ইমাম মাহদী (২)
শত সহস্র ইমাম মাহদী
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া, প্রতিষ্ঠাতা: আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখি যে, যুগে যুগে অনেক মানুষ নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেছেন এবং দ্রুত জুলুম-অনাচার দূর করে ইনসাফপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগে অথবা স্বপ্ন ও কাশফের গল্পে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে গিয়েছেন। সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গিয়েছে। অকারণে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছেন বা রক্ত দিয়েছেন। ইতিহাসের বইগুলো ঘাটলে এরূপ কয়েক হাজার প্রসিদ্ধ ‘ইমাম মাহদী’-র পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে অল্প কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি।
(১) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান হাসানী: আন- নাফসুস যাকিয়্যাহ (৯৩-১৪৫ হি)
তিনি আলী-বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম, আবিদ ও বীর ছিলেন। আব্বাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আগে নবী-বংশের খিলাফতের নামে আব্বাসী নেতৃবৃন্দ তাঁর হাতেই বাইয়াত করেন। কিন্তু ১৩২ হিজরীতে উমাইয়াগণের পতনের পর আব্বাসীগণ ক্ষমতা দখল করেন। দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা মানসূর (১৩৬-১৫৮ হি) তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করেন। তিনি লুকিয়ে থাকার কারণে খলীফার বাহিনী তাঁর পিতা ও আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতার করে এবং নির্যাতন করে হত্যা করেন। এ পর্যায়ে তিনি বিদ্রোহ করেন। মদীনা, বসরা ও অন্যান্য স্থানে তাঁকে খলীফা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু আব্বাসী সেনাবাহিনী ১৪৫ হিজরীতে তাকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হয়। তৎকালীন অনেক নেককার বুজুর্গ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম তাকে ইমাম মাহদী বলে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাঁর বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন।1যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩১৯; যিরকলী, আল-আ’লাম ৬/২২০।
(২) তৃতীয় আব্বাসী খলীফা মাহদী (জন্ম: ১২৭, খিলাফাত: ১৫৮-১৬৯ হি)
তিনি দ্বিতীয় আব্বাসী খলীফা আবূ জাফর মানসূরের পুত্র। মনসূরের মূল নাম আব্দুল্লাহ। তিনি পুত্রের নাম রাখেন মুহাম্মাদ। মানসূরের মৃত্যুর পর মাহদী খলীফা হন। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করতেন। তার এ দাবীর পক্ষে কিছু দুর্বল হাদীসও বিদ্যমান, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে, ইমাম মাহদী আব্বাসের বংশধর হবেন।2ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাত ৪/৪৫; ইবনুল কাইয়িম, আল-মানারুল মুনীফ, পৃ. ১৪১-১৪৮।
(৩) হুসাইন ইবন যাকরাওয়াইহি ইবন মাহরাওয়াইহি (২৯১ হি)
তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। তিনি সিরিয়ার বিভিন্ন দেশ দখল করে লুটপাট ও গণহত্যা চালান। সর্বশেষ আব্বাসী খলীফা মুকতাফী বিল্লাহ নিজের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে এই ইমাম মাহদীর বাহিনীকে পরাজিত করেন ও তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন।3ইবনুল আদীম, বুগইয়াতুত তালাব ফী তারীখি হালাব (শামিলা) ১/৩০০।
(৪) উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন কাদ্দাহ (২৫৯-৩২২ হি)
তৃতীয় হিজরী শতকের শেষ প্রান্তে ২৯৬ হিজরী সালে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে প্রচার করেন। কাইরোয়ানে ২৯৭ হিজরীতে তাঁর অনুসারীরা ইমাম মাহদী ও ইমামে যামান হিসেবে তার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে। দ্রুত তারা মরক্কোয় তাদের ‘ফাতিমী’ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ৩৫৮ হিজরীতে তার বংশধর মিসর দখল করেন। প্রায় দুই শতাব্দী পর ৫৬৭ হিজরী সালে সালাহুদ্দীন আইউবীর হাতে মিসরের ফাতিমী শীয়া মাহদী রাজত্বের পতন ঘটে।4ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/৪৫-৪৬; ইবনুল কাইয়িম: আল-মানারুল মুনীফ, পৃ ১৪১-১৪৮; যিরকলী, আল-আ’লাম ৪/১৯৭।
(৫) হুসাইন ইবন মানসূর হাল্লাজ (৩০৯ হি)
তিনি সূফী ও দার্শনিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি নিজেকে আল্লাহর মধ্যে ফানাপ্রাপ্ত ও বাকা প্রাপ্ত ওলী, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, নতুন শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, ইমাম মাহদী ইত্যাদি দাবি করেন। তাঁর অনুসারীরা তাঁর বহু অলৌকিক ক্ষমতার কথা প্রচার করে। ৩০৯ হি. সালে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়। তবে তাঁর অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি নিহত হন নি, বরং তাঁর একজন শত্রুকে তার আকৃতি প্রদান করে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছেন।5যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৪/৩১৩-৩৫৪; যিরকলী, আল-আ’লাম ২/২৬০।
(৬) আল-মুয়িয্য ইবনুল মানসূর: মাআদ ইবন ইসমাঈল ইবন উবাইদুল্লাহ ফাতিমী (৩৬৫ হি)
পূর্বোক্ত উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন-এর পৌত্র। তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী হিসেবে দাবি করেন। তিনি কয়েক দিন নির্জনে থাকেন এবং দাবি করেন যে, তিনি এ সময়ে আরশে আল্লাহর সাথে ছিলেন। তার অনুসারীরা তার অগণিত কারামত প্রচার করতেন। এভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে তার গভীর প্রভাব পড়ে। তিনি ক্রমান্বয়ে মিসর দখল করে কাইরো শহর প্রতিষ্ঠা করেন।6সুয়ূতী, আল-আরাফুল ওয়ারদী, সম্পাদকের ভূমিকা, পৃ ২৩।
(৭) বালিয়া (৪৮৪ হি)
এ ব্যক্তি শয়তান-সাধক ও জ্যোতিষী (ধংঃৎড়ষড়মবৎ) ছিল। মানুষদেরকে অনেক ভেল্কি দেখিয়ে ৪৮৩ হি. সালে দাবি করে যে, সেই ইমাম মাহদী। তাকে যে অবিশ্বাস করবে সে কাফির। সাধারণ মানুষেরা অনেকেই তাকে বিশ্বাস করে তার দলে যোগ দেয়। সে বসরা অঞ্চলে অনেক শহর ও গ্রাম দখল করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এ বছরেরই শেষ প্রান্তে সে ধৃত ও নিহত হয়।7ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১২/১৬৮।
(৮) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন তাওমারত (৪৮৫-৫২৪ হি)
৬ষ্ঠ হিজরী শতকের শুরুতে মরোক্কোয় তিনি আলিম, আবিদ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি নিজেকে আলীর বংশধর ও ইমাম মাহদী বলে দাবি ও প্রচার করেন। দ্রুত তাঁর অনুসারী বাড়তে থাকে। মরোক্কোর শাসক ইবন তাশফীনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ‘বিশুদ্ধ’ ইসলামী রাষ্ট প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অনুসারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। রাষ্ট্র দখলের আগেই তার মৃত্যু হয়। তার সাথী ও খলীফা আব্দুল মুমিন মরক্কোর শাসনক্ষমতা দখল করে নতুন রাজবংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।8ইবন তাইমিয়া, মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/৪৫; যিরকলী, আল-আ’লাম ৬/২২৮।
(৯) আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন হাশিম মুলাস্সাম (৬৫৮-৭৪০ হি)
মিসরে ফকীহ, আবিদ, সূফী ও ওলী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। একপর্যায়ে ৬৮৯ সালে তিনি নিজেকে মাহদী হিসেবে দাবি করেন। তিনি তার কারামত ও হাল সম্পর্কে আল্লাহর নামে শপথ করে অনেক দাবি-দাওয়া করেন। তিনি দাবি করেন যে, তিনি মহান আল্লাহকে স্বপ্নে দেখেন ও তাঁর সাথে কথা বলেন, তাকে মহান আল্লাহর কাছে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি তাকে মাহদী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া অনেক দাবি-দাওয়া তিনি ও তার অনুসারীরা করেন। তাকে কয়েকবার কারারুদ্ধ করা হয়।
(১০) শাইখ আবুল আব্বাস আহমাদ ইবন আব্দুল্লাহ সালজামাসী, ইবন মহাল্লী (৯৬৭-১০২২ হি)
মরক্কোর সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও সূফী ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি ফিকহে পারদর্শিতা অর্জন করেন। এরপর তিনি তাসাউফের বিভিন্ন তরীকায় অনুশীলন করে কাশফ-কারামত সম্পন্ন সূফী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তার কারামত ও ইবাদতের প্রসিদ্ধির কারণে দলেদলে মানুষ তার ভক্ত হয়ে যায়। তিনি সমাজে প্রচলিত অন্যায়, জুলুম ও পাপাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। তিনি পাপী ও জালিম শাসকদের বিরুদ্ধে জিহাদের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেন। মরোক্কোর তৎকালীন শাসকের বাহিনীকে বিভিন্ন যুদ্ধে পরাজিত করে তিনি সালজামাসা শহর অধিকার করেন এবং তথায় তিন বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি ইনসাফ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। ১০২২ হিজরীতে এক যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মরক্কো শহরের প্রাচীরে তার ও তার কয়েকজন ঘনিষ্ট ভক্তের কর্তিত মাথা প্রায় ১২ বৎসর ঝুলানো ছিল। তার অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, তিনি নিহত হন নি, বরং তিনি লুকিয়ে রয়েছেন এবং যথাসময়ে প্রকাশিত হবেন। পরবর্তী কয়েকশত বৎসর পর্যন্ত অনেক মানুষ এরূপ বিশ্বাস পোষণ করতেন।9যিরকলী, আল-আ’লাম ১/১৬১।
(১১) মুহাম্মাদ আহমদ ইবন আব্দুল্লাহ (১২৫৯-১৩০২হি/১৮৮৫খৃ)
সুদানের সুপ্রসিদ্ধ সূফী ও ইমাম মাহদী। সুদানের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁর প্রভাব সুদূর প্রসারী। ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শিতা অর্জনের পর তিনি তাসাউফের অনুশীলন, ইবাদত-বন্দেগি এবং শিক্ষা প্রচারে মনোনিবেশে করেন। ক্রমান্বয়ে তার ভক্ত-মুরীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তিনি শাসকদের অনাচার থেকে দেশকে পবিত্র করার দাওয়াত দিতে থাকেন। ১২৯৮ হি/১৮৮১ খৃস্টাব্দে তিনি নিজেকে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। সুদানের আলিমদের পত্র লিখে তাকে সহযোগিতা করতে আহ্বান জানান। তিনি ‘দরবেশ’ উপাধিতে আখ্যায়িত তাঁর অনুসারীদেরকে সুদানের সকল অঞ্চলে জিহাদের দাওয়াত দিতে প্রেরণ করেন। মিসর-সুদানের সরকারী বাহিনী ও বৃটিশ বাহিনী অনেকবার মাহদীর বাহিনীকে নির্মূল করতে চেষ্টা করে। কিন্তু মূলত এ সকল বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। সমগ্র সুদান মাহদীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে অল্প কিছুৃ দিনের মধ্যেই তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত ও অনুসারীরা তাদের রাজত্ব সংরক্ষণের চেষ্টা করেন। তবে অল্প সময়েই তারা পরাজিত হন এবং সুদান ও মিসর বৃটিশের অধীনে চলে যায়।10যিরকলী, আল-আ’লাম ৬/২০।
(১২) আলী মুহাম্মাদ ইবন মিরযা রিদা শীরাযী (১২৬৬ হি/ ১৮৫০খৃ)
বাবিয়্যা বাহায়ী মতবাদের মূল প্রতিষ্ঠাতা। ইরানের শীরায প্রদেশে তার জন্ম। সংসার ত্যাগ, সাধনা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রৌদ্রে অবস্থান ইত্যাদি দ্বারা তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি নিজেকে প্রথমে ‘আল-বাব’ অর্থাৎ দরজা উপাধিতে আখ্যায়িত করেন। এরপর তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করেন। স্বভাবতই অনেক মানুষ তার অনুসারী ও ভক্ত হয়ে যায়। সর্বশেষ তিনি সকল ধর্মের সমন্বয়ে নতুন এক ধর্মের উদ্ভাবন করেন। তার এ নতুন ধর্ম সমাজে অনেক হানাহানি সৃষ্টি করে। ১৮৫০ খৃস্টাব্দে তাকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়।১১যিরকলী, আল-আ’লাম ৫/১৭।
(১৩) মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (১৮৪০-১৯০৮খৃ)
কাদিয়ানী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। সে প্রথম দিকে সূফী দরবেশ ও কাশফ-কারামতের অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। ইসলামের পক্ষে হিন্দু ও খৃস্টানদের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও বইপত্র লিখে বৃটিশ শাসিত মুসলিমদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হিন্দু ও খৃস্টানদের প্রতিবাদের নামে ১৮৮০ সালে বারাহীন আহমাদিয়া নামক গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড প্রকাশ করে। গ্রন্থটি মূলত তার নিজের কাশফ ও কারামতের দাবি-দাওয়ায় পরির্পূণ। ক্রমান্বয়ে তার দাবি-দাওয়া বাড়তে থাকে। ১৩০২ হিজর সালে (১৮৮৫খৃ) সে নিজেকে চতুর্দশ হিজরী শতকের মুজাদ্দিদ বলে দাবি করে। ১৮৯১ সালে সে নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করে। এরপর নিজেকে ঈসা মাসীহ বলে দাবী করে। এরপর নিজেকে ওহী-প্রাপ্ত ছায়া নবী বলে দাবি করে। সর্বশেষ ১৯০১ সালে সে নিজেকে তিন লক্ষ মুজিযা প্রাপ্ত পূর্ণ নবী বলে দাবি করে। ১৯০৮ খৃস্টাব্দে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়। বিস্তারিত দেখুন: ঊযংধহ ঊষধযর তধযববৎ, ছধফরুধহরধঃ ধহ অহধষুঃরপধষ ঝঁৎাবু.
(১৪) মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানী (১৪০০ হি/১৯৭৯ খৃ)
১৪০০ হিজরী সালের প্রথম দিনে (১৯/১১/৭৯) এ মাহদীর আবির্ভাব। জুহাইমান উতাইবী নামক একজন সৌদি ধার্মিক যুবক সমাজের অন্যায় অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ আলিমগণ তাকে ভালবাসতেন। ক্রমান্বয়ে জুহাইমানের আন্দোলনে অনেক শিক্ষিত ও ধার্মিক যুবক অংশ গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে জুহাইমানের একজন আত্মীয় মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ কাহতানীকে তিনি প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী হিসেবে ঘোষণা করেন। কাহতানী নিজে এবং তার অনেক অনুসারী স্বপ্নে দেখতে থাকেন যে, রাসূলুল্লাহ (ৎ) স্বয়ং কাহতানীকে ‘ইমাম মাহদী’ বলে জানাচ্ছেন। এভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে তারা সুনিশ্চিত হন যে কাহতানীই ইমাম মাহদী। যেহেতু কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, কাবা শরীফের পাশে হাজারে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহীমের মধ্যবর্তী স্থানে মাহদীর বাইয়াত হবে, এজন্য তারা ১৪০০ হিজরীর প্রথম দিনে এ বাইয়াত সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। অনেকগুলো লাশের কফিনের মধ্যে অস্ত্র ভরে ১/১/১৪০০ (১৯/১১/৭৯) ফজরের সময় তারা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। সালাতের পর তারা মসজিদ অবরোধ করেন এবং ইমাম ও মুসল্লীদেরকে ইমাম মাহদীর বাইয়াত গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। সৌদি সরকারী বাহিনী দীর্ঘ ১৫ দিন প্রাণান্ত প্রচেষ্টার পর অবরুদ্ধ মাসাজিদুল হারাম মুক্ত করেন। ইমাম মাহদী ও তার অনেক অনুচর নিহত হয়। এছাড়া অনেক হাজী ও মুসল্লীও উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিহত হন।
(১৫) হুসাইন ইবন মূসা হুসাইন আল-লুহাইদী
বর্তমান যুগের ‘ইমাম মাহদীগণের’ একজন। তিনি কুয়েতের অধিবাসী। যুবক বয়সে পাপাচারের পথে ছিলেন। এরপর তিনি ইবাদত-বন্দেগি ও নির্জনতার মধ্যে বাস করতে থাকেন। সমাজের অবক্ষয়ের অজুহাতে মসজিদে সালাত আদায় বর্জন করেন। একপর্যায়ে তিনি দাবি করেন যে তিনি ইমাম মাহদী, তার কাছে আল্লাহর ওহী ও ইলহাম আসে। নষ্ট সমাজ পরিবর্তনের বিষয়ে অনেক কথা তিনি বলেন। ফলে অনেকেই তার ভক্ত হয়ে পড়েছে। আমরা দেখেছি যে, সহীহ হাদীসগুলোতে বলা হয়েছে, প্রতিশ্রুত মাহদীর নাম ও পিতার নাম রাসূলুল্লাহ (ৎ)Ñএর মতই হবে। এ বিষয়টি প্রমাণ করে যে, লুহাইদী মাহদী নয়। এজন্য এর ব্যাখ্যায় লুহাইদী প্রচার করে যে, এ সকল হাদীসে মূলত রাসূলুল্লাহ ৎ- এর পুনরাগমনের কথা বলা হয়েছে। তিনি পুনরুজ্জীবিত হয়ে কবর থেকে বেরিয়ে আসবেন। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে তার অনেক ভক্ত অনুসারী বিদ্যমান। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের আলিমগণ তার বিভ্রান্তিগুলো প্রকাশ করে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বিভ্রান্তির কারণ ও প্রতিকার
ইতিহাসে এ জাতীয় শত শত ‘ইমাম মাহদী’-র সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছেন, হত্যাকারী বা নিহত হয়েছেন এবং অনেকে ঈমানহারা হয়েছেন। মাহদী দাবিদার ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অনেক ভ- ও প্রতারক থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক আলিম, আবিদ ও নেককার মানুষও ছিলেন। তাদের বিভ্রান্তির পিছনে তিনটি মৌলিক কারণ কার্যকর বলে আমরা দেখি:
(১) সমাজ পরিবর্তনের অন্ধ আবেগ
সকল সমাজেই পাপ ও জুলুম বিদ্যমান। পাপাচারী, জালিম ও ধর্মহীনদের সংখ্যা সবসময়ই ধার্মিকদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আবেগী ধার্মিক মানুষ, বিশেষত যুবক, এ সকল অন্যায় দূর করে ‘আদর্শ’ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। স্বাভাবিকভাবে ইলম প্রসার ও দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ‘কষ্টকর’, ‘দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ’ ও ‘অসম্ভব’ বলে মনে হয়। এজন্য ‘জিহাদ’ বা ‘ইমাম মাহদী’ বিষয়টি খুবই আকর্ষণীয় বলে গণ্য করেন অধিকাংশ আবেগী ধার্মিক মানুষ। ফলে এ জাতীয় কোনো কথা শুনলে বাছবিচার না করেই শরীক হয়ে যান তারা।
অষ্টম-নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবন খালদূন আব্দুর রাহমান ইবন মুহাম্মাদ (৭৩২-৮০৮ হি) মাহদীর প্রত্যাশায় শীয়া ও সূফীগণের বিভিন্ন মত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মাহদীর ধারণার সাথে মুজাদ্দিদের ধারণা মিশ্রিত হয়ে গিয়েছে। সকলেই অপেক্ষা করেন, এই তো মুজাদ্দিদ বা মাহদী এসে ধর্ম, দেশ, জাতি ও সমাজকে ভাল করে ফেলবেন।
ইবন খালদূন, তারীখ ১/৩২৭। এগুলো সবই পলায়নী মনোবৃত্তির প্রকাশ। ফলাফলের চিন্তা না করে দীন পালন ও প্রচারের দায়িত্ব সাধ্যমত আঞ্জাম দেওয়াই মুমিনের কাজ। দুনিয়ায় ফলাফল যা-ই হোক না কেন এরূপ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মুমিন আখিরাতের অফুরন্ত নিয়ামত ও মর্যাদা লাভ করেন। মাহদী বা মুজাদ্দিদ অনুসন্ধান বা অনুসরণের নামে মুমিন মূলত নিজের এ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ান।
(২) স্বপ্ন-কাশফের উপর নির্ভর করা
মাহদী দাবিদার অধিকাংশ ব্যক্তি ও তার অনুসারীগণ আল্লাহর কসম করে দাবি করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ৎ) উক্ত ব্যক্তিকে মাহদী বলে স্বপ্নে বা কাশফ-ইলহামের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়েছেন। আর রাসূলুল্লাহ (ৎ)-কে স্বপ্নে দেখার কথা শুনলেই মুমিন দুর্বল হয়ে পড়েন। অথচ রাসূলুল্লাহ (ৎ) বলেছেন যে, শয়তান তাঁর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না; তাঁর নাম ধরে জালিয়াতি করতে পারে না- তা তিনি বলেন নি। স্বপ্নে যদি তাঁকে হুবহু দুনিয়ার আকৃতিতে দেখা যায় তবেই তাঁকে দেখা বলে গণ্য হবে। তারপরও স্বপ্নের বক্তব্য অনুধাবন ও ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। এছাড়া স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় শয়তান নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ৎ) দাবি করে মিথ্যা বলতে পারে। বস্তুত, মুসলিমদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ স্বপ্ন, ইলহাম ইত্যাদিকে দীনের দলীল হিসেবে গণ্য করা।
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, শেষ যুগে একজন ন্যায়পরায়ণ সুপথপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম বিশ্ব শাসন করবেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করার প্রমাণ কী? যদি কারো নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইতুল্লাহর পাশে বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি সব মিলে যায় তারপরও তাকে ‘মাহদী’ বলে বিশ্বাস করার কোনোরূপ দলীল নেই। কারণ মাহদীর মধ্যে এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকবে, কিন্তু এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেই তিনি মাহদী নন।
কোনো হাদীসে কোনোভাবে বলা হয় নি যে, মহান আল্লাহ কাউকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ হিসেবে গ্রহণ করলে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দিবেন। কাজেই যিনি নিজেকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন তিনি নিঃসন্দেহে মিথ্যাচারী প্রতারক বা প্রতারিত। তিনি কিভাবে জানলেন যে, তিনি মাহদী বা মুজাদ্দিদ? একমাত্র ওহীর মাধ্যমেই কারো বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা যায়। নবীগণ ওহীর মাধ্যমে তাঁদের নুবুওয়াতের কথা জেনেছেন। এ সকল দাবিদার কিভাবে তাদের বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানলেন?
সাধারণত তারা ওহীর দাবি করেন না; কারণ তাতে মুসলিম সমাজে তারা ভ- নবী বলে গণ্য হবেন। এজন্য তারা স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে তা জানার দাবি করেন। সরলপ্রাণ মুসলিমগণ এতে প্রতারিত হন। অথচ স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি করা আর ওহীর লাভের দাবি একই। কারণ যে ব্যক্তি তার স্বপ্ন বা কাশফের বিষয়কে নিজের বা অন্যের বিশ্বাসের বিষয় বানিয়ে নিয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে তার স্বপ্ন বা কাশফকে নবীদের স্বপ্নের মত ওহীর সম-পর্যায়ের বলে দাবি করেছেন। অনুরূপভাবে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার স্বপ্ন-কাশফ নির্ভর দাবি বিশ্বাস করার অর্থ মুহাম্মাদ (ৎ)-এর পরে কাউকে ওহীপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা।
মাহদী ও অন্য সকল বিষয়ে মুমিন শুধু কুরআন ও হাদীসের কথায় বিশ্বাস করেন। মাহদী ও কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণনামূলক। ভূমিধ্বস হবে, পাহাড় স্থানচ্যুত হবে… অন্যান্য বিষয়ের মত মাহদীর রাজত্বও আসবে। কিয়ামতের কোনো আলামত ঘটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব মুমিনের নয়। অন্যান্য আলামতের মত এ ক্ষেত্রেও ঘটে যাওয়ার পরে মুমিন বলবেন যে, আলামতটি প্রকাশ পেয়েছে। যখন কোনো শাসকের বিষয়ে হাদীসে নির্দেশিত সকল আলামত প্রকাশিত হবে এবং মুসলিমগণ তাকে মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিবেন তখনই মুমিন তাকে মেনে নিবেন।
মুমিনের হয়ত মনে হতে পারে যে, মাহদীকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। চিন্তাটি ভিত্তিহীন। যদি কেউ নিজেকে মাহদী বলে দাবি করেন তবে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে তিনি মিথ্যাবাদী। আর যদি দাবি-দাওয়া ছাড়াই কারো মধ্যে মাহদীর অনেকগুলো আলামত প্রকাশ পায় তবে তার থেকে সতর্কতার সাথে দূরে থাকতে হবে, অবশিষ্ট আলামতগুলো প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত। কারণ তিনি যদি সত্যিকার মাহদী হন তবে আল্লাহই ভূমিধ্বস ও অন্যান্য অলৌকিক সাহায্যের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছে দেবেন। সকল আলামত প্রকাশ পাওয়ার পরে অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয় ও সকল দেশের মুসলিমগণ তাকে মেনে নেওয়ার পরেই শুধু মুমিনের দায়িত্ব তার বাইয়াত করা।
(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীর সরল অর্থ পরিত্যাগ
আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মাহদী বিষয়েও ওহীর অপব্যাখ্যা বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। উপরে আলোচিত মাহদীগণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইয়াতের স্থান, রাজত্বলাভ, জুলুম দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আলামতগুলোর অধিকাংশ বা কোনোটিই পাওয়া যায় না। তারপরও হাজার হাজার মুসলিম তাদের দাবি নির্বিচারে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়েছেন ও হচ্ছেন। হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যগুলো তারা নানান ব্যাখ্যা করে বাতিল করছেন। কারো বিষয়ে একবার সুধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে তার সকল দাবিই ভক্তরা নানা অজুহাতে মেনে নেয়। এজন্য প্রতারকগণ প্রথমে ইবাদত-বন্দেগি, দরবেশি, নির্লোভতা, কাশফ-কারামত ইত্যাদি দেখিয়ে মানুষদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। এরপর নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করে। ফলে তাদের ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিও ভক্তগণ নির্বিচারে বিশ্বাস করেন। ঈমানী দুর্বলতার কারণেই প্রতারকগণ সফল হয়। আমরা দেখেছি, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য দাবি যে, আমরা তাঁর কথা ছাড়া আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করব না। প্রত্যেকের প্রতিটি কথা সুন্নাত দিয়ে যাচাই করব। আর এটিই মুমিনের রক্ষাকবজ।