আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

সাম্প্রতিক সংবাদ

পানাহারের গুরুত্বপূর্ণ আদব: হারাম ভক্ষণ থেকে বিরত থাকা

খাওয়ার প্রথম আদব হল, হারাম খাওয়া যাবে না, হারাম উপার্জন ভক্ষণ করা যাবে না।

আমরা বাংলাদেশের মানুষ, হালাল-হারাম নিয়ে বেশ সচেতন, মাশাআল্লাহ। এত সচেতন যে, দেখেন একজন আমাকে প্রশ্ন করেছে, সে বর্তমানে উচ্চ পদস্থ একজন অফিসার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সে হিসেবে আমাকে স্যার বলে, যদিও আমার বিভাগে সে পড়ে নি, বর্তমানে সিনিয়র একজন সরকারি কর্মকর্তা, দীনদার। সে প্রশ্ন করে বলছে যে, ‘স্যার, গ্রিল করা মুরগি খাওয়া যাবে কি? জায়িয হবে তো?’ কারণ, আমরা আজীবন রান্না করে খেয়েছি। এখন গ্রিল করে এইভাবে এটা খাওয়া জায়িয হবে কি না- তার ভেতরে এটা একটা প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে। কারণ, আমরা হালাল-হারাম সচেতন।

কিন্তু এই সচেতনতা অনেক সময় আমাদের বিপরীত হয়ে গিয়েছে। মুরগি গরম পানিতে দিয়ে চামড়া সাফ করলে জায়িয হবে না কি মাকরূহ হবে বা হারাম হবে- এটা নিয়ে আমরা অনেকেই সচেতন, আলহামদু লিল্লাহ। কিন্তু এই মুরগিটা যে টাকা দিয়ে কিনলাম, সেই টাকাটা কি ওজনে কম দেওয়া, না কি কর্মে ফাঁকি দেওয়া, না কি বাবা-মায়ের হক মেরে দেওয়া, না কি এই ধরণের কোনো অবৈধ উপার্জনের- এই ব্যাপারে আমরা অত সচেতন না।

অথচ ইসলাম ঠিক বিপরীতটা শিখিয়েছে।

যেটা স্বয়ং হারাম, কুরআনে তা খুব সীমিতভাবে বলা হয়েছে। শুয়োর, রক্ত, মৃত প্রাণি, মদ- পানাহারের ব্যাপারে মোটামুটি এগুলোকে কুরআনে হারাম বলা হয়েছে। এছাড়া হাদীস শরীফে হিংস্র পাখি এবং হিংস্র মাংশাসী পশুকে হারাম বলা হয়েছে। এর বাইরে সবই হালাল, মুবাহ।

তবে কুরআন কারীমে শুয়োর, রক্ত, মদ, মৃত প্রাণি যেখানে যেখানে হারাম বলা হয়েছে, সেখানে প্রায়ই বলা হয়েছে, যদি কেউ জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়, সে খেতে পারবে।

তাহলে খাবারের ক্ষেত্রে এই বস্তুগুলো হারাম। আমরা আগেই বলেছি, ইসলামে যা হারাম করা হয়েছে, এটা আমাদের জন্য ক্ষতিকারক। মৃত প্রাণি আমাদের ক্ষতি করে। শুয়োরের মাংস ক্ষতিকারক। শুয়োরের মাংস মানুষের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান বয়ে আনে। রক্ত মানুষের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান বয়ে আনে। কমবেশি যাই হোক। কিছু কিছু বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত। কিছু আরও গবেষণার অপেক্ষা রাখে। তারপরেও জীবন বাঁচানোর জন্য এগুলো খাওয়ার অনুমতি কুরআন বারবারই দিয়েছে, একবার নয়।

এর বিপরীতে মানুষের বিনা অনুমতিতে,

অসম্মতিতে অবৈধভাবে যে সম্পদগুলো আয় করা হয়, এর ভেতরে কুরআন সুদের কথা বলেছে, অবৈধভাবে সম্পদ গ্রহণের কথা বলেছে, যে কোনো পন্থায়ই হোক না কেন। কুরআনে বলা হয়েছে:

وَلَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ.

(তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ ভোগ কোরো না)।1সূরা [২] বাকারাহ, আয়াত: ১৮৮।

এছাড়া কুরআনে বেচাকেনার ক্ষেত্রে ওজনে কম দেওয়া, ওজনে ফাঁকি দেওয়া, পরিমাণে কম দেওয়া ইত্যাদি কাজকে অবৈধ বলা হয়েছে।

এই সকল হারামের ক্ষেত্রে, কোনো এক্সেপশন (ব্যতিক্রম বা বিকল্প ব্যবস্থা) নেই যে, ‘তুমি পেটের দায়ে দুইদিন ওজনে কম দিতে পারবে, অথবা ঘুষ নিতে পারবে, অথবা সুদ নিতে পারবে’- এ রকম কিন্তু নেই।

আমরা বাংলাদেশের মানুষ এই বিষয়ে ভয়ংকরভাবেই ভুলের ভেতরে রয়েছি। আমাদের হালাল-হারাম সচেতনতা অনেকটা ভারতীয় হিন্দু ধর্মের ছুত-অচ্ছুতের মতো হয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টা ওই রকম না।

হারামের ভেতরে বেশি কঠিন হারাম হল,

যেটা উপার্জনের হারাম। তবে আমরা উপার্জনের হারামের ব্যাপারে খুবই অবহেলা করি। একজন হয়তো মদ পান করেন না, মদ পানের কল্পনাও করেন না। কিন্তু তিনি হয়তো বাবা-মায়ের হক আদায় করেন নি, তার ভাইবোনের সম্পত্তি দেন নি, বা মেয়েদের সম্পত্তি দেন নি। অথবা ওজনে কম দেন, বা খাদ্যে ভেজাল দেন। অথবা এই ধরনের হারাম উপার্জনের সাথে জড়িত। এ রকম মুসলমানের বাংলাদেশে অভাব নেই।

সমস্যা হল, এখানে আরও একটা বিষয় আছে। আপনি যদি শুয়োরের গোশত খান, মৃত প্রাণি খান, মদ খান- এই জাতীয় যে কোনো হারাম ভক্ষণ করেন, আপনি যে কোনো সময় অন্তর দিয়ে তাওবা করলে আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন। ‘আল্লাহ, আমার অন্যায় হয়ে গেছে, আর করব না।’ এখানে তাওবার জন্য অনুতপ্ত হওয়া, মাফ চাওয়া, আর কখনো করব না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া, এটাই যথেষ্ট।

কিন্তু আপনি যদি বান্দার হক সংক্রান্ত অন্যায় করেন- যৌতুক নিয়েছেন, চাঁদা নিয়েছেন, জোর করে কারোর সম্পদ কেড়ে নিয়েছেন, কারোর সম্পদ নিয়ে পয়সা দেন নি, রিকশায় চড়ে ভাড়া দেন নি, স্ত্রীর মোহর দেন নি, বউ মরে গেছে; বিয়াইয়ের কাছে যৌতুক নিয়েছিলেন, বাবা-মায়ের হক আদায় করেন নি, এই রকম যে কোনো অপরাধ করেন, এটা কম হোক, বেশি হোক, মাফ পাবেন না, যতক্ষণ না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের থেকে মাফ নিয়ে নেন ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।

দেখেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছেন!

‘যদি কেউ মিথ্যা শপথ করে, মিথ্যা কেস করে, মিথ্যা কৌশলে সমাজের আইনের সহায়তায় একটা মিসওয়াকের ডালও কারোর থেকে অবৈধভাবে কেড়ে নেয়, জবরদখল করে, তাহলে আল্লাহ তাআলার সাথে যখন তার দেখা হবে, তখন আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত হয়ে থাকবেন।’2সহীহ বুখারি, হাদীস ২৩৫৬। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৮।

عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِيْنٍ يَقْتَطِعُ بِهَا مَالَ امْرِئٍ مُسْلِمٍ هُوَ عَلَيْهَا فَاجِرٌ لَقِيَ اللهَ وَهُوَ عَلَيْهِ غَضْبَانُ.

عَنْ أَبِيْ أُمَامَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: مَنِ اقْتَطَعَ حَقَّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ بِيَمِيْنِهِ فَقَدْ أَوْجَبَ اللهُ لَهُ النَّارَ وَحَرَّمَ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ: وَإِنْ كَانَ شَيْئًا يَسِيْرًا يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: وَإِنْ قَضِيْبًا مِنْ أَرَاكٍ

এক হাজার মন শুয়োরের গোশত খেলেও এ রকম কঠিন শাস্তির কথা কুরআনে নেই। এইজন্য, এই বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।

বই : মিম্বারের আহ্বান-১

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
আপনার ইমেইল
Print

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.