আমরা উল্লেখ করেছি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে মানব সভ্যতার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য অন্যতম প্রধান ধাপ দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা, সুসম্পর্ক ও সন্তানদের জন্য পরিপূর্ণ পিতৃ ও মাতৃস্নেহ নিশ্চিত করা। এজন্য নারী ও পুরুষের পবিত্রতা রক্ষা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক রোধ ও নারীদের উপর দৈহিক অত্যাচার রোধ অতীব প্রয়োজনীয়। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নারী-পুরুষ সকলেরই শালীন পোশাকে দেহ আবৃত করে চলা একান্ত প্রয়োজনীয়। পারিবারে সম্প্রীতি, দাম্পত্য সুসম্পর্ক ও সমাজের পবিত্রতা রক্ষারও অন্যতম মাধ্যম শালীন পোশাকে চলাফেরা করা।
ইসলাম নারী পুরুষ উভয়কেই শালীন পোশাক পরতে নির্দেশ দেয়। আমরা জানি যে, প্রকৃতিগতভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে কিছুটা দুর্বল। অপর দিকে আগ্রাসী মনোভাব পুরুষের মধ্যে বেশি। এজন্য নারীর ও সমাজের পবিত্রতা রক্ষার জন্য ইসলামে নারীর পোশাকের পরিধি বৃদ্ধি করা হয়েছে। পুরুষদের জন্য ফরয বা অত্যাবশ্যকীয় যে, তাঁরা নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত শরীর ঢেকে রাখবেন, বাকী অংশ ঢেকে রাখা সামাজিকতা ও শালীনতার অংশ, ফরয নয়। অপরদিকে মহিলাদের জন্য আল্লাহ পুরো শরীর আবৃত করা ফরয করেছেন।
এর কারণ বুঝাতে
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি গল্প না বলে পারছি না। রিয়াদে অবস্থানকালে আমি একটি ইসলামিক সেন্টারে প্রচারকের কাজ করতাম। একদিন এক বৃটিশ ভদ্রলোক আমার কাছে ইসলাম স¤পর্কে জানতে আসলেন। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি বললেন, তিনি ইসলামের একত্ববাদকে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক বলে বিশ্বাস করেন। তবে তিনি মনে করেন যে, ইসলামে পর্দার বিধান দিয়ে নারীদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। অকারণে তাদেরকে সারা শরীর ঢেকে রাখার বিধান দেওয়া হয়েছে এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে।
উত্তরে আমি বললাম: আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিন। ধর্ষণের হার আপনাদের দেশে কেমন? তিনি বললেন: প্রতি বছর লক্ষাধিক মহিলা ধর্ষিতা হন। আমি বললাম: আপনারা বৃটেনের অধিবাসীরা সকলেই উচ্চশিক্ষিত এবং আপনাদের দেশে সকল প্রকার স্বেচ্ছাচার বৈধ। তা সত্ত্বেও সেখানে এত বিপুল সংখ্যক মহিলা অত্যাচারিত হন কেন? তিনি কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। আমি বললাম: এর কারণ, মহিলারা প্রকৃতিগতভাবে দূর্বল এবং পুরুষের পাশবিক আচরনের মুখে অসহায়। সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রগতি কোনো কিছুর দোহাই তাঁদেরকে এসকল পাশবিকতা থেকে রক্ষা করতে পারে না। তাই তাঁদের সর্বোত্তম প্রতিরক্ষা তাদেরকে শালীন পোশাক পরে অনাত্মীয় পুরুষদের থেকে ভদ্র দুরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। আর এজন্যই আল্লাহ পর্দার বিধান দিয়েছেন, মেয়েদেরকে রক্ষা করার জন্য, তাঁদেরকে সমাজ বিচ্ছিন্ন করার জন্য নয়।
আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
তাকালেও বিষয়টি আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। আমাদের দেশের অবক্ষয়িত সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের মাঝেও আমরা দেখতে পাই, যে সকল মেয়ে পর্দার মধ্যে বেড়ে উঠেন সাধারণত তাঁরা মাস্তানদের অত্যাচার, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি অত্যাচার থেকে বেঁচে থাকেন। সাধারণত পাষাণ-হৃদয় মাস্তানও কোনো পর্দানশিন মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতে দ্বিধা করে। তার পাষাণ-হৃদয়ের এক নিভৃতকোণে পর্দানশিন মেয়েদের প্রতি একটুখানি সম্ভ্রমবোধ থাকে।
কুরআন কারীমে আল্লাহ বলেছেন: ﴾يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُـلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِيْنَ يُـدْنِـيْنَ عَـلَيْهِنَّ مِنْ جَـلَابِـيْبِهِنَّ ذٰلِـكَ أَدْنَى أَنْ يُّـعْـرَفْـنَ فَلَا يُـؤْذَيْـنَ وَكَانَ اللهُ غَـفُـوْرًا رَّحِـيْـمًا﴿
“হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের (চাদরের) কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়, এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্ত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।”1সূরা (৩৩) আহযাব: ৫৯ আয়াত।
দেহের সাধারণ পোশাক-জামা, পাজামা, ওড়না ইত্যাদির উপরে যে বড় চাদর বা চাদর জাতীয় পোশাক দিয়ে পুরো দেহ আবৃত করা হয় তাকে জিলবাব বলা হয়। এখানে আল্লাহ মুমিন নারীদেরকে নির্দেশ দিলেন বাইরে বের হওয়ার জন্য সাধারণ পোশাকের উপরে জিলবাব পরিধান করতে এবং জিলবাবের কিছু অংশ মুখের বা দেহের সামনে টেনে নিতে। এতে পর্দানশিন ও শালীন নারীকে অন্যদের থেকে পৃথক করে চেনা যায় এবং স্বভাবতই এরূপ শালীন নারীদের সাথে সকলেই সম্ভ্রমপূর্ণ আচরণ করেন।
সকল লেনদেন,
কাজকর্ম ও কথাবার্তা স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার সাথে সাথে সামাজিক ও মানসিক পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা অন্য একটি আয়াত থেকে অনুধাবন করা যায়। এ আয়াতে ইরশাদ করা হয়েছে:
يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ لَسْـتُنَّ كَأَحَدٍ مِّنَ النِّسَاءِ إِنِ اتَّـقَـيْتُنَّ فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَـطْمَعَ الَّذِيْ فِيْ قَلْبِهِ مَرَضٌ وَّقُلْنَ قَوْلًا مَّعْـرُوْفًا ৩২ وَقَرْنَ فِيْ بُـيُوْتِـكُـنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَـرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُوْلٰى وَأَقِمْـنَ الصَّلَاةَ وَآتِـيْنَ الزَّكَاةَ وَأَطِـعْـنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ ৩৩﴿﴾
“হে নবী-পণ্ডিতগণ, তোমরা অন্য নারীদের মত নও! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সাথে কোমল-কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলবে না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গত (স্বাভাবিক) কথা বলবে। এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে, প্রাচীন জাহিলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে।”2সূরা (৩৩) আহযাব: ৩২-৩৩ আয়াত।
এ আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীদেরকে: যারা মুমিনদের মাতৃতূল্য ছিলেন এবং নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম ও পবিত্রতম ছিলেন তাঁদেরকে- পর-পুরুষদের সাথে কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর কোমল ও আকর্ষণীয় করতে নিষেধ করছেন; কারণ এর ফলে দুর্বল চিত্ত কেউ হয়ত ভেবে বসবে যে তাঁরা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন বা তাঁদেরকে হয়ত প্রলুব্ধ করা সহজ হবে। অথবা সে নিজে কণ্ঠের কোমলতায় আকৃষ্ট ও প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন প্রকারের শয়তানি ওয়াসওয়াসার মধ্যে নিপতিত হবে।
উপরন্তু
তাঁদেরকে গৃহে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং বর্বর যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শন থেকে নিষেধ করেছেন। বর্বর যুগের সৌন্দর্য প্রদর্শনের অর্থ মাথা, মুখ, ঘাড়, গলা, বুক, হাত,পা ইত্যাদিকে অনাবৃত রাখা, যেন মানুষ তা দেখতে পায়।
মুমিনদের মাতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণের অতুলনীয় ঈমান, পবিত্রতা, সততা ও মুমিনদের মনে তাঁদের প্রতি গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাঁদেরকে এসকল কর্ম থেকে নিষেধ করেছেন। তাহলে অন্যান্য নারীদের এ সকল কর্ম থেকে দুরে থাকা কত প্রয়োজন তা সহজেই অনুমেয়।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, বই: পোশাক, পর্দা ও দেহ-সজ্জা, পৃ. ২৫৫-২৫৮।