ঈমানের ৬ষ্ঠ রুকন হলো ‘ঈমান বিল কাদার’। এর অর্থ এ কথা বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ অনাদি-অনন্ত অসীম জ্ঞানের অধিকারী। তিনি তাঁর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও সর্বব্যাপী জ্ঞান ‘কিতাবে মুবীন’ (সুস্পষ্ট কিতাব) বা ‘লাওহে মাহফুজে’ (সংরক্ষিত পত্রে) লিখে রেখেছেন। লিখনের প্রকৃতি আমরা জানিনা। তিনি যা ইচ্ছা রেখে দেন এবং যা ইচ্ছা মুছে ফেলেন। রাখা ও মুছার ধরন আমাদের অজ্ঞাত। এ বিশ্বে যা কিছু সংঘটিত হয় সবই তাঁর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারেই হয়। তাঁর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। তিনিই এ বিশ্বের সবকিছুর স্রষ্টা। মানুষের কর্মও তাঁরই সৃষ্টি। তিনি মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা, বিচার শক্তি ও বিবেক প্রদান করেছেন। মানুষ তার নিজ ইচ্ছায় কর্ম করে এবং নিজ ইচ্ছা ও বিচারবুদ্ধি দিয়ে যে কর্ম সে করবে সে কর্মের ফল সে লাভ করবে। তবে তার কর্ম আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে সংঘটিত হয়। সম্ভবত একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝানো যায়। আল্লাহর নির্ধারণ হলো যে, বিষ মৃত্যু আনে। মানুষকে আল্লাহ বিবেক ও জ্ঞান দান করেছেন যে, বিষ মৃত্যু আনে। এরপরও কেউ বিষ পান করলে সে মৃত্যু বরণ করবে। তবে তা আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুসারে ঘটবে। আল্লাহ তাঁর অনন্ত জ্ঞানে জানেন যে, নির্দিষ্ট ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে বা না জেনে বিষ পান করবে। তিনি তাঁর এ জ্ঞান ‘কিতাব মুবীন’-এ লিপিবদ্ধ করেছেন।

তিনি ইচ্ছা করলে ঐ ব্যক্তির ইচ্ছা শক্তি হরণ করে তাকে বিষপান থেকে বিরত রাখতে পারেন, তেমনি তিনি ইচ্ছা করলে বিষের ক্রিয়া নষ্ট করে বিষপানকারীকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারেন। আল্লাহর জ্ঞান, লিখনি ও নির্ধারণ অনুসারে বিষপানকারীর মৃত্যু আসবে অথবা আসবে না। এবং বিষপানকারী বিষপানে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা ও কর্ম অনুসারে কর্মফল লাভ করবে। ইসলামী তাক্বদীরে বিশ্বাস ও অনৈসলামিক ভাগ্যে বিশ্বাসকে অনেক সময় এক করে ফেলা হয়। অনেকে মনে করেন ভাগ্য অনুসারেই যখন সবকিছু হবে তখন কর্মের কি দরকার। যে অবিশ্বাসী তাক্বদীর নিয়ে বিবাদ করে, সে মূলত নিজেকে আল্লাহর কর্মের পরিদর্শক ও বিচারক নিয়োগ করেছে। সে বলতে চায়, কর্ম করা আমার দায়িত্ব নয়, আমার কাজ হলো আল্লাহর কাজের বিচার করা। আর মুমিনের বিশ্বাস, আল্লাহর কর্মের বিচার করা মানুষের কর্ম নয়। তিনি কি জানেন, কি লিখেছেন, কি মুছেন আর কি রেখে দেন কিছুই মানুষকে জানাননি। কারণ, এসব জানা মানুষের কোনো কল্যাণে আসবেনা। এসব কিছুই তাঁর মহান রুবূবিয়্যাতের অংশ। মানুষের দায়িত্ব আল্লাহর রহমত ও করুণার উপরে আস্থা রেখে আল্লাহর নির্দেশ মত কর্ম করা, ফলাফলের জন্য উৎকণ্ঠিত না হওয়া। ইসলামের তাক্বদীরে বিশ্বাস মুসলিমকে কর্মমূখী করে তোলে, কখনই কর্মবিমূখ করেনা। তাক্বদীরে বিশ্বাসের ফলে মানুষ সকল হতাশা, অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পায়। মুসলিম জানে, তার দায়িত্ব কর্ম করা, ফলাফলের জন্য দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা তার জীবনে অর্থহীন, কারণ ফলাফলে দায়িত্ব এমন এক সত্তার হাতে যিনি তাকে তার নিজের চেয়েও ভাল জানেন, ভালবাসেন, যিনি দয়াময়, যিনি কাউকে জুলুম করেন না। যিনি তাঁর বান্দাকে কর্মের চেয়ে বেশি পুরস্কার দিতে চান। তাই মুমিন উৎকণ্ঠা মুক্ত হয়ে কর্ম করেন।

তাক্বদীরের বিশ্বাস মুসলিমকে অহংকার, অতিউল্লাস ও হতাশা থেকে রক্ষা করে। তার জীবনে সফলতা বা নিয়ামত আসলে সে অহংকারী হয়ে উঠেনা। সে জানে আল্লাহর ইচ্ছায় ও রহমতেই সে সফলতা লাভ করেছে। তার হৃদয় কানায় কানায় ভরে ওঠে কৃতজ্ঞতায়। অপরদিকে মুমিন ব্যর্থতায় বা পরাজয়ে হতাশ হয় না। সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুযায়ী সে ফল পেয়েছে, নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। সে জানে যে, তার প্রচেষ্টা ও কর্মের জন্য সে অবশ্যই আল্লাহর কাছে পুরস্কার লাভ করবে। কাজেই সে হতাশ না হয়ে নিজের কর্মের ভুল দূর করে আল্লাহর নির্দেশ মত চেষ্টা করতে থাকে, ফলাফলের দায়িত্ব আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়। তাক্বদীরে বিশ্বাসের ফল আমরা দেখতে পাই এ বিশ্বাস সর্বপ্রথম যাদের জীবনে এসেছিল তাঁদের জীবনে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনে। আমরা দেখেছি তাক্বদীরের উপর সবচেয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর, আর তাই তিনি সবচেয়ে ছিলেন বেশি দৃঢ় প্রত্যয়ী কর্মবীর। তিনি তার সাধ্যমত কর্ম করেছেন, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন তার করুণার জন্য, আর ফলাফলের ভার ছেড়ে দিয়েছেন তার প্রতিপালকের কাছে। ঠিক তেমনি অকুতোভয় দুঢ়প্রত্যয়ী কর্মবীর ছিলেন তাঁর সাহাবীগণ, তাক্বদীরে বিশ্বাস তাদের সকল সংশয়, ভয়, দুশ্চিন্তা দূর করে বিশ্বজয়ে প্রেরণা জুগিয়েছে। হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, তাকদীরে বিশ্বাস মানুষকে ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠা ও অতীতের আফসোস থেকে রক্ষা করে। পরাজয় বা ব্যর্থতা নিয়ে আফসোস, কেন এরূপ করলাম বা করলাম না ইত্যাদি হা-হুতাশ থেকে রক্ষা করে। আর এরূপ তাকদীরে বিশ্বাসী শক্তিশালী হতাশা ও আফসোস মুক্ত মুমিনকে আল্লাহ ভালবাসেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক ঈমান দান করুন। আমাদেরকে ঈমানের শক্তিতে, কর্মের শক্তিতে, দেহের শক্তিতে, জ্ঞানের শক্তিতে শক্তিশালী করে তাঁর প্রিয় শক্তিশালী মুমিন হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

খুতবাতুল ইসলাম ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ।

তাওহীদের ঈমান (১), তাওহীদের ঈমান (২), তাওহীদের ঈমান (৩), তাওহীদের ঈমান (৪), তাওহীদুল ঈমান (৫), তাওহীদের-ইমান-৬, আমার ঈমানের ক্যান্সার !