মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা)-কে যত মুজিযা দিয়েছেন সেগুলির অন্যতম এক মুজিযা হলো ইসরা ও মি’রাজ। “ইসরা” অর্থ “নৈশ-ভ্রমন” বা “রাত্রিকালে ভ্রমণ করানো।” আর “মি’রাজ” অর্থ “ঊর্ধ্বারোহণ” বা “উর্ধক্ষারোহণের যন্ত্র”।
মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এক রাত্রিতে মক্কা মুআজ্জামা থেকে ফিলিস্তিনের ‘আল-মাসজিদুল আকসা’ পর্যন্ত নিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে ঊর্ধ্বে ৭ আসমান ভেদ করে তাঁর নৈকট্যে নিয়ে যান। মক্কা শরীফ থেকে আল-মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে “ইসরা” এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বে গমনকে মি’রাজ বলা হয়।
মিরাজের ঘটনা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনের অত্যতম ঘটনা। কুরআন কারীমে একাধিক স্থানে এ ঘটনার উলেখ রয়েছে। সূরা বনী ইসরাঈলের শুরতে ইসরার ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন:
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آَيَاتِنَا
“পবিত্র তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমন করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য।”((সূরা ইসরা (বনী ইসরাঈল), ১ আয়াত।))
এরপর আল্লাহ মূসা (আ)-কে কিতাব প্রদান, ইহূদীদের দায়িত্ব এবং ইহূদীদের পাপাচারের কারণে দুবার আল-মাসজিদুল আকসা ধ্বংসের কথা উলেখ করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, খৃস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে সূলাইমান (আ)-এর মাসজিদুল আকসা নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। সুলাইমান (আ)-এর পরে ইহূদীরা মুর্তিপূজা, যুদ্ধবিগ্রহ ও পাপচারে লিপ্ত হয়। প্রায় ৪০০ বৎসর পরে খৃস্টপূর্ব ৫৮৬ সালে ব্যবিলনের সম্রাট নেবুকাদনেজার মসজিদে আকসা সমূলে ধ্বংস করে ইহূদীদের বন্দী করে ব্যবিলন নিয়ে যান। প্রায় ৭০ বৎসর পরে তারা মুক্ত হয়ে পুনরায় মসজিদ নির্মাণ করে। এরপর তাদের অবাধ্যতা ও পাপাচারের ধারা অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ ৭০ খৃস্টাব্দে রোমান সম্রাট ভ্যসপাসিয়ানের সময়ে তার পুত্র পরবর্তী সম্রাট টিটো এ মসজিদ সম্পূর্ণভাে ধ্বংস করেন।
বস্তুত মহান আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মাধ্যমে এ পৃথিবীতে তাওহীদের বাণী পুনরুজ্জীবিত করেন এবং তাকে মানব জাতির ইমামত বা নেতৃত্ব প্রদান করেন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বৎসর আগে, খৃস্টজন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ইবরাহীম (আ) ইরাক, সিরিয়া, আরব, মিসর বা তৎকালীন সভ্য জগতে তাওহীদের প্রচার করেন। ইবরাহীম (আ)-এর বড় ছেলে ইসমাঈল (আ) ও ছোট ছেলে ইসহাক (আ)।
আল্লাহ ইবরাহীম (আ)-কে প্রদত্ত এ নেতৃত্বের দায়িত্ব সাময়িকভাবে ইসহাকের ছেলে ইয়াক‚ব বা ইসরাঈল (আ)-এর বংশধরদেরকে প্রদান করেন, যারা বনী ইসরাঈল বা ইহূদী জাতি বলে প্রসিদ্ধ। মহান আল্লাহ এ জাতিকে অনেক বরকত ও করুণা দান করেন। যেরুশালেম বা বাইতুল মাকদিসকে তাওহীদের বরকতময় কেন্দ্র বানিয়ে দেন। হাজার হাজার নবী তথায় আগমন করেন।
কিন্তু এ জাতি সর্বদা অবাধ্যতা ও পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে। ফলে বারংবার আল্লাহ তাদের উপর গযব নাযিল করেন। সর্বশেষ আল্লাহ তাদের হাত থেকে মানবতার নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে ইবরাহীম (আ)-এর বড় ছেলে ইসমাঈল (আ)-এর বংশধরকে প্রদান করেন। যেরুশালেমকে মক্কার নেতৃত্বে দিয়ে দেওয়া হয়। আর এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা) মি’রাজের মুবারক সফরের শুরুতে প্রথমে বাইতুল মাকদিস গমন করে সকল নবীর ইমাম হয়ে সালাত আদায় করেন। তাঁর উম্মাতের পক্ষ থেকে বিশ্ব মানবতার নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর তিন মহান স্রষ্টার সান্নিধ্যে গমন করেন।
মি’রাজের বিষয় কুরআন কারীমে সূরা নাজমেও আল্লাহ উলেখ করেছেন। এ সূরার শুরুতে আল্লাহ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ জীবরাঈল (আ) থেকে ওহী লাভ করেন এবং তিনি জিবরাঈল (আ)-কে তাঁর প্রকৃত আকৃতিতে দেখেছেন। এরপর মিরাজের রাত্রিতে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট জিবরাঈলকে পুনরায় স্বআকৃতিতে দর্শন এবং আল্লাহর অবর্ণনীয় নিয়ামত দর্শনের বিষয়ে আল্লাহ বলেন:
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى وَلَقَدْ رَآَهُ نَزْلَةً أُخْرَى عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى لَقَدْ رَأَى مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى
“সে (মুহাম্মাদ সা.) যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে তার সাথে বিতর্ক করবে? নিশ্বয়ই সে তাকে (জিবরীলকে) আরেকবার দেখেছিল। সিদরাতুল মুনতাহা-র (প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের) নিকট। যার নিকট অবস্থিত জান্নাতুল মা‘ওয়া। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হবার তদ্বারা ছিল আচ্ছাদিত। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয় নি, দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয় নি। সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিল।”((সূরা (৫৩) নাজ্ম: ১২-১৮।))
হাদীস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থে প্রায় ৪০ জন সাহাবী সহীহ বা যয়ীফ সনদে মিরাজের ঘটনার বিভিন্ন দিক ছোট বা বড় আকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে মি’রাজের তারিখ সম্পর্কে একটি কথাও বর্ণিত হয়নি। সাহাবী-তাবিয়ীগণও তারিখ বিষয়ে তেমন কিছু বলেন নি। এসকল হাদীসের শিক্ষা গ্রহণই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। দিবস পালন তো দূরের কথা তারিখ জানার বিষয়ে তাদের আগ্রহ ছিল অতি সামান্য। ফলে তারিখের বিষয়ে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
মি’রাজ একবার না একাধিকবার সংঘঠিত হয়েছে, কোন্ বৎসর হয়েছে, কোন্ মাসে হয়েছে, কোন্ তারিখে হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে এবং প্রায় ২০টি মত রয়েছে। ফাতহুল বারী, উমদাতুল কারী, আল-মাওয়াহিবুল্লা দুনিয়্যাহ, শারুহুল মাওয়াহিব, তারিখে ইবন কাসীর, সীরাহ শামিয়্যাহ ইত্যাদি হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও সীরাতুন্নাবী বিষয়ক যে কোনো মৌলিক আরবী গ্রন্থে আপনারা এ সকল মত দেখতে পারবেন।
কোনো কোনো আলিমের মতে যুলকাদ মাসে, কারো মতে রজব মাসের এক তারিখে, বা রজব মাসের প্রথম শুক্রবারে এবং কারো মতে রজব মাসের ২৭ তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। তবে অধিকাংশ আলিমই বলেছেন যে, রবিউল আউয়াল মাসে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাবিয়ীদের মধ্যে ইমাম যুহরী ও উরওয়া ইবনুয যুবাইর থেকে এ মত বর্ণিত। ইবনু আবী শাইবা সংকলিত এক মুরসাল হাদীসে জাবির (রা) ও ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন, এদিনেই তিনি নুবুওয়াত লাভ করেন, এ দিনেই তিনি মি’রাজে গমন করেন, এদিনেই তিনি হিজরত করেন এবং এদিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।((মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামী, সুবুলুল হুদা (সীরাহ শামিয়্যাহ) ৩/৬৪-৬৬। আরো দেখুন ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/৪৭০-৪৮০; কাসতালানী, আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ ২/৩৩৯-৩৯৮; খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি,. পৃ. ৪০৯।))
মিরাজের বিস্তারিত ঘটনার বিশদ বর্ণনা অনেক সময়ের প্রয়োজন। মিরাজ বিষয়ক সিহাহ সিত্তার হাদীসগুলি একত্রিত করেছেন ইমাম ইবনুল আসীর তাঁর “জামিউল উসূল” গ্রন্থে। এ ছাড়া এ বিষয়ক বিষয়ক প্রসিদ্ধ, অপ্রসিদ্ধ সহীহ-যয়ীফ সকল হাদীস সংকলন ও সমন্বয় করেছেন আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামী তার “সীরাহ শামিয়্যাহ” গ্রন্থে। এগুলির আলোকে সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে মিরাজের সংক্ষেপ ঘটনা আমরা এখানে আলোচনা করব।
রাসূলুল্লাহ (সা) কাবা ঘরের উত্তর পার্শে হাতীম-এর মধ্যে শুয়ে ছিলেন। এমতাবস্থায় জিবরাঈল (আ) কয়েকজন ফিরিশতা সহ তথায় আগমন করেন। তারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বক্ষের উপরিভাগ থেকে পেট পর্যন্ত কেটে তাঁর হৃৎপিণ্ড বের করেন, তা ধৌত করেন এবং বক্ষকে ঈমান, হিকমাত ও প্রজ্ঞা দ্বারা পরিপূর্ণ করেন এবং তাঁর হৃৎপিণ্ডকে পুনরায় বক্ষের মধ্যে স্থাপন করেন। এরপর “বুরাক” নামে আলোর গতি সম্পন্ন একটি বাহন তার নিকট আনয়ন করা হয়। তিনি এ বাহনে বাইতুল মাকদিস বা যেরুশালেমে গমন করেন। মহান আল্লাহ তথায় পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলদেরকে সমবেত করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ইমামতিতে তাঁরা তথায় দু রাক‘আত সালাত আদায় করেন। এরপর “মি’রাজ” আনয়ন করা হয়। “মি’রাজ” অর্থ “ঊধ্বারোহণ যন্ত্র”। এ যন্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে হাদীসে শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। তিনি মি’রাজে উঠে ঊধ্বে গমন করেন এবং একে একে সাত আসমান অতিক্রম করেন। প্রথম আসমানে আদম (আ), দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া (আ) ও ঈসা (আ), তৃতীয় আসমানে ইউসুফ (আ), চতুর্থ আসমানে ইদরীস (আ), পঞ্চম আসমানে হারূন (আ), ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আ) এবং সপ্তম আসমানে ইবরাহীম (আ)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাত, সালাম ও দুআ বিনিময় হয়। এরপর তিনি সৃষ্টিজগতের শেষ প্রান্ত “সিদরাতুল মুনতাহা” গমন করেন।
তথা থেকে তিনি জান্নাত, জাহান্নাম ও মহান আল্লাহর অন্যান্য মহান সৃষ্টি পরিদর্শন করেন ও তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন। মহান আল্লাহর তাঁর উম্মাতের জন্য দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত সালাতের বিধান প্রদান করেন। ফিরে আসার সময় মূসা (আ)-এর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি প্রশ্ন করেন, আল্লাহ আপনাকে কী নির্দেশ দিলেন? তিনি বলেন, তিনি আমাকে দৈনিক ৫০ ওয়াক্ত সালাতের বিধান দিয়েছেন। মূসা (আ) বলেন, আমি আমার উম্মাতের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আপনার উম্মাত এ বিধান মানতে পারবে না, আপনি মহান রবের কাছে ফিরে গিয়ে বিধানটি সহজ করার আবেদন করুন।
রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর মহান রব্বের কাছে ফিরে যেয়ে আবেদন করেন। এতে আল্লাহর দশ রাক‘আত কমিয়ে দেন। মূসা (আ) এবারো আপত্তি করেন এবং আরো সহজ করার জন্য আবেদনের পরামর্শ দেন। এভাবে মূসা (আ)-এর পরামর্শে রাসূলুল্লাহ (সা) বারংবার আল্লাহর দরবারে কমানোর আবেদন করতে থাকেন এবং আল্লাহ প্রতিবার ১০ ওয়াক্ত করে কমাতে থাকেন। সর্বশেষ দশ থেকে কমিয়ে তিনি ৫ ওয়াক্ত নামায ফরয করেন এবং বলেন, আমার নির্দেশ বলবত থাকল, আমি আমার বান্দাদেরকে দশ গুণ সাওয়াব দিব। তারা ৫ ওয়াক্ত সালাতে ৫০ ওয়াক্তের সাওয়াব পাবে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) মিরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করেন।
মিরাজে গমন ও প্রত্যাবর্তনের সময় এবং জান্নাত-জাহান্নামে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বিভিন্ন পাপ ও পুন্যের বিভিন্ন প্রকার শাস্তি ও পুরস্কার দেখানো হয়। এক পর্যায়ে তিনি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর সুগন্ধের ঘ্রাণ লাভ করেন। তিনি বলেন, জিবরাঈল, এটি কিসের সুঘ্রাণ। জিবরাঈল বলেন, এ হলো ফিরাউনের কন্যার চুল আঁচড়ানো দাসী ও তার সন্তানদের সুগন্ধ। দাসীটি ঈমানদার ছিল। একবার চুল আঁচড়ানোর সময় চিরুনী পড়ে গেলে সে বিসমিল্লাহ বলে তা তুলে নেয়। ফিরাউন-কন্যা বলে, আমার পিতার নাম নিয়েই না কর্ম শুরু করতে হবে! দাসীটি বলে, তোমার, আমার ও তোমার পিতার রব্ব আল্লাহর নামে। ফিরাউন-কন্যা ক্রোধান্বিত হয়ে তার পিতাকে বিষয়টি জানায়।
ফিরাউন উক্ত দাসীকে তাওহীদ ত্যাগ করতে চাপ দেয়। কোনো প্রকার ভয়ভীতিতে দাসীটি বিচলিত হয় না। তখন ফিরাউন অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে দাসীকে বলে, তুমি যদি আমার ধর্মে ফিরে না আস তবে তোমার সন্তানগণ সহ তোমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। দাসীটি ঈমানের উপর অবিচল থাকে। তখন একে একে তার সন্তানদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। সর্বশেষ তার কোলে ছিল দুগ্ধপোষ্য একটি শিশু। শিশুটির দিকে তাকিয়ে মায়ের মন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন শিশুটির মুখে আল্লাহ কথা দেন। সে তার মাকে বলে, মা দ্বিধা করো না, তুমি তো সত্যের উপর রয়েছ। আখিরাতের অনন্ত কষ্ট থেকে বাঁচতে দুনিয়ার কয়েক মুহূর্তের কষ্ট কিছুই নয়। দাসীটি তখন শিশুটিকে নিয়ে আগুন বরণ করে নেয়। তাদেরকে আল্লাহ আখিরাতে এরূপ মহান মর্যাদা দিয়েছেন।
তিনি দেখেন যে, কিছু মানুষ শয়ন করে রয়েছে এবং বিশাল পাথর দিয়ে আঘাত করে তাদের মাথা চুর্ণবিচুর্ণ করা হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার মাথাগুলি স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে এবং পুনরায় তাদেরকে এভাবে আঘাত করা হচ্ছে। জিবরাঈল (আ) বলেন, এরা হলো আপনার উম্মাতের ঐ সব মানুষ, যারা ফরস সালাত যথাসময়ে আদায়ে অবহেলা করে, যাদের মস্তিক ফরয সালাত আদায়ের চিন্তা না করে অন্য চিন্তায় রত থাকে।
তিনি দেখেন যে, একব্যক্তি রক্তের নদীতে সাতার কাটছে এবং তাকে বড় বড় পাথর জোর করে গেলান হচ্ছে। জিবরাঈল বলেন, এ হলো সূদ খোরের শাস্তি। তিনি আরো দেখেন যে, কিছু মানুষের হাতে পিতলে নখর লাগানো এবং তার এ নখগুলি দিয়ে প্রচণ্ড জোরে তাদের মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ আঁচড়ে রক্তাক্ত করছে। জিবরাঈল (আ) জানান যে, এরা পৃথিবীতে মানুষদের গীবতে লিপ্ত হতো।
এভাবে তিনি এতিমের সম্পদ ভক্ষণকারী, গীবতকারী, মানুষের মধ্যে শত্র“তাসৃষ্টিকারী, ব্যভিচাÍী ও অন্যান্য পাপীদের কবরের ও জাহান্নামের শাস্তির প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ যিকর, তাহাজ্জুদ, তাহিয়্যাতুল ওযূ, আল্লাহ পথে জিহাদ ও অন্যান্য ইবাদতের পুরস্কার প্রত্যক্ষ করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা) মিরাজের রাত্রিতে আল্লাহকে দেখেছিলেন কি না সে বিষয়ে সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদ রয়েছে। সূরা নাজমের ব্যাখ্যায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর অন্তর দিয়ে দুবার তার রব্বকে দেখেছিলেন। এ মতের অনুসারী সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, মহান আল্লাহ মূসা (আ)-কে তাঁর সাথে কথা বলার মুজিযা দিয়েছিলেন এবং মুহাম্মাদ (সা)-তে তাঁর দর্শনের মুজিযা দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে হযরত আয়েশা ও অন্যান্য সাহাবী বলেছেন যে, তিনি আল্লাহকে দেখেন নি। সহীহ বুখারী সংকলিত হাদীসে প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাসরূক বলেন: “আমি আয়েশা (রা)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলাম।
তিনি বলেন, হে আবূ আয়েশা (মাসরূক), তিনটি কথার যে কোনো একটি কথা যদি কেউ বলে তবে সে আল্লাহ নামে জঘন্য মিথা বলার অপরাধে অপরাধী হবে। আমি বললাম: সে কথাগুলি কী কী? তিনি বলেন, যদি কেউ মনে করে যে, মুহাম্মাদ (সা) তাঁর প্রতিপালককে (আল্লাহকে) দেখেছিলেন তবে সে আল্লাহর নামে জঘন্য মিথ্যচারী বলে গণ্য হবে। মাসরূক বলেন, আমি তখন হেলান দিয়ে ছিলাম। তাঁর কথায় আমি উঠে বসলাম এবং বললাম: হে মুমিনগণের মাতা, আপনি আমাকে একটু কথা বলতে দিন, আমার আগেই আপনার বক্তব্য শেষ করবেন না। আল্লাহ কি বলেন নি: “সে তো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছিল”((সূরা (৮১) তাকবীর: ২৩ আয়াত।)), “নিশ্চয় তাকে সে আরেকবার দেখেছিল”((সূরা (৫৩) নাজম: ১৩ আয়াত।))?
আয়েশা (রা) বলেন: এ উম্মাতের মধ্যে আমিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) উত্তরে বলেন: “এ হলো জিবরীলের কথা। আল্লাহ তাঁকে যে আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন আমি এই দুবার ছাড়া আর কখনো তাঁকে তাঁর সেই প্রকৃত আকৃতিতে দেখি নি। আমি দেখলাম তিনি আকাশ থেকে নেমে আসছেন। তাঁর আকৃতির বিশালত্ব আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী সবকিছু অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে।” আয়েশা বলেন: তুমি কি আল্লাহকে বলতে শোন নি: “তিনি দৃষ্টির অধিগম্য নন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি তাঁর অধিগত; এবং তিনিই সূদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত”((সূরা (৬) আন‘আম: ১০৩ আয়াত।))? তুমি কি আল্লাহকে বলতে শোন নি((সূরা (৪২) শূরা: ৫১ আয়াত।)): “কোনো মানুষের জন্যই সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যম ব্যতিরেকে, অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে, অথবা এমন দূত প্রেরণ ব্যতিরেকে, যে দূত তার অনুমতিক্রমে তিনি যা চান তা ব্যক্ত করেন, তিনি সমুন্নত, প্রজ্ঞাময়”?((বুখারী, আস-সহীহ ৩/১১৮১; মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৫৯-১৬১; তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৬২, ৩৯৪; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/৩১৩, ৮/৬০৬।))
রাসূলুল্লাহ (সা) প্রভাতের দিকে মক্কায় ফিরে আসেন। আবূ বাকর (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি সারারাত কোথায় ছিলেন, আমি রত্রিবেলায় আপনাকে খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাই নি। তিনি তাঁকে মিরাজের কথা জানান। আবূ বাক্র সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন। দিবসে রাসূলুল্লাহ (সা) ইসরার বিষয় আবূ জাহল ও অন্যান্য কাফিরকে জানালে তারা তাদের অভ্যাসমত তা অস্বীকার করে।
উপরন্তু এ বিষয়কে তারা তাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচারের একটি বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বলতে থাকে, বাইতুল মাকদিস বা যিরুশালেম শহরে যেতে আসতে আমাদের মাসাধিক কাল সময় লাগে, আর মুহাম্মাদ নাকি রাতারতি সেখান থেকে ঘুরে এসেছে। কতিপয় দুর্বল ঈমান মানুষ তাদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ইসলাম ত্যাগ করে। এক পর্যায়ে কাফিররা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অপদস্ত করার সমবেত হয়ে তাঁকে বাইতুল মাকদিস বা যিরুশালেম নগরীর বিভিন্ন খুটিনাটি বিষয়ে প্রশ্ন করে।
রাত্রিকালে রাসূলুল্লাহ (সা) শহরকে অত ভালভাবে লক্ষ্য করেন নি। তিনি ভীত হয়ে পড়েন। তখন মহান আল্লাহ বাইতুল মাকদিস শহরকে তাঁর সামনে তুলে ধরেন। তিনি কাফিরদের প্রশ্নের উত্তরে শহরের বর্ণনা প্রদান করেন। মক্কাবাসীদের অনেকেই ব্যবসা উপলক্ষ্যে তথায় যাতায়াত করত। তারা অবাক হয়ে বলতে থাকে, বর্ণনা তো হুবহু মিলে যায়। তখন আবূ জাহল ও তার অনুসারীরা বিষয়টিকে মুহাম্মাদ (সা)-এর যাদু বলে মানুষদেরকে বুঝাতে থাকে।
শুধু আবূ জাহলের সহচরগণই নয়, পরবর্তী হাজার বৎসর যাবৎ অনেকেই বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে বিভিন্নভাবে মিরাজকে অস্বীকার করার বা অপব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অনেকে দাবি করেছে মিরাজ ছিল একটি স্বপ্ন মাত্র। বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে তারা দাবি করেছে যে, পৃথিবীর উপরে বা বিভিন্ন আসমানে বরফ, আগুন, বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদির স্তর রয়েছে, যেগুলি ভেদ করে কোনো মানুষ যেতে পারে না। কেউ দাবি করেছে মধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমরা দেখেছি যে, কুরআন কারীমে আল্লাহ বলেছেন, তিনি তাঁর “বান্দা”-কে মিরাজে নিয়েছিলেন। আর ‘বান্দা’ বলতে আত্মা ও দেহের সমন্বিত মানুষকেই বুঝানো হয়। কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে “বান্দা” বলতে দেহ ও আত্মার সমন্বিত জাগ্রত মানুষকেই বুঝানো হয়েছে, ঘুমন্ত মানুষের আত্মাকে কখনো “বান্দা” বলা হয় নি। অগণিত হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, মি’রাজ জাগ্রত অবস্থাতেই হয়েছিল। এছাড়া আমরা জানি যে, কাফিরগণ ইসরা ও মি’রাজ অস্বীকার করে এবং একে অসম্ভব বলে দাবি করে। এমনকি কতিপয় দুর্বল ঈমান মুসলিম ইসলাম পরিত্যাগ করে। এ থেকে নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) জাগ্রত অবস্থায় দৈহিকভাবে মিরাজ সংঘটিত হওয়ার কথাই বলেছিলেন।
নইলে কাফিরদের অস্বীকার করার ও দুর্বল ঈমান মুসলিমদের ঈমান হারানোর কোনো কারণই থাকে না। স্বপ্নে এরূপ নৈশভ্রমন বা স্বর্গারোহণ কোনো অসম্ভব বা অবাস্তব বিষয় নয় এবং এরূপ স্বপ্ন দেখার দাবি করলে তাতে অবাক হওয়ার মত কিছু থাকে না। যদি কেউ দাবি করে যে, ঘুমের মধ্যে সে একবার পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে এবং একবার পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে চলে গিয়েছে, তবে তার দেহ স্বস্থানেই রয়েছে এবং দৈহিক অবস্থার পরিবর্তন হয় নি, তবে কেউ তার এরূপ স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা অস্বীকার করবে না বা এতে অবাকও হবে না।
আধুনিক বিজ্ঞান সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে, জাগ্রত অবস্থায় সশরীরের এরূপ অলৌকিক নৈশভ্রমন ও ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব নয়। মি’রাজের ঘটনাবালির মধ্যে আরো অনেক বৈজ্ঞানিক মুজিযার সন্ধান পেয়েছেন আধুনিক বিজ্ঞানীরা।
আমরা অনেকে শুধু ২৭শে রজব আসলে মিরাজ আলোচনা করি। আবার কেউ এ দিনে ও রাতে খাস ইবাদত-বন্দেগী করি। আমরা দেখেছি যে, কুরাআন ও হাদীসে অগণিত স্থানে মিরাজের বর্ণনা এসেছে, কিন্তু কোথাও তারিখ বলা হয় নি।মিরাজের রাত্রিতে বা দিনে নফল সালাত, নফল সিয়াম বা অন্য কোনো খাস ইবাদতের কথা রাসূলুল্লাহ (সা) বা সাহাবীগণ শিক্ষা দেন নি। মিরাজের তারিখই রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদেরকে জানান নি। কয়েক শতক আগেও ‘শবে মি’রাজ’ বলতে নির্দিষ্ট কোনো রাত নির্দিষ্ট ছিল না। ২৭শে রবজ শবে মিরাজ হওয়ার বিষয়টি আলিম ও ঐতিহাসিগণের অনেকগুলি মতের মধ্যে একটি মত মাত্র। এ জন্য আমাদের উচিত এ মাসে এবং সারা বৎসরই কুরআন কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে মিরাজের ঘটনাবলি ও শিক্ষা আলোচনা করা।
মিরাজের অন্যতম নেয়ামত হল ৫ ওয়াক্ত ফরয সালাত। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূলকে দীনের যত আহকাম দিয়েছেন সবই ওহীর মাধ্যমে জিবরাঈল দুনিয়াতে দিয়ে গিয়েছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো সালাত। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল (সা)-কে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে তাকে তার উম্মাতের জন্য সালাতের মহান নিয়ামত প্রদান করেছেন। সালাতের মাধ্যমেই উম্মাত দুনিয়া ও আখিরাতের সর্বোচ্চ নিয়ামত লাভ করতে পারবে। আবার সালাত অবহেলা করলে মুমিনের ঈমান হারিয়ে সর্বহারা হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। সালাতকে গ্রহণ করলে মিরাজের হাদিয়া গ্রহণ করা হয়।
ইসরা ও মিরাজের শিক্ষা অনুধাবনের জন্য আমাদের কুরআন কারীমের “সূরা ইসরা” অধ্যয়ন করা দরকার। ১৫ পারার প্রথম সূরা, কুরআন কারীমের ১৭ নং সূরার নাম “সুরা ইসরা”। এ সূরাকে “সূরা বনী ইসরাঈল”ও বলা হয়। এ সূরায় ইসরা ও মিরাজের বিষয় উল্লেখের মধ্যে মহান আল্লাহ পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদের শাস্তি, শিরকমুক্ত তাওহীদের গুরুত্ব, পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন, দরিদ্র ও অন্যান্য মানুষের অধিকার পালনের গুরত্ব, ব্যভিচার, হত্যা, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ, ওযনে-পরিমাপে কম দেওয়া, আন্দাযে ধারণা ভিত্তিক মতামত প্রকাশ বা অপবাদ দেওয়া, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, অহঙ্কার করা ইত্যাদি মহাপাপের ভয়াবহতা বর্ণনা করেছেন। আমরা দেখেছি যে, মিরাজের মধ্যে এ ধরনের পাপের শাস্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে প্রদর্শন করানো হয়। ইসরা ও মিরাজ উপলক্ষ্যে এ সূরার অনুধাবন ও পর্যালোচনা অতীব প্রয়োজন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
পিডিএফ ডাউনলোড করতে এখানে ক্লিক করুন