ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সাবেক চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
সন্তানের অধিকার
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী আলা রাসূলিহীল কারীম। আম্মা বাদ, আজ আমরা সন্তানের অধিকার ও সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য বিষয়ে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ পৃথিবীর জীবনে মানুষের প্রিয়তম বস্তু ও হৃদয়ের অন্যতম আনন্দ হলো সন্তান-সন্ততি। শুধু তাই নয় আখেরাতের জীবনেরও সাথী ও আনন্দ। কুরআন কারীমে একাধিক স্থানে ঘোষণা করা হয়েছে যে, জান্নাতে মুমিনগণ তাদের সন্তানদের সাহচার্য উপভোগ করবেন। একস্থানে আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ
“এবং যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তান-সন্ততি যারা ঈমানের বিষয়ে তাদের অনুগামি হয়েছে, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং তাদের কর্মফল কিছু মাত্র হ্রাস করব না।”
সন্তানদেকে দুনিয়া ও আখিরাতে সত্যিকারের আনন্দের উৎস বানাতে আমাদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্বের অবহেলার কারণে সন্তান আনন্দের পরিবর্তে চিরস্থায়ী পরিতাপের কারণ হতে পারে। এজন্য কুরআন-হাদীসে সন্তানদের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য ও দায়িত্ব বিশেষরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম দায়িত্ব হলো সন্তানের জন্য যোগ্য পিতা ও মাতা বাছাই করা। শুধুমাত্র পাত্র বা পাত্রীর ব্যক্তিগত আনন্দ, তৃপ্তি ও জাগতিক সুবিধাদির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আগত প্রজন্মের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে বিবাহের পাত্রপাত্রীর নির্ধারণ করতে হবে। এজন্য হাদীস শরীফে উভয় পক্ষকে সততা, ধার্মিকতা ও নৈতিক দৃঢ়তার দিকে লক্ষ্য রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সন্তানের প্রতি পিতামাতার প্রাথমিক দায়িত্বগুলির অন্যতম হলো, জন্মের সময় তার কানে আযান দেওয়া, তার সুন্দর নাম রাখা, মুখে মিষ্টি বা খাদ্য ছোয়ান, আকীকা করা, খাতনা করা ইত্যাদি। নবজাতকের কানে যেন সর্বপ্রথম আল্লাহর নাম ও তাঁর মহত্ব ও একত্বই সর্বপ্রথম প্রবেশ করে এজন্য জন্মের পরেই তার কানে আযান দেওয়ার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবী আবু রাফি’ বলেন,
رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ أَذَّنَ فِي أُذُنِ الْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ حِينَ وَلَدَتْهُ فَاطِمَةُ بِالصَّلاةِ
“আমি দেখলাম যে, ফাতেমা (রা) যখন হাসানকে জন্ম দিলেন তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসানের কানে নামাযের আযানের মত আযান প্রদান করলেন।” বর্তমানে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা মাতৃসদনে অনেকেই এ মূল্যবান সুন্নাত পালনে অবহেলা করছেন। পিতা বা অভিভাবকদের এ বিষয়ে খুবই সচেতন হওয়া দরকার। এছাড়া ক্লিনিক-হাসপাতালের কতৃপক্ষকেও এ বিষয়ে সঠিক ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আমাদের দেশে সন্তানদের ‘ভাত মুখে’ দেওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত আছে। রেওয়াজটি ইসলামী নয়। তবে হাদীস শরীফে কাছাকাছি একটি রীতি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। আরবীতে একে ‘তাহনীক’ বলা হয়। নবজাতক শিশুকে জন্মের কয়েকদিনের মধ্যে কোনো নেককার বুজুর্গের নিকট নিয়ে তাঁর মুখের মধ্যে খেজুর, মধু বা অনুরূপ কোনো খাদ্যদ্রব্য ছোয়ানকে তাহনীক বলা হয়। সাহাবীগণ এভাবে তাঁদের নবজাতক শিশুদের তাহনীক করাতেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এনে।
সন্তানের প্রতি পিতামাতার অন্যতম দায়িত্ব হলো তার জন্য একটি সুন্দর ভাল অর্থবোধক নাম রাখা। জন্মের পরেই তাহনীক বা গালে মিষ্টি ছোয়ানোর সময়েই কারো কারো নাম রেখেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। অন্যান্য হাদীসে জন্মের সপ্তম দিনে নাম রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হলো নামের সৌন্দর্য ও অর্থ।
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) শিশুদের নাম রাখার জন্য সুন্দর বা সঠিক অর্থবহ নাম, আল্লাহর নামের দাসত্ব বোধক নাম, নবীগণের নাম ইত্যাদি পছন্দ করতেন। ‘আব্দুল্লাহ’ এবং ‘আব্দুর রাহমান’ নাম দুটি আল্লাহর নিকট প্রিয়তম বলে তিনি বলেছেন। আর যে সব নামের অর্থ ব্যক্তির নেককারত্ব দাবী করে, বা ব্যক্তির তাকওয়া বুঝায়, যে সকল নামের অর্থ খারাপ বা কঠিন এরূপ নাম রাখতে তিনি অপছন্দ করতেন। অনেক সময় তিনি এই ধরনের নাম পরিবর্তন করে দিতেন।
আমাদের বাংলাদেশী সমাজে একটি অত্যন্ত আপত্তিকর অভ্যাস হলো নাম বিকৃত করা। দুইভাবে আমরা তা করি। প্রথমত, নামকে বিকৃত করা। যেমন হাসান-কে হাসান্যা, বা হাসু বলা। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর দাসত্ব বোধক নামগুলিকে আল্লাহর নামে ডাকা। আব্দুর রহমান, আব্দুর রায্যাক, ইত্যাদি অগণিত নাম আমরা ‘আব্দুল’ ফেলে শুধুম রহমান, রায্যাক, ইত্যাদি নামে ডেকে থাকি। এ বিকৃতি বেশি মারাত্মক, কঠিন গোনাহ এবং অনেক ক্ষেত্রে ঈমানের পরিপন্থী। আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর দাসকে ‘আল্লাহ’ ডাকার বা ‘রহমানের দাসকে’ ‘রহমান’ বলে ডাকার চেয়ে ঘোরতর অন্যায় আর কি হতে পারে!? আমাদের অবশ্যই এই অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
সন্তানের প্রতি পিতামাতার পরবর্তী দায়িত্ব হলো আকীকা। জন্মের ৭ম দিনে নবজাতকের শরীরের ময়লা পরিস্কার করা, চুল কাটা, চুলের ওযনের সমপরিমান রৌপ্য দান করা এবং তার পক্ষ থেকে একটি মেষ বা ছাগল আকীকা হিসাবে জবাই করার নির্দেশ হাদীস শরীফে দেওয়া হয়েছে। আরবের মানুষেরা কন্যাসন্তানের জন্য কোনো আকীকা দিত না। এজন্য কোনো কোনো হাদীসে মেয়ের জন্য অন্তত একটি ও ছেলের জন্য দুইটি ছাগল বা মেষ আকীকা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে হাসান ও হুসাইনের জন্য একটি করে ছাগী আকীকা দিয়েছেন। তিনি বলেন:
مَنْ وُلِدَ لَهُ وَلَدٌ فَأَحَبَّ أَنْ يَنْسُكَ عَنْهُ فَلْيَنْسُكْ، عَنْ الْغُلامِ شَاتَانِ مُكَافِئَتَانِ وَعَنْ الْجَارِيَةِ شَاةٌ
“যদি কারো সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহলে সে চাইলে তার সন্তানের পক্ষ থেকে পশু জবাই করবে। পুত্র শিশুর পক্ষ থেকে দুইটি সমান ছাগল-মেষ এবং কন্যা সন্তানের পক্ষ থেকে একটি।
ইবনু আব্বাস (রা) বলেন,
(إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ عَقَّ عَنْ الْحَسَنِ وَالْحُسَيْنِ كَبْشًا كَبْشًا (عَنِ الْحَسَنِ كَبْشاً وَعَنِ الْحُسَيْنِ كَبْشاً
“রাসূলুল্লাহ (সা.) হাসানের পক্ষ থেকে একটি ও হুসাইনের পক্ষ থেকে একটি মেষ আকীকা দেন।”
আকীকা হিসাবে ভেড়া, দুম্বা বা ছাগল জবাই করার কথাই হাদীসে বলা হয়েছে। আনাস (রা) নিজের সন্তানদের পক্ষ থেকে উট আকীকা প্রদান করতেন বলে বর্ণিত হয়েছে। (তাবারানী) আয়েশা (রা)-এর এক ভাতিজার জন্মের পর একজন তাঁকে উট আকীকা দিতে পরামর্শ দেন। তখন তিনি বলেন
مَعَاذَ الله، وَلَكِنْ مَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ: شَاتَانِ مُكَافِئَتَانِ
“নাঊযু বিল্লাহ! তা করব কেন! বরং রাসূলুল্লাহ (সা.) যা বলেছেন তা করব: দুটি সমান মেষ।”
আকীকার পশু জবাইয়ের সময় (اللهم منك ولك، هذه عقيقة فلان، بسم الله، الله أكبر) (হে আল্লাহ, আপনার পক্ষ থেকে এবং আপনারই জন্য। অমুকের আকীকা। বিসমিল্লাহ, আল্লাহু আকবার) বলার কথা কোনো কোনো হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। আকীকার গোশত কুরবানীর গোশতের ন্যায় পরিবারের সদস্যগণ সহ ধনী দরিদ্য সকলেই খেতে পারেন। হাদীস শরীফে ৭ম দিনে আকীকা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী যুগে অনেক ফকীহ ৭ দিনের পরেও আকীকা দেওয়া যাবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি নফল এবং এতে প্রশস্ততা রয়েছে। তবে সুন্নাতের হুবহু অনুকরণ অনুসরণ উত্তম।
সন্তনের প্রতি মুসলিম পিতামাতার অন্যতম দায়িত্ব তাকে যথাসময়ে খাত্না করানো। হাদীস শরীফে জন্মের সপ্তন দিনেই খাতনা করানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও জন্মের ৭ম দিনের মধ্যে খাতনা করানো উত্তম। তবে পরে খাতনা করানো নিষিদ্ধ নয়। খাতনা উপলক্ষে অনুষ্ঠানাদি করার কোনো নির্দেশ বা অনুমতি হাদীস শরীফে দেখা যায় না। জাবির (রা) বলেন,
إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ عَقَّ عَنِ الْحَسَنِ وَالْحُسَيْنِ وَخَتَنَهُمَا لِسَبْعَةِ أَيَّامٍ
“রাসূলুল্লাহ হাসান ও হুসাইনের জন্য তাঁদের আকীকা করেন এবং তাদের খাতনা করান তাদের জন্মের ৭ম দিনে।” ইবনু আব্বাস (রা) বলেন,
سَبْعَةٌ مِنَ السُّنَّةِ فِيْ الصَّبِيِّ يَوْمَ السَّابِعِ يُسَمَّى وَيُخْتَنُ
“শিশুর জন্মের ৭ম দিনে ৭টি বিষয় সুন্নাত, তার অন্যতম হলো তার নাম রাখা ও খাতনা করানো।”
মাতার উপর দায়িত্ব হলো দু বছর সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো। পিতার দায়িত্ব মাতার জন্য এরূপ দুগ্ধদানের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করা। মাস বয়স থেকেই শিশুকে অন্যান্য খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্থ করতে হবে। যেন দুবছরের মধ্যে তাকে বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যায়। আল্লাহ বলেন:
وَالْوَالِدَاتُ يُرْضِعْنَ أَوْلَادَهُنَّ حَوْلَيْنِ كَامِلَيْنِ لِمَنْ أَرَادَ أَنْ يُتِمَّ الرَّضَاعَةَ وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ
“মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ দু বছর বুকের দুধ খাওয়াবে, যে দুধ পান করানোর সময়টি পূর্ণ করতে চায়। আর পিতার উপর দায়িত্ব হলো যথাবিধি তাদের ভরণপোষণ করা।”
সন্তানকে দৈহিক, আত্মিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী, স্বাবলম্বী ও সম্মানিতরূপে গড়ে তোলা পিতামাতার মূল দায়িত্ব। প্রথম যে বিষয়টি সন্তানদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে তা হলো সততা ও ধার্মিকতা। তারা ইসলামের সঠিক বিশ্বাস, কর্ম ও আচরণ শিখবে এবং পালন করবে। স্বার্থপরতা, ধোঁকাবাজি, মুনাফিকী, বক-ধার্মিকতা, সৃষ্টির অকল্যাণ ইত্যাদি যে সকল বিষয় আল্লাহ নিষেধ করেছেন তা তারা ঘৃণা করবে এবং বর্জন করবে। নামায, রোযা, যাকাত, যিকির, সৃষ্টির সেবা, সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ ইত্যাদি সকল দায়িত্ব তারা আগ্রহভরে পালন করবে। সন্তানদেরকে এই পর্যায়ে তৈরি করা পিতা ও মাতার উপর অন্যতম ফরয আইন। এই ফরয দায়িত্বে অবহেলা করে যদি কেউ ফরযে কেফায়া বা নফল দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হন তাহলে তা বক-ধার্মিকতায় পর্যবসিত হবে। আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا
“হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা নিজদেরকে এবং পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা কর।”
আমরা অনেক সময় ব্যক্তিগত রাগ বা জাগতিক ক্ষতির কারণে সন্তানদের শাসন করি। অথচ ধর্মীয় ও নৈতিক আচরণের ত্র“টিগুলি তত গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। রাসূলুল্লাহ (সা.)ও তাঁর সাহাবীগণ আমাদেরকে এর উল্টো আচরণ শিক্ষা দিয়েছেন। জাগতিক বিষয়াদির ক্ষতি, কষ্ট বা ব্যক্তিগত রাগ তাঁরা সহ্য করেছেন। কিন্তু দ্বীনী বিষয়ে অবহেলা তাঁরা শাসন করেছেন। কারণ জাগতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠা খুবই সহজ। পক্ষান্তরে নৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতন যুবক-কিশোরদের দুনিয়া ও আখেরাতে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে পারে। আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
وَاللَّهِ لَقَدْ خَدَمْتُهُ تِسْعَ سِنِينَ مَا عَلِمْتُهُ قَالَ لِشَيْءٍ صَنَعْتُهُ لِمَ فَعَلْتَ كَذَا وَكَذَا أَوْ لِشَيْءٍ تَرَكْتُهُ هَلاَّ فَعَلْتَ كَذَا وَكَذَا
“আল্লাহর শপথ, আমি নয়টি বছর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমত করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কোনো দিক দেখিনি যে, আমি কোনো কাজ করে ফেললে তিনি আমাকে জবাবদিহী করে বলেছেন, কেন অমুক অমুক কাজ করলে? অথবা আমি তাঁর নির্দেশিত কোনো কাজ না করলে তিনি আমাকে জবাবদিহী করে বলেছেন, কেন অমুক অমুক কাজ করলে না?”
কিন্তু ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয়ে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে তিনি কঠোর হতে বলেছেন। তিনি বলেছেন,
مُرُوا أَوْلادَكُمْ بِالصَّلاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ
“তোমাদের সন্তানদের বয়স ৭ হলে তাদেরকে নামায আদায়ের জন্য নির্দেশ দিবে। এবং দশ বছর বয়সে তাদেরকে নামাযের জন্য মারধর করবে এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দেবে।”
সন্তানকে সৎ ও ধার্মিকরূপে গড়ে তুলতে পারা একদিকে নিজের উপর অর্পিত ফরয দায়িত্ব পালন, অপরদিকে তা দুনিয়া ও আখেরাতের পরম সাফল্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلا مِنْ ثَلاثَةٍ إِلا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ
“যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সকল কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র তিনটি ছাড়া: প্রবাহমান দান, কল্যাণকার জ্ঞান এবং নেককার সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে।
إِنَّ الرَّجُلَ لَتُرْفَعُ دَرَجَتُهُ فِي الْجَنَّةِ فَيَقُولُ أَنَّى هَذَا فَيُقَالُ بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ
“জান্নাতে কোনো কোনো ব্যক্তির মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে। তখন সে বলবে : কিভাবে আমার মর্যাদা বৃদ্ধি পেল? তখন তাকে বলা হবে, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমা প্রার্থনার ফলে।”
বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখি যে, সন্তানদের আচরণ লক্ষ্য করা এবং তাদেরকে স্নেহের সাথে সঠিক আচরণ শিক্ষা দেওয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রীতি। এক হাদীসে উমার ইবনু আবু সালামাহ (রা) বলেন, “আমি কিশোর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর গৃহে লালিত পালিত হয়েছি, খাওয়ার সময় আমি হাত বাড়িয়ে খাঞ্চার বিভিন্ন স্থান থেকে খাদ্য গ্রহণ করতাম। তিনি আমাকে বলেন, ‘হে কিশোর, তুমি আল্লাহর নাম নাও, ডান হাত দিয়ে খাও এবং খাঞ্চার মধ্যে তোমার নিকটবর্তী স্থান থেকে খাদ্য গ্রহণ কর।’ উমার বলেন, তখন থেকে আমি সর্বদা এভাবেই খাদ্য গ্রহণ করে থাকি।”
সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অন্যতম বিষয় হলো, তাদেরকে “শক্তিশালী” রূপে গড়তে হবে। ঈমানের শক্তি, মনের শক্তি, দেহের শক্তি সকল দিক থেকেই তারা শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ
“শক্তিশালী মুমিন আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ও প্রিয়তর।”
সন্তানদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশ ও শক্তি অর্জনের জন্য তাদের শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা করাতে ইসলামে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত তীর নিক্ষেপ, ঘোড়ার পিঠে আরোহণ, সাঁতার ইত্যাদি খেলাধুলা বিশেষভাবে উৎসাহ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ। আয়েশা (রা) বলেন, হাবশীগণ লাঠি-বল্লম ইত্যাদি নিয়ে খেলা করছিল। উমার (রা) তাদেরকে আপত্তি করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, উমার, তুমি ওদের খেলতে দাও। এরপর তিনি ক্রীড়ারতদেরকে বলেন:
اِلْعَبُوْا (خُذُوا) يا بني أرفدة لَتَعْلَمُ يَهُودُ أَنَّ فِي دِينِنَا فُسْحَةً إِنِّي أُرْسِلْتُ بِحَنِيفِيَّةٍ سَمْحَةٍ
হে হাবশীগণ, তোমরা খেল, যেন ইহূদী নাসারারা জানতে পারে যে, আমাদের দ্বীনের মধ্যে প্রশস্ততা আছে। আমি প্রশস্ত দ্বীনে হানীফ সহ প্রেরিত হয়েছি।”
অন্য হাদীসে সাহাবী উকবা ইবনু আমির বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
وَارْمُوا وَارْكَبُوا وَأَنْ تَرْمُوا أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ تَرْكَبُوا
“তোমরা নিক্ষেপ কর এবং আরোহণ কর। আরোহন করার চেয়ে নিক্ষেপ করা আমার নিকট বেশি প্রিয়।”
এ সকল হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, নিক্ষেপ, আরোহণ, সাঁতার এবং এই জাতীয় সকল প্রকার ব্যায়াম, খেলাধুলা, প্রতিযোগিতা বা শরীরচর্চা ইসলামে নির্দেশিত। কিশোর-যুবকদের জন্য এই জাতীয় খেলাধুলার ব্যবস্থা করা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব।
সম্মানিত উপস্থিতি, সন্তানদের অর্থনৈতিক শক্তি ও সচ্ছলতার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ
“তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে সচ্ছল রেখে যাবে সেটাই উত্তম, তাদেরকে মানুষের দয়ার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে।”
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আত্মিক ও মানসিক দিক থেকে সন্তানদের শক্তিশালীরূপে গড়ে তোলা। দৈহিক শক্তি প্রয়োজনীয়। তবে মানসিক শক্তি ও স্থিতি আরো বেশি প্রয়োজনীয়। মনই মানুষের নিয়ন্ত্রক। আজকাল পাশ্চাত্যের বিপথগামী সমাজগুলির মত আমাদের মুসলিম সমাজের পিতামাতা সন্তানদের মানসিক বিকাশের দিকে লক্ষ্য দেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পিতামাতা নিজেদের কর্ম, বন্ধুত্ব ও সামাজিকতা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানদেরকে সময় দিতে পারেন না। অথচ পিতামাতার সময় ও বন্ধুত্বের সবচেয়ে বেশি হকদার সন্তানগণ। প্রতিদিন তাদেরকে কিছু সময় দেওয়া, তাদের মনের কথা ও সমস্যাগুলি জানা, তাদের সাথে নিয়মিত কিছু সময় ইসলাম সম্মত চিত্ত- বিনোদন ও খেলাধুলায় সময় কাটানো পিতামাতার দায়িত্ব। কুরআন ও হাদীসে বারংবার দয়া, মমতা, ক্ষমা ইত্যাদির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য সকলের চেয়ে এগুলির সবচেয়ে বেশি পাওনাদার সন্তানগণ। এছাড়া সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের জন্য স্নেহ, মমতা, দয়া ও সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশ বিশেষভাবে দেওয়া হয়েছে। স্বামীস্ত্রীর পারস্পরিক মমতা, বিনম্রতা, ক্ষমা ইত্যাদি সন্তানদেরকে প্রভাবিত করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) আয়েশা (রা)-কে বলেন,
يَا عَائِشَةُ ارْفُقِي فَإِنَّ اللَّهَ إِذَا أَرَادَ بِأَهْلِ بَيْتٍ خَيْرًا دَلَّهُمْ عَلَى بَابِ الرِّفْقِ
“হে আয়েশা, তুমি বিনম্র ও বন্ধুভাবাপন্ন (kind, friendly, courteous, nice) হও। কারণ আল্লাহ যদি কোনো পরিবারের কল্যাণ চান তাহলে তাদেরকে বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা দান করেন।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে শিশু কিশেরাদের অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। তার কাছে খেজুর ইত্যাদি হাদীয়া আসলে তিনি দোয়া করতেন এবং তার নিকট অবস্থানকারীদের মধ্যে সবচেয়ে যে ছোট তাকে প্রথমে তা প্রদান করতেন। (আল-আদাবুল মুফরাদ, বুখারী)। তাঁর কাছে শিশু কিশোরকে আনা হলে তাকে কোলে নিতেন, আদর করতেন এবং মাথায় হাত বুলাতেন। (আল-আদাবুল মুফরাদ, বুখারী) তিনি তাঁর নাতিদেরকে নিয়ে খেলতেন, ঘোড়া হতেন এবং তাদেরকে অনেক সময় দিতেন। (হাকিম। সহীহ।) হযরত আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন,
مَا رَأَيْتُ أَحَدًا كَانَ أَرْحَمَ بِالْعِيَالِ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
“সন্তানসন্ততি ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি স্নেহ, দয়া ও মমতা করার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেয়ে বেশি কাউকে আমি দেখিনি।”
মতা, হাদিয়া, উপঢৌকন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে সকল সন্তানের মধ্যে সমতা বজায় রাখতে হবে। কোনো সন্তানকে অন্যদের থেকে পৃথকভাবে অতিরিক্ত স্নেহ করা, অথবা পুত্রদের বেশি স্নেহ ও কন্যাদের কম স্নেহ কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। নোমান ইবনু বাশীর (রা) বলেন, “তাঁর পিতা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে বলেন, আমি আমার এই ছেলেকে একটি খাদেম দান করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমার সকল সন্তানকেই কি তুমি এরূপ দান করেছ? তিনি বলেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, এটি ফিরিয়ে নাও।”
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
اعْدِلُوا بَيْنَ أَوْلادِكُمْ
“তোমাদের সন্তানদের মধ্যে সমতা বজায় রাখবে।”
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকরূপে সন্তান প্রতিপালনের তাওফীক প্রদান করুন। আমীন!!
1 Comment
muftisiraji
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার প্রতি মোবারকবাদ রহিল