তাকফীর বা ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলা
উপরের আলোচনায় আমরা কুফর ও র্শিকের পরিচয় জানতে পেরেছি। আমরা দেখতে পাই যে, (কুফর বনাম তাকফীর) এ সকল কুফর বা র্শিক অনেক মুসলিম নামধারী মানুষের মধ্যে বিদ্যমান। সমাজের অনেক মানুষই নিজেকে মুমিন ও তাওহীদে বিশ্বাসীদ বলে দাবি করার পরেও উপরে আলোচিত বিভিন্ন প্রকার র্শিক বা কুফরের মধ্যে লিপ্ত থাকেন।
এদের এ সকল কর্ম র্শিক বা কুফর বলে আমরা নিশ্চিত জানার পরেও এদেরকে কাফির বা মুশরিক বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ইসলামের নির্দেশ। কোনো কর্মকে কুফর বা র্শিক বলা এবং কোনো ব্যক্তিকে কাফির বা মুশরিক বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ক মূলনীতি এ অনুচ্ছেদে আলোচনা করব। এছাড়া পরবর্তী অনুচ্ছেদে বিভিন্ন বিভ্রান্ত মুসলিম ফিরকাকে কাফির বলার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মূলনীতি আমরা আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
তাকফীর অর্থ কাউকে কাফির বলা বা কাফির বলে অভিযুক্ত করা। (seduction to infidelity, charge of unbelief)। অর্থাৎ ঈমানের দাবিদার বা মুসলিম বলে দাবিকারী কোনো ব্যক্তিকে কাফির বলে ঘোষণা করা। কাউকে কাফির বলার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে, যেমন কবীরা গোনাহ বা আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে কাফির বলা, সুস্পষ্ট কুফরী কর্মের কারণে কাফির বলা, অস্পষ্ট কুফরীর কারণে কাফির বলা, কাল্পনিক কুফরীর কারণে কাফির বলা ইত্যাদি।
ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার নিষেধাজ্ঞা
ঈমানের দাবিদারকে কাফির বলার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মাতকে সতর্ক করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রাদিআল্লাহ আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إِذَا كَفَّرَ الرَّجُلُ أَخَاهُ فَقَدْ بَاءَ بِهَا أَحَدُهُمَا (إِنْ كَانَ كَمَا قَالَ وَإِلَّا رَجَعَتْ عَلَيْهِ)
“যদি কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে এ কথা দুজনের একজনরে উপর প্রযোজ্য হবে। যদি তার ভাই সত্যিই কাফির না হয় তবে যে তাকে কাফির বলল তার উপরেই কুফরী প্রযোজ্য হবে।”1বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২৬৩-২২৬৪; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৭৯।
অন্য হাদীসে আবূ হুরাইরা রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِذَا قَالَ الرَّجُلُ لأَخِيهِ يَا كَافِرُ فَقَدْ بَاءَ بِهِ أَحَدُهُمَا
“যদি কেউ তার ভাইকে বলে, হে কাফির, তবে তাদের দুজনের একজনের উপর এই কুফরীর দায়ভার বর্তাবে।”2বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২৬৪।
আবূ যার রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ دَعَا رَجُلَا بِالْكُفْرِ أَوْ قَالَ عَدُوَّ اللهِ وَلَيْسَ كَذٰلِكَ إِلَّا حَارَ عَلَيْهِ
“যদি কেউ কোনো মানুষকে কুফরীর সাথে জড়িত করে আহ্বান করে অথবা তাকে বলে ‘হে আল্লাহর শত্রু’ আর সে তা না হয়। তবে তা বক্তার উপর বর্তাবে।”3মুসলিম, আস-সহীহ ১/৭৯।
আবূ সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহ আনহু বলেন,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَا أَكْفَرَ رَجُلٌ رَجُلًا إِلَّا بَاءَ أَحَدُهُمَا بِهَا إِنْ كَانَ كَافِراً وَإِلَّا كُفِّرَ بِتَكْفِيْرِهِ
“যে কোনো মানুষ যদি অন্য কাউকে কাফির বলে গণ্য করে তবে দুজনের একজনের উপর তা বর্তাবে। যদি সে কাফির হয় তবে ভাল, নইলে তাকে কাফির ঘোষণা করার কারণে কাফির ঘোষণাকারীই কাফির হয়ে যাবে।”4ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১/৪৮৩।
সাবিত ইবনু দাহহাক রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
مَنْ رَمَى مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهُوَ كَقَتْلِهِ
“যদি কেউ কোনো মুমিনকে কুফরীতে অভিযুক্ত করে তবে তা তাকে হত্যা করার মতই অপরাধ হবে।”5বুখারী, আস-সহীহ ৫/২২৪৭, ২২৬৪।
এই অর্থে অন্যান্য সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। একই অর্থে ৮/১০ জন সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে হাদীস বর্ণিত হওয়া প্রমাণ করে যে, এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়শ তাঁর সাহাবীগণকে সতর্ক করতেন।
মক্কা বিজয়ের পূর্বে
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীগণকে যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু কোন্ দিকে রওয়ানা দিবেন বা কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন তা কিছুই বলেন না। তার উদ্দেশ্য ছিল যথাসম্ভব কম রক্তপাতে পবিত্র মক্কা বিজয় সম্পন্ন করা। সাহাবী হাতিব ইবনু আবী বালতা‘আ বুঝতে পারেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা অভিমুখে রওয়ানা দিবেন। তিনি মক্কার কাফিরদেরকে এ বিষয়ে সংবাদ দিয়ে চিঠি লিখেন।
এ বিষয়ে আলী রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমি, যুবাইর ও মিকদাদ-তিনজনকে বললেন, দ্রুত রাওদা খাখ-এ চলে যাও। সেখানে একজন মহিলা যাত্রী পাবে। তার কাছে একটি পত্র আছে। তোমরা পত্রটি নিয়ে আসবে। আমরা তথায় গিয়ে মহিলাকে পেলাম। তাকে বললাম চিঠিটি দাও। সে বলল, আমার কাছে কোনো চিঠি নেই। আমরা বললাম, তুমি যদি চিঠিটি না দাও তবে আমরা তোমাকে উলঙ্গ করে তল্লাশি করব।
তখন মেয়েটি তার খোপার ভিতর থেকে চিঠিটি বের করে দিল। চিঠিটি ছিল হাতিবের পক্ষ থেকে মক্কার কাফিরদেরেকে লিখা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হাতিব, এ কী? হাতিব বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি একটু ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনুন। আমি কুরাইশ বংশের লোক নই, তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মক্কায় ছিলাম।
মক্কা থেকে হিজরত করে
আসলেও আমার পরিজন তথায় বাস করছে। আপনার কুরাইশ সাহাবীগণের কাফির আত্মীয়স্বজনেরা তাদের ধনসম্পদ ও পরিজনদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কিন্তু আমার কেউ নেই। আমি চেয়েছিলাম এই খবর প্রদানের মাধ্যমে মক্কার কাফিরদের একটু উপকার করতে। যেন তারা আমার পরিবারের দিকে লক্ষ রাখে। আমি কুফরীর কারণে, ধর্মত্যাগ করতে বা কাফিরদের কুফরীতে সন্তুষ্টির কারণে আমি এ কাজ করিনি।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হাতিব তোমাদেরকে সত্য কথাই বলেছে। তখন উমার রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিককে হত্যা করি। তিনি বলেন, হাতিব বদরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আর সম্ভবত আল্লাহ বদরবাসীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলেছেন, তোমরা যা চাও কর, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছি।”6বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৯৫; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৪১।
এখানে হাতিবের কাজ বাহ্যত ইসলামের বিরুদ্ধে কাফিরদের বিজয়ের জন্য ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা এবং কুফর। এজন্যই উমার তাঁকে মুনাফিক বলেছেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত না দিয়ে তাঁর কাছে এ কাজের ব্যাখ্যা চেয়েছেন এবং তাঁর ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছেন।
অন্য হাদীসে
আবূ হুরাইরা রাদিআল্লাহ আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَسْرَفَ رَجُلٌ عَلَى نَفْسِهِ فَلَمَّا حَضَرَهُ الْمَوْتُ أَوْصَى بَنِيهِ فَقَالَ إِذَا أَنَا مُتُّ فَأَحْرِقُونِي ثُمَّ اسْحَقُونِي ثُمَّ اذْرُونِي فِي الرِّيحِ فِي الْبَحْرِ فَوَاللهِ لَئِنْ قَدَرَ عَلَيَّ رَبِّي لَيُعَذِّبُنِي عَذَابًا مَا عَذَّبَهُ بِهِ أَحَدًا قَالَ فَفَعَلُوا ذٰلِكَ بِهِ فَقَالَ لِلأَرْضِ أَدِّي مَا أَخَذْتِ فَإِذَا هُوَ قَائِمٌ فَقَالَ لَهُ مَا حَمَلَكَ عَلَى مَا صَنَعْتَ فَقَالَ خَشْيَتُكَ يَا رَبِّ أَوْ قَالَ مَخَافَتُكَ فَغَفَرَ لَهُ بِذٰلِكَ
“এক ব্যক্তি জীবনভর সীমালঙ্ঘন ও পাপে লিপ্ত থাকে। যখন তার মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয় তখন সে তার পুত্রদেরকে ওসিয়ত করে বলে: আমার মৃত্যু হলে তোমরা আমাকে আগুনে পুড়াবে। এরপর আমাকে বিচুর্ণ করবে। এরপর ঝড়ের মধ্যে আমাকে (আমার দেহের বিচুর্ণিত ছাই) সমূদ্রের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে। কারণ, আল্লাহর কসম, যদি আমার প্রতিপালক আমাকে ধরতে সক্ষম হন। তবে আমাকে এমন শাস্তি দিবেন যে শাস্তি তিনি অন্য কাউকে দেননি।
তার সন্তানগণ তার ওসিয়ত অনুসারে কর্ম করে। তখন আল্লাহ যমিনকে নির্দেশ দেন যে, যা সে গ্রহণ করেছে তা ফেরৎ দিতে। তৎক্ষণাৎ লোকটি পুনর্জীবিত হয়ে তাঁর সামনে দ-ায়মান হয়ে যায়। তখন তিনি লোকটিকে বলেন: তুমি এরূপ করলে কেন? লোকটি বলে: হে আমার প্রতিপালক, আপনার ভয়ে। তখন তিনি তাকে এজন্য ক্ষমা করে দেন।”7বুখারী, আস-সহীহ ৩/১২৮৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২১১০।
এখানে আমরা দেখি যে, এ ব্যক্তি একটি কুফরী বিশ্বাস পোষণ করেছে। সে ধারণা করেছে যে, তার দেহ এভাবে পুড়িয়ে ছাই করে সমূদ্রে ছড়িয়ে দিলে মহান আল্লাহ তাকে আর পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন না এবং শাস্তিও দিতে পারবেন না। বাহ্যত তার এরূপ ধারণা ছিল অজ্ঞতা প্রসূত। এজন্য তার মধ্যে বিদ্যমান নির্ভেজাল আল্লাহ-ভীতির কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে আমরা দেখি যে, একটি বিশ্বাস সুনিশ্চিত কুফরী হলেও উক্ত বিশ্বাসে লিপ্ত ব্যক্তিকে কাফির বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তাকফীরের মূলনীতি
কুরআন-হাদীসের এ সকল নির্দেশনার আলোকে সাহাবীগণ এবং তাদের অনুসারী আহলুস সুন্নাতের আলিমগণ ঈমানের দাবিদার কাউকে কাফির বলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। তাদের মূলনীতি হলো, মুমিন নিজের ঈমানের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন। সকল কুফর, র্শিক, পাপ ও ইসলাম বিরোধী চিন্তাচেতনা থেকে সতর্কতার সাথে আত্মরক্ষা করবেন। কিন্তু অন্যের ঈমানের দাবি গ্রহণ করার বিষয়ে বাহ্যিক দাবির উপর নির্ভর করবেন।
কোনো ঈমানের
দাবিদারকেই কাফির না বলার জন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করবেন। ভুল করে কোনো মু’মিনকে কাফির বলে মনে করার চেয়ে ভুল করে কোনো কাফির-মুশরিককে মুসলিম মনে করা অনেক অনেক ভাল ও নিরাপদ। প্রথম ক্ষেত্রে কঠিন পাপ ও নিজের ঈমান নষ্ট হওয়ার ভয় রয়েছে। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কোনোরূপ পাপ বা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এ নীতির ভিত্তিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছেন। তাঁকে কোনো পাপের কারণে ‘অমুসলিম’, কাফির বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা যাবে না। তিনি তাঁর পাপ থেকে তাওবা করুন, অথবা নাই করুন। যতক্ষণ না তিনি সুষ্পষ্টভাবে ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী কোনো বিশ্বাস পোষণ করার ঘোষণা দিবেন। ইসলামী আইন লঙ্ঘনকারী, বা আল্লাহর নির্দেশ অমান্যকারী মুসলিম পাপী মুসলিম বলে গণ্য হবেন।
কখনোই তাকে পাপের কারণে ‘অমুসলিম’ বা ধর্মত্যাগী বলে গণ্য করা হবে না। তবে যদি তাঁর এই পাপ বা অবাধ্যতাকে তিনি বৈধ মনে করেন বা ইসলামী বিধানকে বাজে, ফালতু, অচল বা অপালনযোগ্য বলে মনে করেন। বা ইসলামের কিছু বিধান পরিত্যাগ করেও ভাল মুসলিম হওয়া যায় বলে মনে করেন তবে তা কুফরী বা ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হবে।
ঈমানের দাবিদার জেনে শুনে কুফরী করবেন না বলেই ধরে নিতে হবে। কারো কথা বা কর্ম বাহ্যত কুফরী হলেও যদি তার কোনোরূপ ইসলামসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া যায় তবে দূরবর্তী হলেও ইসলামী ব্যাখ্যা গ্রহণ করে তাকে মুমিন বলে মেনে নিতে হবে। সর্বোপরি ঈমানের দাবিদার কোনো ব্যক্তি যদি সুস্পষ্ট কোনো কুফরী বা র্শিকী কাজে লিপ্ত হয়। তবে তার কর্মকে কুফরী বলা হলেও ব্যক্তিগতভাবে তাকে কাফির বলার আগে এ বিষয়ে তার কোনো ওযর আছে কিনা তা জানতে হবে। সেই ব্যক্তি অজ্ঞতা, ভয় বা অন্য কোনো ওজরের কথা উল্লেখ করলে তা গ্রহণ করা হবে। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের দৃষ্টিতে এ হলো ইসলামের অন্যতম মূলনীতি।
ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
ولا نكفر مسلما بذنب من الذنوب وإن كانت كبيرة إذا لم يستحلها، ولا نزيل عنه اسم الإيمان، ونسميه مؤمنا حقيقة ويجوز أن يكون مؤمنا فاسقا غير كافرا.
“আমরা কোনো মুসলিমকে কোনো পাপের কারণে কাফির বলি না, যদিও তা কোনো কবীরা গোনাহ হয়, যতক্ষণ না সে পাপটিকে হালাল বলে বিশ্বাস করে। আমরা পাপের কারণে কোনো মুসলিমের ‘ঈমান’-এর নাম অপসারণ করি না। বরং আমরা তাকে প্রকৃতই মুমিন বলে আখ্যায়িত করি, সে কাফির না হয়ে একজন পাপী মুমিন হতে পারে।”8মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ১১৭।
ইমাম তাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন:
“আমাদের কিবলাপন্থীদের ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা মু’মিন বলে আখ্যায়িত করব যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা স্বীকার করবে এবং তিনি যা কিছু বলেছেন সব সত্য বলে বিশ্বাস ও গ্রহণ করবে।… যেসব বিষয় ঈমানের অন্তর্ভুক্ত করেছে, এমন কোনো বিষয় অস্বীকার না করলে, সে ঈমানের গণ্ডি হতে বের হয় না।”9আবূ জাফর তাহাবী, মাতনুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৪।
এ প্রসঙ্গে মোল্লা আলী কারী রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, ‘আহলু কিবলা’ বলতে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলি যারা মেনে নিয়েছেন তাদেরকে বুঝানো হয়। তাওহীদ, রিসালাত, আরকানুল ঈমান ও আনুষঙ্গিক সকল বিষয় যা কুরআন কারীমে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে, মুসলিম উম্মাহর সকল আলিম যে বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন বা যে বিষয়টি মুসলিম উম্মার মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ এরূপ কোনো বিষয় যদি কেউ অস্বীকার করেন বা অবিশ্বাস করেন তবে তাকে ‘আহলু কিবলা’ বলা হয় না।
যেমন তাওহীদুর রুবূবিয়্যাত অস্বীকার করা, তাওহীদুল উলূহিয়্যাত অস্বীকার করা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রিসালাতের সার্বজনীনতা বা খাতমুন নুবুওয়াত অস্বীকার করা। কাউকে কোনো পর্যায়ে তাঁর শরীয়তের ঊর্ধ্বে বলে বিশ্বাস করা, আখিরাত অস্বীকার করা ইত্যাদি। এরূপ অবিশ্বাসে লিপ্ত ব্যক্তি যদি আজীবন কা‘বা শরীফের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেন বা ইসলামের অন্যান্য বিধান পালন করেন তবে তাকে ‘আহলু কিবলা’ বলা হবে না। কারণ তিনি ঈমানই অর্জন করেননি, কাজেই তার ইসলাম বা কিবলামুখী হওয়া বাতিল ও অর্থহীন।
এছাড়া তিনি উল্লেখ করেছেন যে, কোনো মুমিন মুসলিম যদি এমন কোনো কর্মে লিপ্ত হয়, বা কথা বলে যা কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশ অনুসারে কুফ্র বা র্শিক বলে গণ্য। তবে তার কর্মকে অবশ্যই র্শিক বা কুফর বলা হবে, তবে ‘ব্যক্তিগতভাবে’ উক্ত ব্যক্তিকে কাফির বা মুশরিক বলার আগে দেখতে হবে। যে, অজ্ঞতা, ব্যাখ্যা, ভুল বুঝা বা এজাতীয় কোনো ওযর তার আছে কি না।10মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৭-২৬২।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহিমাহুল্লাহ, বই: ইসলামী আকীদা, পৃ. ৫৭৮-৫৮৪।
যাকাত: গুরুত্ব ও বিধান, আল্লাহর পথের পাথেয় (২), ইসলামের ইতিহাসে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ: একটি পর্যালোচনা, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ: আলোচিত ও অনালোচিত কারণসমূহ, হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচাই: রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশ ও সাহাবীগণের