আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

সাম্প্রতিক সংবাদ

চাঁদ দেখে ঈ‌দের বিধান

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

বিভক্তি ও মতভেদের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত মুসলিম উম্মাহর বিভক্তি বৃদ্ধি পায় রামাদানে। বিশেষত চাঁদ দেখে সিয়াম ও ঈদ পালন বিষয়ে মতভেদ ক্রমান্বয়ে ব্যাপক হচ্ছে। কুরআন কারীমে আল্লাহ বলেছেন:

شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآَنُ…. فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ
“রামাদান মাস, যাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে… অতএব তোমাদের মধ্যে যে-ই এ মাসটিতে উপস্থিত হবে সে তাতে সিয়াম পালন করবে।”1সূরা বাকারা: ১৮৫ আয়াত

এ থেকে জানা যায় যে মুমিন রামাদান মাস প্রত্যক্ষ করলে বা রামাদান মাস উপস্থিত হলেই মুমিনকে সিয়াম পালন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: (صوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته) “ তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম পালন করবে এবং চাঁদ দেখে ঈদুল ফিতর পালন করবে।2বুখারী-মুসলিম

এ আয়াত ও হাদীসে আলোকে অনেক সচেতন মুমিন বিশ্বের যে কোনো স্থানে রামাদানের চাঁদ দেখা গেলেই সিয়াম পালন শুরু করেন এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলেই ঈদুল ফিতর পালন করেন।

কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আচরিত সুন্নাতকে সামনে রাখা আমাদের প্রয়োজন। সুন্নাতের আলোকে আমরা দেখি যে, তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ ছাড়া সিয়াম পালনের অনুমতি দেন নি। সুন্নাতের আলোকে আমরা দেখি যে, ‘চাঁদ দেখে সিয়াম বা ঈদের’ অর্থ এ নয় যে, যে কেউ যেখানে ইচ্ছা চাঁদ দেখলেই ঈদ করা যাবে।

এ হাদীসের অর্থ: চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে তোমরা সিয়াম পালন কর এবং চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে ঈদুল ফিতর পালন কর। চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার সুন্নাহ নির্দেশিত পদ্ধতি শাসক বা প্রশাসকের নিকট সাক্ষ্য গৃহীত হওয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সাক্ষ্য গৃহীত হলে বা চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলেই শুধু ঈদ করা যাবে।

রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সমাজের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ঈদ পালন করতে নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
الْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ النَّاسُ وَالأَضْحَى يَوْمَ يُضَحِّي النَّاسُ

“যে দিন সকল মানুষ ঈদুল ফিত্র পালন করবে সে দিনই ঈদুল ফিত্র-এর দিন এবং যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করবে সে দিনই ঈদুল আযহার দিন।”3তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৫ (কিতাবুস সাওম, বাবু মা জাআ ফিল ফিতরি ওয়াল আদহা মাতা ইয়াকূনু তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।

প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাসরূক বলেন, আমি একবার আরাফার দিনে, অর্থাৎ যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখে আয়েশা (রা)-এর নিকট গমন করি। তিনি বলেন, মাসরূককে ছাতু খাওয়াও এবং তাতে মিষ্টি বেশি করে দাও।

মাসরূক বলেন, আমি বললাম, আরাফার দিন হিসাবে আজ তো রোযা রাখা দরকার ছিল, তবে আমি একটিমাত্র কারণে রোযা রাখি নি, তা হলো, চাঁদ দেখার বিষয়ে মতভেদ থাকার কারণে আমার ভয় হচ্ছিল যে, আজ হয়ত চাঁদের দশ তারিখ বা কুরবানীর দিন হবে।

তখন আয়েশা (রা) বলেন: اَلنَّحْرُ يَوْمَ يَنْحَرُ الإِمَامُ وَالْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ الإِمَامُ

যেদিন রাষ্ট্রপ্রধান কুরবানীর দিন হিসাবে পালন করবেন সে দিনই কুরবানীর দিন। আর যেদিন রাষ্ট্রপ্রধান ঈদুল ফিতর পালন করবে সে দিনই ঈদের দিন।”4বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১৭৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৯০; মুনযিরী, তারগীব ২/৬৮। মুনযিরী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

মুমিনের জন্য নিজ দেশের সরকার ও জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈদ করা রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ। অন্য দেশের খবর তো দূরের কথা যদি কেউ নিজে চাঁদ দেখেন কিন্তু রাষ্ট্র তার সাক্ষ্য গ্রহণ না করে তাহলে তিনিও একাকী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপরীতে ঈদ করতে পারবেন না।

সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, এক্ষেত্রে ভুল হলেও ঈদ, হজ্জ, কুরবানী সবই আদায় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ভুলের জন্য মুমিন কখনোই দায়ী হবেন না।5ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৫৬।

সরকারের পাপাচার বা ইসলাম বিরোধিতার অজুহাতে এ সকল ক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা শরীয়ত নিষিদ্ধ। কোনো মুসলিম দেশকে ‘দারুল হারব’ বা ‘তাগূতী’ রাষ্ট্র বলে গণ্য করা খারিজী ও শীয়াগণের পদ্ধতি। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত শাসক বা সরকারের পাপ বা কুফরীর কারণে মুসলিমদের দেশকে কাফিরের দেশ বানান নি।

ইয়াযীদের জুলম-পাপের রাষ্ট্র, মামূনের কুফরী মতবাদের রাষ্ট্র, আকবারের দীন ইলাহীর রাষ্ট্র ও অন্যান্য সকল মুসলিম রাষ্ট্রকেই তারা ‘দারুল ইসলাম’ হিসেবে গণ্য করেছেন এবং জুমুআ, জামা‘আত, ঈদ, জিহাদ, হজ্জ ইত্যাদি সকল বিষয়ে এরূপ সকল দেশে দারুল ইসলামের আহকাম পালন করেছেন।

বর্তমানে ‘সারা বিশ্বে একদিনে ঈদ’ বিষয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। তবে ‘সকল দেশে একদিনে ঈদ’ পালনের নামে ‘একই দেশে একাধিক দিনে ঈদ’ পালন নিঃসন্দেহে ইসলামী নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা ও মতবিনিময় অবশ্যই হতে পারে।

রাষ্ট্র যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্য কোনো দেশের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করে ঘোষণা দেয় তবে জনগণ তা অনুসরণ করবে। তবে আমাদের বুঝতে হবে যে, মহান আল্লাহ ইসলামকে সহজ-পালনীয় করেছেন।

বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে বিশ্বের কোথাও চাঁদ উঠলে সকল দেশেই তা জানা সম্ভব। কিন্তু অতীতে তা ছিল না। আর দূরবর্তী এলাকার চাঁদের খবর নিতে কেউ চেষ্টা করেন নি। মদীনায় চাঁদ দেখার পরে -ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহায় রাতারাতি বা ৯ দিনের মধ্যে- দ্রুত দূরবর্তী অঞ্চলে সংবাদ প্রদানের চেষ্টা বা সর্বত্র একই দিনে ঈদ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা রাসূলুল্লাহ সা. বা খুলাফায়ে রাশেদীন করেন নি।

সাহাবীগণের যুগ থেকেই

একাধিক দিবসে ঈদ হয়েছে বলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানছি। একাধিক দিনে ঈদ পালনের বিষয়টিকে সাহাবীগণ কোনোভাবেই অন্যায়, অনুচিত বা ইসলামী নির্দেশনা বিপরীত বলে গণ্য করেন নি। বরং এভাবে একাধিক দিনে ঈদ পালনকেই সুন্নাতের সঠিক নির্দেশনা বলে গণ্য করেছেন। ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস সংকলিত নিম্নের হাদীসটি দেখুন:

عَنْ كُرَيْبٍ أَنَّ أُمَّ الْفَضْلِ بِنْتَ الْحَارِثِ بَعَثَتْهُ إِلَى مُعَاوِيَةَ بِالشَّامِ قَالَ فَقَدِمْتُ الشَّامَ فَقَضَيْتُ حَاجَتَهَا وَاسْتُهِلَّ عَلَىَّ رَمَضَانُ وَأَنَا بِالشَّامِ فَرَأَيْتُ الْهِلاَلَ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ ثُمَّ قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ فِى آخِرِ الشَّهْرِ فَسَأَلَنِى عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبَّاسٍ – رضى الله عنهما – ثُمَّ ذَكَرَ الْهِلاَلَ فَقَالَ مَتَى رَأَيْتُمُ الْهِلاَلَ فَقُلْتُ رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ.

فَقَالَ أَنْتَ رَأَيْتَهُ فَقُلْتُ نَعَمْ وَرَآهُ النَّاسُ وَصَامُوا وَصَامَ مُعَاوِيَةُ. فَقَالَ لَكِنَّا رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ السَّبْتِ فَلاَ نَزَالُ نَصُومُ حَتَّى نُكْمِلَ ثَلاَثِينَ أَوْ نَرَاهُ. فَقُلْتُ أَوَلاَ تَكْتَفِى بِرُؤْيَةِ مُعَاوِيَةَ وَصِيَامِهِ فَقَالَ لاَ هَكَذَا أَمَرَنَا رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم-.

তাবিয়ী কুরাইব বলেন, উম্মুল ফাদল বিনতুল হারিস (রা) তাঁকে সিরিয়ায় মুআবিয়া (রা)-এর নিকট প্রেরণ করেন। কুরাইব বলেন, আমি সিরিয়া আগমন করি এবং তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ করি। আমি সিরিয়া থাকতেই রামাদান শুরু হলো। আমি শুক্রবারের রতে নতুন চাঁদ দেখলাম। এরপর মাসের শেষে আমি মদীনায় আগমন করলাম।

তখন আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন- চাঁদের কথা উল্লেখ করে বললেন, তোমরা কখন নতুন চাঁদ দেখেছিলে? আমি বললাম শুক্রবারের রাতে।

তিনি বললেন: তুমি নিজে দেখেছিলে? আমি বললাম: হ্যাঁ এবং মানুষেরাও দেখেছিল এবং তারা সিয়াম পালন করেন এবং মুআবিয়া (রা) ও সিয়াম পালন করেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন: কিন্তু আমরা নতুন চাঁদ দেখেছি শনিবার রাতে, কাজেই আমরা ত্রিশ দিন পূর্ণ করা পর্যন্ত সিয়াম পালন করতে থাকব অথবা (শাওয়ালের) নতুন চাঁদ দেখব।

আমি বললাম: মুআবিয়া (রা)-এর চাঁদ দেখা ও তাঁর সিয়াম পালনকেই কি যথেষ্ট হিসেবে গণ্য করবেন না? তিনি বলেন: না, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন।

হাদীসের ব্যাখ্যায় ফকীহগণের অনেক বক্তব্য বিদ্যমান। কিন্তু সব কিছুর বাইরে আমরা এখানে নিশ্চিত হচ্ছি যে, সাাহাবীগণের যুগে একাধিক দিনে সিয়াম ও ঈদ পালন করা হতো এবং এ বিষয়টিকে তাঁরা কোনোভাবেই কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক বলে কল্পনা করেন নি।

কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা এখন যে অর্থ বুঝার দাবি করছি সাহাবীগণ সে অর্থ বুঝেন নি। কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ অনুসারে আমাদের বিশ্বাস করা উচিত দীন পালন ও দীন অনুধাবনে সাহাবীগণ আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। তাঁদের চেয়ে অধিক ধার্মিক, দীনদরদী বা দীন অনুধাবনকারী হওয়ার প্রচেষ্টা বিভ্রান্তির দরজা খুলে দেয়।

বস্তুত, সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও পরবর্তী আলিমগণ বিভিন্ন দেশে একাধিক দিনে ঈদ পালনকে ইসলামী নির্দেশনার বিরোধী বলে গণ্য করেন নি। পক্ষান্তরে একই রাষ্ট্রের মধ্যে বা একই ইমামের (রাষ্ট্রপ্রধানের) অধীনে একাধিক দিনে ঈদ পালনকে সকলেই নিষিদ্ধ, অবৈধ ও ইসলামী নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক বলে গণ্য করেছেন।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
আপনার ইমেইল
Print

মন্তব্য করুন

Your email address will not be published.