আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

সাম্প্রতিক সংবাদ

পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা

আজ …… হিজরী সালের রবিউস সানী মাসের দ্বিতীয় জুমুআ। আজ আমরা পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা নিয়ে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

ইসলাম পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার ধর্ম। মানুষের প্রাকৃতিক পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রেও ইসলামের সুস্পষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গোঁফ কর্তন করা, দাড়ি বড় করা, মিসওয়াক করা বা দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করা, নাকের মধ্যে পানি দিয়ে নাক পরিস্কার করা, নখ কর্তন করা, দেহের অঙ্গসন্ধিগুলি ধৌত করা, বগলের নিচের চুল পরিষ্কার করা, নাভির নিচের চুল মুণ্ডন করা, পানি ব্যবহার করে শৌচকার্য করা, কুলি করা, খাতনা করা ইত্যাদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতামূলক কর্মগুলিকে ফিত্রাত বা মানবীয় প্রকৃতি নির্দেশিত ইসলামের জরুরী কর্ম বলে উল্লে­খ করেছেন। সামগ্রিকভাবে দেহ, পোশাক, বাড়িঘর সবকিছু পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখতে বিভিন্নভাবে নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। দেহে বা পোশাকে অপরিচ্ছন্ন কাউকে দেখলে আপত্তি করতেন।

এক হাদীসে তিনি বলেন:
نَظِّفُوا أُرَاهُ قَالَ أَفْنِيَتَكُمْ وَلا تَشَبَّهُوا بِالْيَهُودِ، تَجْمَعُ الأَكْبَاءَ فِيْ دُوْرِهَا
“তোমরা তোমাদের বাড়ির আঙ্গিনা-সর্বদিক পরিচ্ছন্ন রাখবে, ইহুদিদের অনুকরণ করবে না, ইহুদিরা তাদের বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার করে না। তারা বাড়িতে আবর্জনা জমা করে রাখে।”1তিরমিযী, আস-সুনান ৫/১১১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২৮৬; আলবানী, জিলবাবুল মারাআহ, পৃ. ১৯৭-১৯৮। হাদীসটির সনদ সহীহ।

দুঃখজনক হলো ইহূদীরা আজ পরিচ্ছন্ন আর মুমিনের বাড়িঘর আঙ্গিনা সবই নোংরা।

পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার অন্যতম দিক মল-মূত্র ত্যাগ। এ বিষয়ে ইসলামের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। মল-মুত্র ত্যাগের অন্যতম আদব হলো, অন্যের দৃষ্টি থেকে সতর আবৃত রাখা। এজন্য সর্বদা চেষ্টা করতে হবে সেনেটারী পায়খানা বা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি ‘পায়খানা’র মধ্যে মলমুত্র ত্যাগ করা। যদি একান্ত বাধ্য হয়ে ফাঁকা স্থানে ইসতিনজা করার প্রয়োজন পড়ে তবে অবশ্যই লোক চক্ষুর আড়ালে বসতে হবে। মলমুত্র পরিত্যাগের সময় নিজ সতর অন্যকে দেখতে দেওয়া কঠিন হারাম ও অভিশাপের কারণ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
وَمَنْ أَتَى الْغَائِطَ فَلْيَسْتَتِرْ
যে ব্যক্তি মলত্যাগের জন্য গমন করবে, সে যেন নিজেকে আড়াল করে।2আবূ দাউদ, আস-সুনান ১/৯; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১/৯৪।

সাধারণ মানুষের অসুবিধা হতে পারে এরূপ স্থানে মলমুত্র ত্যাগ করা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
اتَّقُوا الْمَلاعِنَ الثَّلاثَ قِيلَ مَا الْمَلاعِنُ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ أَنْ يَقْعُدَ أَحَدُكُمْ فِي ظِلٍّ يُسْتَظَلُّ فِيهِ أَوْ فِي طَرِيقٍ أَوْ فِي نَقْعِ مَاءٍ (أو الْمَوَارِد)
তোমরা তিনটি অভিশাপের স্থান বর্জন করে চলবে। তখন বলা হলো: হে আল্লাহর রাসূল, অভিশাপের স্থানগুলি কি? তিনি বলেন: মানুষ ছায়াগ্রহণ করে এরূপ ছায়াময় স্থানে অথবা রাস্তায় অথবা জলাধার বা জলাশয়ের মধ্যে বা পানির ঘাটে মলমূত্র ত্যাগ করতে করতে বসা।

মলমূত্র ত্যাগের সময় কিবলার দিকে মুখ করা বা পিছন দেওয়া নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إِذَا أَتَيْتُمُ الْغَائِطَ فَلا تَسْتَقْبِلُوا الْقِبْلَةَ وَلا تَسْتَدْبِرُوهَا
তোমরা মলত্যাগ বা মুত্রত্যাগের জন্য গমন করলে কিবলা সামনে রাখবে না বা পিছনে রাখবে না।3বুখারী, আস-সহীহ ১/১৫৪; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২২৪।

সেনিটারী ‘পায়খানা’-য় মল-মূত্র ত্যাগ করলে তা ভালভাবে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। কোনো পাত্রে, পটিতে, প্যানের মধ্যে পেশাব জমা থাকলে সেই বাড়িতে ফিরিশতা প্রবেশ করেন না বলে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لاَ يُنْقَعُ بَوْلٌ فِيْ طَسْتٍ فِيْ الْبَيْتِ فَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لاَ تَدْخُلُ بَيْتاً فِيْهِ بَوْلٌ مُنْتَقَعٌ
বাড়ির মধ্যে কোনো পাত্রে যেন পেশাব জমা না থাকে। কারণ যে বাড়িতে কোনো পেশাব জমে আছে সেই বাড়িতে ফিরিশতারা প্রবেশ করেন না।4হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২০৪। হাসীসটির সনদ হাসান।

দেহ ও পোশাক পেশাবের ছিটা থেকে পবিত্র রাখা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
عَامَّةُ عَذَابِ الْقَبْرِ فِيْ الْبَوْلِ فَاسْتَنْزِهُوْا مِنَ الْبَوْلِ
“কবরের আযাব অধিকাংশ ক্ষেত্রে পেশাবের কারণেই হয়। কাজেই তোমরা তোমরা পেশাব থেকে পবিত্র থাকবে।”5হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২০৭; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩৮। হাদীসটি সহীহ।

ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি কবরের পার্শ দিয়ে গমন করার সময় বলেন:
إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لا يَسْتَتِرُ مِنْ الْبَوْلِ وَأَمَّا الآخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ
“এ দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কোনো কঠিন বা বৃহৎ বিষয়ে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের একজন পেশাব থেকে সাবধান থাকতো না। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি কুটনামি করত বা একজনের কথা আরেকজনকে বলে পারস্পরিক সম্প্রীতি নষ্ট করত।”6বুখারী, আস-সহীহ ১/৮৮; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৪০।

অধিকতর পবিত্রতা নিশ্চিত করতে মলমূত্র ত্যাগের পর পানি ব্যবহারের পূর্বে ঢিলা-কুলুখ বা টিস্যু ব্যবহার করে আগে ময়লা স্থান পরিস্কার করা প্রয়োজন। এছাড়া পেশাব শেষে উঠে দাঁড়ালেই যাতে দুই/এক ফোঁটা পেশাব কাপড়ে বা দেহে না পড়ে এজন্য পেশাবের পরে বসা অবস্থাতেই পুরুষাঙ্গ তিনবার টান দিয়ে এরপর পানি ঢেলে ধুয়ে ফেলা উচিত।

দুর্বল সনদের একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
إِذَا بَالَ أَحَدُكُمْ فَلْيَنْتُرْ ذَكَرَهُ ثَلاثَ مَرَّاتٍ (وفي رواية زاد) فَإِنَّ ذَلِكَ يُجْزِئُ عَنْهُ
“তোমাদের কেউ পেশাব করলে সে যেন তার পুরুষাঙ্গ তিনবার টান দেয়। এভাবে তিনবার টান দেওয়াই তার জন্য যথেষ্ট বলে গণ্য হবে।”7ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১৮; আহমদ, আল-মুসনাদ ৪/৩৪৭। বিস্তারিত দেখুন: এহইয়াউস সুনান, ৪৫১-৪৫৫ পৃষ্ঠা।

মুমিনের উচিত সকল অবস্থায় আল্লাহর নেয়ামতের স্মরণ করা, দোয়া করা ও কৃতজ্ঞতা জানানো। ‘পায়খানা’ বা শৌচাগারে প্রবেশের পূর্বে ও সেখান থেকে বের হওয়ার পরে দোয়া পাঠের নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মল-মুত্র ত্যাগের স্থানে প্রবেশের পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخُبُثِ وَالْخَبَائِثِ
হে আল্লাহ, আমি অপবিত্র কর্ম বা পুরুষ ও নারী অপবিত্রদের (শয়তানদের) থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি।8বুখারী, আস-সহীহ ১/৬৬; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৮৩-২৮৪।

অন্য হাদীসে আয়িশা (রা) বলেন,
كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا خَرَجَ مِنَ الْخَلاءِ قَالَ غُفْرَانَكَ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন শৌচাগার বা মলমুত্রত্যাগের স্থান থেকে বের হতে তখন বলতেন: “গুফরা-নাকা”, অর্থাৎ “আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছি”।9তিরমিযী, আস-সুনান ১/১২; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৪/২৯১। হাদীসটি হাসান।

শৌচাগারে প্রবেশের সময় জুতা সেন্ডেল বা পাদুকা পায়ে রাখা পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রয়োজনীয়। এছাড়া মাথা আবৃত রাখাও আদব। যয়ীফ সনদে বর্ণিত একটি হাদীসে রয়েছে:
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا دَخَلَ الْمِرْفَقَ لَبِسَ حِذَاءَهُ وَغَطَّى رَأْسَهُ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শৌচাগারে প্রবেশ করতে চাইলে তাঁর জুতা পরিধান করতেন এবং মাথা আবৃত করতেন।10ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/৩৮৩; বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১/৯৬; ইবনু হাজার আসকালানী, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ. ১৫১; আব্দুর রাউফ মুনাবী, ফাইযুল কাদীর ৫/১২৮; আলবানী, যায়ীফুল জামি’, পৃ. ৬৩৭।

সহীহ সনদে আবু বাকর সিদ্দীক (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলে এভাবে মাথা আবৃত করে যেতেন।((ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, পৃ. ১০৭; আবূ বকর কুরাশী, মাকারিমুল আখলাক, পৃ. ৪০; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৬/১৪২; আবূ নুআইম ইসপাহানী, হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/৩৪; দারাকুতনী, আল-ইলাল ১/১৮৬। ))

ইসলামী পবিত্রতার অন্যতম বিষয় ওযূ ও গোসল। কাপড়ে, দেহে বা কোনো স্থানে ময়লা বা নাপাকি লাগলে তা পানির মাধ্যমে ধুয়ে পাক করতে হয়। আর মলূ-মুত্র ত্যাগ, বায়ু ত্যাগ, ঘুম বা রক্তপাত ইত্যাদি মাধ্যমে ওযু নষ্ট হলে ওযুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। এইরূপ পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত বা নামায আল্লাহ কবুল করেন না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
لا تُقْبَلُ صَلاةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلا صَدَقَةٌ مِنْ غُلُولٍ
অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের দান কবুল হয় না এবং ওযু ছাড়া সালাত কবুল হয় না।১১বুখারী, আস-সহীহ ২/৫১১; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২০৪।

অন্য হাদীসে তিনি বলেন:
لا تُقْبَلُ صَلاةُ أَحَدِكُمْ إِذَا أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ
“যখন তোমাদের কেউ বায়ু ত্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে ওযু নষ্ট করে ফেলে তখন পুনরায় ওযু না করা পর্যন্ত তার সালাত কবুল করা হবে না।”12বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৫১; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২০৪।

ওযূ শুধু নামাযের শর্তই নয়। ওযূ নিজেই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হাদীসে ওযূ গোসল ও পাক পবিত্র হওয়াকে ঈমানের অর্ধাংশ বলে উল্লে­খ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ.
“পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ।”13মুসলিম, আস-সহীহ ১/২০৩।

এই ইবাদতের জন্য মহান পুরস্কার ও বিশেষ সাওয়াব রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِهِ حَتَّى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِهِ
“যে ব্যক্তি ওযু করবে এবং সুন্দররূপে ওযু করবে তার পাপ-অন্যায়গুলি তার দেহ থেকে বেরিয়ে যাবে, এমনকি তার নখগুলির নিচে থেকেও বেরিয়ে যাবে।”14মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১৬।

অন্য হাদীসে তিনি বলেন;
أَلا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ وَانْتِظَارُ الصَّلاةِ بَعْدَ الصَّلاةِ فَذَلِكُمْ الرِّبَاطُ
“যদ্বারা আল্লাহ পাপরাশী ক্ষমা করেন এবং পুন্য বৃদ্ধি করেন তা কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব না? সাহাবীগণ বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, অবশ্যই জানাবেন। তিনি বলেন: কষ্ট সত্ত্বেও পূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদের দিকে বেশি বেশি পদক্ষেপ এবং এক সালাতের পরে অন্য সালাতের জন্য অপেক্ষা করা। আর এটিই জিহাদের প্রহরা।”15মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১৯।

অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
إِذَا تَطَهَّرَ الرَّجُلُ ثُمَّ أَتَى الْمَسْجِدَ يَرْعَى الصَّلاةَ كَتَبَ لَهُ كَاتِبُهُ بِكُلِّ خُطْوَةٍ يَخْطُوهَا إِلَى الْمَسْجِدِ عَشْرَ حَسَنَاتٍ وَالْقَاعِدُ يَرْعَى الصَّلاةَ كَالْقَانِتِ وَيُكْتَبُ مِنْ الْمُصَلِّينَ مِنْ حِينِ يَخْرُجُ مِنْ بَيْتِهِ حَتَّى يَرْجِعَ إِلَيْهِ
“যখন কোনো মানুষ পবিত্র হয়ে বা ওযু করে মসজিদে আগমন করে তখন তার আমল লেখক মসজিদের দিকে তার প্রতি পদক্ষেপের জন্য দশটি সাওয়াব লিখেন। যে ব্যক্তি মসজিদে বলে সালাতের অপেক্ষা করে তার সালাতে রত থাকার সাওয়াব হয়। বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত পুরো সময় তার জন্য সালাত আদায়ের সাওয়াব লেখা হয়।”16আহমদ, আল-মুসনাদ ৪/১৫৭; আলবানী, সহীহহুত তারগীব ১/৭২। হাদীসটি সহীহ।

ওযুর নিয়ম আমরা মোটামুটি সবাই জানি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা নি®প্রয়োজন। তবে সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ওযূর প্রতিটি অঙ্গ ভালভাবে পানি দ্বারা ধোয়া হয়েছে। যদি কোনো অঙ্গের কোনো স্থান শুকনো থাকে তবে ওযূ হবে না, ফলে নামাযও হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একব্যক্তিকে দেখেন যে, সে পায়ের গোড়ালী দুইটি ধৌত করে নি।

তখন তিনি বলেন:
ويل لِلأَعْقَابِ مِنَ النَّارِ
“গোড়ালীগুলির জন্য জাহান্নামের শাস্তির ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে।”১৭বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৩, ৪৮, ৭২; মুসলিম, আস-সহীহ ১/২১৩-২১৪।

ওযূর অঙ্গগুলি ভালভাবে ধোয়ার বিষয়ে সতর্কতার অর্থ এই নয় যে, আমরা পানির অপচয় করব। পানির অপচয় করা অথবা তিনবারের বেশি কোনো অঙ্গ ধোয়া আপত্তিকর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অল্প পানি দিয়েই পূর্ণরূপে ওযূ করতেন।

আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَوَضَّأُ بِالْمُدِّ وَيَغْتَسِلُ بِالصَّاعِ إِلَى خَمْسَةِ أَمْدَادٍ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওযু করতেন এক মুদ্দ (প্রায় ১ লিটার) পানি দিয়ে এবং গোসল করতেন এক সা’ (প্রায় ৪ লিটার) থেকে পাঁচ মুদ্দ (প্রায় ৫ লিটার) পানি দিয়ে।”18মুসলিম, আস-সহীহ ১/২৫৮।

ইসলামে সব সময় মেসওয়াক ব্যবহার করতে এবং দাঁত ও মুখের অভ্যন্তর পরিষ্কার রাখতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত ওযূর সময়ে দাত ও মুখ পরিষ্কার করতে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ
দাঁত পরিস্কার করা মুখের পবিত্রতা আনয়ন করে এবং প্রতিপালকের সন্তুষ্টি আনয়ন করে।19ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১০৬; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ১/৭০; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৫০। হাদীসটি সহীহ।

لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي لأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ وُضُوءٍ (وفي رواية: عِنْدَ كُلِّ صَلاَةٍ)
“যদি আমি আমার উম্মতের জন্য কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে না করতাম তাহলে তাদেরকে প্রত্যেক ওযুর সাথে মিসওয়াক করার জন্য নির্দেশ প্রদান করতাম।” অন্য বর্ণনায় আমি তাদেরকে প্রত্যেক সালাতের সময় ওযুর সাথে মেসওয়াকের নির্দেশ প্রদান করতাম।”20মুসলিম, আস-সহীহ ১/২২০; ইবনু খুযাইমা, আস-সহীহ ১/৭৩; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ৪/৩৯৯।

চেষ্টা করতে হবে, নিম বা অনুরূপ গাছের কাঁচা ডালের মেসওয়াক ব্যবহার করা। না হলে টুথ ব্রাশ ও পেস্ট ব্যবহার করতে হবে। মূল ইবাদত হলো মুখ পরিষ্কার করা ও দুর্গন্ধ দূর করা।

হাদীস শরীফে ওযূর পরে দোয়া পাঠের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ يَتَوَضَّأُ فَيُبْلِغُ أَوْ فَيُسْبِغُ الْوَضُوءَ ثُمَّ يَقُولُ أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ إِلا فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ الثَّمَانِيَةُ (يَدْخُلُ مِنْ أَيِّهَا شَاءَ)
“যদি কেউ পরিপূর্ণরূপে ওযু করে এবং এরপর বলে: আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দাস ও প্রেরিত দূত, তাহলে তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেওয়া হবে। (সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা জান্নাতে প্রবেশ করবে।)”21মুসলিম, আস-সহীহ ১/২০৯।

প্রত্যেক ওযূর পরে সে ওযূ দ্বারা কিছু নফল সালাত আদায় করা খুবই ভাল। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন ফজরের সালাতের সময় বলেন: বেলাল, তুমি ইসলাম গ্রহণের পরে তোমার মতে সবচেয়ে বড় নেক আমল কোন্টি করেছ, যে আমলের জন্য সবচেয়ে বেশি সাওয়াব তুমি আশা কর; কারণ আমি গত রাতে জান্নাতে আমার আগে আগে তোমার পাদুকার শব্দ শুনেছি। তখন বেলাল বলেন:

مَا عَمِلْتُ عَمَلا فِي الإِسْلامِ أَرْجَى عِنْدِي مَنْفَعَةً مِنْ أَنِّي لا أَتَطَهَّرُ طُهُورًا تَامًّا فِي سَاعَةٍ مِنْ لَيْلٍ وَلا نَهَارٍ إِلا صَلَّيْتُ بِذَلِكَ الطُّهُورِ مَا كَتَبَ اللَّهُ لِي أَنْ أُصَلِّيَ
“আমি ইসলামে যত কর্ম করেছি সেগুলির মধ্যে যে কর্মটির ফায়দা ও সাওয়াব বেশি আশা করি তা হলো, আমি দিনে বা রাতে যখনই ওযূ করি তখনই সেই ওযূতে আমাকে আল্লাহ যতটুকু তাওফীক প্রদান করেন তদনুসারে কিছু নফল সালাত আদায় করি।”22বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৮৬, ৬/২৭৩৯; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯১০। অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:

مَنْ تَوَضَّأَ مِثْلَ هَذَا الْوُضُوءِ ثُمَّ أَتَى الْمَسْجِدَ فَرَكَعَ رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ جَلَسَ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ قَالَ وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لا تَغْتَرُّوا
যে ব্যক্তি আমার ওযুর মত ওযু করবে, এরপর মসজিদে গমন করে সেখানে দুই রাক‘আত সালাত আদায় করবে, অতঃপর মসজিদে বসবে, তার পূর্ববর্তী পাপ ক্ষমা করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন: তবে তোমরা ধোঁকায় পড়ো না। (অর্থাৎ ক্ষমার কথা শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে পাপে লিপ্ত হবে না। মুমিন সর্বদা পাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করবে। তা সত্ত্বেও ছোটখাট সাধারণ পাপ-অন্যায় হয়ে যাবে, যেগুলি এসকল কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ ক্ষমা করবেন।)23বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩৬৩।

ওযূর মূল উদ্দেশ্য

সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি। এ ছাড়াও সর্বদা ওযূ অবস্থায় থাকা ভাল। বিশেষত ঘুমানোর আগে অযূ করে অযূ অবস্থায় ঘুমানো উত্তম। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওযূ অবস্থায় ঘুমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَبِيْتُ عَلَى طُهْرٍ ثُمَّ يَتَعَارُّ مَنَ اللَّيْلِ فَيَذْكُرُ اللهَ وَيَسْأَلُ اللهَ خَيْراً مِنْ خَيْرِ الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ إِلاَّ آتَاهُ اللهُ إِيَّاهُ، وفي رواية: مَنْ بَاتَ طَاهِراً عَلَى ذِكْرِ اللهِ
“যদি কোনো মুসলিম ওযূ অবস্থায় (অন্য বর্ণনায়: ওযূ অবস্থায় আল্লাহর যিক্র করতে করতে) ঘুমিয়ে পড়ে, এরপর রাত্রে কোনো সময়ে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং সে সে সময়ে আল্লাহর যিকর করে এবং আল্লাহর কাছে কিছু চায় তবে আল্লাহ তাকে তা প্রদান করবেন।24হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২২৩। হাদীসটি হাসান। অন্য হাদীসে তিনি বলেন,

طَهِّرُوا هَذِهِ الأَجْسَادَ طَهَّرَكُمُ اللهُ فَإِنَّهُ لَيْسَ مِنْ عَبْدٍ يَبِيْتُ طَاهِراً إِلاَّ بَاتَ مَعَهُ فِيْ شِعَارِهِ مَلَكٌ لاَ يَنَقَلَّبُ سَاعَةً مِنَ اللَّيْلِ إِلاَّ قَالَ اللّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فَإِنَّهُ بَاتَ طَاهِراً
“তোমরা এই দেহগুলিকে পবিত্র রাখবে। যদি কেউ ওযূ অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ে তবে তার সাথে তার বিছানায় একজন ফিরিশতা শুয়ে থাকবেন। রাত্রে যখনই যে নড়াচড়া করবে তখনই ঐ ফিরিশতা আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, হে আল্লাহ, আপনার বান্দা ওযূ অবস্থায় শুয়েছেন, আপনি তাকে ক্ষমা করে দিন।২৫হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২২৬, ১০/১২৮। হাদীসটি হাসান।

হযরত বারা ইবনুল আযিব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বলেন, “যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন সালাতের ওযুর মতো ওযু করবে। এরপর ডান কাতে শুয়ে বলবে :

اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ وَوَجَّهْتُ وَجْهِي إِلَيْكَ وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ رَغْبَةً وَرَهْبَةً إِلَيْكَ لا مَلْجَا وَلا مَنْجَا مِنْكَ إِلا إِلَيْكَ آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ وَبِنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ
“হে আল্লাহ, আমি সমর্পণ করলাম আমাকে আপনার নিকট, দায়িত্বার্পণ করলাম আপনাকে আমার যাবতীয় কর্মের, আমার পৃষ্ঠকে আপনার আশ্রয়ে সমর্পিত করলাম, আপনার প্রতি আশা ও ভয়ের সাথে। আপনার নিকট থেকে আপনি ছাড়া কোনো আশ্রয়স্থল নেই ও কোনো মুক্তির স্থান নেই। আমি ঈমান এনেছি আপনি যে কিতাব নাযিল করেছেন তার উপর এবং আপনি যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রেরণ করেছেন তার উপর।”

এই বাক্যগুলি তোমার শেষ কথা হবে (এর পরে আর কোনো কথাবার্তা বলবে না)। যে ব্যক্তি এই দু‘আ পাঠের পরে সেই রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করবে সেই ব্যক্তি ফিতরাতের উপরে (নিষ্পাপভাবে) মৃত্যু বরণ করবে। আর যদি বেঁচে থাকে তাহলে কল্যাণময় দিবস শুরু করবে।”26সহীহ বুখারী ১/৯৭, নং ২৪৪, ৫/২৩২৬, নং ৫৯৫২, ৫/২৩২৭, নং ৫৯৫৬, সহীহ মুসলিম ৪/২০৮২, নং ২৭১০।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক প্রদান করুন। আমীন!!

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহিমাহুল্লাহ, বই: খুতবাতুল ইসলাম, পৃ. ১৩৫-১৪২।

ইমাম মাহদী (১), হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশ ও সাহাবীগণের, শবে কদর, ইতিকাফ ও ফিতরা

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
আপনার ইমেইল
Print

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.