আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

প্রশ্নোত্তর

ক্যাটাগরি

প্রশ্নোত্তর 7

ঈমান

প্রকাশকাল: 5 ফেব্রু. 2006

প্রশ্ন

আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। মুহতারাম, যে ব্যক্তি আত্যহত্যা করে মৃত্যুবরণ করে তার সাথে আমাদের মুয়ামালা বা আচরণ কেমন হবে দয়া করে কুরআন হাদীসের আলোকে জানাবেন।

উত্তর

ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। প্রশ্নটি করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। নিম্নে উক্ত বিষয়ে আলোচনা করা হল। আশা করি আপনি তাতে আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন ইনশাল্লাহ। আত্যহত্যা করার হুকুমঃ আত্যহত্যা নিঃসন্দেহে কবীরা গুনাহ এবং মূলত এটি একটি কুফরী গোনাহ যার শাস্তি অনন্তকাল জাহান্নাম। একজন মানুষ আত্যহত্যা করার কারণ কয়েকটি হতে পারে। প্রথমতঃব্যক্তি যখন আত্যহত্যা করে তখন সে সাধারনত আলাহর রহমত হতে নিরাশ হয়েই এই জঘন্য পাপকাজে লিপ্ত হয়। কারণ কোনোরূপ আশা থাকলে কেউ আত্মহত্যা করেন না। যখন কেউ চিন্তা করে যে, আমার জীবনের উন্নতির, কল্যাণের বা ভালর কোনো আশা আর নেই তখনই সে আত্মহত্যা করে। আর এ হলো মহান আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কুফুরী। কোরআনে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হতে বারবার নিষেধ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: وَلَا تَيْأَسُوا مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ অর্থঃ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না । কেবল মাত্র কাফের সম্প্রদায়ই আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়। সূরা ইউসুফ,আয়াত-৮৭। দ্বিতীয়তঃ সে বৈধ মনে করে আত্যহত্যা করবে। এক্ষেত্রেও তার এ কাজ কোরআন হাদীসের দৃষ্টিতে কুফুরী হিসাবে বিবেচিত হবে। কোরআন ও হাদীসে হালালকে হারাম মনে করা এবং হারামকে হালাল বা বৈধ মনে করাকে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং এটাকে কুফুরী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। তৃতীয়তঃ উক্তব্যক্তি নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে বা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এই ভয়াবহ অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। উপরের দুটি অবস্থায় আত্মহত্যাকারীর ক্ষমার কোনোই আশা থাকে না। তৃতীয় পর্যায়ের লোকটির ক্ষমার সামান্য একটু সম্ভাবনা থাকে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির বিষয়ে আমরা জানিনা যে, সে কোন অবস্থাতে আত্যহত্যার পথ বেছে নিল। সে যে অবস্থাতে বা যে কারনেই আত্যহত্যা করুক নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং কবীরাহ গুনাহ। রাসূল সা. আত্যহত্যাকারীর ব্যাপারে চিরদিন জাহান্নামে থাকার মত ভয়াবহ শাস্তির কথাও হাদীস শরীফে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। হযরত আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণীত এক হাদীসে রাসূল সা. বলেন: مَن تردى من جبل فقتل نفسه فهو في نار جهنم يتردى فيه خالداً مخلداً فيها أبداً ، ومَن تحسَّى سمّاً فقتل نفسه فسمُّه في يده يتحساه في نار جهنم خالداً مخلداً فيها أبداً ، ومَن قتل نفسه بحديدة فحديدته في يده يجأ بها في بطنه في نار جهنم خالداً مخلداً فيها أبداً অর্থঃ যে ব্যক্তি আত্যহত্যার উদ্দেশ্যে পাহাঢ় থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামের আগুনে চিরোদিন পড়তে থাকবে। আর যে বিষ পান করে আত্যহত্যা করবে বিষ তার হাতে থাকবে এবং জাহান্নামের আগুনে চিরদিন সে তা পান করতে থাকবে। আর যে লোহার টুকরা দিয়ে আত্যহত্যা করবে উক্ত লোহার টুকরা তার হাতে থাকবে এবং জাহান্নামের আগুনে সে চিরদিন তা পেটের ভিতর ঢুকাতে থাকবে। বুখারী,আস সহীহ, বাব, শুরবিস সাম্মি, হাদীস নং ৫৭৭৮। সাবেত ইবনে দহহাক রাঃ থেকে বর্ণীত একটি হাদীসে তিনি বলেন: مَن قتل نفسه بشيء في الدنيا عذب به يوم القيامة অর্থঃ যে ব্যক্তি দুনিয়ার কোন জিনিস দ্বারা আত্যহত্যা করল কিয়ামতের দিন তাকে তা দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে। বুখারী, আস সাহীহ, হাদীস নং ৬৬৪৭। মুসলিম, আস সহীহ, হাদীস নং ৩১৬। জুনদুব ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ এর সূত্রে বর্ণীত একটি হাদীসে আছে: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : كان فيمن كان قبلكم رجل به جرح فجزع فأخذ سكيناً فحز بها يده فما رقأ الدم حتى مات . قال الله تعالى : بادرني عبدي بنفسه حرمت عليه الجنة অর্থঃ তোমাদের পূর্বে একব্যক্তির শরীরে যখম ছিলো সে ধৈর্যহারা হয়ে পড়ল একটি ছুরি দ্বারা নিজের হাত কেটে ফেলল এবং রক্ত বন্ধ হলনা। অবশেষে লোকটি মারা গেল। আল্লাহ তায়ালা বললেন: আমার বান্দা তাড়াহুড়া করেছে তার জন্য জান্নাত হারাম। বুখারী, আস সহীহ, হাদীস নং ৩৪৬৩। এ সকল হাদীস প্রমাণ করে যে, আত্মহত্যাকারীর জন্য মুক্তির আশা নেই। সে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। রাসূল সা. আত্যহত্যা কারীর জানাযার নামাজে শরীক হতে অস্বীকার করেন। জাবের ইবনে সামুরা রাঃ থেকে বর্ণীত তিনি বলেন: أُتي النبي صلى الله عليه وسلم برجل قتل نفسه بمَشاقص فلم يصل عليه অর্থঃ তীর দ্বারা আত্যহত্যা করেছে এমন এক ব্যক্তিকে রাসূল সাঃ এর কাছে আনা হল ক্ন্তিু তিনি তার জানাযার নামাজ পড়লেন না। বুখারী আস সহীহ, বাব,তারকুস সালাতি আলা ক্বাতিলি নাফসিহী, হাদীস নং ২৩০৯। তার জানাযার নামাজঃ ইমাম নববী রহঃ বলেন: উপরোক্ত হাদীসের আলোকে উমার ইবনে আব্দুল আজীজ এবং আওজায়ী রহঃ বলেন আত্যহত্যা কারীর জানাজার নামাজ পড়া যাবে না। পক্ষান্তরে হাসান বসরী, ইমাম নাখয়ী, ইমাম মালেক, ইমাম আবু হানীফা এবং ইমাম শাফী রহঃ সহ অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে আত্যহত্যা কারীর জানাযার নামাজ পড়তে হবে। কেননা রাসূল সা. নিজে এমন ব্যক্তির জানাযার নামাজে শরীক না হলেও সাহাবয়ে কেরামকে এব্যাপারে অনুমতি প্রদান করেছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম তার জানাযার নামাজ পড়েছেন। যেমন তিনি ইসলামের শুরুর যুগে কেউ ঋনি হয়ে মারা গেলে (ঋন আদায়ে অবহেলা করার ব্যাপারে সতর্ক করার জন্য) তার জানাযায় শরীক হতেন না এবং সাহাবায়ে কেরামকে তার জানাযায় শরীক হতে আদেশ করতেন। তিনি বলতেন: صَلُّوا عَلَى صَاحِبكُمْ (তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযার নামাজ পড়)। বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ২২৮৯। কাজী ইয়াজ বলেন, সকল উলামায়ে কেরামের মত হল, প্রত্যেক মুসলমানের জানাযার নামাজ পড়া হবে। ব্যাক্তি হোক হদের শাস্তি প্রাপ্ত, রজমকৃত, আত্যহত্যাকারী কিংবা অবৈধ সন্তান। (শরহুন নববী আলা মুসলিম, ৩/৪০৫। কিতাব, আলজানাইয, বাব, তারকুস সালাত আলাল কাতিলি নাফসিহি। (শামিলা) এ হিসাবে উলামায়ে কেরামের মতে সুন্নাত হল, আলেম বা শ্রেষ্ঠব্যাক্তিরা আত্যহত্যাকারীর জানাযায শরীক হবেনা বরং সাধারন মানুষদের মাধ্যমে তার জানাযার নামাজ সম্পূর্ণ করা হবে। চিরোদিন জাহান্নামে থাকাঃ উপরের হাদীসগুলোতে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ …. বারবার বলেছেন যে, আত্মহত্যাকারী অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। এর বিপরীতে মূলত কোনো হাদীস নেই। তবে দু-একটি হাীসের প্রাসঙ্গিক নিরর্শনা ও ইসলামের মূলনীতির আলোকে আলিমগণ বলেছেন যে, যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করবে সে চিরদিন জাহান্নামে থাকবে না যদিও সে কবীরা গুনাহে লিপ্ত হয়। উপরে উাল্লেখিত হাদীসগুলোতে আত্যহত্যাকারীর চিরদিন জাহান্নামে থাকার যে কথা এসেছে উলামায়ে কেরাম এ হাদীসের ব্যাক্ষায় বলেন, যে ব্যক্তি বৈধমনে করে আত্যহত্যা করবে সে তা বৈধ মনে করার কারণে কাফের হয়ে যাবে। অথবা যদি কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে আত্মহত্যা করে তবে তাকে অনন্তকাল জাহান্নামে থাকতে হবে। যদি সে এটাকে বৈধ মনে না করে বা আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ মহাপাপ করে ফেলে তবে তার মুক্তির আশা করা যায়। আল্লাহর ইচ্ছায় সে একদিন জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে ইনশাল্লাহ। কারন কোরআনে মহান দয়াময় আল্লাহ একমাত্র শিরক ছাড়া অন্য সকল গুনাহ মাফ করে দেয়ার ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেন: إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ (অর্থঃ) নিশ্চই আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার বিষয়কে ক্ষমা করবেন না। আর তিনি অন্যান্য গুনাহের ব্যাপারে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন। সূরা নিসা-১১৬। আর আত্মহত্যা শিরক বা কুফর পর্ায়ে না গেলে আমার আশা করতে দয়াময় আল্লাহ তাকে একদিন মাফ করে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়াঃ হা তাদের জন্য দোয়া করা যেতে পারে। একটি হাদীসে এসেছে রাসূল সাঃ এমন ব্যাক্তির জন্য দোয়া করেছেন। হযরত তুফাইল ইবরে আমর দাউসি রাঃ থেকে বর্ণীত একটি হাদীসে এসেছে: : فلما هاجر النبي صلى الله عليه وسلم إلى المدينة هاجر إليه الطفيل بن عمرو وهاجر معه رجل من قومه فاجتووا المدينة فمرض فجزع فأخذ مشاقص له فقطع بها براجمه فشخبت يداه حتى مات، فرآه الطفيل بن عمرو في منامه فرآه وهيئته حسنة، ورآه مغطيا يديه! فقال له: ما صنع بك ربك؟ فقال: غفر لي بهجرتي إلى نبيه صلى الله عليه وسلم. فقال: ما لي أراك مغطيا يديك؟ قال: قيل لي: لن نصلح منك ما أفسدت. فقصها الطفيل على رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: اللهم وليديه فاغفر… অর্থঃ যখন নবী সাঃ মদীনায় হিজরত করলেন তুফাইল ইবরে আমর রাঃ রাসূল সাঃ এর কাছে হিজরত করলেন এবং তার গোত্রের একটি লোক তার সাথে হিজরত করল। যখন তারা মদীনায় পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হল তখন সে কয়েকটি তির নিয়ে তা দ্বারা আঙ্গুলের গিরা কেটে ফেলল এবং দুইহাতা দিয়ে বিরামহীনভাবে রক্ত ঝরতে লাগল এবং অবশেষে সে মৃত্যুবরণ করল। হযরত তুফাইল রাঃ স্বপ্নে তাকে ভাল অবস্থায় দেখতে পেলেন। তবে তার দুই হাত ঢাকা ছিলো। তখন তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমার প্রতিপালক তোমার সাথে কেমন আচরণ করেছেন। উত্তরে তিনি বললেন রাসূল সাঃ এর কাছে হিজরত করার কারণে আমাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে। তখন তুফাইল রাঃ তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল তোমার হাত ঢাকা দেখছি কেন? তিনি বললেন, আমাকে বলা হল, তোমার যে অংশ তুমি নষ্ট করেছে তা আমি ঠিক করে দিবনা। রাসূল সাঃ এর কাছে এঘটনা শোনানের পর রাসূল সাঃ আল্লাহর কাছে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে বললেন, হে আল্লাহ তুমি তার দুই হাতকে মাফ করে দাও। মুসলিম, আস সহীহ খন্ড ১,পৃষ্ঠা ৭৬ হাদীস নং ৩২৬। মোটকথা, আত্যহত্যা অত্যন্ত মারত্নক একটি কবীরাহ গুনাহ। এব্যাপারে রাসূল সা. এর পক্ষথেকে চিরদিন জাহান্নামে থাকার মত কঠোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি কাজটি কুফুরী হিসাবে গণ্য হওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যদি আল্লাহ দয়া করে তাকে অন্য কোন ভাল কাজের বিনিময়ে জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করেন তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। তবে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা একেবারেই কম। কিন্তু কেউ যদি একাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে তার জন্য দোয়া করাতে কোন দোষ নেই। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে মাফ করলেও করতে পারেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উত্তম মৃত্যু দান করুন। আমীন।