আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

প্রশ্নোত্তর

ক্যাটাগরি

প্রশ্নোত্তর 51

বিবিধ

প্রকাশকাল: 21 মার্চ 2006

প্রশ্ন

আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। মুহতারাম, হজ্জের গুরুত্ব, ফযীলত, করণীয় এবং বর্জনীয় বিষয়গুলো জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।

উত্তর

ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ । প্রশ্নে উল্লেখিত বিষয়গুলি নিম্নে সংক্ষেপে দেওয়া হল। হজ্জের গুরুত্বঃ হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। নামায, রোযা, যাকাত ইত্যাদির মত হজ্জও একটি ফরয আঈন ইবাদত। কেউ হজ্জের আবশ্যকীয়তা বা ফরয হওয়া অস্বীকার করলে তাকে অমুসলিম বলে গণ্য করা হবে। আর যদি কোন সক্ষম ব্যক্তি হজ্জ ফরয মানা সত্বেও তা আদায় না করেন তাহলে তিনি কঠিন পাপের মধ্যে নিপতিত হবেন এবং ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। আল্লাহ বলেছেন: وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلا বাইতুল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির উপর আল্লাহর জন্য হজ্জ আদায় করা ফরয। (সূরা আলে ইমরান,আয়াত ৯৭) নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনীয় খরচ মিটিয়ে মক্কা শরীফে যাওয়ার খরচ বহনের ক্ষমতা হলেই মুসলিম পুরষ ও মহিলার জন্য জীবনে একবার হজ্জ আদায় করা ফরয হয়ে যায়। এমনকি কারো যদি নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি থাকে, যে জমির ফসল না হলেও তার বৎসর চলে যায়, অথবা অতিরিক্ত বাড়ি থাকে যে বাড়ি তার ব্যবহার করতে হয় না, বরং ভাড়া দেওয়া, অথচ যে বাড়ির ভাড়া না হলেও তার বছর চলে যায় তবে সেই জমি বা বাড়ি বিক্রয় করে হজ্জে যাওয়া ফরয হবে বলে অনেক ফকীহ সুস্পষ্টত উল্লেখ করেছেন। আর হজ্জ ফরয হওয়ার পরেও হজ্জ না করে মৃত্যুবরণ করাকে কোনো কোনো হাদীসে ইহূদী-খৃস্টান হয়ে মরা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহ বলেন: إِنَّ عَبْداً صَحَّحْتُ لَهُ جِسْمَهُ وَوَسَّعْتُ عَلَيْهِ فِيْ الْمَعِيْشَةِ تَمْضِيْ عَلَيْهِ خَمْسَةُ أَعْوَامٍ لاَ يَفِدُ إِلَيَّ لَمَحْرُوْمٌ যে বান্দার শরীর আমি সুস্থ রেখেছি এবং তার জীবনযাত্রায় সচ্ছলতা দান করেছি, এভাবে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সে আমার ঘরে আগমন করল না সে সুনিশ্চিত বঞ্চিত ও হতভাগা। (সহী ইবনে হিব্বান, তাহকীক, শুয়াইব আরনাউত, হাদীস নং ৩৭০৩) হাদীসটিকে শাইখ আলবানী সহী বলেছেন,সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস নং ১১৬৬। যখন যে বয়সেই তা ফরয হোক তা যতশীঘ্র সম্ভব আদায় করতে হবে। প্রকৃত সত্য কথা হলো, হজ্জ যৌবনকাল ও শক্তির সময়ের ইবাদত। কোনো বৃদ্ধ মানুষ সঠিকভাবে হজ্জ আদায় করতে পারেন না। সম্পূর্ণ বৈরি আবহাওয়ায়, লক্ষলক্ষ মানুষের ভিড়ের মধ্যে মাইলের পর মাইল হাঁটা, দৌঁড়ানো, কাঁকর নিক্ষেপ করা ইত্যাদি ইবাদতের সুন্নাত পর্যায় রক্ষা করা তো দূরের কথা ওয়াজিব পর্যায় ঠিক রাখাও বৃদ্ধ ব্যক্তির জন্য কষ্টকর। এজন্য যুবক বয়সের হজ্জই প্রকৃত ও পরিপূর্ণ হজ্জ হতে পারে। হজ্জের ফযীলতঃ কুরআন ও হাদীসে অগণিত স্থানে বারংবার হজ্জের গুরত্ব ও ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিবেদিতভাবে, সর্বপ্রকার পাপ, অন্যায় ও অশ্লীলতা মুক্ত হয়ে হজ্জ আদায় করলো, সে নবজাতক শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরল। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৫২১) الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلا الْجَنَّةُ একবার উমরা আদায়ের পরে দ্বিতীয়বার যখন উমরা আদায় করা হয়, তখন দুই উমরার মধ্যবর্তী গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। আর পুণ্যময়-পরোপকারময় হজ্জের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত। (বুখারী,হাদীস নং ১৭৭৩,মুসলীম হাদীস নং ৩৩৫৫) تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ وَالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَلَيْسَ لِلْحَجَّةِ الْمَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ তোমরা বারবার হজ্জ ও উমরা আদায় কর, কারণ কর্মকারের ও স্বর্ণকারের আগুন যেমন লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা মুছে ফেলে তেমনিভাবে এ দুই ইবাদত দারিদ্র্য ও পাপ মুছে ফেলে। আর পুণ্যময়-পরোপকারময় হজ্জের একমাত্র পুরস্কার হলো জান্নাত। হাদীসটি সহীহ (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৮১০) হজ্জের মাধ্যমে গোনাহ মাফ ছাড়াও রয়েছে অগণিত পুরস্কার ও সাওয়াব। হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, হাজী যখন বাড়ি থেকে বের হন তখন থেকে তার প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ তাকে অগণিত নেকী প্রদান করেন, তার ব্যয়িত প্রতিটি টাকার বহুগুণ এমনকি ৭০০ গুণ সাওয়াব প্রদান করেন বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, আল্লাহ হাজীর দুআ ও ইসতিগফার কবুল করেন এবং হাজী সাহেব যাদের জন্য দুআ করেন তাদেরকেও আল্লাহ ক্ষমা করেন। হজ্জের সবচেয়ে বরকতময় দিন হলো আরাফাতের দিন। বিভিন্ন হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, আরাফাতের দিনে আল্লাহ যত মানুষকে ক্ষমা করেন অন্য কোনো দিনে অত মানুষকে ক্ষমা করেন না। আরাফাতের দিনে সমবেত হাজীদের জীবনের পাপগুলি তিনি ক্ষমা করেন। হাদীসটিকে শাইখ আলবানী হাসান লিগাইরিহী বলেছেন। (সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হাদীস নং ১১১২) এছাড়াও হজ্জের মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিকতা প্রশস্ততা লাভ করে, বৃহৎ মানব গোষ্ঠীর সকল জাতি ও বর্ণের পাশাপাশি সমাবেশ ঘটে। পরস্পরে বর্ণগত, ভাষাগত, দেশগত, জাতিগত সকল হিংসা, বিদ্বেষ ও রেষারেষি হজ্জপালনকারীর হৃদয় থেকে মুছে যায়। সে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে বিশ্ব কত বড় আর সকল মুসলিম কত আপন। মুসলিম জাতির মধ্যে সাম্য, ঐক্য ও সহযোগিতার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। হজ্জে করণীয় এবং বর্জণীয় বিষয় সমূহঃ নির্ধারিত স্থান থেকে ইহরাম করে মক্কায় যেয়ে জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে মক্কার প্রান্তরে আরাফাত নামক স্থানে অবস্থান করা ও এর আগে ও পরে কাবাঘর তাওয়াফ করা, সাফা-মারওয়া সাঈ করা, মিনায় অবস্থান করা, মিনার জামারাতগুলিতে কাঁকর নিক্ষেপ করা, হজ্জের কুরবানী বা হাদী জবাই করা, মাথা মুন্ডন করা, এ সকল কর্মের মধ্যে আল্লাহর যিকির করা, দোয়া করা ইত্যাদি হলো হজ্জের কার্যসমূহ। মূলত আরাফাতের দিন দুপুর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের মাঠে অবস্থান করে আল্লাহর যিকর ও দুআয় কাটানোই মূলত হজ্জ। যারা হজ্জে যাচ্ছেন তারা এ বিষয়ে খেয়াল রাখবেন। ফ্রী খাবার জোগাড় করতে, হাজীদের সাথে গল্প করতে বা খাওয়া দাওয়ার পিছনে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। যথাসাধ্য একাকী হয়ে জীবনের সকল পাপ স্মরণ করে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে পাপী মনে করে আল্লাহর কাছে দুআ ও ইসতিগফার করুন। ক্লান্তি লাগলে আল্লাহর যিকর করুন। রাসূলল্লাহ (সাঃ) বলেন: خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِي لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ সর্বশ্রেষ্ট দুআ হলো আরাফাতের দিনের দুআ। আর আমি এবং আমার পূর্বের নবীগণ সর্বশ্রেষ্ঠ যে কথাটি বলেছি তা হলো: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুআ আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর। আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই, এবং প্রশংসা তাঁরই এবং তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। হাদীসটি হাসান(সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৮৫) অধিকাংশ সময় হাজি সাহেব কিছু ইবাদত বন্দেগি, তাওয়াফ, সায়ী, দোয়া-মুনাজাত করেন। এরপর মানবীয় প্রকৃতি অনুসারে সাথীদের সাথে গল্পগুজব ও কথাবার্তায় রত হয়ে পড়েন। আর গল্প ও কথাবার্তার অর্থই হলো অকারণ বাজে কথায় সময় নষ্ট করা অথবা অনুপস্থিত কোনো মানুষের আলোচনা-সমালোচনা করে গীবত ও অপবাদের মত ভয়ঙ্কর পাপে লিপ্ত হওয়া। গল্প-গুজবের মধ্যে এ দুটি ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই। কেউবা বাজারে ঘুরাঘুরি করে সময় নষ্ট করেন অথবা পাপময় দৃশ্য দেখে পাপ কামায় করেন। এস্ বিষয়, বিশেষ করে গীবত ও পরচর্চা করা বা শোনা, টেলিভিশনে বা বাস্তবে অসুন্দর, তাকওয়াবিহীন বা আপত্তিকর দৃশ্য দেখা বা গল্প করা বা আল্লাহর ভয় ও যিক্র মন থেকে সরিয়ে দেয় এমন গল্পগুজব থেকে যথাসাধ্য আত্মরক্ষা করুন। হজ্জের আহকামগুলি সুন্দরভাবে জেনে নেবেন। বিশেষ করে সুন্নাত জানার ও মানার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করবেন। অমুক কাজ জায়েয, ভাল ইত্যাদি বিষয় দেখবেন না। বরং দেখবেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগণ কিভাবে কোন্ কাজটি করেছেন। তাঁরা যে কর্ম যেভাবে করেছেন হুবহু সেভাবে তা পালন করুন। তারা যা করেন নি তা বর্জন করুন। এভাবে হুবহু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর তরীকা অনুসারে ইবাদত পালন করতে পারা সৌভাগ্যের লক্ষণ। এতেই রয়েছে কবুলিয়্যাতের নিশ্চয়তা। বিশেষত মদীনা শরীফে ইবাদত-বন্দেগী, যিয়ারাত, দুআ ইত্যাদি সকল বিষয়ে অবশ্যই হুবহু সুন্নাতের মধ্যে থাকবেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য ইমাম সংকলিত হাদীসে রাসূলুল্লহ (সাঃ) বলেন: الْمَدِينَةُ حَرَمٌ مَا بَيْنَ عَائِرٍ إِلَى كَذَا مَنْ أَحْدَثَ فِيهَا فِيهَا حَدَثًا أَوْ آوَى مُحْدِثًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلا عَدْلٌ আইর থেকে অমুকস্থান পর্যন্ত মদীনার সমস্ত এলাকা মহাসম্মানিত হারাম বা পবিত্রস্থান। এ স্থানের মধ্যে যদি কেউ নব-উদ্ভাবিত কোনো কর্ম করে, অথবা কেনো নব-উদ্ভাবককে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তাহলে তার উপর আল্লাহর লানত, ফিরিশতাগণের লানত এবং সকল মানুষের লানত। তার থেকে তাওবা, কাফ্ফারা বা ফরয-নফল কোনো ইবাদতই কবুল করা হবে না। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৩৬) বড় ভয়ঙ্কর কথা। এত কষ্ট করে সাওয়াব অর্জনের জন্য সেই পবিত্রভূমিতে যেয়ে অভিশাপ অর্জন করে আসা! আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, হাজীরা মদীনায় গেলেই নব-উদ্ভাবিত কর্ম বেশি করেন। মসজিদে নববীতে, রাওযা শরীফে, বাকী গোরস্থানে, উহদের শহীদদের গোরস্থানে, খন্দকের মসজিদগুলিতে, কুবা ও অন্যান্য মসজিদে ও অন্যান্য স্থানে যিয়ারত, সালাত, দুআ ইত্যাদি ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে হাজীগণ আবেগ ও অজ্ঞতার সংমিশ্রণে অনেকভাবে সুন্নাতের ব্যতিক্রম নব-উদ্ভাবিত পদ্ধতি অনুসরণ করেন। সাবধান হোন! যিয়ারতের সময় রাসূলুল্লাহ ৎ কি বলতেন, কিভাবে দাঁড়াতেন, কি করতেন তা সহীহ হাদীসের আলোকে জেনে নিন। কুবা, খন্দক, কিবলাতাইন ও অন্যান্য স্থানে গমন ও সালাত আদায়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীগণের হুবহু পদ্ধতি সহীহ হাদীসের আলোকে জেনে নিন। তাঁরা যা করেন নি তা বিষবৎ পরিত্যাগ করুন। সাওয়াব কামাতে গিয়ে অভিশাপ ও ধ্বংস কামাই করবেন না। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে হজ্জম পালন করার তাওফীক দান করুন । হজ্জের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়াদির বিস্তারিত আলোচনা এ পরিসরে সম্ভব নয়। তবে অধিকাংশ হাজী হজ্জের নিয়মকানুন মেনে চললেও হজ্জ বিষয়ক মূল নির্দেশনার বিষয়ে সচেতন হন না। মহান আল্লাহ হজ্জ প্রসঙ্গে বলেছেন: الْحَجُّ أَشْهُرٌ مَعْلُومَاتٌ فَمَنْ فَرَضَ فِيهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ এখানে মহান আল্লাহ হজ্জের সময় বিশেষ করে তিনটি বিষয় বর্জন করতে নির্দেশ দিলেন: (১) অশালীনতা, (২) পাপকর্ম ও (৩) ঝগড়া-বিতর্ক। অধিকাংশ হাজীই এ তিন প্রকারের পাপে লিপ্ত হয়ে পড়েন। (১) পর্দাহীনতা: হজ্জে লক্ষ লক্ষ নারী ও পুরুষ জমায়েত হন। অধিকাংশ হাজীই পর্দার বিধান জানেন না। বিশেষত মহিলাদের জামাতে ও মসজিদে সালাত আদায়ের সুন্নাত নির্দেশিত নিয়ম ও বিধান না জানার কারণে প্রায় সকল মহিলা হাজী এবং তাদের পুরুষ সাথী হজ্জের সফরে অনেক অনেক কবীরা গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়েন। যেমন পরিপূর্ণ পর্দা ছাড়া রাস্তায়, মসজিদে বা হজ্জের ময়দানে গমন, মসজিদে সালাত আদায় বা তাওয়াফের জন্য পুরুষদের ভীড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি ও ধাক্কাধাক্কিতে লিপ্ত হওয়া, পুরুষদের মধ্যে সালাতের জামাতে দাড়িয়ে পড়া, মসজিদের পুরুষদের দৃষ্টির মধ্যেই পরিধেয় পোশাক ঠিক করার জন্য নিজের ফরয সতর অনাবৃত করা, পুরুষদের মধ্যে ওযূ করা… ইত্যাদি। এছাড়া হজ্জের সময় হোটেল বা বাসায় এক কক্ষে কয়েকজন মহিলা অবস্থান করেন। স্বভাবতই এক মহিলার মাহরাম অন্য মহিলার মাহরাম নন। কিন্তু মহিলারা অনেক সময় গাইর মাহরাম পুরুষদের সামনে পূর্ণ পর্দা রক্ষা করেন না। অন্যের মাহরামের সামনে নিজেকে পূর্ণ আবৃত করেন না। ফলে একজন মহিলা বা পুরুষ হজ্জের চল্লিশ দিনের সফরে পর্দাহীনতার এত পাপ করেন যা হয়ত তিনি দেশের চল্লিশ বছরেও করেন নি। হজ্জে আগত অধিকাংশ মানুষই এরূপ। ফলে অনেকে আবার মনে করতে থাকেন হজ্জের সময় হয়ত পর্দা তেমন লাগে না! মহান আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। (২) পাপকর্ম: হজ্জের সময় সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে, লক্ষলক্ষ মানুষের ভিড়ে হাজী সাহেব প্রায়ই বিরক্তি, রাগারাগি, গীবত, অন্যান্য হাদীসের সমালোচনা ইত্যাদি পাপে লিপ্ত হয়ে পড়েন। (৩) ঝগড়-বিতর্কঃ হজ্জের অন্যতম কর্ম ঝগড়া-বিতর্ক। হজ্জের সফরের ৩৫/৪০ দিনে হাজী সাহেব প্রায় ৪০ বৎসরের ঝগড়া-বিতর্ক করেন। দেশে সাংসারিক কাজে অতি ব্যস্ত থাকার কারণে বিতর্কের সময় পাওয়া যায় না। হজ্জের সময় অনেক অলস সময় পাওয়া যায়, ফলে বিতর্ক-ঝগড়া খুবই জমে। এছাড়া সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের মধ্যে ভাল মানুষেরাও আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। বিমান বন্দরে, বিমানের মধ্যে, জিদ্দা হজ্জ টার্মিনালে, মক্কার আবাসস্থলে, মসজিদে হারামে, মিনা-মুযদালিফা-আরাফায়, মদীনায় … সকল স্থানেই হাজী সাহেবগণ অতি সাধারণ বিষয় নিয়ে ঝগড়া-বিতর্কে জাড়িয়ে পড়েন। এগুলো সবই হজ্জের মূল সাওয়াব নষ্ট করে দেয়। বিশেষ করে হজ্জের সময় বিভিন্ন মাযহাব ও মতের মুসলিম একত্রিত হন। এজন্য ধর্মীয় মাসআলা নিয়ে ভয়ঙ্কর সব বিতর্ক ও বিদ্বেষ শুরু হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সর্বদা নিজের গোনাহ এবং মহান আল্লাহর সানিধ্যের কথা মনে করতে হবে। অন্যকে নিয়ে ভাবনা ত্যাগ করতে হবে। নিজের নিকট গ্রহণযোগ্য মাসআলা অনুসরণের পাশাপাশি অন্যদের মত নিয়ে বিতর্ক বা নিজের মতের প্রাধান্য প্রমাণের চেষ্টা বর্জন করতে হবে। আমরা সকলেই হজ্জ মাবরূর পরিভাষা ব্যবহার করি। কিন্তু হজ্জ মাবরূর কী? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন: إطعام الطعام وطيب الكلام/ لين الكلام খাদ্য খাওয়ানো এবং সুন্দর-বিন কথা বলাই হলো হজ্জের র্বির বা হজ্জে মাবরূর। (আল মুজামুল আওসাত হাদীস নং ১৫২৪, হাইছামী হাদীসের সনদটিকে সহীহ বলেছেন, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ,হাদীস নং ৫২৬৬) পানাহার নিয়ে সকল প্রকারের বিতর্ক পরিহার করে অন্যকে খাওয়ানোর চেষ্টা করতে হবে। পুরো হজ্জের সফরে যদি কারো সাথে কঠোর বা কর্কশ কথা না বলে সকল অবস্থায় সকলের সাথে সুন্দর, বিন্ম্র ও আন্তরীকতাময় কথা বলতে পারি তবে আমরা মাবরূর হজ্জ অর্জন করার আশা করতে পারি।