিঠ ধনুকের মত বাকা নয়, বরং তীরের মত সোজা রাখাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নির্দেশ ও কর্ম। তিনি সালাতের পদ্ধতি শিক্ষা দিয়ে বলেন:
وَإِذَا رَكَعْتَ فَضَعْ رَاحَتَيْكَ عَلَى رُكْبَتَيْكَ وَامْدُدْ ظَهْرَكَ
“যখন তুমি রুকুু করবে তখন তোমার দুই হাত দুই হাটুর উপর রাখবে এবং তোমার পিঠ সোজা লম্বা করে দেবে।13আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/২২৭; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৫/২০৬; আলবানী, সহীহুত তারগীব ২/১৭। হাদীসটি হাসান।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

যখন রুকুু করতেন তখন দুই হাত হাঁটুর উপর দৃঢ়ভাবে রাখতেন (বুখারী, মুসলিম), হাতের আঙ্গুল ফাঁক করে রাখতেন (হাকিম, তায়ালিসী), মনে হত তিনি হাঁটু আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। (বুখারী, আবূ দাউদ) তিনি তাঁর দুই বাহু ও কনুউকে দেহ থেকে সরিয়ে রাখতেন (তিরমিযী, ইবনু খুযাইমা)। এ অবস্থায় তিনি তাঁর পিঠ লম্বা করে দিতেন এবং পিঠ, কোমর ও মাথা এমনভাবে সোজা ও সমান্তরাল করতেন। যে, এ সময়ে তাঁর পিঠের উপর পানি ঢেলে দিলে তা গড়িয়ে পড়ত না। (বাইহাকী, তাবারানী, ইবনু মাজাহ) ইবনু আব্বাস (রা) বলেন:

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ رسول صلى الله عليه وسلم إِذاَ رَكَعَ اسْتَوَى فَلَوْ صُبَّ عَلَى ظَهْرِهِ الْمَاءُ لاسْتَقَرَّ
“যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুকুু করতেন তখন তাঁর পিঠ পুরোপুরি সোজা করে দিতেন। এমনকি যদি তার পিঠের উপর পানি ঢালা হতো তবে পানি থেমে থাকত।”14হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/১২৩। হাদীসটির সনদ সহীহ।

সাজদা হলো সালাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ইবাদত সাজদা। বান্দা সাজদার মাধ্যমে আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভ করে। কাজেই সে অনুভুতি নিয়েই সাজদা করতে হবে। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন:
أُمِرَ النَّبِيُّ رسول صلى الله عليه وسلم أَنْ يَسْجُدَ عَلَى سَبْعَةِ أَعْضَاءٍ وَلا يَكُفَّ شَعَرًا وَلا ثَوْبًا الْجَبْهَةِ وَالْيَدَيْنِ وَالرُّكْبَتَيْنِ وَالرِّجْلَيْنِ
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন। ৭টি অঙ্গের উপর সাজদা করার নির্দেশ দিয়েছেন: মুখম-ল, দুই হাত, দুই হাঁটু ও দুই পা। তিনি আরো নির্দেশ দিয়েছেন যে। মুসল্লী তার চুল বা কাপড় গোটাবে না।”15বুখারী, আস-সহীহ ১/২৮০।

মুমিন যতক্ষণ সাজদায় থাকবে ততক্ষণ এ সাতটি অঙ্গ মাটিতে লেগে থাকবে। মুখম-ল বলতে কপাল ও নাক উভয়কে বুঝানো হয়েছে। যতক্ষণ কপাল মাটিতে থাকবে ততক্ষণ নাকও মাটিতে থাকবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لاَ يُصِيْبُ أَنْفُهُ مِنَ الأَرْضِ مَا يُصِيْبُ الْجَبِيْنُ
“কপাল যেভাবে মাটিতে থাকতে ঠিক সেভাবে যার নাক মাটিতে না থাকবে তার সালাত হবে না।”16বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২/১০৪; আলবানী, সিফাতুস সালাত, পৃ. ১৪২। হাদীসটি সহীহ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম

তাঁর দুই হাত দুই কান বরাবর মাটিতে বা দুই কাঁধ বরাবর মাটিতে রাখতেন। তিনি হাতের আঙ্গুলগুলি মিলিয়ে কিবলামুখি করে রাখতেন। তিনি তাঁর দুই বাহু ও কনুই মাটি থেকে উপরে রাখতেন। কনুই দুটি দেহের বাইরে বের করে দূরে সরিয়ে রাখতেন। সাজদা অবস্থায় তাঁর হাত ও পেট এমনভাবে উচু ও ফাঁকা থাকত যে, কোনো মেশ শাবক ইচ্ছা করলে সেখান দিয়ে যাতায়াত করতে পারত। তিনি তাঁর দুই পায়ের আঙ্গুলগুলি কিবলামুখি করতেন। দুই পা খাড়া রেখে দুই পায়ের গোড়ালি একত্রে মিলিয়ে রাখতেন।

দুই সাজদার মাঝে ও তাশাহ্হুদে বসার সময় বাম পা বিছিয়ে দিতেন এবং ডান পা খাড়া রাখতেন। ডান পায়ের আঙুলগুলি কিবলামুখি করে রাখতেন। এভাবে তিনি আবেগের সাথে দীর্ঘ সময় সাজদায় থাকতেন। সাজদা রত অবস্থায় ও দুই সাজদার মাঝে বসা অবস্থায় পরিপূর্ণ শান্ত হতে ও তাড়াহুড়ো না করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। দুই সাজদার মাঝের বৈঠকে পরিপূর্ণ শান্তভাবে না বসলে তার সালাত হবে না বলে তিনি জানিয়েছেন।

জামাতে সালাতের অনেক আদব রয়েছে।

মুমিনের উচিত আযানের আগেই ওযূ করে মসজিদে যেয়ে সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। এইরূপ অপেক্ষা আল্লাহর নিকট অন্যতম জিহাদ ও অত্যন্ত বড় নেককর্ম। যদি জামাতে বেরোতে দেরি হয়, তবে ব্যস্ত ভাবে বা দৌঁড়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। প্রশান্ত মনে গাম্ভির্যের সাথে স্বাভাবিক গতিতে যেতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

إِذَا أُقِيمَتْ الصَّلاةُ فَلا تَأْتُوهَا تَسْعَوْنَ وَأْتُوهَا تَمْشُونَ عَلَيْكُمْ السَّكِينَةُ (وَالوَقَارُ) فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوا وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوا … فَإنَّ أَحَدَكُمْ إَذاَ كَانَ يَعْمِدُ إِلَى الصَّلاَةِ فَهُوَ فِيْ صَلاَةٍ
“যদি সালাতের ইকামত হয়ে যায় তবে তাড়াহুড়ো করে মসজিদে যাবে না। শান্তভাবে এবং গাম্ভির্যের সাথে যাবে। যতটুকু নামায ইমামের সাথে পাবে তা আদায় করবে, বাকিটা পরে নিজে আদায় করবে। কারণ তোমাদের কেউ যখন সালাতের উদ্দেশ্যে বের হয় তখন সে সালাত আদায়েই রত থাকে।17বুখারী, আস-সহীহ ১/৩০৮; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪২০-৪২১।

অন্য হাদীসে তিনি বলেন:
مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ وُضُوءَهُ ثُمَّ رَاحَ فَوَجَدَ النَّاسَ قَدْ صَلَّوْا أَعْطَاهُ اللَّهُ جَلَّ وَعَزَّ مِثْلَ أَجْرِ مَنْ صَلاَّهَا وَحَضَرَهَا لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أَجْرِهِمْ شَيْئًا

“যদি কেউ সুন্দর ও পূর্ণরূপে ওযূ করে (মসজিদে) গমন করে, এবং তথায় দেখে যে, মানুষেরা সালাত আদায় করে ফেলেছে, তবে তাকে আল্লাহ জামাতে উপস্থিত হয়ে যারা সালাত আদায় করেছে তাদের সাওয়াব প্রদান করবেন, কিন্তু এতে মুসল্লীদের সাওয়াব কমবে না।18আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/১৫৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৩২৭; আলবানী, সহীহহুত তারগীব ১/৯৬-৯৮। হাদীসটি সহীহ।

প্রথম কাতারে সালাত

আদায়ের জন্য রয়েছে বিশেষ সাওয়াব ও মর্যাদা। ইরবাদ (রা) বলেন:
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ رسول صلى الله عليه وسلم إِذاَ رَكَعَ اسْتَوَى فَلَوْ صُبَّ عَلَى ظَهْرِهِ الْمَاءُ لاسْتَقَرَّ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম কাতারের জন্য তিনবার করে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন এবং দ্বিতীয় কাতারের জন্য একবার।”19ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৩১৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৩৩৪, ৩৩৭; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১১৮। হাদীসটি সহীহ। অন্য হাদীসে আবূ উমামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى الصَّفِّ الأَوَّلِ
“প্রথম কাতারের জন্য আল্লাহ রহমত প্রদান করেন এবং ফিরিশতাগণ দোয়া করেন।”20নাসাঈ, আস-সুনান ২/১৩; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৩১৮; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১১৮। হাদীসটি সহীহ।

সামনের কাতারে স্থান রেখে পিছনের কাতারে দাঁড়ালে মুসল্লীকে শাস্তি পেতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لا يَزَالُ قَوْمٌ يَتَأَخَّرُونَ عَنْ الصَّفِّ الأَوَّلِ حَتَّى يُؤَخِّرَهُمْ اللَّهُ فِي النَّارِ
“কিছু মানুষ নিয়মিত কাতারে পিছিয়ে পড়তে থাকবে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামের মধ্যে পিছিয়ে দিবেন।”21আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/১৮১; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১২৩।

জামাতে সালাতের কাতার সোজা করা,

কাতারের মাঝের ফাঁক পূরণ করা, গায়ে গা লাগিয়ে ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
سَوُّوا صُفُوفَكُمْ وَحَاذُوا بَيْنَ مَنَاكِبِكُمْ وَلِينُوا فِي أَيْدِي إِخْوَانِكُمْ (وَسِّطُوا الإِمَامَ) وَسُدُّوا الْخَلَلَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَدْخُلُ بَيْنَكُمْ بِمَنْزِلَةِ الْحَذَفِ، وَمَنْ وَصَلَ صَفًّا وَصَلَهُ اللَّهُ وَمَنْ قَطَعَ صَفًّا قَطَعَهُ اللَّهُ

“তোমরা তোমাদের কাতারগুলি সোজা কর, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াও, তোমাদের ভাইদের হাতে নরম হয়ে যাও, ইমামকে মধ্যস্থানে রেখে কাতার দাও এবং কাতারের মাঝের ফাঁক পূরণ কর। কারণ শয়তান মেশ শাবকের ন্যায় তোমাদের মধ্যে প্রবেশ করে। যে ব্যক্তি কাতার মিলিয়ে দেবে বা সংযুক্ত করবে আল্লাহ তাকে মিলিয়ে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কাতার বিচ্ছিন্ন করবে বা ভাঙ্গবে আল্লাহ তাকে ভাঙ্গবেন।22আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/১৭৮, ১৮২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৯১, ৯৩; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/১১৮-১১৯। হাদীসটি সহীহ।

আনাস (রা) বলেন,

“সালাতের ইকামত হয়ে যাওয়ার পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের দিকে ফিরে বলেন
أَقِيمُوا صُفُوفَكُمْ فَإِنِّي أَرَاكُمْ مِنْ وَرَاءِ ظَهْرِي، وَكَانَ أَحَدُنَا يُلْزِقُ مَنْكِبَهُ بِمَنْكِبِ صَاحِبِهِ وَقَدَمَهُ بِقَدَمِهِ وَرُكْبَتَهُ بِرُكْبَةِ صَاحِبِهِ وَكَعْبَهُ بِكَعْبِهِ
“তোমরা তোমাদের কাতারগুলি সোজা কর; কারণ আমি আমার পিছন দিকেও তোমাদেরকে দেখতে পাই। তখন আমরা একে অপরের কাঁধের সাথে কাঁধ, পায়ের সাথে পা, হাঁটুর সাথে হাঁটু ও টাখনুর সাথে টাখনু লাগিয়ে দাঁড়াতাম।”23বুখারী, আস-সহীহ ১/২৫৪; আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/১৭৮।

وَاللَّهِ لَتُقِيمُنَّ صُفُوفَكُمْ أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللَّهُ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ
“আল্লাহর কসম, তোমরা কাতারগুলি সোজা কর। নইলে আল্লাহ তোমাদের অন্তরের মধ্যে বৈপরীত্য ও বিরোধ সৃষ্টি করে দিবেন।24আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/১৭৮; সহীহুত তারগীব ১/১২৩। হাদীসটি সহীহ। মহান আল্লাহ সবাইকে সঠিক ভাবে পরিপূর্ণ সুন্নাত মোতাবেক সালাত আদায়ের তাওফীক দিন। আমীন।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহিমাহুল্লাহ, বই: খুতবাতুল ইসলাম, পৃ. ১৫১-১৫৬।

সালাতের সংক্ষিপ্ত বিধান ও নিয়ম, সালাত: গুরুত্ব, ফযীলত, ঈদুল ফিতর, আমাদের আমল, আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ (৫), হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশ ও সাহাবীগণের, সালাতের গুরুত্ব ও ফযীলত,