আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

প্রশ্নোত্তর

ক্যাটাগরি

প্রশ্নোত্তর 39

লেনদেন

প্রকাশকাল: 9 মার্চ 2006

প্রশ্ন

আসসালামুয়ালাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লা…এলাকায় একধরনের লোন প্রচলিত আছে কেউ এক বছরের জন্য ১ লাখ টাকা দিলে তাকে ১ বছর পর ১লাখ ২৫ হাজার টাকা ফেরত দিতে হয়,কখনো অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা লোন দেবার সময় কেটে নেয়া হয় অর্থাত ১ লাখ টাকা না দিয়ে অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা কেটে ৭৫ হাজার টাকা দেয়া হয় সেটাকে এলাকায় খাজনা বলে থাকে। প্রচলিত এই লোন ব্যক্তি পর্যায়ে আদান প্রদান হচ্ছে। কুরআন ও হাদিসের আলোকে জানতে চাই

উত্তর

ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ। উল্লেখিত লেনদেন এক কথায় হারাম। কারণ এটা সুদ। নিচে দলীল সহ বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হলো: এই লেনদেনটি যেহেতু সুদ তাই প্রথমে সুদ সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। সুদকে আরবীতে রিবা বলে। যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত বা বেশী। ইসলামী পরিভাষায় সুদের অর্থ: আল্লামা আব্দুল আযীয বিন বায বলেন, هو الزيادة في أحد النوعين من المال على النوع الآخر، هذا إذا كانا من جنس واحد، كالذهب بالذهب والفضة بالفضة والبر بالبر والشعير بالشعير ونحو ذلك، إذا زاد أحدهما على الآخر يقال له ربا، شرع অর্থাৎ লেনদেনের সময় একজাতীয় পণ্যের একটিকে আরেকটির তুলনায় বেশী দেয়া। যেমন, সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিমেয়ে রুপা, ….যখন একটিকে আরেকটির চেয়ে বেশী দেয়া হবে তখন তাকে সুদ বলা হবে। আল্লামা আবুল বারাকাত আন-নাসাফী আল হানাফী বলেন, فَضْلُ مَالٍ بِلَا عِوَضٍ فِي مُعَاوَضَةِ مَالٍ بِمَالٍ অর্থাৎ পণ্য লেনদেনের সময় বিনিময় ছাড়া অতিরিক্ত পণ্যই সুদ। আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে মাহমুদ আলমাউসুলি আল হানাফী বলেন, الزيادة المشروطة في العقد ، وهذا إنما يكون عند المقابلة بالجنس অর্থাৎএক জাতীয় পণ্যের বিনিময়ের চুক্তিতে শর্তকৃত অতিরিক্ত অংশ হলো সুদ। মোট কথা সোনা-রুপা, টাকা-পয়সা বা শস্য ইত্যাদির বিনিময়কালে কম-বেশি দেয়া নেয়াই হলো সুদ। এ থেকে আমরা জানতে পারছি যে, কাউকে টাকা, সোনা, রূপা ইত্যাদি প্রদান করে পরে তার থেকে প্রদত্ত পরিমানের চেয়ে বেশি টাকা, সোনা, রূপা ইত্যাদি গ্রহণ করাই সূদ। কাউকে ১ হাজার টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে ১ হাজার ১ টাকা নিলে এক টাকা সূদ বলে গন্য হবে। উপরে দেলনদেনে ৭৫ হাাজার টাকা দিয়ে ১ লক্ষ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত ২৫ হাজার টাকা সুদ। অনুরূপভাবে এক লক্ষ টাকা দিয়ে পরে তার থেকে এক লক্ষের বেশি যে টাকাই নেওয়া হোক না কেন তা ইসলামী শরীয়াতে সূদ বলে গণ্য। সুদের সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে আবু সাইদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন, الذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ وَالشَّعِيرُ بِالشَّعِيرِ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلاً بِمِثْلٍ يَدًا بِيَدٍ فَمَنْ زَادَ أَوِ اسْتَزَادَ فَقَدْ أَرْبَى الآخِذُ وَالْمُعْطِى فِيهِ سَوَاءٌ অর্থ: সোনার বিনিময়ে সোনা, রুপার বিনিময়ে রুপা, গমের বিনিময়ে গম, জবের বিনিময়ে জব, খেজুরের বিনিময়ে খেজুর এবং লবণের বিনিময়ে লবন বিক্রি করবে সমান সমান নগদ নগদ। সুতরাং যে বেশী গ্রগন করবে কিংবা প্রদান করবে সে সুদী কারবার করল। দাতা ও গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান। উল্লেখ্য যে, তখনকার সময় সোনা-রুপাই ছিল মুদ্রা। হযরত আবু হুরাইরা রা. এবং আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত তার বলেন, أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم اسْتَعْمَلَ رَجُلاً عَلَى خَيْبَرَ فَجَاءَهُ بِتَمْرٍ جَنِيبٍ ، فَقَالَرَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم كُلُّ تَمْرِ خَيْبَرَ هَكَذَا فَقَالَ : لاَ وَاللَّهِ يَا رَسُولَ اللهِ إِنَّا لَنَأْخُذُ الصَّاعَ مِنْ هَذَا بِالصَّاعَيْنِ {وَالصَّاعَيْنِ} بِالثَّلاَثَةِ فَقَالَ : لاَ تَفْعَلْ بِعِ الْجَمْعَ بِالدَّرَاهِمِ ثمَّ ابْتَعْ بِالدَّرَاهِمِ جَنِيبًا রাসূল সা. খয়বারে এক ব্যক্তিকে জাকাত আদায়ের জন্য নিযুক্ত করলেন। সে তাঁর নিকটে উৎকৃষ্টমানের খেজুর নিয়ে আসলো। রাসূল সা. বললেন, খয়বারের সব খেজুর কি একই মানের? সে বলল, আল্লাহর শপথ হে আল্লাহর রাসূল! না, বিষয়টি এমন নয়। আমরা উন্নতমানের খেজুরের এক সা বিক্রি করি নিম্নমানের খেজুরের দুই সা এর বিনিময়ে এবং দুই সা কে তিন সা এর বিনিময়ে। রাসূল সা. বললেন, তুমি এমন করবে না।নিম্নমানের খেজুর বিক্রি করবে দিরহাম দ্বারা এরপর উন্নতমানের খেজুর ক্রয় করবে দিরহাম দ্বারা। সহীহ বুখারী: হাদীস নং ৪২৪৫। উবাদা ইবনে সামেত, উমার (রা.) সহ আরো অনেক সাহাবী থেকে এই অর্থের অনেক হাদীস বর্ণিত আছে। এ হাদীস অনুধাবনের জন্য একটি উদাহরণ দেখুন। মনে করুন বাজারে খুব ভাল চাউল ৬০ টাকা এবং কমা চাউল ৪০ টাকা। তাহলে তিন কেজি কমা চাউল বিক্রয় করলে ২ কেজি ভাল চাউল কেনা যায়। কিন্তু ক্উে যদি ক্রয় বিক্রয় না করে সরাসরি তিন কেজি কমা চাউল দিয়ে দুই কেজি ভাল চাউল গ্রহণ করে তবে এক কেজি সূদ বলে গণ্য হবে। ইসলাম বাজারে ক্রয়বিক্রয়ে ধারা বৃদ্ধি করতে উৎসাহ দেয়। কোনো অজুহাতেই সূদ গ্রহণ বৈধ করে নি। এই সব হাদীসের ভিত্তিতে সমস্ত আলেম একমত যে, মুদ্রার বিনিময়ে মুদ্রা (যদি এক জাতীয় হয়) কমবেশী করে বিনিময় করা হারাম। আর টাকা যেহেতু মুদ্রা তাই টাকার ক্ষেত্রেও কমবেশী করে বিনিময় হারাম হবে। সুতরাং একলক্ষ টাকা দিয়ে পরবর্তীতে এর চেয়ে বেশী নেয়া নিঃসন্দেহ সুদ। এটা পরিহার করতে হবে। সুদের ভয়াবহাতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لاَ يَقُومُونَ إِلاَّ كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُواْ إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىَ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ وَمَنْ عَادَ فَأُوْلَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ (২৭৫) অর্থ: যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতে দন্ডায়মান হবে সেভাবে, যেভাবে দন্ডায়মান হয় ঐ ব্যক্তি, শয়তান যাকে মোহবিষ্ট করে দেয়। তাদের এ অবস্থার কারণ এই যে, তারা বলেছে, ক্রয় বিক্রয় ও তো সুদেরই মত! অথচ আল্লাহ তায়ালা ক্রয় বিক্রয় বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন। অতঃপর যার কাছে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে উপদেল এসেছে এবং বিরত হয়েছে, যা পূর্বে হয়ে গেছে তা তার এবং সেই বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার জিম্মাই। আর যারা পূনরায় সুদ খাবে তারা জাহান্নামে যাবে। সূরা বাকারাহ, আয়াত ২৭৬। হযরত জাবির রা. বলেন, لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- آكِلَ الرِّبَا وَمُوكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ. রাসূল সা. সুদ দাতা, গ্রহীতা, লেখক, সাক্ষীদ্বয় সবার উপর লানাত দিয়েছেন এবং বলেছেন, তারা সবাই সমান। সহীহ মুসলিম, ৪১৭৭। আল্লাহ আমাদের যাবতীয় হারাম কাজ থেকে বেঁেচ থাকার তাওফীক দান করুন।