হিজরী সালের মুহাররাম মাসের দ্বিতীয় খুতবা। আজকের খুতবায় আমরা আরকানুল ঈমান ও তাওহীদ সম্পর্কে আলোচনা করব।
সম্মানিত উপস্থিতি, মহান আল্লাহ বলেন:
্لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآَخِرِ وَالْمَلائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآَتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلاةَ وَآَتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ
“পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো পূণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য তার যে বিশ্বাস স্থাপন করেছে আলাহে, পরকালে, মালাকগণে (ফিরিশতাগণে), গ্রন্থসমূহে এবং নবীগণে, এবং ধন সম্পদের প্রতি মনের টান থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়—স্বজন, পিতৃহীন—অনাথ, অভাবগ্রস্ত, পথিক, সাহায্যপ্রার্থনাকারিগণকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থ প্রদান করে, এবং সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে, প্রতিশ্রম্নতি দিলে তা পূর্ণ করে এবং অর্থ—সংকটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রাম—সংকটে ধৈর্য ধারণ করে। এরাই প্রকৃত সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকী।”1সূরা (২) বাকারা: ১৭৭ আয়াত।
এখানে আল্লাহ জানিয়েছেন যে, শুধু আনুষ্ঠানিকতার নাম ইসলাম নয়, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতায় কোনো পূণ্য নেই। ইসলাম বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়। এখানে আল্লাহ মুমিনের বিশ্বাসের মৌলিক পাঁচটি বিষয় এবং তার মৌলিক কর্ম ও চরিত্রের বর্ণনা দান করেছেন। কুরআন কারীমে অন্যান্য স্থানে ঈমানের এ পাঁচটি রুকুন ছাড়াও ৬ষ্ঠ রুকুনের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّه
“ঈমান হলো এই যে, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহে, তাঁর ফিরিশতাগণে, তাঁর গ্রন্থসমূহে, তাঁর রাসূলগণে এবং পরকালে, এবং বিশ্বাস করবে আল্লাহর পূর্ব নিধার্রণে (ভাগ্যে), তাঁর ভাল এবং মন্দে।”2মুসলিম, আস—সহীহ ১/৩৫—৩৬।
ঈমানের প্রথম রুকুন হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
هَلْ تَدْرُونَ مَا الإِيمَانُ بِاللَّهِ … شَهَادَةُ أَنْ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لا شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ
“তোমরা কি জান যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান কী?… এ কথা সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই তিনি একক তাঁর কোনো শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল।”3বুখারী, আস—সহীহ ১/২৯, ৪৫, ৪/১৫৮৮, ৬/২৬৫২, ২৭৪৭; মুসলিম, আস—সহীহ ১/৪৭।
অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ— وفي رواية: أَنْ يُوَحَّدَ اللَّهَ— وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ— وفي رواية: وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ— وَإِقَامِ الصَّلاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ وَصَوْمِ رَمَضَانَ، وفي رواية: صيام رمضان والحج
“ইসলামকে পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, তা হলো: বিশ্বাসের সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই (অন্য বর্ণনায়: আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস করা) এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর বান্দা ও রাসুল, সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, রামাদান মাসের সিয়াম (রোযা) পালন করা, বাইতুল্লাহ হজ্জ আদায় করা।”4বুখারী, আস—সহীহ, ১/১২, ৪/১৬৪১; মুসলিম, আস—সহীহ ১/৪৫।
এ সকল আয়াত ও হাদীস থেকে আমরা জানছি যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ আল্লাহর তাওহীদে বা একত্বে বিশ্বাস করা। আর আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসের অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই বলে বিশ্বাস করা। আমরা এখানে বিষয়টি আলোচনা করব।
তাওহীদ অর্থ ‘এক করা’, ‘এক বানানো’, ‘একত্রিত করা’, ‘একত্বের ঘোষণা দেওয়া’ বা ‘একত্বে বিশ্বাস করা’। কুরআন কারীমের অগণিত বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, মহান আল্লাহকে এক মানা বা তাঁর একত্বের ঘোষণা দেওয়ার দুটি পর্যায় রয়েছে। প্রথমত রাব্ব বা প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহকে এক মানা। একে আরবীতে ‘তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ বলা হয়। দ্বিতীয়ত, ইলাহ বা মাবূদ হিসেবে আল্লাহকে এক মানা। একে আরবীতে তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ বলা হয়। আরবের কাফিরগণ প্রথম পর্যায়টি বিশ্বাস করত কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়টি অস্বীকার ও অবিশ্বাস করত।
আল্লাহ বলেন:
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ
“বল, আসমান এবং জমিন থেকে কে তোমাদেরকে রিয্ক দান করেন? কে দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির মালিক? কে মৃত থেকে জীবিতকে নির্গত করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে নির্গত করেন? বিশ্ব পরিচালনা করেন কে? তারা উত্তরে বলবে: আল্লাহ। বল: তাহলে কেন তোমরা আল্লাহকে ভয় করছ না।”5সূরা (১০) ইউনূস: ৩১ আয়াত।
আল্লাহ জাল্লা জালালুহু আরো বলেন:
قُلْ لِمَنِ الأَرْضُ وَمَنْ فِيهَا إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَذَكَّرُونَ. قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَرَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ. سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلا تَتَّقُونَ. قُلْ مَنْ بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ يُجِيرُ وَلا يُجَارُ عَلَيْهِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ. سَيَقُولُونَ
لِلَّهِ قُلْ فَأَنَّى تُسْحَرُونَ.
“(কাফিরদেরকে) বল, তোমাদের যদি জ্ঞান থাকে তবে বল, এই পৃথিবী এবং এর মধ্যে যারা রয়েছে তারা কার? তারা বলবে: আল্লাহর। বল, তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না? বল, সপ্ত আকাশের রব্ব—প্রতিপালন ও মহান আরশের রব্ব—প্রতিপালক কে? তারা বলবে: আল্লাহ। বল, তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না? বল, তোমরা যদি জান তবে বল, সকল কিছুর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব কার হাতে? যিনি ত্রাণের ক্ষমতা রাখেন, যার উপর ত্রাণ দাতা বা রক্ষাকর্তা নেই? তারা বলবে: আল্লাহ। বল, তবুও তোমরা কেমন করে বিভ্রান্ত হচ্ছ?”6সূরা (২৩) মুমিনূন: ৮৪—৮৯ আয়াত।
কুরআন কারীমে অনেক স্থানে বিষয়টি বারংবার বিভিন্নভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে, কাফিরগণ বিশ্বাস করত যে, মহান আল্লাহই বিশ্বের সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, বৃষ্টিদাতা, ফসলদাতা, রিয্কদাতা, একক সার্বভৌমত্ব ও সকল ক্ষমতার মালিক, মানুষের সকল শক্তি তাঁর নিয়ন্ত্রণে, তিনি অনিষ্ট চাইলে কেউ তা দূর করতে পারে না এবং তিনি কল্যাণ চাইলে কেউ তা রোধ করতে পারে না। এভাবে তারা রাব্ব বা প্রতিপালক হিসেবে আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাস করত। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা আল্লাহর ইবাদাত করত এবং আল্লাহকে ইলাহ বা মাবূদ হিসেবে বিশ্বাস করত। তবে তারা আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ বা মা’বূদ হিসেবে মানতে অস্বীকার করত। বরং তারা দাবি করত যে, মহান আল্লাহর
পাশাপাশি তাঁর খাস কিছু বান্দাও ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য। মহান আল্লাহই তাদেরকে শরীক বানিয়েছেন, কিছু ক্ষমতা তাদেরকে দিয়েছেন, তাদের এবং তাদের ইবাদাত করলে তিনি খুশি হন এবং তাঁর নৈকট্য পাওয়া যায়। এদের সুপারিশ তিনি শুনেন। এরূপ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তারা আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি ফিরিশতাগণ, কোনো কোনো নবী—রাসূল, সত্য বা কল্পিত আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তাঁদের মুর্তি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান, দ্রব্য বা পাথরের ইবাদাত করত।
আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের তাওহীদের অংশ হলো আল্লাহর নাম ও গুণাবলির তাওহীদ। অর্থাৎ দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, মহান আল্লাহ সকল পূর্ণতার গুণে গুণান্বিত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর বিভিন্ন নাম ও বিশেষণের উল্লেখ করেছেন। এ সকল নাম ও বিশেষণের উপর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, সকল প্রকার বিকৃতি, অপব্যাখ্যা থেকে মুক্ত থাকতে হবে এবং বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহর কোনো কর্ম, গুণ বা বিশেষণ কোনো সৃষ্টজীবের কর্ম, গুণ বা বিশেষণের মত নয়, তুলনীয় নয় বা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন:
وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
“এবং আল্লাহরই নিমিত্ত উত্তম নামসমূহ, তোমরা তাঁকে সে সকল নামেই ডাকবে। যারা তাঁর নামসমূহ বিকৃত করে বা নামসমূহের বিষয়ে বক্রতা অবলম্বন করে তাদেরকে তোমরা বর্জন করবে। শীঘ্রই তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের ফল প্রদান করা হবে।”7সূরা (৭) আরাফ: ১৮০ আয়াত।
যেহেতু যুগে যুগে কাফিরগণ রব্ব হিসেবে আল্লাহর একত্ব স্বীকার করত, কিন্তু মাবূদ হিসেবে তার একত্ব অবিশ্বাস করত এজন্য তাওহীদের ব্যাখ্যায় কুরআন ও হাদীসে সর্বদা তাওহীদুল ইবাদাত অর্থাৎ ইলাহ বা মাবূদ হিসেবে আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেওয়ার কথাই বলা হয়েছে।
ইবাদাত শব্দটি আভিধানিকভাবে ‘আবদ’ বা ‘দাস’ শব্দ থেকে গৃহীত। দাসত্ব বলতে ‘উবূদিয়্যাত’ ও ‘ইবাদাত’ দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। উবূদিয়্যাত ব্যবহৃত হয় লৌকিক বা জাগতিক দাসত্বের ক্ষেত্রে। আর ‘ইবাদাত’ বুঝানো হয় অলৌকিক, অজাগতিক বা অপার্থিব দাসত্বের ক্ষেত্রে। আরবী অভিধানের ভাষাই উবূদিয়্যাত হলো বিনয়—ভক্তি প্রকাশ করা। আর ইবাদাত হলো চূড়ান্ত বিনয়—ভক্তি, অসহায়ত্ব ও মুখাপেক্ষিত্ব প্রকাশ করা। শরীয়তের পরিভাষায় পরিপূর্ণ ভালবাসা, ভক্তি, বিনয় ও ভীতির সমন্বিত অবস্থাকে ইবাদাত বলা হয়। যাকে চূড়ান্ত কর্ম—ক্ষমতা ও দয়ার মালিক বলে বিশ্বাস করা হয়, শুধু তার উদ্দেশ্যেই এরূপ চূড়ান্ত ভক্তি প্রকাশ করা হয়।8রাগিব ইসপাহানী, আল—মুফরাদাত, পৃ. ৩১৯; ইবনু কাসীর, তাফসীর ১/২৬।
সকল যুগে সকল দেশের মানুষই জীবন, মৃত্যু ইত্যাদি অতিপরিচিত শব্দের মতই ‘ইবাদাত’, উপাসনা, worship, veneration ইত্যাদি শব্দের অর্থ স্বাভাবিকভাবেই বুঝে। মানুষ অন্য মানুষের দাস হতে পারে বা দাসত্ব করতে পারে, তবে সে অন্য যে কোনো সত্তার ‘ইবাদাত’ বা উপাসনা করে না। শুধু মাত্র যার মধ্যে অলৌকিক বা অপার্থিব ক্ষমতা আছে, ইচ্ছা করলেই মঙ্গল করার বা অমঙ্গল করার বা তা রোধ করার অলৌকিক শক্তি বা অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করে তারই ‘ইবাদাত’ করে।
আরবীতে “ইলাহাহ” শব্দটি “ইবাদাহ” শব্দের সমার্থক।9ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব ১৩/৪৬৮—৪৬৯; খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন—সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ৭৯—১১৪। কুরআন কারীমের বিভিন্ন কিরাআত বা পাঠে “ইলাহাত” শব্দটি ইবাদাত শব্দের হুবহু সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।10সূরা আরাফ: ১২৭ আয়াত; তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ১/৫৪। ইলাহ শব্দের অর্থ মাবুদ বা ইবাদাত—কৃত বা উপাস্য। আরবীতে সকল পূজিত, উপাসনাকৃত বা অলৌকিকভাবে ভক্তিকৃত দ্রব্য, ব্যক্তি বা বস্তুকে ইলাহ বলা হয়। এজন্য সূর্যের আরেক নাম ছিল “ইলাহাহ”; কারণ আরবের কিছু মানুষ সূর্যের উপসনা করত।১১ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকাইসিলুগাহ ১/১২৭; রাগিব ইসপাহানী, আল—মুফরাদাত, পৃ. ২১। এভাবে আমরা দেখছি যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের অর্থ হলো, এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য আর কেউ নেই। তিনিই একমাত্র মাবূদ ও উপাস্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। তিনি এক, একক ও অদ্বিতীয়।
তাওহীদের এ বিশ্বাসই মুক্তির ও সফলতার একমাত্র পথ। কুরআন কারীমে আমরা দেখি যে, সকল নবীই তাঁর জাতিকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করতে এবং অন্য সকল মাবূদের ইবাদাত পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সকল নবীরই দাওয়াত ছিল:
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ
“হে আমার জাতি, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মা’বূদ নেই।”12সূরা আ’রাফ: ৫৯, ৬৫, ৭৩, ৮৫ আয়াত, সূরা হূদ: ৫০, ৬১, ৮৪ আয়াত, সূরা মুমিনূন: ২৩, ৩২ আয়াত।
মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সূরা আম্বিয়া ২৫ নং আয়াতে এরশাদ করেছেন:
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنَا فَاعْبُدُونِ
“আপনার আগে আমি যত রাসূলই প্রেরণ করেছি তাদের প্রত্যেকের কাছেই এই ওহী পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই; অতএব আমারই ইবাদাত কর।”
সূরা নাহল ৩৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন:
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
আমি সকল জাতির কাছে রাসূল বা আমার বাণীবাহক পাঠিয়েছি, যেন তারা আল্লাহর ইবাদাত করে এবং তাগুতকে অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর ইবাদাত করা হয় সবকিছুকে বর্জন করে।”
এভাবে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য স্থানে আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু) এ কথা ঘোষণা করা হয়েছে, একমাত্র তাঁরই উপাসনা ইবাদাত করতে এবং অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্তুর ইবাদাত—উপসনা সর্বতোভাবে বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তাওহীদের এ বিশ্বাসই ইহকাল ও পরকালে সকল সফলতার চাবিকাঠি। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ تُفْلِحُوا
‘‘হে মানুষেরা, তোমরা বল: (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু) তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।’’13ইবনু খুযাইমা, আস—সহীহ ১/৮২; ইবনু হিব্বান, আস—সহীহ ১৪/৫১৮; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৬/২১। হাদীসটি সহীহ।
এই বিশ্বাসই পরকালীন মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশের প্রথম শর্ত। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
مَنْ شَهِدَ (وفي رواية قَالَ) أَنْ لاَ إِلهَ إلاَّ اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ
‘‘যে ব্যক্তি বলবে বা সাক্ষ্য দেবে যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু: আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই” সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”14ইবনু হিব্বান, আস—সহীহ ১/৩৬৪, ৩৯২, হাকিম, আল—মুসতাদরাক ৪/২৭৯; আলবানী, সহীহুল জামি ২/১০৮৩। হাদীসটি সহীহ।
مَنْ شَهِدَ أَنْ لاَ إِلهَ إلاَّ اللهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ وَأَنَّ مُحَمَّداً رَسُوْلُ اللهِ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ النَّارَ
‘‘যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে “আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল” আল্লাহর তার জন্য জাহান্নাম হারাম করবেন।”15মুসলিম, আস—সহীহ ১/৫৭।
এ বিশ্বাস শুধু মুখের কথা নয়। এ বিশ্বাস হলো পরিপূর্ণ জ্ঞান, সুদৃঢ় প্রত্যয়, সন্দেহাতীত বিশ্বাস, পরিপূর্ণ সমর্পণ,আনুগত্য ও কর্ম। রাসূলুল্লাহ সা.—এর কয়েকটি হাদীস শুনুন:
مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ
‘‘যে ব্যক্তি এই সুদৃঢ় প্রত্যয়ের জ্ঞান নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে যে আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, সেই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’16মুসলিম, আস—সহীহ ১/৫৫।
أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ لا يَلْقَى اللَّهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيهِمَا إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ‘আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল’, এ দুটি বিষয়ের ঈমানসহ সকল সন্দেহ ও দ্বিধা থেকে মুক্ত হয়ে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”১৭মুসলিম, আস—সহীহ ১/৫৫।
فَمَنْ لَقِيتَ مِنْ وَرَاءِ هَذَا الْحَائِطِ يَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ فَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ
‘‘… যে ব্যক্তি তার অন্তরের সুদৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দান করবে।”18মুসলিম, আস—সহীহ ১/৬০।
فَإِنَّ اللَّهَ قَدْ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ يَبْتَغِي بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের বিশুদ্ধ ইচ্ছা নিয়ে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” বলবে আল্লাহ তার জন্য জাহান্নামের আগুন নিষিদ্ধ করবেন।’’19বুখারী, আস—সহীহ ১/৩৯৭, ৫/২০৬৩, ৬/২৫৪২; মুসলিম, আস—সহীহ ১/৪৫৫।
শিরকমুক্ত তাওহীদের বিশুদ্ধ বিশ্বাসই রাসূলুল্লাহ সা.—এর শাফাআত লাভের একমাত্র শর্ত ও পথ। আবু হুরাইরা (রা) প্রশ্ন করেনঃ ‘‘হে আল্লাহর রাসূল, সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে যে কেয়ামতের দিন আপনার শাফাআত লাভে ধন্য হবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ
أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ
“সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যে আমার শাফায়াত লাভে ধন্য হবে সে ঐ ব্যক্তি তার অন্তরের বিশুদ্ধতম বিশ্বাস নিয়ে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু” “আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই” এ কথা বলেছে।”20বুখারী, আস—সহীহ ১/৪৯।
তাওহীদের বিশ্বাসই সকল মানসিক ও আত্মিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি দান করে। এ বিশ্বাস মানুষকে মানবীয় পূর্ণতার শিখরে তুলে দেয় এবং মানুষের মনে এনে দেয় পরিপূর্ণ প্রশান্তি। তাওহীদে বিশ্বাসী ও শিরকে লিপ্ত মানুষের আত্মিক ও মানসিক অবস্থার পার্থক্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন:
ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلا رَجُلا فِيهِ شُرَكَاءُ مُتَشَاكِسُونَ وَرَجُلا سَلَمًا لِرَجُلٍ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلا الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لا يَعْلَمُونَ
“আল্লাহ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন: এক ব্যক্তির প্রভু অনেক, যারা পরস্পর বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন এবং এক ব্যক্তির প্রভু কেবল একজন; এ দুইজনের অবস্থা কি সমান? প্রশংসা আল্লাহরই নিমিত্ত, কিন্তু এদের অধিকাংশই তা জানেন না।”21সূরা যুমার: ২৯ আয়াত
এখানে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে কিভাবে তাওহীদে বিশ্বাস একজন মানুষকে মানবীয় পূর্ণতার শিখরে তুলে দেয়। যারা মুশরিক, যারা বিশ্বাস করেন যে, বিভিন্ন মানুষ, দেব—দেবী, গাছ পাথর বা জিন পরী, ভুত প্রেত ইত্যাদির কোনো ঐশ্বরিক বা অলৌকিক ক্ষমতা আছে বা তারা অলৌকিক ইচ্ছার মালিক, ইচ্ছা করলেই মানুষের উপকার বা অপকার করতে পারে, তারা সর্বদা অস্থির চিত্ত, শংকাগ্রস্ত। তারা বিভিন্ন স্থানে ছুটে বেড়াচ্ছেন কল্যাণের আশায় বা বরলাভ করতে, অথবা অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বা “অভিশাপ” কাটানোর জন্য। তাদের মনের অস্থিরতার শেষ নেই। তার অবস্থা ঠিক ঐ কর্মচারীর মত যাকে কয়েকজন পরস্পর বিরোধী মেজাজের কর্মকর্তার অধীনে কাজ করতে হয়, তাদের সবাইকে খুশি করতে গিয়ে বেচারার দুশ্চিন্তা ও ব্যস্ততার অন্ত থাকে না।
অপর পক্ষে যিনি তাওহীদে বিশ্বাসী তিনি এ সকল দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত। কারো সামনে তার মন নত হয়না। তিনি জানেন যে, তার সকল কল্যাণ—অকল্যাণ ভাল—মন্দ, উন্নতি—অবনতি সবকিছু একমাত্র আল্লাহর হাতে। তিনি জানেন, তার মালিক সর্বজ জ্ঞানী, পরম করুণাময়। তিনি তার প্রিয়তম, নিকটতম। তিনি তার মঙ্গল করবেনই, কারণ তিনি তাকে তার নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসেন। আর তিনি না দিলে কেউই দিতে পারবে না। বান্দার একমাত্র দায়িত্ব হলো আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা, তার কছে প্রার্থনা করা। কাজেই হাসি—আনন্দে, ব্যাথা—বেদনায়, দুঃখে—কষ্টে সর্বদা তার মন একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত। আনন্দে তিনি তারই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন, বেদনায় তিনি তার একমাত্র নিকটতম ও প্রিয়তম প্রভুর কাছেই মনের আকুতি তুলে ধরেন। আস্থা ও প্রশান্তিতে তার মন ভরপুর। এই পূর্ণতা ও প্রশান্তির গভীরতা নির্ভর করে তাওহীদের বিশ্বাসের গভীরতার উপর।
মহান আল্লাহর দরবারে সকাতরে দোয়া করি, তিনি আমাদেরকে বিশুদ্ধ তাওহীদের ঈমান অর্জনের তাওফীক প্রদান করুন এবং আমাদের ঈমান ও আমল কবুল করুন। আমীন!
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ, বই: খুতবাতুল ইসলাম, পৃ. ৫৫০-৫৫১।