এভাবে বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) অত্যন্ত পরিস্কারভাবে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি আল্লাহর সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর আগমনের সাথে সাথে নুবুওয়াত ও রিসালাতের সমাপ্তি ঘটেছে। তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না। তিনি একথাও স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তাঁর পরে যদি কেউ নুবুওয়াতের দাবী করে তবে সে অবশ্যই একজন ঘোর মিথ্যাবাদী ভণ্ড।
বিভিন্ন হাদীসে তিনি তাঁর উম্মতকে ভণ্ড নবীদের আবির্ভাবের সংবাদ দান করে তাদের থেকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে জাবির ইবনু সামুরাহ (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
إِنَّ بَيْنَ يَدَيْ السَّاعَةِ كَذَّابِينَ فَاحْذَرُوهُمْ
‘‘নিশ্চয় কিয়ামতের পূর্বেই অনেক ঘোর মিথ্যাবাদীর (ভণ্ড নবীর) আবির্ভাব ঘঠবে। তোমরা তাদের থেকে সাবধান থাকবে।’’1মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৫৪, ৪/২২৩৯।
অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
إِنَّ الرِّسَالَةَ وَالنُّبُوَّةَ قَدْ انْقَطَعَتْ فَلا رَسُولَ بَعْدِي وَلا نَبِيَّ
“রিসালাত বা রাসূলের পদ এবং নুবুওয়াত বা নবীর পদ শেষ হয়ে গিয়েছে, কাজেই আমার পরে কোনো রাসূল নেই এবং কোনো নবীও নেই।”2তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৫৩৩; আহমদ, আল-মুসনাদ ৩/২৬৭; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৪৩৩। হাদীসটি ইমাম মুসলিমের শর্তানুসারে সহীহ।
গবেষকগণ উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সা.-এর মাধ্যমে নুবুওয়াতের সমাপ্তির বিষয়ে ৩৭ জন সাহাবী থেকে সহীহ সনদে ৬৫টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এভাবে আমরা দেখছি যে, কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনার পাশাপাশি মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে বিষয়টি সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত।
বরং প্রকৃত বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ সা.-এর নবুয়ত ও খাতমুন-নুবুওয়াত একইভাবে বর্ণিত ও প্রমাণিত। যারা তাঁর নুবুওয়াতের বিষয় বর্ণনা করেছেন তাঁরাই তাঁর খাতমুন নুবুওয়াতের বিষয়ও বর্ণনা করেছেন। সাহাবীগণ সর্বসম্মতভাবে নবুওয়তের দাবিদার এবং তাদের অনুসারীদেরকে ধর্মত্যাগী মুরতাদ বলে গণ্য করেছেন।
যদি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরে কেউ নিজেকে নবী বলে দাবি করে বা কেউ এরূপ দাবিদারের কথা সত্য বলে মনে করে তবে সে নিঃসন্দেহে ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী দাজ্জাল বা এরূপ ভণ্ডের অনুসারী। যদি কোনো মুসলিম নামধারী এরূপ দাবি করে বা এরূপ দাবিদারের কথা বিশ্বাস করে তবে সে ধর্মত্যাগী মুরতাদ বলে গণ্য হবে।
উপরন্তু যদি কেউ বিশ্বাস করে যে মুহাম্মাদ (সা.)-এর পরে কোনো নবী বা রাসূল এসেছেন, আসতে পারেন, আসার সম্ভাবনা আছে বা আসা অসম্ভব নয় তবে সে ব্যক্তিও অমুসলিম কাফির ও ধর্মত্যাগী মুরতাদ বলে গণ্য হবে, যদিও সে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে একজন নবী ও রাসূল বলে মানে, অথবা তাঁকে শ্রেষ্ঠ নবী বলে মানে, অথবা তাঁর শরীয়তের বিধান মেনে চলে।
এই ব্যক্তি মূলত “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”-য় বিশ্বাস করে নি। কারণ কুরআনের মাধ্যমে এবং অগণিত মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে প্রমাণিত তাঁর দ্ব্যর্থহীন শিক্ষাকে অস্বীকার ও অমান্য করলে আর তাঁর নুবুওয়াতের স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ থাকে না।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলামের সোনালী দিনগুলিতে নুবুওয়াতের দাবি করে কেউ ইসলামের ক্ষতিসাধন করতে পারে নি। কারণ এ বিষয়ে মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের সচেতনতা ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু গত কয়েক শতাব্দী যাবত অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে।
বিশেষত ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে মুসলিমদের অজ্ঞতা এবং সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসকগণের কূটকৌশলের কারণে এ সকল ভণ্ড মুসলিম সমাজের বিশেষ ক্ষতি সাধন করতে এবং অসংখ্য মুসলিমকে ধর্মচ্যুত করতে সক্ষম হয়েছে। এ সকল ভণ্ডের অন্যতম পাঞ্জাবের গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৪০-১৯০৮ খৃ)।
১৮৪০ সালে সে পাঞ্জাবের কাদিয়ান নাম স্থানে জন্মগ্রহণ করে। ১৮৭৭ সালের দিকে সে দাবি করে যে, খৃস্টান ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে সে বিশাল একটি গ্রন্থ রচনা করবে। এ সময়ে খৃস্টান মিশনারী ও হিন্দু আর্য সমাজের মানুষের মুসলিমদের খুবই উত্যক্ত করছিল। গোলামের প্রচারণায় অনেকেই তার ভক্তে পরিণত হয়। এ সময়ে সে নিজেকে একজন আল্লাহর ওলী ও কাশফের অধিকারী বলে দাবি করে।
এতে তার অনেক ভক্ত ও মুরিদ তৈরি হয়। ১৮৮৫ সালে (১৩০৩ হিজরীতে) সে নিজেকে শতাব্দীর মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে। তার ভক্তদের অনেকেই সে দাবী মেনে নেয়। ১৮৯১ সালে সে দাবি করে যে, সে ইমাম মাহদী। এরপর সে দাবী করে যে, সে ঈসা মাসীহ। এরপর সে দাবি করে যে, তার কাছে ইলহাম আসে এবং তাকে মুহাম্মাদী দীনকে সংস্কার করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তখন সে বারবার বলত সে আহলূস সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অনুসারী এবং সে নবী নয়। সে যা কিছু বলে সবই ইলহামের মাধ্যমে সরাসরি রাসূলুল্লাহ সা. বা আল্লাহর নিকট থেকে জেনে বলে।
এ সময়ে তার মূল কর্ম ছিল:
(১) নিজেকে ইলহাম, ইলকা ও কাশফপ্রাপ্ত ওলী ও শতাব্দীর মুজাদ্দিদ বলে দাবি করা,
(২) বৃটিশ সরকারে পক্ষে কথা বলা এবং বৃটিশ বিরোধী সকল কর্মের জোরালো নিন্দা করা,
(৩) তার মতের বাইরে সমাজের সকল আলিম-উলামার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা,
(৪) নিজের অনুসারীদেরকে একমাত্র সঠিক মুসলিম বলে দাবি করা ও সাধারণ মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি পৃথক দল তৈরি করা,
(৫) বিভিন্নভাবে বহসের চ্যালেঞ্জ দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এরপর ক্রমান্বয়ে সে নুবুওয়াত দাবি করে। ১৯০১ সালে সে দাবী করে যে, সে একজন নবী এবং সে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। ১৯০৮ সালে সে অভিশপ্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
এখানে উল্লেখ্য যে, গোলাম আহমদ ও তার মত ভণ্ড নবীরা সরাসরি নুবুওয়াত দাবি করে নি; কারণ তাহলে কোনো মুসলিমই তার দাবি গ্রহণ করবে না। বরং তারা প্রথমে বেলায়াত, কাশফ, ইলহাম, ইলকা, মুজাদ্দিদত্ব ইত্যাদি দাবি করে। এগুলি সবই ইসলামী পরিভাষা ও ইসলাম স্বীকৃত বিষয়।
কিন্তু এগুলির অর্থ ও মর্ম না জানার কারণে অনেকেই এ সকল কথা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়। এভাবে তারা যখন কিছু মানুষকে তাদের একান্ত ভক্ত হিসেবে পেয়ে যায়, তখন বিভিন্ন কৌশলে নুবুওয়াত দাবি করে। আর তার অনুসারী ভক্তরা বিভিন্ন অজুহাত ও ব্যাখ্যা দিয়ে তার দাবি মেনে নেয়।
যুগে যুগে মুসলিম সমাজে মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক আসবেন বলে আবূ দাউদ সংকলিত একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কেউ কখনোই নিজেকে মুজাদ্দিদ দাবি করেন নি। আলিমদের কর্ম বিবেচনা করে সাধারণত তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে পরবর্তী যুগের আলিমগণ কাউকে কাউকে মুজাদ্দিদ বলে মনে করেছেন। এ-ই ‘মনে করা’ বা ধারণা করাও একান্তই ব্যক্তিগত ইজতিহাদ।
কোন্ যুগে কে বা কারা মুজাদ্দিদ ছিলেন সে বিষয়ে আলিমদের অনেক মতভেদ রয়েছে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর পূর্বে কেউ কখনো নিজেকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন নি। যদি কেউ নিজেকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে, অথবা তার অনুসারীগণ তার জীবদ্দশাতেই তাকে মুজাদ্দিদ বলে দাবি ও প্রচার করে আর তিনি তা সমর্থন করেন এবং তার এই ‘পদমর্যাদা’-র কারণে তার মতের বিশেষত্ব, অভ্রান্ততা বা পবিত্রতা দাবি করেন তবে তিনিও অনুরূপভাবে মিথ্যাবাদী ভণ্ড প্রতারক বা শয়তান কর্তৃক প্রতারিত।
এগুলি সবই নুবুওয়াত দাবি করার বিভিন্ন পর্যায় ও পদক্ষেপ। এগুলির পরে কেউ যদি সরাসরি নুবুওয়াত দাবি করে তবে সে নিঃসন্দেহে প্রতারক ভণ্ড ও ধর্মত্যাগী মুরতাদ কাফির।3বিস্তারিত দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ. ১১৫-২৪০।
মহান আল্লাহ শয়তানের ষড়যন্ত্র জাল থেকে মুসলিমগণকে হেফাযত করুন। আমিন।
1 Comment
এইচ, এম, হুজ্জাতুল্লাহ
খুব সুন্দর আলোচনা । মাশা আল্লাহ