ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সাবেক চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
ওসীলা বিষয়ক শির্ক
ওসীলা বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা সমাজে বিদ্যমান। ওসীলা কখনো ইসলাম নির্দেশিত বা সুন্নাত—সম্মত কর্ম, কখনো সুন্নাত বহির্ভুত বা সুন্নাতের ব্যতিক্রম কর্ম এবং কখনো তা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে বা উলূহিয়্যাতে শির্কের পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। মহান আল্লাহর কাছে তাঁর মহান গুণাবলি, তাঁর পবিত্র নামসমূহ এবং তাঁর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.—এর প্রতি ঈমানের ওসীলা দিয়ে সকাতরে আর্জি করি যে, তিনি যেন সঠিকভাবে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করার এবং ব্যাখ্যা করার তাওফিক আমাকে প্রদান করেন।
‘ওসীলা’ শব্দটির বিষয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা এর অর্থের পরিবর্তন ও বিবর্তন। ভাষাতত্ত্বের সাথে পরিচিত সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের অর্থের পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটে। সময়ের আবর্তনের কারণে একই ভাষার মধ্যে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটতে পারে। আবার এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় গমনের কারণেও অর্থের পরিবর্তন ঘটে। যেমন বাংলা ভাষায় এক শতাব্দী আগে ‘সন্দেশ’ শব্দটির অর্থ ছিল সংবাদ। কিন্তু বর্তমানে শব্দটির অর্থ বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন। কুরআন—হাদীসে ব্যবহৃত আরবী ভাষায় ‘লাবান’ অর্থ দুধ। কিন্তু বর্তমানে আরব দেশে ‘লাবান’ অর্থ ঘোল।
ভাষান্তরের কারণে অর্থের পরিবর্তন খুবই বেশি। আরবীতে ‘জিন্স’ অর্থ শ্রেণী বা লিঙ্গ, কিন্তু বাংলায় ‘জিনিস’ অর্থ এগুলির কিছুই নয়, বরং বাংলায় এর অর্থ দ্রব্য বা বস্তু। আরবীতে ও ফার্সীতে নেশা বা নাশওয়া অর্থ ‘মাতলামী’ বা মাদকতা। কিন্তু বাংলায় শব্দটির অর্থ মাদকতা হয় আবার অভ্যস্ততাও হয়। একারণে অনেক সময় আমরা অস্পষ্টতার মধ্যে পড়ে যাই। কেউ বলেন, নেশা হারাম। উত্তরে অন্যে বলেন, ভাত, চা ইত্যাদিও তো নেশা? বস্তুত বাংলা ‘নেশা’ বা অভ্যস্ততা হারাম নয়, বরং ফার্সী নেশা বা মাতলামী ও মাদকতা হারাম। অভ্যস্ততা হারাম বা হালাল হবে অভ্যাসের বিষয়ের বিধান অনুসারে, আর মাদকতা সর্বাবস্থায় হারাম।
কুরআন ও হাদীসের ভাষায় ওসীলা
‘ওসীলা’ শব্দটির অর্থের মধ্যে এরূপ বিবর্তন ঘটার কারণে এ বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে। ফলে সুন্নাত ও ইসলাম সম্মত ব্যবহার থেকে ওসীলা শব্দটি কখনো কখনো শির্কের পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।
কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত প্রাচীন আরবী ভাষায় ওসীলা শব্দের অর্থ নৈকট্য। পরবর্তীকালে আরবী ভাষাতেই ওসীলা শব্দটির অর্থ হয় ‘যদ্বারা নৈকট্য চাওয়া হয়’ বা ‘নৈকট্যের উপকরণ’। আধুনিক যুগে আরবীতে এবং বিশেষ করে বাংলায় ওসীলা শব্দটি ‘উপকরণ’, মধ্যস্থতা, যন্ত্র, হাতিয়ার, দূত ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থের পরিবর্তনের কারণে শব্দটির বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে।
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবনু ফারিস [৩৯৫ হি.] বলেন: “ওয়াও, সীন ও লাম: দুটি পরস্পর বিরোধী অর্থ প্রকাশ করে: প্রথম অর্থ: আগ্রহ ও তালাশ।… দ্বিতীয় অর্থ চুরি করা।”((ইবনু ফারিস, মু‘জামুু মাকায়ীসুল লুগাত ৬/১১০।))
প্রসিদ্ধ মুফাস্সির ও ভাষাবিদ রাগিব ইসপাহানী [৫০৭ হি.] বলেন: “ওসীলা: অর্থ আগ্রহের সাথে কোনো কিছুর নিকটবর্তী হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘তোমরা তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর’। আল্লাহর দিকে ওসীলার হাকীকাত হলো ইলম ও ইবাদতের মাধ্যমে এবং শরীয়তের মর্যাদাময় বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় প্রতিষ্ঠিত থাকা। এ হলো নেক আমল বা নৈকট্য।”((রাগিব ইসপাহানী, আল—মুফরাদাত পৃ. ৫২৩—৫২৪।))
আমরা ইতোপূর্বে তৃতীয় অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ সা.—এর মর্যাদা বিষয়ক আলোচনায় দেখেছি যে, মহান আল্লাহ তাঁকে ‘ওসীলা’ প্রদান করবেন। স্বভাবতই এখানে ওসীলা অর্থ উপকরণ বা মধ্যস্থতাকারী নয়, বরং ওসীলা অর্থ নৈকট্য। মহান আল্লাহ তাঁকে সর্বোচ্চ নৈকট্য ও নিকটতম মর্তবা প্রদান করবেন।
‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআনে দু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। এক স্থানে আল্লাহ বলেন:
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنْكُمْ وَلا تَحْوِيلا أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
“বল, ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে (ইলাহ) ধারণা কর তাদেরকে আহ্বান কর, তোমাদের দুঃখ—দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহ্বান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য (ওসীলা) সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তার দয়া প্রত্যাশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।”((সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৫৬—৫৭ আয়াত।))
এখানে আরবীজ্ঞাত পাঠক দেখতে পাচ্ছেন যে, ‘তারা ওসীলা সন্ধান করে কে কত নিকটতর’, এ কথাটির মধ্যে প্রথমে ‘ওসীলা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং পরে ‘কুরবাহ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে কুরআনের ব্যবহার থেকেই সুস্পষ্ট যে, ওসীলা ও ‘কুরবাহ’ শব্দদ্বয় সমার্থক এবং ওসীলা সন্ধানের অর্থ নৈকট্য লাভের চেষ্টা।
অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তার নৈকট্য সন্ধান কর এবং তার পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”((সূরা (৫) মায়িদা: ৩৫ আয়াত।))
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু জারীর আত—তাবারী [৩১০ হি.] বলেন:
وابتغوا إليه الوسيلة يقول واطلبوا القربة إليه ومعناه بما يرضيه والوسيلة هي الفعلية من قول القائل توسلت إلى فلان بكذا بمعنى تقربت إليه
“তার দিকে ওসীলা সন্ধান কর। এর অর্থ: তার দিকে নৈকট্য সন্ধান কর,অর্থাৎ যে কর্ম করলে তিনি সন্তুষ্ট হন তা কর। ওসীলা শব্দটি ‘তাওয়াস্সালতু’ কথা থেকে ‘ফায়ীলাহ’ ওযনে গৃহীত ইসম। বলা হয় ‘তাওয়াস্সালতু ইলা ফুলান বি—কাযা, অর্থাৎ আমি অমুক কাজ করে অমুকের নিকটবর্তী হয়েছি।”((তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ৬/২২৬।))
এরপর ইমাম তাবারী বিভিন্ন জাহিলী কবির কবিতা উদ্ধৃৃৃত করে প্রমাণ করেন যে, ওসীলা শব্দটির অর্থ নৈকট্য। অতঃপর তিনি সাহাবী ও তাবিয়ীগণ থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাদের মতামত সনদসহ উদ্ধৃত করেন। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা., তাবিয়ী আবূ ওয়ায়িল, আতা ইবনু আবি রাবাহ, কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ, মুজাহিদ ইবনু জাবর, হাসান বাসরী, আব্দুল্লাহ ইবনু কাসীর, সুদ্দী আল—কাবীর, ইবনু যাইদ, প্রমুখ মুফাস্সির থেকে তিনি উদ্ধৃৃৃত করেছেন যে, সকলেই বলেছেন ‘তার ওসীলা সন্ধান কর’ অর্থ তার নৈকট্য সন্ধান কর, অর্থাৎ তার আনুগত্য ও রেযামন্দিমূলক নেককর্ম করে তার নৈকট্য ও মহব্বত লাভে সচেষ্ট হও।((তাবারী, তাফসীর ৬/২২৬—২২৭ ও ১৫/১০৪—১০৬।))
এ আয়াতটি মূলত মুমিনের সফলতার মূল কর্মগুলি বর্ণনা করেছে: (১) ঈমান, (২) তাকওয়া, (৩) অতিরিক্ত নেককর্ম ও (৪) জিহাদ। নিজের প্রতি মুমিনের দায়িত্ব ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে মূল বেলায়াত অর্জন করা। তাকওয়া মূলত ফরয পালন ও হারাম বর্জনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এরপর অতিরিক্ত নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে প্রতিযোগিতা করতে হবে। সর্বোপরি সমাজ, জাতি ও মানবতার জন্য দীন প্রচার, প্রসার, সংরক্ষণ ও জিহাদ করতে হবে। ইতোপূর্বে আমরা বেলায়াত সংক্রান্ত হাদীসে বিষয়টি দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে মূল বেলায়াত লাভ হয়। আর অনবরত নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর বেলায়াত, নৈকট্য বা ওসীলা লাভের বা মাহবূবিয়্যাত অর্জনের ক্ষেত্রে মুমিনগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়।
উপরের বিষয়গুলি খুবই স্পষ্ট এবং এ অর্থে বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য বা ওসীলা সন্ধান করা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু পরবর্তীকালে, ওসীলা শব্দটি আরো কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন মতভেদ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সেগুলির অন্যতম: (১) দু‘আর মধ্যে ‘ওসীলা’, (২) পীর—মাশাইখের ‘ওসীলা’ ও (৩) উপকরণ বা মধ্যস্থতাকারী অর্থে ওসীলা।
দু‘আর মধ্যে ওসীলা
মহান আল্লাহর কাছে দু‘আর সময় কোনো কিছুর ‘দোহাই’ দেওয়াকে ‘ওসীলা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। দু‘আর মধ্যে ‘বা’ (الباء) অব্যয়টি ব্যবহার করে দু‘আ চাওয়া বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে। এ অব্যয়টির অর্থ দ্বারা, সাহায্যে বা কারণে। যেমন হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দু‘আয় বলা হয়েছে: হে আল্লাহ, আপনার মহান নামগুলির দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন। আমি আপনার নামগুলি দ্বারা আপনার কাছে দু‘আ করছি। আমার অমুক কর্মের দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন… ইত্যাদি। তবে এ অর্থে “হে আল্লাহ, অমুকের ওসীলায় (بوسيلة) কথাটি কোনো হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। এ অর্থে আরবীতে ‘বিহাক্কি’ (بِحق) অর্থাৎ “অমুক কর্ম বা ব্যক্তির অধিকারের কারণে বা দ্বারা’ এবং ‘বিহুরমাতি’ অর্থাৎ “অমুকের সম্মানে’ কথাও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ হিসেবে এক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় কোনো কিছুর দোহাই বা বা ওসীলা দেওয়া কয়েকভাবে হতে পারে:
(১) মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া।
(২) নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দেওয়া।
(৩) কারো দু‘আর দোহাই দেওয়া।
(৪) কারো ব্যক্তিগত মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া।
প্রথমত: মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া
যেমন বলা যে, হে আল্লাহ, আপনার রহমান নামের গুণে, বা গাফ্ফার নামের ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। এরূপ দোহাই দেওয়া কুরআন— হাদীসের নির্দেশ এবং দু‘আ কবুল হওয়ার কারণ। মহান আল্লাহ বলেন:
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا
“এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে।”((সূরা (৭) আ‘রাফ: ১৮০।))
আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন:
إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ
“আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, ১০০’র একটি কম, যে ব্যক্তি এই নামগুলি সংরক্ষিত রাখবে বা হিসাব রাখবে (মুখস্থ রাখবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”((বুখারী, আস—সহীহ ২/৯৮১; মুসলিম, আস—সহীহ ৪/২০৬৩।))
রাসূলুল্লাহ সা.—এর শেখানো মাসনূন দু‘আগুলি পাঠ করলে আমরা সেগুলির মধ্যে এরূপ অনেক দু‘আ পাই, যাতে আল্লাহর পবিত্র নাম বা গুণাবলির দোহাই দিয়ে দু‘আ করতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরূপ বিশেষ নাম বা গুণাবলির দোহাই দিয়ে দু‘আ করলে দু‘আ কবুল হবে বলে বিশেষভাবে উলেস্নখ করা হয়েছে। যেমন এরূপ একটি দু‘আয় রাসূলুল্লাহ সা. শিখিয়েছেন:
أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ…
আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার সকল নাম ধরে বা নামের ওসীলা দিয়ে, যে নামে আপনি নিজেকে ভূষিত করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি গাইবী জ্ঞানে আপনার একান্ত নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন (সকল নামের ওসীলায় আমি আপনার কাছে চাচ্ছি যে,)…।((ইবনু হিব্বান, আস—সহীহ ৩/২৫৩, হাকিম, আল—মুসতাদরাক ১/৬৯০, আহমদ, আল—মুসনাদ ১/৩৯১, ৪৫২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩৬, ১৮৬।))
আমার লেখা ‘রাহে বেলায়াত’ পুস্তকে পাঠক এরূপ অনেক মাসনূন দু‘আ দেখতে পাবেন।
দ্বিতীয়ত, নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দেওয়া
নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই বা ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করলে কবুল হয় বলে হাদীস শরীফে উলেস্নখ করা হয়েছে। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, অতীত যুগের তিনজন মানুষ বিজন পথে চলতে চলতে বৃষ্টির কারণে এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রবল বর্ষণে একটি বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে গুহাটি তাদের জীবন্ত কবরে পরিণত হয়। এ ভয়ানক বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তারা দু‘আ করতে মনস্থ করেন। তারা একে অপরকে বলেন:
ادْعُوا اللَّهَ بِأَفْضَلِ عَمَلٍ عَمِلْتُمُوهُ
“জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ যে আমল করেছ তদ্বারা (তার ওসীলা দিয়ে) আল্লাহর কাছে দু‘আ কর বা তার দোহাই দিয়ে আল্লাহকে ডাক।”
তখন তাদের একজন তার জীবনে সন্তানদের কষ্ট উপেক্ষা করে পিতামাতার খেদমতের একটি ঘটনা উলেস্নখ করে বলেন:
اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً نَرَى مِنْهَا السَّمَاءَ
“হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে আপনি পাথরটি একটু সরিয়ে দিন যেন আমরা আকাশ দেখতে পাই।”
মহান আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তার দু‘আ কবুল করে পাথরটি একটু সরিয়ে দেন। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁর এক সুন্দরী প্রেমিকার সাথে ব্যভিচারের সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর ভয়ে পাপ পরিত্যাগ করার একটি ঘটনা উলেস্নখ করে বলেন:
فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً
“হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি আরেকটু সরিয়ে দিন।”
মহান আল্লাহ তার দু‘আ কবুল করেন এবং পাথরটি দু—তৃতীয়াংশ সরে যায়। তখন তৃতীয় ব্যক্তি নিজের অসুবিধা ও স্বার্থ নষ্ট করে একজন শ্রমিকের বেতন ও আমানত পরিপূর্ণরূপে আদায়ের একটি ঘটনা উলেস্নখ করে বলেন,
اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا
“হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি সরিয়ে দিন।”
আল্লাহ তাদের দু‘আ কবুল করেন এবং পাথরটি একেবারে সরে যায়।((বুখারী, আস—সহীহ ২/৮২১, ৩/১২৭৮, ৫/২২২৮; মুসলিম, আস—সহীহ ৪/২০৯৯।))
নিজের ঈমান, মহব্বত ইত্যাদির ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়াও এ প্রকারের ওসীলা প্রদান। বুরাইদাহ আসলামী রা. বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সা.—এর সাথে মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন এক ব্যক্তি সালাতরত অবস্থায় দু‘আ করছে নিম্নের কথা দিয়ে:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
“হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, এ ওসীলায় (এদ্বারা) যে, আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, আপনিই আল্লাহ, আপনি ছাড়া কোনো মা‘বুদ নেই। আপনিই একক, অমুখাপেক্ষী, যিনি জন্মদান করেননি ও জন্মগ্রহণ করেননি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।”
তখন রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَدْ سَأَلَ اللَّهَ بِاسْمِهِ الأَعْظَمِ الَّذِي إِذَا دُعِيَ بِهِ أَجَابَ وَإِذَا سُئِلَ بِهِ أَعْطَى
“যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, নিশ্চয় এই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তার ইসমু আ‘যম ধরে প্রার্থনা করেছে, যে নাম ধরে ডাকলে তিনি সাড়া দেন এবং যে নাম ধরে চাইলে তিনি প্রদান করেন।”((তিরমিযী, আস—সুনান ৫/৫১৫; আবূ দাউদ, আস—সুনান ২/৭৯; ইবনু মাজাহ, আস—সুনান ২/১২৬৭; ইবনু হিব্বান, আস—সহীহ ৩/১৭৪, হাকিম, আল—মুসতাদরাক ১/৬৮৩, ৬৮৪, আলবানী, সহীহ সুনানুত তিরমিযী ৩/১৬৩। হাদীসটি সহীহ।))
>এখানে আমরা দেখছি যে, ঈমান ও শাহাদতের ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া হয়েছে। বিভিন্নভাবে এরূপ দু‘আ করা যায়, যেমন: “হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমি অমুক কর্মটি আপনার সন্তুষ্টির জন্য করেছিলাম, সেই ওসীলায় আমার প্রার্থনা কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমার কোনো উলেস্নখযোগ্য নেক আমল নেই যে, যার ওসীলা দিয়ে আমি আপনার পবিত্র দরবারে দু‘আ চাইব। শুধুমাত্র আপনার হাবীব নবীয়ে মুস্তাফা সা.—এর নামটি ঈমান নিয়ে মুখে নিয়েছি, এর ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। হে আলস্নাহ, আমার কিছুই নেই, শুধুমাত্র আপনার নবীয়ে আকরাম সা.—এর সুন্নাতের মহব্বতটুকু হৃদয়ে আছে, সেই ওসীলায় আমাকে ক্ষমা করুন, আমার দু‘আ কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমি কিছুই আমল করতে পারি নি, তবে আপনার পথে অগ্রসর ও আমলকারী নেককার বান্দাদেরকে আপনারই ওয়াস্তে মহব্বত করি, তাদের পথে চলতে চাই, আপনি সেই ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন…।” ইত্যাদি।
তৃতীয়ত: কারো দু‘আর দোহাই দেওয়া
কারো দু‘আর ওসীলা দেওয়ার অর্থ এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ, অমুক আমার জন্য দু‘আ করেছেন, আপনি আমার বিষয়ে তার দু‘আ কবুল করে আমার হাজত পূরণ করে দিন। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, নেককার মুত্তাকী মুমিনদের নিকট দু‘আ চাওয়া সুন্নাতসম্মত রীতি। এরূপ কারো নিকট দু‘আ চাওয়ার পরে মহান আল্লাহর দরবারে উক্ত নেককার ব্যক্তির দু‘আর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার বিষয়টি একটি হাদীস থেকে জানা যায়। উসমান ইবনু হানীফ রা. বলেন,
أَنَّ رَجُلا ضَرِيرَ الْبَصَرِ أَتَى النَّبِيَّ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يُعَافِيَنِي قَالَ إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ وَإِنْ شِئْتَ صَبَرْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ قَالَ فَادْعُهْ قَالَ فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ فَيُحْسِنَ وُضُوءَهُ (فيحسن ركعتين) وَيَدْعُوَ بِهَذَا الدُّعَاءِ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، (يا محمد) إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ (يا محمد إني أَتَوَجَّهُ بِكَ إلى اللهِ أَنْ يَقْضِيَ حَاجَتِيْ) (فَيُجْلِيْ لِيْ عَنْ بَصَرِي) اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ (وشَفِّعْنِي فِيْهِ) (اللهم شَفِّعْهُ فِيَّ وَشَفِّعْنِيْ فِيْ نَفْسِيْ)
“একজন অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.—এর নিকট আগমনে করে বলে, আমার জন্য দু‘আ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করেন। তিনি বলেন: তুমি যদি চাও আমি দু‘আ করব, আর যদি চাও তবে সবর কর, সেটাই তোমার জন্য উত্তম। লোকটি বলে: আপনি দু‘আ করুন। তখন তিনি তাকে নির্দেশ দেন, সে যেন সুন্দর করে ওযূ করে (অন্য বর্ণনায়: এবং দু রাকাত সালাত আদায় করে) এবং এই দু‘আ করে: “হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার নবী মুহাম্মাদের দ্বারা, যিনি রহমতের নবী, হে মুহাম্মাদ, আমি মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার দ্বারা আমার প্রতিপালকের দিকে আমার এ প্রয়োজনটির বিষয়ে, যেন তা মেটানো হয়। (অন্য বর্ণনায়: যেন তিনি তা মিটিয়ে দেন, যেন তিনি আমার দৃষ্টি প্রদান করেন)। হে আল্লাহ আপনি আমার বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করুন (অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং তাঁর জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং আমার বিষয়ে আমার নিজের সুপারিশও কবুল করুন)।”((তিরমিযী, আস—সুনান ৫/৫৬৯; হাকিম, আল—মুসতাদরাক ১/৭০০, ১/৭০৭; নাসাঈ, আস—সুনানুল কুবরা ৬/১৬৮—১৬৯। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ গরীব। হাকিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।))
এ হাদীসে অন্ধ লোকটি রাসূলুল্লাহ সা.—এর নিকট দু‘আ চেয়েছে। তিনি দু‘আ করেছেন এবং তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর দু‘আর ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে নিজে দু‘আ করতে। লোকটি সেভাবে দু‘আ করেছে। তিরমিযীর বর্ণনায় দু‘আর ফলাফল উলেস্নখ করা হয় নি। তবে অন্যান্য সকল বর্ণনায় রাবী বলেন যে, দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন এবং লোকটি তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ ফিরে পায়, যেন সে কখনোই অন্ধ ছিল না।
অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক রা. বলেন:
إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ كَانَ إِذَا قَحَطُوا اسْتَسْقَى بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ
“উমার রা. যখন অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত হতেন তখন আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে রা. দিয়ে বৃষ্টির দু‘আ করাতেন, অতঃপর বলতেন: হে আল্লাহ আমরা আমাদের নবী সা.—এর ওসীলায় আপনার নিকট প্রার্থনা করতাম ফলে আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আমাদের নবী সা.—এর চাচার ওসীলায়, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। আনাস বলেন, তখন বৃষ্টিপাত হত।”((বুখারী, আস—সহীহ ১/৩৪২, ৩/১৩৬০।))
আব্বাস রা. নিম্নের বাক্যগুলি বলে দু‘আ করলে আল্লাহ বৃষ্টি দিতেন:
اللهم إنه لم ينزل بلاء إلا بذنب ولم يكشف إلا بتوبة وقد توجه القوم بي إليك لمكانى من نبيك وهذه أيدينا إليك بالذنوب ونواصينا إليك بالتوبة فاسقنا الغيث
“হে আল্লাহর, পাপের কারণ ছাড়া বালা—মুসিবত নাযিল হয় না এবং তাওবা ছাড়া তা অপসারিত হয় না। আপনার নবীর সাথে আমার সম্পর্কের কারণে মানুষেরা আমার মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। এ আমাদের পাপময় হাতগুলি আপনার দিকে প্রসারিত এবং আমাদের ললাটগুলি তাওবায় আপনার নিকট সমর্পিত, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।”((ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ২/৪৯৭।))
এ হাদীসেও স্পষ্ট যে, আব্বাস রা. বৃষ্টির জন্য দু‘আ করেছেন উমার রা. আব্বাসের রা. দু‘আর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করেছেন। তাঁর কথা থেকে বুঝা যায় যে, যতদিন রাসূলুল্লাহ সা. জীবিত ছিলেন, ততদিন খরা বা অনাবৃষ্টি হলে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সা.—এর কাছে দু‘আ চাইতেন এবং সে দু‘আর ওসীলায় আল্লাহ তাদের বৃষ্টি দান করতেন। তাঁর ওফাতের পরে যেহেতু আর তাঁর কাছে দু‘আ চাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু তাঁর চাচা আব্বাসের রা. কাছে দু‘আ চাচ্ছেন এবং দু‘আর ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন।
চতুর্থত: কোনো ব্যক্তি, তাঁর মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া
আল্লাহর কাছে দু‘আ করার ক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ বা দোহাই দেওয়ার চতুর্থ পর্যায় হলো, কোনো ব্যক্তির, বা তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দেওয়া। যেমন জীবিত বা মৃত কোনো নবী—ওলীর নাম উল্লেখ করে বলা: হে আল্লাহ অমুকের ওসীলায়, বা অমুকের মর্যাদার ওসীলায় বা অমুকের অধিকারের ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। এরূপ দু‘আ করার বৈধতার বিষয়ে আলিমদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। অনেক আলিম এরূপ দু‘আ করা বৈধ বলেছেন। তাঁরা সাধারণভাবে উপরের দুটি হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন। বিশেষত তাবারানী ও বাইহাকী অন্ধ ব্যক্তির হাদীসটির প্রসঙ্গে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাদের বর্ণনার সার—সংক্ষেপ যে, খলীফা উসমান রা.—এর সময়ে এক ব্যক্তি তাঁর দরবারে একটি প্রয়োজনে যায়। কিন্তু খলীফা তার প্রতি দৃকপাত করেন না। লোকটি উসমান ইবনু হানীফের রাহ. নিকট গমন করে তাকে খলীফা উসমানের নিকট তার জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করে। তখন উসমান ইবনু হানীফ লোকটিকে অন্ধ লোকটিকে রাসূলুল্লাহ সা. যে দু‘আটি শিখিয়েছিলেন সে দু‘আটি শিখিয়ে দেন। লোকটি এভাবে দু‘আ করার পরে খলীফা উসমান রা. তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন।((তাবারানী, আল—মু‘জামুল কাবীর ৯/৩০; আল—মু‘জামুস সাগীর ১/৩০৬; বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ৬/৩৫৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৭৯। এ বর্ণনাটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে আপত্তি ও মতপার্থক্য আছে।))
এ থেকে বুঝা যায় যে, শুধু রাসূলুল্লাহ সা.—এর দু‘আর ওসীলাই নয়, উপরন্তু তাঁর ইন্তিকালের পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া বৈধ। রাসূলুল্লাহ সা. ছাড়া অন্য কোনো ফিরিশতা, নবী, সাহাবী, তাবিয়ী বা ওলী—আল্লাহর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনো কথা কোনো হাদীসে বা সাহাবী—তাবিয়ীগণের বক্তব্যে পাওয়া যায় না। তবে এ মতের আলিমগণ সকলকেই রাসূলুল্লাহ সা.—এর মত ও তাঁর সাথে তুলনীয় ধরে এরূপ যে কারো নামের ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ চাওয়া জায়েয বলেছেন।
কোনো কোনো আলিম কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ সা.—এর ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা জায়েয বলেছেন। অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া নাজায়েয বলেছেন। তাঁদের মতে, কারো মৃত্যুর পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করা জায়েয বলার পরে রাসূলুল্লাহ সা. কে বাদ দিয়ে অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ করা তাঁর সাথে বেয়াদবী ছাড়া কিছুই নয়।
পক্ষান্তরে অন্য অনেক আলিম কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির, তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা অবৈধ ও নাজায়েয বলে গণ্য করেছেন। তারা বলেন যে, এরূপ কোনো জীবিত বা মৃত কারো ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনোরূপ নযির কোনো সহীহ ও প্রসিদ্ধ হাদীসে বা সাহাবী—তাবিয়ীগণের মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া নবীগণ ও যাদের নাম মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন তাঁরা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে কখনোই বলা যায় না যে, উক্ত ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বা আল্লাহর কাছে তাঁর কোনো বিশেষ মর্যাদা বা অধিকার আছে। সর্বোপরি তাঁরা উপরে উল্লিখিত উমার রা. কতৃর্ক আব্বাসের ওসীলা প্রদানকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। যদি কারো দু‘আর ওসীলা না দিয়ে তাঁর সত্তার ওসীলা দেওয়া জায়েয হত তবে উমার রা. ও সাহাবীগণ কখনোই রাসূলুল্লাহ সা.কে বাদ দিয়ে আব্বাস রা.—এর ওসীলা পেশ করতেন না।
শাহ ওয়ালিউলস্নাহ মুহাদ্দিস দেহলভী তাঁর ‘আল—বালাগুল মুবীন’ গ্রন্থে উমার রা.—এর হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন: “এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা শরীয়ত বিরোধী। যদি শরীয়ত সিদ্ধ হইত হযরত ওমর রা. হুযুর সা.—কে ওসীলা করিয়াই দু‘আ করিতেন। কারণ, মৃত বা জীবিত যে কোন ব্যক্তির চেয়েই হুযুর রা.—এর ফযীলত সীমাহীন—অনন্ত। তাই হযরত ওমর রা. এই কথা বলেন নাই যে, হে আল্লাহ, ইতিপূর্বে তো আমরা তোমার নবীকে ওসীলা করিয়া দু‘আ করিতাম। কিন্তু এখন তিনি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান নাই তাই আমরা তাঁহার রুহু মোবারককে অসিলা করিয়া তোমার কাছে আরযী পেশ করিতেছি। তাই কোন মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা মোটেই বৈধ নহে।”((শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আল—বালাগুল মুবীন, পৃ. ৩১।))
ইমাম আবূ হানীফা রাহ, ইমাম আবূ ইউসূফ রাহ. ও ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. সকলেই একমত যে কারো অধিকার বা মর্যাদার দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ চাওয়া মাকরূহ। আলস্নামা ইবনু আবিল ইয্য হানাফী বলেন:
قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ وَصَاحِبَاهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ: يُكْرَهُ أَنْ يَقُولَ الدَّاعِي: أَسْأَلُكَ بِحَقِّ فُلانٍ، أَوْ بِحَقِّ أَنْبِيَائِكَ وَرُسُلِكَ، وَبِحَقِّ الْبَيْتِ الْحَرَامِ، وَالْمَشْعَرِ الْحَرَامِ، وَنَحْوِ ذَلِكَ
“ইমাম আবূ হানীফা রাহ. ও তাঁর সঙ্গীদ্বয় বলেছেন: ‘আমি অমুকের অধিকার বা আপনার নবী—রাসূলগণের অধিকার, বা বাইতুল হারামের অধিকার বা মাশ‘আরুল হারামের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বা প্রার্থনা করছি’ বলে দু‘আ করা মাকরূহ।”((ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত—তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ২৩৭।))
আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী [৫৮৭ হি.] বলেন:
وَيُكْرَهُ لِلرَّجُلِ أَنْ يَقُولَ فِي دُعَائِهِ أَسْأَلُك بِحَقِّ أَنْبِيَائِك وَرُسُلِك وَبِحَقِّ فُلانٍ لأنَّهُ لا حَقَّ لأحَدٍ عَلَى اللَّهِ…
“আমি আপনার নবী—রাসূলগণের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি এবং অমুকের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বলে দু‘আ করা মাকরূহ; কারণ মহান আল্লাহর উপরে কারো কোনো অধিকার নেই।”((কাসানী, বাদাইউস সানাইয় ৫/১২৬।))
কারো ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা শির্ক নয়; কারণ, এতে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকা হয় না বা দু‘আ করা হয় না; একমাত্র আল্লাহকেই ডাকা হয়। এ বিষয়ক বিতর্ক জায়েয—নাজায়েযের মধ্যে সীমিত। কাজেই শির্ক প্রসঙ্গে আমরা এ বিষয়ক বিতর্কের বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না।
পঞ্চমত: আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওসীলার কাছেই চাওয়া
ওসীলা বিষয়ক চূড়ান্ত শির্ক হলো ওসীলার নামে ওসীলার কাছেই দু‘আ করা বা ত্রাণ, সাহায্য, বিপদমুক্তি ইত্যাদি প্রার্থনা করা। উপরে ওসীলা বলতে যা কিছু বলা হয়েছে তা হলো কারো ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করা। এর বিপরীতে আরেকটি কর্ম হলো, যাকে ওসীলা বলে মনে করা হচ্ছে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সরাসরি তাকেই ডাকা। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট শির্ক। পরবর্তীতে আমরা তা আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।
পীর—মাশাইখের ওসীলা
আমরা উপরে দেখেছি যে, আল্লাহ তাঁর ওসীলা বা নৈকট্য সন্ধান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবী, তাবিয়ী ও পরবর্তী সকল মুফাস্সির একমত যে, নেক আমল হলো ওসীলা, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। প্রায় হাজার বৎসর যাবৎ এ বিষয়ে অন্য কোনো মতামত প্রচারিত হয় নি। এরপর কোনো কোনো আলিম উলেস্নখ করেছেন যে, ‘পীর—মাশাইখ’—ও ওসীলা। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথার প্রেক্ষাপট বুঝা যায়। তাতার আক্রমণে মুসলিম বিশ্ব একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এরপর মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রীয় প্রশাসন, শিক্ষাদীক্ষার উন্নয়ন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে স্থবিরতা আসে। বিশাল মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি রাজধানী বাদ দিলে সর্বত্র অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পূর্ববর্তী বা পার্শ্ববর্তী ধর্মের প্রভাব, বাতিনী শীয়াগণের প্রভাব ইত্যাদি কারণে শির্ক—কুফর প্রবল হয়ে ওঠে। উম্মাতের এ দুর্দিনে সরলপ্রাণ প্রচারবিমুখ সুফী, দরবেশ ও পীর—মাশাইখ আম—জনগণের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা বিস্তারে নিরলস চেষ্টা করে যান। তাঁদের সাহচর্যে যেয়ে মানুষ তাওহীদ, রিসালাত, ঈমান, ইসলাম ও ইসলামের হুকুম আহকাম কমবেশি শিক্ষা লাভ করত এবং আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করত। সাধারণ মানুষদের ঈমান, ইসলাম ও আখলাক গঠনে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিকে লক্ষ্য করে কোনো কোনো আলিম মতামত পেশ করেন যে, পীর—মাশাইখের সাহচর্যও একটি বিশেষ নেক আমল যা মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।
কিন্তু অজ্ঞতার কারণে এবং স্বার্থান্বেষীদের মিথ্যা প্রচারণার কারণে একথাটি ক্রমান্বয়ে শির্কী অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। আরবের মুশরিকগণ যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ফিরিশতা, নবী, ওলী ও অন্যান্য উপাস্যের ইবাদত করত, ঠিক তেমনি অনেকে পীর—মাশাইখের ইবাদত করাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বলে মনে করতে থাকে। কেউ বা ওসীলা বলতে ‘মধ্যস্থতাকারী’ বা উপকরণ বলে মনে করতে থাকে। তারা মনে করতে থাকে যে, পীর—মাশাইখ আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। তাদের মধ্যস্থতা ছাড়া কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি বা রহমত পেতে পারে না। এরূপ অনেক শির্কী ধারণা মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ক ধারণাগুলি নিম্নরূপ:
(১) পীরের সাহচর্যকে আল্লাহর নৈকট্যের একটি ওসীলা মনে করা
এ ধারণাটি মূলত ইসলাম—সম্মত। কুরআন ও হাদীসে নেককার মুমিন—মুত্তাকীগণের সাহচর্য গ্রহণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ওসীলা অর্থ নেক আমল। আর কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুসারে এরূপ মুত্তাকীগণের সাহচর্য গ্রহণ, সাক্ষাত করা এবং আল্লাহর ওয়াস্তে তাদেরকে ভালবাসা এ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেক—আমল বা ওসীলা।
তবে এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, ‘পীর’ বলে কোনো বিশেষ পদমর্যাদা কুরআন ও হাদীসে উলেস্নখ করা হয় নি। বরং আলিম, সত্যবাদী, মুত্তাকী, নেককার, সৎকর্মশীল, ফরয ও নফল ইবাদত পালনকারী, সুন্নাতের অনুসারী ইত্যাদি বিশেষণ উলেস্নখ করা হয়েছে। পীর নামধারী ব্যক্তির মধ্যে যদি এ সকল বাহ্যিক গুণ বিদ্যমান না থাকে তবে তার সাহচর্য গ্রহণ আল্লাহর নৈকট্য নয়, বরং শয়তানের নৈকট্যের অন্যতম ওসীলা, যদিও এরূপ ব্যক্তি পীর, মুরশিদ, ওলী, বা অনুরূপ কোনো নাম ধারণ করে। আর যদি কুরআন—হাদীসে উল্লিখিত উপর্যুক্ত বাহ্যিক গুণাবলি কারো মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তিনি ‘পীর’ নাম ধারণ করুন আর নাই করুন তার সাহচর্য মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভের ওসীলা বলে গণ্য।
কুরআন, হাদীস ও সাহাবী—তাবিয়ীগণের কর্মধারার আলোকে পীর—মুরিদির গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, সুন্নাত—সম্মত পদ্ধতি, ভুল—ধারণা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘এহইয়াউস সুনান’ ও ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে। সম্মানিত পাঠককে পুস্তকদুটি পাঠ করতে সবিনয়ে অনুরোধ করছি।
দ্বিতীয়ত, মূলত মুমিনের নিজের কর্মই তাঁর ওসীলা, অন্য কোনো মানুষ বা তার কর্ম নয়। এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নেককার মানুষদের সাহচর্য গ্রহণই নেককর্ম ও ওসীলা। ইসলামী অর্থে কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির ‘ওসীলা’ হতে পারে না, কেবলমাত্র মুমিনের নিজের কর্মই তার ওসীলা। এমনকি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. কোনো ব্যক্তির জন্য ওসীলা হবেন না যতক্ষণ না সে তাঁর উপর ঈমান গ্রহণ করবে এবং তাঁর শরীয়ত পালন করবে। এক্ষেত্রে মূলত মুমিনের ঈমান ও শরীয়ত পালনই ওসীলা। এর কারণে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে এবং আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর জন্য রাসূলুল্লাহ সা.—এর শাফা‘আত, জান্নাতের সাহচর্য ইত্যাদি নসীব করে দিতে পারেন।
(২) পীরের সাহচর্যকে আল্লাহর নৈকট্যের একমাত্র ওসীলা মনে করা
ওসীলা বিষয়ক বিভ্রান্তিকর ধারণার একটি হলো, পীরের সাহচর্যকে আল্লাহর নৈকট্যলাভের একমাত্র ওসীলা বলে মনে করা। অগণিত নফল মুস্তাহাব নেককর্মের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক—কর্ম হলো নেককার বান্দাদের সাহচর্য গ্রহণ করা। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুসারে ঈমান ও ইসলামের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ইত্যাদি আহকাম মেনে চলাই মূল দীন। নেক—সাহচর্য এ সকল ইবাদত পালনে সহায়ক। সর্বদা কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা, হাদীস, সীরাত, শামাইল পাঠ করা, সাহাবীগণের জীবনী পাঠ করার মাধ্যমেও প্রকৃত সাহচর্য গ্রহণ করা যায়।
(৩) পীরের কর্মকে নিজের ওসীলা বলে মনে করা
এ বিষয়ক অন্য বিভ্রান্তি হলো, পীরের বেলায়াতকে নিজের নাজাতের উপকরণ বলে বিশ্বাস করা। এরূপ বিশ্বাসের কারণে অনেকের ধারণা, আমার নিজের কর্ম যাই হোক না কেন, পীর সাহেব যেহেতু অনেক বড় ওলী, কাজেই তিনি আমাকে পার করিয়ে দিবেন। এরূপ বিশ্বাস কুরআন—হাদীসের নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক। প্রথমত, কে বড় ওলী তা নিশ্চিত জানা তো দূরের কথা কে প্রকৃত ওলী বা কে জান্নাতী তাও নিশ্চিত জানার উপায় নেই। আমরা বাহ্যিক আমলের উপর নির্ভর করে ধারণা পোষণ করি এবং সাহচর্য গ্রহণ করি। দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ সা. বারংবার বলেছেন যে, তাঁর সন্তান, আত্মীয়—স্বজন, সাহাবী বা অন্য কাউকে তিনি আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ত্রাণ করতে পারবেন না। প্রত্যেককে তার নিজের নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নাজাত লাভ করতে হবে। মূলত মুমিনের নিজের কর্মই তার নাজাতের ওসীলা। পীরের সাহচর্য থেকে মুমিন আল্লাহর পথে চলার কর্ম শিক্ষা করবেন, প্রেরণা লাভ করবেন এবং নিজে আমল করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবেন।
এ বিশ্বাসের ভিত্তি হলো যে, মহান আল্লাহ কাউকে শাফা‘আত করার উন্মুক্ত অনুমতি বা অধিকার দিয়েছেন বা দিবেন, তিনি নিজের ইচ্ছামত কাফির—মুশরিক, ফাসিক—খোদাদ্রোহী যাকে ইচ্ছা ত্রাণ করবেন। বস্তুত কারো সুপারিশ আল্লাহ শুনবেনই বা আল্লাহ তাকে ইচ্ছামত সুপারিশ করার অধিকার দিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ক্ষমতায় শির্ক করা। এ বিশ্বাসটি মূলত আরবের মুশরিকদের ‘শাফা‘আত’ বিষয়ক বিশ্বাসের মত।
(৪) ওসীলা অর্থ উপকরণ বলে মনে করা
ওসীলা বিষয়ক আরেকটি বিভ্রান্তি হলো ওসীলা অর্থ উপকরণ বলে মনে করা। আমরা ইতোপূর্বে ওসীলা শব্দটির অর্থ ও তার বিবর্তন আলোচনা করেছি। কুরআনে মুমিনকে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আল্লাহর পথে কোনো অতিরিক্ত উপকরণ তালাশ করতে বলা হয় নি। উপকরণ দু প্রকারের: জাগতিক ও ধর্মীয়। জাগতিক উপকরণ সকলেই জাগতিক জ্ঞানের মাধ্যমে জানে। যেমন ভাত সিদ্ধ হওয়ার উপকরণ পানি ও আগুণ, বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার উপকরণ মাটি, পানি ও আলো। আর ধর্মীয় উপকরণ একমাত্র ওহীর মাধ্যমে জানা যায়। যেমন ওযূ করা সালাত কবুল হওয়ার উপকরণ, ঈমান বিশুদ্ধ হওয়া নেক আমল কবুল হওয়ার উপকরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ও মানুষের উপকার করা রিযক বৃদ্ধির উপকরণ। পীরের সাহচর্য লাভ, মুরীদ হওয়া ইত্যাদি কোনো নেক আমল কবুল হওয়া, দু‘আ কবুল হওয়ার উপকরণ নয়। কারণ কুরআন—হাদীসে কোথাও তা বলা হয় নি। এরূপ ধারণা আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা এবং তা পরবর্তী শির্কী বিশ্বাসগুলির পথ উন্মুক্ত করে।
(৫) পীরকে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী মনে করা
ওসীলা বিষয়ক শির্কী বিশ্বাসের অন্যতম হলো পীরকে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করা। দুভাবে এ বিশ্বাস ‘প্রমাণ’ করা হয়: প্রথমত কুরআনের অর্থ বিকৃত করা এবং দ্বিতীয়ত আরবের মুশরিকদের মত ‘যুক্তি’ পেশ করা। প্রথম পর্যায়ে সরলপ্রাণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করতে এরা সাধারণত বলে থাকে ‘আল্লাহ কুরআনে বলেছেন ওসীলা ধরে তার কাছে যেতে, কাজেই সরাসরি তাকে ডাকলে হবে না। আগে ওসীলা ধরো।’ এভাবে তারা কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করেন। বিকৃতির মূল ভিত্তি ওসীলা শব্দের অর্থের পরিবর্তনের মধ্যে। কুরআনের ভাষায় ওসীলা অর্থ নৈকট্য এবং ওসীলা সন্ধানের অর্থ মুমিনের নিজের নেক কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য সন্ধান। আর এরা বুঝান ওসীলা অর্থ মধ্যস্থতাকারী।
দ্বিতীয় পর্যায়ে এরা যুক্তি দেন যে, পৃথিবীতে যেমন রাজা—বাদশাহর দরবারে যেতে মন্ত্রী বা আমলাদের সুপারিশ, মধ্যস্থতা ও রিকমেন্ডেশন প্রয়োজন, তেমনিভাবে আল্লাহর দরবারেও পীর বা ওলীগণের রিকমেন্ডেশন প্রয়োজন। পীর, বা ওলীর সুপারিশ বা রিকমেন্ডেশন ছাড়া কোনো দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন না। বান্দা যতই আল্লাহকে ডাকুক বা ইবাদত করুক, যতক্ষণ না তা ‘যথাযথ কতৃর্পক্ষের মাধ্যমে’ অর্থাৎ পীরের রিকমেন্ডেশন সহ তার দরবারে যাবে ততক্ষণ তা গ্রহণ করা হবে না। অথবা পৃথিবীর বিচারালয়ে যেমন উকিল—ব্যারিষ্টারের প্রয়োজন হয়, তেমনি আল্লাহর দরবারে পীর ও ওলীগণ উকিল—ব্যারিষ্টারি করে মুরিদ—ভক্তদের পার করে দিবেন। এ জাতীয় ধারণাগুলি সবই আরবের মুশরিকদের বিশ্বাসের অনুরূপ এবং সুস্পষ্ট শির্ক। এ বিষয়ে কুরআন—হাদীসের নির্দেশনা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
(ক) আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, এগুলি সবই আরবের মুশরিকদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই ছিল তাদের সকল শির্কের মূল।
(খ) এ সকল চিন্তা সবই মহান আল্লাহর নামে মিথ্যাচার। মহান আল্লাহ কোথাও ঘুনাক্ষরেও বলেন নি যে, তাঁর কাছে যেতে বা দু‘আ কবুল হতে কখনো কারো সুপারিশ বা রিকমেন্ডেশন লাগবে। বরং বারংবার বলেছেন যে, তিনি বান্দার সবচেয়ে কাছে এবং বান্দা ডাকলেই তিনি শুনেন ও সাড়া দেন।
(গ) জাগতিক রাজা—বাদশাহর দরবারে বাইরের অপরিচিত কেউ গেলে তার জন্য সুপারিশ দরকার হয়, তার নিজের দরবারের বা চাকরদের কেউ গেলে তার জন্য সুপারিশ বা অনুমতির দরকার হয় না, কারণ তিনি নিজেই তাকে ভালভাবে চেনেন। আল্লাহর সকল বান্দাই তার দরবারের আপনজন। কাজেই এক চাকরকে দরবারে যেতে আরেক চাকরের অনুমতি বা সুপারিশ লাগবে কেন?
(ঘ) জাগতিক রাজা—বাদশাহ তার দেশের সবাইকে চেনেন না। যে ব্যক্তি তার দরবারে কিছু প্রার্থনা করতে গিয়েছে সে কি প্রতারক, মিথ্যাবাদী না সত্যবাদী তা তিনি জানেন না। এজন্য তাকে আমলাদের সুপারিশের উপর নির্ভর করতে হয়। মহান আল্লাহ কি এরূপ? কোনো বান্দার বিষয়ে কোনো পীর, ওলী কি মহান আল্লাহর চেয়ে বেশি জানেন?
(ঙ) জাগতিক রাজা—বাদশাহ ক্রোধ—বশত হয়ত প্রজার উপর কঠোরতা করতে পারেন, এক্ষেত্রে মন্ত্রী—আমলাদের সুপারিশ তার ক্রোধ সম্বরণ করতে সাহায্য করে। মহান আল্লাহ কি তদ্রƒপ? মহান আল্লাহর দয়া বেশি না পীর—ওলীগণের দয়া বেশি?
(চ) জাগতিক বিচারালয়ে বিচারক জানেন না যে, সম্পত্তিটি কার পাওনা। উকিল—ব্যারিষ্টার সত্য বা মিথ্যা যুক্তি—তর্ক ও আইনের ধারা দেখিয়ে বিচারককে বুঝাতে চেষ্টা করেন। মহান আল্লাহ কি তদ্রƒপ? উকিল সাহেবরা কি মহান আল্লাহকে অজানা কিছু জানাবেন? নাকি তাকে ভুল বুঝিয়ে মামলা খারিজ করে আনবেন? কুরআন কারীমে আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, উকিল হিসেবে তিনিই যথেষ্ট (كفى بالله وكيلاً)((সূরা (৪) নিসা: ৮১, ২৩২, ১৭১; সূরা (৩৩) আহযাব: ৩, ৪৮।)) এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে উকিল ধরতে নিষেধ করেছেন (ألا تتخذوا من دوني وكيلا)।((সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ২ আয়াত।)) এরপরও কি তাঁর কাছে অন্য কাউকে উকিল ধরার দরকার আছে?
(ছ) মহান আল্লাহকে মানুষের সাথে বা মানবীয় রাজা—বাদশাহদের সাথে তুলনা করা সকল শির্কের মূল। মহান আল্লাহর প্রতি কুধারণা ছাড়া এগুলি কিছুই নয়।
(৬) মধ্যস্থতাকারীকে উলূহিয়্যাতের হক্কদার মনে করা
আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নামে ফিরিশতা ও নবী—ওলীগণের ইবাদত করা হলো আরবের মুশরিকদের অন্যতম শির্ক যা কুরআনে উলেস্নখ করা হয়েছে। ইবাদত অর্থ চূড়ান্ত ও অলৌকিক ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ। এরূপ অনুভুতি নিয়ে পীর—ওলীকে সাজদা করা, তার নাম যপ করা, বিপদে আপদে দূর থেকে তাকে ডাকা, তার কাছে ত্রাণ চাওয়া ইত্যাদি এ পর্যায়ের শির্ক।
4 Comments
নওশাদ
রাহিমাহুল্লাহ
Zunayed evan
তাৎপর্য পূর্ন বিশ্লেণ
Mohammad Ali
খুবই দরকারি ও গুরুত্বপূর্ণ লেকচার। প্রিয় স্যারের জন্য প্রান থেকে দোয়া রইল আল্লাহ্ সুবহানুতা’য়ালা উনাকে বেহেস্ত নসিব করুন। আমিন
abu baker siddique mithu
Jajakallah.