সহীহ হাদীসের প্রকারভেদ ও উৎস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট  

পূর্ববর্তী প্রবন্ধে আমরা ওহীর প্রকারভেদ ও সহীহ-যযীফ হাদীস প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি। এ প্রবন্ধে আমরা সহীহ হাদীসের প্রকারভেদ ও উৎস প্রসঙ্গে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

মুতাওয়াতির বনাম আহাদ হাদীস

এক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন, তা হলো, বর্ণনাকারীদের সংখ্যা। বর্ণনাকারীদের সংখ্যার দিক থেকে মুহাদ্দিসগণ বিশুদ্ধ বা সহীহ হাদীসকে ভাগ করেছেন: (১) মুতাওয়াতির ও (২) আহাদ।

(১) যে হাদীস সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত সকল স্তরে অনেক রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে মুতাওয়াতির বা অতি-প্রসিদ্ধ হাদীস বলে। অর্থাৎ যে হাদীস রাসূলুল্লাহ সা. থেকে অনেক সাহাবী বর্ণনা করেছেন, প্রত্যেক সাহাবী থেকে অনেক তাবিয়ী বর্ণনা করেছেন এবং প্রত্যেক তাবিয়ী থেকে অনেক তাবি-তাবিয়ী বর্ণনা করেছেন, এভাবে রাসূলুল্লাহ সা. থেকে সংকলন পর্যন্ত প্রত্যেক পর্যায়ে বহু সংখ্যক ব্যক্তি যে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাকে মুতাওয়াতির হাদীস বলা হয়। কোনো যুগেই এতগুলি মানুষের একত্রিত হয়ে মিথ্যা কথা বানানোর কোনো সম্ভাবনা থাকে না। যেমন সালাতের ওয়াক্ত ও রাকা‘আত সংখ্যা, যাকাতের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়।

(২) যে হাদীসকে সাহাবীগণের যুগ থেকে সংকলন পর্যন্ত কোনো যুগে অল্প কয়েকজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে ‘আহাদ’ বা খাবারুল ওয়াহিদ হাদীস বলা হয়।
খাবারুল ওয়াহিদ হাদীসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে:

(ক) গরীব: যে হাদীসের সনদের মধ্যে কোনো এক পর্যায়ে মাত্র একজন রাবী বা বর্ণনাকারী রয়েছেন তাকে গরীব হাদীস বলা হয়।
(খ) আযীয: যে হাদীসের সনদের মধ্যে কোনো পর্যায়ে মাত্র দুজন রাবী রয়েছেন সে হাদীসকে আযীয হাদীস বলা হয়।
(গ) মুসতাফীয: যে হাদীসের রাবীর সংখ্যা সকল পর্যায়ে দুজনের বেশি, তবে অনেক নয় সে হাদীসকে মুসতাফীয হাদীস বলা হয়।

মুসতাফীয হাদীসকে মাশহূর হাদীসও বলা হয়। অনেক মুহাদ্দিসের মতে যে হাদীস সাহাবীগণের যুগে দু-একজন সাহাবী বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তাবিয়ীগণের বা তাবি-তাবিয়ীগণের যুগ থেকে তা মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছেছে তাকে মাশহূর হাদীস বলা হয়। ((সাখাবী, ফাতহুল মুগীস ৩/২৮-৩৫; ড. মুহাম্মাদ যিয়াউর রাহমান আ’যামী, মু’জামু মুসতালাহাতিল হাদীস, পৃ. ১৪-১৬।))

মুতাওয়াতির বা ‘অতি-প্রসিদ্ধ’ হাদীস দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান বা “ইলম কাত‘য়ী’ (العلم القطعي) এবং ‘দৃঢ় বিশ্বাস’ বা ‘ইয়াকীন’ (اليقين) লাভ করা যায়। কুরআন কারীমের পাশাপাশি এই প্রকারের হাদীসই মূলত ‘আকীদা’র ভিত্তি। এই প্রকারের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তথ্য অস্বীকার করলে তা ধর্মত্যাগ বা অবিশ্বাস (কুফরী) বলে বিবেচিত হয়।

মাশহুর বা প্রসিদ্ধ হাদীস দ্বারা নির্ভরযোগ্য জ্ঞান (علم الطمأنية) লাভ করা যায়। এরূপ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত তথ্য অস্বীকার করলে তা পাপ ও বিভ্রান্তি বলে গণ্য। খাবারুল ওয়াহিদ বা একক বর্ণনার সহীহ হাদীসও আকীদার বিষয়ে গৃহীত। তবে সাধারণভাবে ফকীহগণের নিকট খাবারুল ওয়াহিত সুনিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। বরং তা কার্যকর ধারণা (الظن العملي) প্রদান করে। কর্মের ক্ষেত্রে বা কর্ম বিষয়ক হালাল, হারাম ইত্যাদি বিধিবিধানের ক্ষেত্রে এরূপ হাদীসের উপরে নির্ভর করা হয়। আকীদার মূল বিষয় প্রমাণের জন্য সাধারণত এরূপ হাদীসের উপর নির্ভর করা হয় না। তবে মূল বিষয়ের ব্যাখ্যায় ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তার উপর নির্ভর করা হয়। ((রাহমাতুল্লাহ কিরানবী, ইযহারুল হক্ক ৩/৯২০।))

অনেক আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, সহীহ হাদীস যদি ‘খাবারুল ওয়াহিদ’ হয় এবং তা তাবিয়ীগণের যুগে না হলেও তাবি-তাবিয়ীগণের যুগে প্রসিদ্ধি লাভ করে তবে ‘আকীদা’র ক্ষেত্রে তার নির্ভর করা যাবে। কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন যে, বুখারী এবং মুসলিম উভয়ের সংকলিত হাদীসসমূহের বিশুদ্ধতা যেহেতু প্রমাণিত হয়েছে এবং মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ এগুলিকে বিশুদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সেহেতু এগুলি দ্বারা সুনিশ্চিত বিশ্বাস লাভ করা সম্ভব। তবে সাধারণভাবে অধিকাংশ আলিম মত প্রকাশ করেছেন যে, ‘খাবারুল ওয়াহিদ’ পর্যায়ের সহীহ হাদীস ‘ধারণা’ বা ‘কার্যকরী ধারণা’ প্রদান করে, সুনিশ্চিত বিশ্বাস প্রদান করে না।

এ বিষয়ে ইমাম নববী (৬৭৬ হি) বলেন: “সহীহ হাদীস বিভিন্ন প্রকারের। সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহীহ হাদীস যা বুখারী ও মুসলিম উভয়েই সহীহ বলে উদ্ধৃত করেছেন। এরপর যা শুধু বুখারী সংকলন করেছেন, এরপর যা কেবল মুসলিম সংকলন করেছেন, এরপর যা বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত অনুসারে সহীহ বলে গণ্য, এরপর যা বুখারীর শর্ত অনুসারে সহীহ বলে গণ্য, এরপর যা মুসলিমের শর্ত অনুসারে সহীহ বলে গণ্য, এরপর যা অন্যদের বিচারে সহীহ বলে গণ্য। শাইখ তাকীউদ্দীন ইবনুস সালাহ (৪৬৩ হি) উল্লেখ করেছেন যে, বুখারী ও মুসলিম অথবা উভয়ের একজন যে হাদীসকে সহীহ হিসেবে সংকলন করেছেন সে হাদীসটি সুনিশ্চিতরূপেই সহীহ এবং তদ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ হয়। মুহাক্কিক বা সুপণ্ডিত গবেষকগণ এবং অধিকাংশ আলিম তাঁর এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, মুতাওয়ারি পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত সকল প্রকারের সহীহ হাদীস দ্বারাই ‘ধারণা’ (ظن) লাভ করা যায়।” ((নববী, আত-তাকরীব, পৃ. ১।))

দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের কর্মধারা থেকে স্পষ্ট হয় যে, যে সকল হাদীস সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং তাবিয়ী-তাবি-তাবিয়ীগণের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে তা সবই আকীদার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। উপরে আমরা ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও ইমাম তাহাবী (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে জেনেছি যে, আকীদার বিষয়েও তাঁরা সহীহ হাদীসের উপরে নির্ভর করতেন, এ বিষয়ক হাদীস মুতাওয়াতির হতে হবে তা শর্ত করেন নি। পার্থক্য এই যে, কুরআনে উল্লেখিত বা মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে পরিজ্ঞাত কোনো বিষয় অস্বীকার করলে তা কুফ্রী বলে গণ্য হয়। আর খাবারুল ওয়াহিদের মাধ্যমে পরিজ্ঞাত বিষয় অস্বীকার করলে তা বিভ্রান্তি বলে গণ্য হয়।

আকীদার ক্ষেত্রে ‘মুতাওয়াতির’ হাদীসের উপর গুরুত্ব প্রদানের দ্বিবিধ কারণ রয়েছে:
(ক) হাদীসের এ শ্রেণীভাগ বুঝতে নিম্নের উদাহরণটি আলোচনা করা যায়। যে কোনো বিচারালয়ে উত্থাপিত মামলায় প্রদত্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বিচারক একটি দৃঢ় ‘ধারণা’ (ظن) লাভ করেন। তিনি মোটামুটি বুঝতে পারেন যে এ সম্পদ সত্যই এ লোকের বলেই মনে হয় অথবা এ লোকাটি সত্যই এ হত্যাকাণ্ডে জাড়িত ছিল বলে বুঝা যায়। তিনি এও জানেন যে, তার এই ‘ধারণা’র মধ্যে ভুল হতে পারে। সকল বিচারকেরই কিছু রায় ভুল হয়। কিন্তু এ জন্য বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পন্ন বিচারের রায় প্রদান বন্ধ রাখা হয় না। অনুরূপভাবে সামগ্রিক সনদ বিচার ও অর্থ যাচাইয়ের পরে ‘খাবরুল ওয়াহিদ’ বা ‘এককভাবে বর্ণিত’ সহীহ হাদীসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিস অনুরূপ ‘কার্যকরী ধারণা’ লাভ করেন যে, কথাটি সত্যই রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন। তবে বর্ণনার মধ্যে সামান্য হেরফের থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনা তিনি অস্বীকার করেন না। তবে সম্ভাবনা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত একে কার্যত নির্ভুল বলে গণ্য করা হয়। যখন এরূপ বর্ণনা ‘অতি-প্রসিদ্ধ’ (মুতাওয়াতির) বা ‘প্রসিদ্ধ’ (মাশহূর) পর্যায়ের হয় তখন ভুল-ভ্রান্তির সামান্য সম্ভাবনাও রহিত হয়।

কুরআন পুরোপুরিই ‘মুতাওয়াতির’ভাবে বর্ণিত। যেভাবে রাসূলুল্লাহ সা.-এর উপরে তা অবতীর্ণ হয়েছে অবিকল সেভাবেই শতশত সাহাবী তা লিখিত ও মৌখিকভাবে বর্ণনা করেছেন, তাদের থেকে হাজার হাজার তাবিয়ী তা সেভাবে গ্রহণ করেছেন এবং প্রচার করেছেন। কেউ একটি শব্দকে সমার্থক কোনো শব্দ দিয়ে পরিবর্তন করেন নি। সহীহ হাদীস তদ্রুপ নয়। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবী-তাবিয়ীগণ অর্থের দিকে বেশি লক্ষ্য রাখতেন। আরবী ভাষা ও বর্ণনাশৈলীর বিষয়ে অভিজ্ঞ সাহাবী-তাবিয়ীগণ প্রয়োজনে একটি শব্দের পরিবর্তে সমার্থক অন্য শব্দ ব্যবহার করতেন। মূল হাদীসের অর্থ ঠিক রেখে শব্দ পরিবর্তনের প্রচলন তাদের মধ্যে ছিল। ((নববী, আত-তাকবীর, ৩/৯২০-৯২১।))

(খ) আকীদা বা বিশ্বাস মূলত প্রতিটি মুসলমানের ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন হতে হয়। বিশুদ্ধ আকীদা ও আমল শেখাতেই আল্লাহ নবী রাসূল প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ  তাঁর উম্মতকে বিশুদ্ধতম আকীদা ও আমল শিখিয়ে গিয়েছেন। আমলের ক্ষেত্রে বিকল্প আছে। সব মুসলিমের উপর ফরয কিছু কাজ ব্যতীত বিভিন্ন ফযীলত মূলক নেক কাজে একটি না করলে অন্যটি করা যায়। কিন্তু আকীদার ক্ষেত্রে কোনো বিকল্প নেই। আকীদা সবার জন্য একই রূপে সর্বপ্রথম ফরয। যে বিষয়টি বিশ্বাস করা মুমিনের জন্য প্রয়োজন সেই বিষয়টি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর সকল সাহাবীকে জানিয়েছেন এবং সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষাতেই জানিয়েছেন এবং সাহাবীগণও এভাবে তাবিয়ীগণকে জানিয়েছেন। এতে আমরা বুঝতে পারি যে, আকীদার বিষয়ে হয় কুরআনে স্পষ্ট আয়াত থাকবে, অথবা অগণিত সাহাবী থেকে মুতাওয়াতির হাদীস বর্ণিত থাকবে।

এ ছাড়া কর্মের বিষয়ে ‘ইজতিহাদ’ বা কিয়াসের উপরে নির্ভর করা যায়। বিশ্বাসের ভিত্তি ‘গাইবী’ বিষয়ের উপরে। এ সকল বিষয় ওহীর নির্দেশনা ছাড়া কোনো ফয়সালা দেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে ইজতিহাদ অচল। বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ওহীর বিষয়কে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায়, তবে যুক্তি দিয়ে নতুন কিছু সাব্যস্ত করা যায় না।

সহীহ হাদীসের উৎস

উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি যে কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসই ইসলামী আকীদা এবং সকল ইসলামী জ্ঞান ও কর্মের ভিত্তি ও উৎস। এজন্য সাহাবীগণের যুগ থেকেই আলিমগণ হাদীসের বিশুদ্ধতা যাচইয়ের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁরা দ্বিবিধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন: সংকলন ও যাচাই-বাছাই।

রাসূলুল্লাহ  এর ওফাতের প্রায় ৯০ বৎসর পর থেকে পরবর্তী প্রায় ২০০ বৎসরের মধ্যে তাঁর নামে বর্ণিত প্রায় সকল হাদীস এবং সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবেয়ীগণের বক্তব্য, কর্ম ও মতামত বিভিন্ন ‘হাদীস’-গ্রন্থে সনদ সহকারে সংকলিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন তাফসীর, ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থেও কিছু হাদীস সনদ সহকারে সংকলন করা হয়েছে। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের লক্ষ্য ও পদ্ধতি ছিল সনদ সহকারে প্রচলিত সকল হাদীস সংকলন করা। এজন্য তাঁরা সনদসহ সহীহ, যায়ীফ, মাউযূ ইত্যাদি সকল প্রকার হাদীস সংকলন করতেন। এছাড়া তাফসীর, ইতিহাস ও এ জাতীয় গ্রন্থগুলিতে গ্রন্থকারগণ মূলত বিষয় সংশ্লিষ্ট সকল হাদীস সনদ সহ জমা করতেন, সহীহ বা মাউযূ কোনো বিচার করতেন না বা উল্লেখও করতেন না। অল্প সংখ্যক মুহাদ্দিস কেবলমাত্র সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও আলিম সনদ-সহ হাদীস উল্লেখ করলে আর তা সহীহ না বানোয়াট তা বলার প্রয়োজন মনে করতেন না। কারণ যেহেতু সনদ উল্লেখ করা হয়েছে, সেহেতু সকলেই তা বিচার করতে পারবে। ((আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আজবিবাতুল ফাদিলাহ, পৃ. ৯১))

মুহাদ্দিসগণের সংকলন-পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক মানুষ মনে করেন যে, হাদীসের নামে যা কিছু বলা হয় তা সবই সহীহ। অথবা বড় বড় আলিমগণ তাদের গ্রন্থে যা কিছু সংকলন করেছেন তা যাচাই-বাছাইয়ের পরেই করেছেন, কাজেই সংকলিত সব হাদীসই বোধহয় সহীহ। হাদীস সংকলন সম্পর্কে নিরেট অজ্ঞতাই এরূপ চিন্তার কারণ।

আল্লামা ইবনুস সালাহ (৬৪৩ হি) বলেন: “বুখারী ও মুসলিমের বাইরে সহীহ হাদীস খুজতে হবে মাশহুর হাদীসের বইগুলিতে, যেমন আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু খুযাইমা, দারাকুতনী ও অন্য্ন্যাদের সংকলিত গ্রন্থ। তবে এ সকল গ্রন্থে যদি কোনো হাদীস উদ্ধৃত করে তাকে সুস্পষ্টত ‘সহীহ’ বলে উল্লেখ করা হয় তবেই তা সহীহ বলে গণ্য হবে, শুধুমাত্র এ সকল গ্রন্থে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়েছে বলেই হাদীসটিকে সহীহ মনে করা যাবে না; কারণ এ সকল গ্রন্থে সহীহ এবং যয়ীফ সব রকমের হাদীসই রয়েছে।” ((ইরাকী, আত-তাকঈদ ওয়াল ঈদাহ শারহু মুকাদ্দিমাতি ইবনুস সালাহ, পৃ. ৩১-৩২।))

আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী (৮৫২ হি) বলেন: “দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী সকল যুগের অধিকাংশ মুহাদ্দিসের রীতি ছিল যে, সহীহ, যয়ীফ, মাউযূ, বাতিল সকল প্রকার হাদীস সনদ-সহ সংকলন করা। তাঁদের মূলনীতি ছিল যে, সনদ উল্লেখ করার অর্থই হাদীসটি বর্ণনার দায়ভার রাবীদের উপর ছেড়ে দেওয়া, সংকলকের আর কোনো দায় থাকে না।” ((ইবনু হাজার, লিসানুল মীযান ৩/৭৪।))

দ্বাদশ হিজরী শতকের অন্যতম আলিম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (১১৭৬হি/ ১৭৬২খৃ) হাদীসের গ্রন্থগুলিকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে তিনখানা গ্রন্থ: সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক। এই তিনখানা গ্রন্থের সকল সনদসহ বর্ণিত হাদীসই গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে সে সকল গ্রন্থ যেগুলির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলিতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এসকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন ও তাদের মধ্যে এগুলি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই পর্যায়ে রয়েছে তিনখানা গ্রন্থ: সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাঈ, সুনানে তিরমিযী। ইমাম আহমদের মুসনাদও প্রায় এই পর্যায়ের।

তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখ মুহাদ্দিসের আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে বিশুদ্ধ, দুর্বল, মিথ্যা, ভুল সব ধরনের হাদীসই রয়েছে, যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ভিন্ন এসকল গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দিসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এই পর্যায়ে রয়েছে : মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবন হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বাইহাকীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (সুনানে কুবরা, দালাইলুন নুবুওয়াত, শুয়াবুল ঈমান,… ইত্যাদি), ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থসমূহ (র্শাহ মায়ানীল আসার, র্শাহ মুশকিলিল আসার,… ইত্যাদি), তাবারানীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ (আল-মু’জামুল কবীর, আল-মু’জামুল আওসাত, আল-মু’জামুস সাগীর,… ইত্যাদি)। এ সকল গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তাঁরা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেননি।

চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলি হলো ঐ সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রন্থের সংকলকরা মূলত নিু প্রকারের হাদীস সংকলন করেছেন :

(১) যে সকল ‘হাদীস’ পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারণে পূর্ববতী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি,

(২) যে সকল হাদীস কোনো অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল,

(৩) লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়ায়েযদের ওয়াযে প্রচারিত বিভিন্ন কথা, যা কোনো হাদীসের গ্রন্থে স্থান পায়নি,

(৪) বিভিন্ন দুর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা,

(৫) যে সকল ‘হাদীস’ মূলত সাহাবী বা তাবেয়ীদের কথা, ইহুদিদের গল্প বা পূর্ববতী যামানার জ্ঞানী ব্যক্তিদের কথা, যেগুলিকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোনো বর্ণনাকারী হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন,

(৬) কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতীয় কথা যা ভুলক্রমে কোনো সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন,

(৭) হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূবক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন, অথবা

(৮) বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন। এধরনের হাদীসের সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ইবনু হিব্বানের আদ-দুয়াফা, ইবনু আদীর আল-কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নুয়াইম আল-আসফাহানী, ইবনু আসাকির, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ।… এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় দুর্বল অথবা বানোয়াট।

পঞ্চম পর্যায়ের গ্রন্থসমূহে ঐ সকল হাদীস রয়েছে যা ফকীহগণ, সূফীগণ বা ঐতিহাসিকগণের মধ্যে প্রচলিত ও তাঁদের লেখা বইয়ে পাওয়া যায়। যে সকল হাদীসের কোনো অস্তিত্ব পূর্বের চার পর্যায়ের গন্থে পাওয়া যায় না। এসব হাদীসের মধ্যে এমন হাদীসও রয়েছে যা কোনো ধর্মচ্যুত ভাষাজ্ঞানী পণ্ডিত পাপাচারী মানুষ তৈরি করেছেন। তিনি তার বানোয়াট হাদীসের জন্য এমন সনদ তৈরি করেছেন যার ত্র“টি ধরা দুঃসাধ্য, আর তার বানোয়াট হাদীসের ভাষাও এরূপ সুন্দর যে রাসূলুল্লাহ -এর কথা বলে সহজেই বিশ্বাস হবে। এ সকল বানোয়াট হাদীস ইসলামের মধ্যে সুদূর প্রসারী বিপদ ও ফিতনা সৃষ্টি করেছে। তবে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ হাদীসের ভাষা ও সনদের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তার ত্র“টি খুঁজে বের করতে সক্ষম হন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রাহ) বলেন: প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের হাদীস গ্রন্থের উপরেই শুধুমাত্র মুহাদ্দিসগণ নির্ভর করেছেন। তৃতীয় পর্যায়ের হাদীসগ্রন্থসমূহ থেকে হাদীস শাস্ত্রে সুগভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইলমুর রিজাল ও ইলাল শাস্ত্রে পণ্ডিত বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ ছাড়া কেউ উপকৃত হতে পারেন না, কারণ এ সকল গ্রন্থে সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্য থেকে মিথ্যা হাদীস ও নির্ভরযোগ্য হাদীসের পার্থক্য শুধু তাঁরাই করতে পারেন। আর চতুর্থ পর্যায়ের হাদীসগ্রন্থসমূহ সংকলন করা বা পাঠ করা এক ধরনের জ্ঞান বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। সত্য বলতে, রাফেযী, মুতাযিলী ও অন্যান্য সকল বিদ‘আতী ও বাতিল মতের মানুষেরা খুব সহজেই এসকল গ্রন্থ থেকে তাদের মতের পক্ষে বিভিন্ন হাদীস বের করে নিতে পারবেন। কাজেই, এ সকল গ্রন্থের হাদীস দিয়ে কোনো মত প্রতিষ্ঠা করা বা কোনো মতের পক্ষে দলিল দেওয়া আলিমদের নিকট বাতুলতা ও অগ্রহণযোগ্য। ((শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, ১/৩৮৫-৩৯১।))

চতুর্থ পর্যায়ের হাদীসগন্থসমূহে সংকলিত হাদীসসমূহের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রাহ)-এর পুত্র শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী (১২৩৯ হি) বলেন: এই পর্যায়ের হাদীসগুলির অবস্থা এই যে, প্রথম যুগের (প্রথম তিন হিজরী শতাব্দীর) মুহাদ্দিসদের মধ্যে এগুলি পরিচিতি লাভ করে নি, অথচ পরবর্তী যুগের আলিমগণ তা বর্ণনা ও সংকলন করেছেন। এর দুটি ব্যাখ্যা হতে পারে: প্রথম সম্ভাবনা এই যে, প্রথম যুগের মুহাদ্দিসগণ এগুলির বিষয়ে জেনেছিলেন এবং এগুলির সনদ বা সূত্র সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছিলেন। তাঁরা এগুলির কোনো সনদ বা ভিত্তি জানতে পারেন নি, এজন্য তাঁরা এ সকল হাদীস সংকলন করেন নি।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা এই যে, তাঁরা এগুলির সনদ বা সূত্র জানতে পেরেছিলেন। তবে তাঁদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে এগুলির সনদে কঠিন আপত্তি ও ত্র“টি জানতে পেরেছিলেন, যে ত্র“টির কারণে হাদীসগুলি প্রত্যাখ্যান করা জরুরি ছিল। এজন্য তাঁরা হাদীসগুলি সংকলন করেন নি।

সর্বাবস্থায় এ সকল হাদীসের উপর কোনো অবস্থাতেই নির্ভর করা যায় না এবং এগুলি দ্বারা কোনো আকীদা বা কর্ম প্রমাণ করা যায় না। এই পর্যায়ের হাদীসগুলি অনেক মুহাদ্দিসকেই বিভ্রান্ত করেছে এবং তাঁদেরকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে। কারণ, এ সকল গ্রন্থে বিদ্যমান এ সকল হাদীসের অনেক সনদ দেখে প্রতারিত হয়ে তারা এগুলিকে ‘মুতাওয়াতির’ বলে গণ্য করেছেন এবং ‘সুনিশ্চিত জ্ঞান’ ও সুদৃঢ় বিশ্বাস প্রমাণের জন্য এগুলির উপর নির্ভর করেছেন। এভাবে তাঁরা প্রথম দুই পর্যায়ের বিপরীতে নতুন মতবাদের উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন।” ((সিদ্দীক হাসান কান্নুজী, আল-হিত্তাহ, পৃ. ৫৭-৫৮))

বিস্তারিত জানতে ড.খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত “কুরআন সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা


পিডিএফ ডাউনলো করতে এখানে ক্লিক করুন