ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

(তয় অংশ)

১৯৯২ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত আরবী বাইবেলে বক্তব্যটি নিম্নরূপ:
فإنه إن كان صدق الله قد ازداد بكذبي لمجده فلماذا أدان أنا بعد كخاطئ

অর্থাৎ “যদি আল্লাহর সত্য তার মর্যাদার নিমিত্ত আমার মিথ্যা দ্বারা বৃদ্ধি পায় তবে এরপরও আমি পাপী বলে বিচারকৃত হব কেন?”

উইলিয়াম কেরি অনূদিত বাইবেলে এর অনুবাদ নিম্নরূপ: “কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাঁহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমিও বা এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন?”

বাংলাদেশ ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনী কর্তৃক ২০০৬ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত পবিত্র বাইবেল জুবিলী বাইবেলের অনুবাদ নিম্নরূপ: “কিন্তু আমার মিথ্যাচারিতায় যদি ঈশ্বরের সত্যনিষ্ঠা তার গৌরবার্থে উপচে পড়ে, তবে আমি কেনই বা এখনও পাপী বলে বিবেচিত হচ্ছি?”

বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি কর্তৃক ২০০০ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত বাইবেলের অনুবাদ নিম্নরূপ: “ কেউ হয়ত বলবে, আমার মিথা কথা বলবার দরুন আরও ভালভাবে প্রকাশ পায় যে, ঈশ্বর সত্যবাদী। এতে যখন ঈশ্বর গৌরব লাভ করেন তখন পাপী বলে আমাকে দোষী করা হয় কেন?”

বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি কর্তৃক ২০০৬ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত ‘কিতাবুল মোকাদ্দস নামক বাইবেলের অনুবাদ নিম্নরূপ: “কেউ হয়ত বলবে, ‘আমার মিথ্য কথা বলবার দরুন আরও ভালভাবে প্রকাশ পায় যে, আল্লাহ সত্যবাদী। এত যখন আল্লাহ গৌরব লাভ করেন তখন গুনাহগার বলে আমাকে দোষী করা হয় কেন?”

সম্মানিত পাঠক, খুব সচেতনভাবে ইংরেজি দুটি ভাষ্য ও আরবী ভাষ্য লক্ষ্য করুন। বাংলা অনুবাদের প্রথম দুটি ভাষ্য দেখুন। এরপর শেষ দুটি ভাষ্য দেখুন। ‘কেউ হয়ত বলবে’ কথাটুকু এ শ্লোকের কোনো ইংরেজি ভাষ্যে নেই, আরবীতেও নেই। প্রথম দুটি বাংলা অনুবাদেও নেই। সর্বশেষ দুটি অনুবাদে ‘কেউ হয়ত বলবে’ কথাটুকু সংযোজন করে পুরো বক্তব্যের অর্থই পরিবর্তন করা হয়েছে।

মূলত সাধু পল তার বিভিন্ন পত্রে বারবার বলেছেন যে, তিনি বহুরূপী। ঈশ্বরের ধর্ম বিস্তারের স্বার্থে তিনি প্রত্যেকের মন জুগিয়ে ভিন্ন কথা বলেন বা মিথ্যা কথা বলেন (দেখুন ১ করিন্থীয় ৯/ ১৯-২২)। এ কথাটিই তিনি এখানে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন। কিন্তু একটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বাক্যাংশ সংযোজন করে মূল কথাটির অর্থ সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলা হয়েছে। বাহ্যত তাঁর স্বস্বীকৃত মিথ্যাচার অস্পষ্ট করার জন্যই এরূপ করা হয়েছে।

অষ্টম উদাহরণ: নতুন নিয়মের ৭ম পুস্তক করিন্থীয়দের প্রতি প্রেরিত পলের ১ম পত্র। এ পত্রের ১৫ অধ্যায়ে সাধু পল যীশু খৃস্টের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের পর যে সকল শিষ্যের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন। ১৫ অধ্যায়ের ৫ম শ্লোকটি ইংরেজি কিং জেমস ভার্শন ও রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শন উভয়েই নিম্নরূপ: “And that he was seen of Cephas, then of the twelve”

কেরির বাংলা অনুবাদ নিম্নরূপ: “আর তিনি কৈফাকে, পরে সেই বারো জনকে দেখা দিলেন।”

আর বাংলা বাইবেলে ২০০০-এর অনুবাদ: “ আর তিনি পিতরকে এবং পরে তাঁর প্রেরিতদের দেখা দিয়েছিলেন।” কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ: “আর তিনি পিতরকে ও পরে তাঁর সাহাবীদের দেখা দিলেন।”

কেরির অনুবাদ মূলাশ্রয়ী। কিন্তু বাংলা বাইবেল ২০০০ ও কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদে (ঃযব ঃবিষাব) বা ‘সেই বারোজন’ পরিবর্তন করে ‘প্রেরিতদের’ এবং ‘সাহাবীদের’ লেখা হয়েছে। এভাবে মূলের পরিবর্তন ছাড়াও অত্যন্ত অসাধু সম্পাদনা আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

এখানে সাধু পল ভুল করেছেন। যীশুর মৃত্যু থেকে উঠার পরে যখন প্রেরিতদের সাথে সাক্ষাৎ করেন তখন সেই বারো জনের একজন ঈষ্করিয়োতীয় যিহূদা মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করে যীশুকে ইহূদীদের হাতে সমর্পন করেছিলেন এবং পরদিন আত্মহত্যা করে মারা যান। ফলে প্রেরিতগণের সংখ্যা ছিল ১১ জন। এজন্য সাধু পলের কথাটি এখানে ভুল। এ ভুল দ্বারা প্রমাণ হয় যে, সাধু পল পবিত্র আত্মর সাহায্যে তাঁর পত্রগুলো লিখেন নি। বরং সাধারণ একজন ধর্ম প্রচারক হিসেবেই লিখেছেন। এজন্য তাঁর ভুল হতো। এ ভুলটি লুকানোর জন্য মূলকে পরিবর্তন করা হয়েছে।

নবম উদাহরণ: নতুন নিয়মের ঊনবিংশ পুস্তক ‘ইব্রীয়’। এ পত্রের ৬ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোক (verse) কিং জেমস ভার্শন (KJV/AV)-এ নিম্নরূপ: “Therefore leaving the principles of the doctrine of Christ, let us go on perfection” (অতএব, খৃস্টের শিক্ষার মূলনীতিগুলো পরিত্যাগ করে আসুন আমরা পূর্ণতার দিকে গমন করি)

রিভাইযড স্টান্ডার্ড ভার্শন (RSV) নিম্নরূপ: “Therefore let us leave the elementrary doctrine of Christ and go on to maturity” (অতএব আসুন আমরা খৃস্টের প্রাথমিক শিক্ষা পরিত্যাগ করি এবং পরিপক্কতার দিকে গমন করি)।

এখানে সাধু পলের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। তিনি বলছেন যে, খৃস্টের শিক্ষা ছিল প্রাথমিক এবং পলের শিক্ষা উন্নত স্তরের। কাজেই প্রাথমিককে পিছে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।

সম্মানিত পাঠক যদি (biblegateway.com) ওয়েবসাইটে ইব্রীয় ৬/১-এর সকল ইংরেজি মিলিয়ে পড়েন((https://www.biblegateway.com/verse/en/Hebrews%206:1)) তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। যদিও কোনো কোনো ইংরেজি অনুবাদে বিষয়টিকে কিছু অস্পষ্ট করা হয়েছে, অধিকাংশ অনুবাদেই বিষয়টি সুস্পষ্ট। যেমন এমপ্লিফাইড বাইবেল (Amplified Bible)-এর পাঠ নিম্নরূপ:

Therefore let us go on and get past the elementary stage in the teachings and doctrine of Christ (the Messiah), advancing steadily toward the completeness and perfection that belong to spiritual maturity. “অতএব, এস, আমরা খৃস্টের নীতি ও শিক্সার প্রাথমিক স্তর পিছনে রেখে চলে যাই, স্থিরভাবে এগিয়ে যাই পূর্ণতা ও উৎকর্ষতার দিকে, যা আধ্যাত্মিক পরিপক্কতার অন্তর্ভুক্ত।”

পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, যীশুর শিষ্যগণ অনেকেই যীশুর শিক্ষা অনুসারে তাওরাতের শরীয়ত পালন করাকে গুরুত্ব দিতেন। পক্ষান্তরে সাধু পল শরীয়ত পালনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এজন্য শিষ্যগণ অনেকেই পলের বিরোধিতা করেছেন। নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোর মধ্যে এ বিরোধিতা বিদ্যমান। এ বিরোধিতাকে পাশ কাটাতে তিনি এখানে যীশু খৃস্টের শিক্ষাকে প্রাথমিক ও পূর্ণতার পরিপন্থী এবং তার নিজের পলীয় শিক্ষাকে পূর্ণতর বলে দাবি করেছেন। অর্থাৎ যীশু খৃস্ট প্রাইমারি ও সাধু পল বিশ্ববিদ্যালয়!

কিন্তু বাংলা অনুবাদে বিষয়টি অস্পষ্ট। কেরির অনুবাদ: “অতএব আইস, আমরা খৃস্ট বিষয়ক আদিম কথা পশ্চাতে ফেলিয়া সিদ্ধির চেষ্টায় অগ্রসর হই।”

জুবিলি বাইবেলের অনুবাদ নিম্নরূপ: “সুতরাং এসো, খৃস্ট বিষয়ক প্রাথমিক শিক্ষা পাশে রেখে আমরা সিদ্ধতার কথার দিকে এগিয়ে যাই।”

পবিত্র বাইবেল ২০০০ সালের অনুবাদ নিম্নরূপ: “এইজন্য খৃস্টের বিষয়ে প্রথমে যে শিক্ষা পেয়েছি, এস, তা ছাড়িয়ে আমরা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাই।”
কিতাবুল মোকাদ্দসের অনুবাদ নিম্নরূপ: “এজন্য মসীহের বিষয়ে প্রথমে যে শিক্ষা পেয়েছি, এস, তা ছাড়িয়ে আমরা পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাই।”

বাইবেলের বঙ্গানুবাদে এরূপ হেরফের অগণিত। সবচেয়ে অবাক বিষয় যে, এরূপ বিকৃতি সবই ধার্মিক মানুষেরা করছেন, যারা পবিত্র বাইবেলকে অভ্রান্ত ঐশী বাণী বলে বিশ্বাস করেন। অথচ বাইবেল থেকেই আমরা নিচের বিষয়গুলো জানছি:

(ক) মিথ্যা নিষিদ্ধ ও ঈশ্বরের নিকট ঘৃণিত এবং বিশ্বস্ততা মুক্তির পথ (লেবীয় ১৯/১১; হিতোপদেশ ১২/২২), (খ) অনন্ত নরকই মিথ্যাবাদীদের ঠিকানা (প্রকাশিত বাক্য ২১/৮), (গ) পবিত্র আত্মার নিন্দার কোনো ক্ষমা নেই (মথি ১২/৩১-৩২), (ঘ) যে ব্যক্তি পাক কিতাবের মধ্যে সামান্যতম সংযোজন বা বিয়োজন করবে সে অভিশপ্ত এবং পরকালের মুক্তি থেকে বঞ্চিত (প্রকাশিত বাক্য ২২/১৮-১৯)।

অনুবাদের মধ্যে এভাবে পরিবর্তন, সংযোজন বা বিয়োজন কি মিথ্যা নয়? এগুলো কি ঈশ্বর বা পবিত্র আত্মার নামে মিথ্যা নয়? এগুলো কি পাক কিতাবের মধ্যে সংযোজন ও বিয়োজন নয়? তাহলে কিভাবে এ সকল ধার্মিক, ধর্মগুরু, বাইবেল বিশেষজ্ঞ ও ধর্মপ্রচারক এভাবে পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজন করলেন? তাঁহলে কী তাঁরা ঈশ্বরের থেকে মিথ্যার আত্মা বা মিথ্যাবাদী আত্মা লাভ করেছেন? (১ রাজাবলি ২২/২২; ২২/২৩; ২ বংশাবলি ১৮/২১; ১৮/২২; প্রকাশিত বাক্য ২০/১০)।

সর্বাবস্থায়, বঙ্গানুবাদের এ হেরফেরের কারণে আমরা বাইবেলের বাংলা উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে সাধারণভাবে কেরির অনুবাদের উপর নির্ভর করব। সহজবোধ্য হওয়ার জন্য কখনো কখনো পরবর্তী অনুবাদের উপরও নির্ভর করব। পাশাপাশি ইংরেজি অথোরাইযড ভারশন বা কিং জেমস ভারশন (AV/KJV), রিভাইযড স্ট্যান্ডার্ড ভারশন (RSV) ও অন্যান্য ইংরেজি অনুবাদের সহায়তা গ্রহণ করব।

১. ৬. পুরাতন নিয়মের সংকলনের বিবর্তন

১. ৬. ১. তৃতীয় শতাব্দীতে হিব্রু বাইবেল চূড়ান্ত রূপ পায়

বাইবেলের বিবর্তন বিষয়ে দুটি বিষয় বিবেচ্য: (১) পুস্তকগুলোর সংখ্যা এবং (২) পুস্তকগুলোর বক্তব্য বা বিষয়বস্তু। খৃস্টান প্রচারকগণ দাবি করেন যে, বাইবেলের পুস্তকগুলো বিভিন্ন নবীর লেখা এবং তাদের সময় থেকেই সংকলিত। তবে বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাচীন পা-ুলিপিগুলোর ভিত্তিতে ইহূদী-খৃস্টান আধুনিক গবেষক প-িতদের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাইবেলের পুস্তকগুলোর সংখ্যা ও বিষয়বস্তু উভয়ই যুগে যুগে পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। পুস্তকগুলোর সংখ্যার হেরফের আমরা দেখেছি। যীশু খৃস্টের প্রায় ১৩০০ বৎসর পূর্বে মূসা (আ)-এর আগমন। পরবর্তী প্রায় হাজার বছর ধরে ইহূদী জাতির বিভিন্ন নবীর নামে অনেক ধর্মগ্রন্থ তাদের সমাজে প্রচলিত ছিল। সময়ের আবর্তনে সেগুলো পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। পুস্তকগুলোর সংখ্যা এবং আকার নিয়ে অনেক মতভেদ ছিল। ঈসা (আ)-এর প্রায় ৩০০ বৎসর পরে ‘ইহূদী বাইবেল’ চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ করা হয়।
আমরা দেখেছি যে, ঈসা (আ)-এর প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্বে ইহূদী ধর্মগ্রন্থগুলোকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কিন্তু প্রায় ৫০০ বৎসর পরে ইহূদীগণ এ পুস্তকের মধ্যে বিদ্যমান অনেক পুস্তক অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করেন এবং অন্য অনেক পুস্তকের বিষয়বস্তুর বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্করণ ও পা-ুলিপির উপর নির্ভর করেন।
প্রথম খৃস্টীয় শতকের শেষ দিক থেকেই ইহূদী বাইবেলের একটি চূড়ান্ত ও নির্ধারিত রূপ দানের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল একদিকে রোমান আক্রমনে ইহূদী রাজ্যের বিলুপ্তি, ইহূদীদের নির্বাসন এবং ইহূদী জাতির অস্তিত্বের সংকট। আরেকদিকে উদীয়মান খৃস্টান ধর্ম কর্তৃক ইহূদী বাইবেলের গ্রীক অনুবাদের অপব্যবহার। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সিডি সংস্করণের (Biblical litarature) প্রবন্ধে (the new testament canon) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
“In the last decade of the 1st century, the Synod of Jamnia (Jabneh), in Palestine, fixed the canon of the Bible for Judaism, which, following a long period of flux and fluidity and controversy about certain of its books…. A possible factor in the timing of this Jewish canon was a situation of crisis: the fall of Jerusalem and reaction to the fact that the Septuagint was used by Christians and to their advantage, as in the translation of the Hebrew word ʿalma (young woman) in chapter 7, verse 14, of Isaiah—“Behold, a young woman shall conceive and bear a son, and shall call his name Immanuel”—into the Greek term parthenos (virgin).”

“প্রথম খৃস্টীয় শতকের শেষ দশকে ফিলিস্তিনে অনুষ্ঠিত ইহূদী ধর্মগুরুদের ‘জামনিয়া (জাবনেহ) সম্মেলনে ইহূদীদের জন্য বিশুদ্ধ বা স্বীকৃত বাইবেল নির্ধারণ করা হয়। দীর্ঘ সময়ব্যাপী নিরন্তন পরিবর্তন প্রবাহ, তারল্য এবং এর কিছু পুস্তকের বিষয়ে মতপার্থর্কের পরে এ নির্ধারণ সম্পন্ন হয়।… ইহূদী ধর্মগ্রন্থটি এ সময়ে নির্ধারণ করার একটি সাম্ভাব্য কারণ ছিল সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব: যেরুজালেমের পতন ঘটে (ইহূদীদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়) এবং সেপ্টুআজিন্ট বা ইহূদী বাইবেলের গ্রীক অনুবাদকে খৃস্টানগণ তাদের সুবিধামত ব্যবহার করতে থাকে। যেমন যিশাইয়র পুস্তকের ৭ অধ্যায়ের ১৪ শ্লোক নি¤œরূপ: “দেখ! একজন যুবতী মেয়ে গর্ভবতী হবে এবং একটি শিশু প্রসব করবে এবং তার নাম রাখা হবে ‘ইম্মানুয়েল’। এ শ্লোকে হিব্রু বাইবেল বিদ্যমান ‘আলমা’ (যুবতী মেয়ে) শব্দটিকে গ্রীক ‘পারথেনস (কুমারী) বলে অনুবাদ করা।”

তবে এ প্রচেষ্টা চূড়ান্ত রূপ পেতে আরো শতাধিক বছর পার হয় বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকগণ। উইকিপিডিয়া লিখেছে: “There is no scholarly consensus as to when the Hebrew Bible canon was fixed: some scholars argue that it was fixed by the Hasmonean dynasty, while others argue it was not fixed until the second century CE or even later”

“হিব্রু বিধিবদ্ধ বাইবেল কখন নির্ধারিত হয়েছে সে বিষয়ে গবেষকদের কোনো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেই। কেউ বলেন হাসমোনিয়ান (Hasmonean) রাজত্বকালে (খৃস্টপূবূ ১৪০-১১৬ অব্দ) তা সংকলিত হয়েছে। অন্যরা বলেন খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতক বা তারা পরেও ইহূদী বাইবেল নির্ধারিত হয় নি।”((উইকিপিডিয়া:Development of the Hebrew Bible canon, The Hasmonean dynasty.))

অর্থোডক্স ধর্মগুরু ফ্রান্সিস জেমস বার্নস্টেইন (Fr. James Bernstein, Orthodox churchman) ‘ কোনটি প্রথম: চার্চ না নতুন নিয়ম? (Which Came First: The Church or the New Testament? 1994, p 5) পুস্তকে (http://www.protomartyr.org/first.html) বলেন:

“…the Jews did not decide upon a definitive list or canon of Old Testament books until after the rise of Christianity… The modern Jewish canon was not rigidly fixed until the third century A.D. Interestingly, it is this later version of the Jewish canon of the Old Testament, rather than the canon of early Christianity, that is followed by most modern Protestants today. When the Apostles lived and wrote, there was no New Testament and no finalized Old Testament. The concept of “Scripture” was much less well-defined than I had envisioned.”

“ইহূদীগ ইহূদীগণের ধর্মগ্রন্থের তালিকা বা পুরাতন নিয়মের বিশুদ্ধ পুস্তকগুলোর বিষয়ে ইহূদীগণ কোনো সিদ্ধান্ত নেন নি; খৃস্টধর্মের উত্থানের পরবর্তী সময় পর্যন্ত।… তৃতীয় খৃস্টীয় শতক পর্যন্ত আধুনিক ইহূদী ধর্মগ্রন্থের বিধিবস্থ রূপটি স্থিরভাবে ঠিক করা হয় নি। মজার বিষয় হলো, আধুনিক যুগের অধিকাংশ প্রটেস্ট্যান্ট প্রথম যুগের খৃস্টধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ বাদ দিয়ে পরবর্তীতে সংকলিত ইহূদী বাইবেল বা পুরাতন নিয়মের সংস্করণ অনুসরণ করেন। যখন শিষ্যগণ জীবিত ছিলেন এবং (তাদের পুস্তক বা পত্রগুলো) লিখতেন তখন ‘নতুন নিয়ম’ বলে কিছুই ছিল না এবং

পুরাতন নিয়মের চূড়ান্ত কোনো রূপও বিদ্যমান ছিল না। ‘ধর্মগ্রন্থ’ বিষয়ক ধারণা আমার পূর্ব ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ঢিলেঢালা ছিল।”

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার (biblical literature) প্রবন্ধে ইহূদী বাইবেলের তৃতীয় অংশ ‘কেতুবিম’ (The Ketuvim) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:

That the formation of the Ketuvim as a corpus was not completed until a very late date is evidenced by the absence of a fixed name, or indeed any real name, for the third division of Scripture. Ben Sira refers to “the other books of our fathers,” “the rest of the books”; Philo speaks simply of “other writings” and Josephus of “the remaining books.” A widespread practice of entitling the entire Scriptures “the Torah and the Prophets” indicates a considerable hiatus between the canonization of the Prophets and the Ketuvim. … Ben Sira omits mention of Daniel and Esther. No fragments of Esther have turned up among the biblical scrolls (e.g., the Dead Sea Scrolls) from the Judaean Desert. … A synod at Jabneh (c. 100 CE) seems to have ruled on the matter, but it took a generation or two before their decisions came to be unanimously accepted and the Ketuvim regarded as being definitively closed. The destruction of the Jewish state in 70 CE, the breakdown of central authority, and the ever widening Diaspora (collectively, Jews dispersed to foreign lands) all contributed to the urgent necessity of providing a closed and authoritative corpus of sacred Scriptures.

“একক সংকলন হিসেবে ‘কিতুবিম’-এর রূপগ্রহণ অনেকে দেরি করে হয়েছে। এর প্রমাণ, ইহূদী বাইবেলের তৃতীয় অংশ হিসেবে এর কোনো নির্ধারিত নাম ছিল না, বরং কোনো নামই ছিল না। বিন সিরা এ অংশের বিষয়ে বলেছেন: “আমাদের পিতৃগণের অন্যান্য পুস্তক’, অন্যান্য পুস্তক। ফিলো (মৃত্যু ৫০ খৃ) শুধু বলেছেন: ‘অন্যান্য লিখনি’। যোশেফাস (মৃত্যু ১০০ খৃ) বলেছেন: “অবশিষ্ট পুস্তকগুলো। ইহূদী ধর্মগ্রন্থগুলো একত্রে বুঝাতে ব্যাপকভাবে বলা হতো: “তাওরাত ও নবীগণ”। এতে বুঝা যায় যে, নবীগণের পুস্তকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এবং ‘কিতুবীম’ গ্রন্থগুলোর গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। … বেন-সিরা দানিয়েল ও ইস্টেরের কোনো উল্লেখই করেন নি। জুদিয় রাজ্যের (বর্তমান জর্দানের) মরুভূমিতে পাওয়া বাইবেলের পা-ুলিপিগুলোর (মৃত সাগরের পা-ুলিপি) মধ্যে ইস্টেরের কোনো অংশ পাওয়া যায় নি। … জাবানেহ-এ অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন (১০০ খৃস্টাব্দে) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বলে প্রতীয়মান। তবে তা সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরো এক বা দু প্রজন্ম পার হয়েছিল। ৭০ খৃস্টাব্দে ইহূদী রাষ্টের ধ্বংস, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিলোপ এবং ইহূদীদের সামষ্টিক বিতাড়নের মত ঘটনাগুলো একত্রে ইহূদীদেরকে উদ্বুদ্ধ করে ধর্মগ্রন্থগুলোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে।”

১. ৬. ২. প্রথম শতাব্দীর ইহূদী প-িত যোসেফাসের তালিকা

প্রথম খৃস্টীয় শতাব্দীর প্রসিদ্ধতম ইহূদী ঐতিহাসিক যোসেফাস (Flavius Josephus) (মৃত্যু ১০০ খৃ) ইহূদী বাইবেল বা খৃস্টান বাইবেলের পুরাতন নিয়মের পুস্তকের সংখ্যা ২২টি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন:

“For we have not therefore among us innumerable books… but only two and twenty…. which are justly considered divine compsitions.. of these five are the books of Moses … the prophets after Moses wrote the events of their day in thirteen books. The remaining four books contain hymns to God, and precepts for the conduct of human life.”

“আমাদের মধ্যে বিদ্যমান বই অগণিত নয়। আমাদের গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ২২টি… যেগুলো যথাযথই ঐশ্বরিক গ্রন্থ। তন্মধ্যে ৫টি মোশির। … পরবর্তী নবীগণের লেখা গ্রন্থ ১৩টি। বাকি চারটি গ্রন্থ ঈশ্বরের বন্দনায় গীত সঙ্গীত ও অনুরূপ বিষয়ের সংকলন।((দেখুন: Eusebius Pamphilus, The Ecclesiastical History, page 97, 244-245.))

বর্তমানে প্রচলিত ইহূদী বাইবেলের পুস্তক সংখ্যা ২৪ টি: তাওরাত বা মোশির পুস্তক ৫টি, নবীগণের পুস্তক ৮ টি এবং কিতুবিম বা লিখনিসমূহ ১১টি। পক্ষান্তরে যোশেফাস বলছেন নবীগণের গ্রন্থ ১৩টি এবং অন্যান্য গ্রন্থ ৪টি। বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, যোশেফাসের সময়ে ইহূদীগণ যে বাইবেল ব্যবহার করতেন বর্তমান ইহূদী বাইবেল বা খৃস্টান বাইবেল থেকে তার পুস্তক সংখ্যা কম ছিল।

আমরা দেখেছি যে, বর্তমান ইহূদী বাইবেলে নবীগণের পুস্তক দুভাগে বিভক্ত: পূর্ববর্তী নবীগণ ৪টি: যিহশূয়, বিচারকর্তৃগণ, সমূয়েল এবং রাজাবলি এবং পরবর্তী নবীগণ ৪টি: যিশাইয়, যিরমিয়, যিহিষ্কেল ও দ্বাদশ। সর্বশেষ পুস্তকের মধ্যে ১২ জন নবীর পুস্তক একত্রিত: হোশেয়, যোয়েল, আমোস, ওবাদিয়, যোনা, মিখা, নাহূম, হাবাক্কুক, যেফনিয়, হগয়, সখরিয় ও মালাখি। বারজনকে পৃথক ধরলে ইহূদী বাইবেলে নবীগণের পুস্তক সংখ্যা হয় ১৯। ক্যাথলিক বাইবেলে নবীগণের পুস্তক ১৮টি এবং প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে নবীগণের পুস্তক ১৭টি। কোনো অবস্থাতেই নবীগণের পুস্তক ১৩ হয় না।

যোশেফাস ‘অন্যান্য পুস্তকের’ সংখ্যা ৪ বলেছেন। অথচ আমরা দেখেছি যে, বর্তমান ইহূদী বাইবেলের তৃতীয় অংশ (কিতুবীম/ কবঃাঁরস/ ঞযব ডৎরঃরহমং)-এর পুস্তক সংখ্যা ১১টি: গীতসংহিতা, হিতোপদেশ, ইয়োব, পরমগীত, রুত, বিলাপ, উপদেশক, ইস্টের, দানিয়েল, ইয্রা-নেহেমিয় এবং বংশাবলি।

এভাবে আমরা দেখছি যে, কোনোভাবেই উদ্ভট গোজামিল দেওয়া ছাড়া যোশেফাসের সংখ্যার সাথে বর্তমান ইহূদী বাইবেল বা খৃস্টান বাইবেলের সমন্বয় সম্ভব না।((উইকিপিডিয়া: Development of the Hebrew Bible canon, Development of the Old Testament canon, Josephus on the Hebrew Bible Canon.))

১. ৬. ৩. তৃতীয় শতাব্দীর খৃস্টান প-িত ওরিগনের তালিকা

চতুর্থ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ খৃস্টান ধর্মগুরু ইউসিবিয়াস (মৃত্যু ৪৩০ খৃ), তৃতীয় শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু অরিগন (ঙৎরমবহ: ২৫৪ ঈঊ) থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি পুরাতন নিয়মের মধ্যে ২২টি পুস্তক বিদ্যমান বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি পুস্তকগুলির নামও উল্লেখ করেছেন। নামের বর্ণনায় তিনি প্রচলিত কিছু পুস্তককে একত্রিত করে উল্লেখ করেছেন: তাঁর বর্ণনামতে মোশির পাঁচটি পুস্তক ছাড়া অবশিষ্ট ১৭টি পুস্তক নিম্নরূপ: (১) যিহোশূয়ের পুস্তক, (২) বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ও রূতের বিবরণ একত্রে, (৩) শমুয়েলের প্রথম ও দ্বিতীয় পুস্তক একত্রে, (৪) রাজাবলির প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড একত্রে, (৫) বংশাবলির প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড একত্রে, (৬) ইয্রার প্রথম ও দ্বিতীয় (নহিমিয়ের) পুস্তক একত্রে, (৭) গীতসংহিতা, (৮) হিতোপদেশ, (৯) উপদেশক, (১০) পরমগীত, (১১) যিশাইয় ভাববাদীর পুস্তক, (১২) যিরমিয় ভাববাদীর পুস্তক, যিরমিয়ের বিলাপ ও যিরমিয়ের পত্র একত্রে, (১৩) দানিয়েলের পুস্তক, (১৪) যিহিষ্কেল ভাববাদীর পুস্তক, (১৫) ইয়োবের বিবরণ, (১৬) ইস্টেরের বিবরণ ও (১৭) মাকাবিজের পুস্তক।((Eusebius Pamphilus, The Ecclesiastical History, page 97, 244-245.))

এ বিবরণ থেকে নি¤েœর কয়েকটি বিষয় আমরা জানতে পারছি:

প্রথমত: এ বিবরণ অনুসারে ১২ জন গৌণ ভাববাদীর পুস্তক বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত নয়: হোশেয় (Hosea), যোয়েল (Joel), আমোষ (Amos), ওবদিয় (Obadiah), যোনা (Jonah), মীখা (Micah), নহূম (Nahum), হবক্কূক (Habakkuk), সফনিয় (Zephaniah), হগয় (Haggai), সখরিয় (Zechariah) ও মালাখি (Malachi)।

দ্বিতীয়ত: আমরা দেখছি যে, ওরগিন ম্যাকাবীয় পুস্তককে পুরাতন নিয়মের অংশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাহ্যত মাকাবীয় পুস্তক বলতে প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় খ-কেই বুঝানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমান ইহূদী বাইবেল এবং প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে বই দুটো নেই। তারা এ দুটো বইকে জাল ও অনির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেন।

তৃতীয়ত: ওরিগনের বক্তব্য অনুসারে ক্যাথলিক বাইবেলের মাকাবীয়-১ ও মাকাবীয়-২ পুস্তকদ্বয় প্রামাণ্য বলে গণ্য। তবে তাদের বাইবেলের অতিরিক্ত ৫টি পুস্তক জাল বলে প্রমাণিত।
চতুর্থত: ওরিগন বাইবেলের পুস্তকগুলোর মধ্যে ১২ নং পুস্তক হিসেবে যিরমিয় ভাববাদীর পুস্তক, যিরমিয়ের বিলাপ ও যিরমিয়ের পত্র তিনটি পুস্তকের উল্লেখ করেছেন। বর্তমান ইহূদী ও খৃস্টান বাইবেলের মধ্যে প্রথম দুটি পুস্তক বিদ্যমান কিন্তু যিরমিয়র পত্র (Epistle/ Letter of Jeremiah) ক্যাথলিক বা প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলে নেই। তবে সেপ্টুয়াজিন্ট বা গ্রীক বাইবেল ও অর্থোডক্স বাইবেলে তা বিদ্যমান। ক্যাথলিক বাইবেলের বারুকের পুস্তক নামক গ্রন্থটির ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে যিরমিয়ের পত্র বিদ্যমান।((মাইক্রোসফট এনকার্টা, আর্টিকেল: Baruch.))

১. ৭. নতুন নিয়ম সংকলনের বিবর্তন
১. ৭. ১. প্রথম শতাব্দীতে কোনো ইঞ্জিল বা নতুন নিয়ম ছিল না

পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, যীশু খৃস্টের শিষ্যগণ ও শিষ্যগণের শিষ্যগণ (Apostles) যখন খৃস্টধর্ম প্রচার করতেন তখন পুরাতন নিয়মের চূড়ান্ত রূপ যেমন ছিল না, তেমনি তখন ‘নতুন নিয়ম’ বলেও কিছুই ছিল না।

বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হলেও বাস্তব। সাধারণত ধর্মের অনুসারীগণ ধর্মপ্রবর্তক থেকে মূলত ধর্মগ্রন্থটিই গ্রহণ করেন। যেমন ইহূদীগণ মূসা (আ) থেকে তাওরাত গ্রহণ করেন। পরিবর্তন-বিবর্তন যাই হোক না কেন, মূসার সময় থেকেই ইহূদী সমাজে ‘তাওরাত’ প্রচলিত ছিল। খৃস্টধর্মের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন দেখা যায়। সকল খৃস্টান প-িত একমত যে, খৃস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কোনো চার্চে কোনো গসপেল পঠিত হতো অথবা প্রথম শতাব্দীর কোনো গসপেলের পা-ুলিপির কোনো খ-িত অংশ কোনো চার্চে পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায় না। এ সময়ে শিষ্যদের পত্র ও পুস্তুকগুলো প্রসিদ্ধি লাভ করে, তবে ইঞ্জিলের কোনো খবর পাওয়া যায় না।
পরবর্তী আলোচনায় আমরা বিস্তারিত জানব যে, এর অন্যতম কারণ ছিল দুটি।

প্রথমত: যীশু খৃস্ট বারংবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, শিষ্যদের জীবদ্দশায়ই কিয়ামত হবে। এজন্য শিষ্যরা যতটুকু সম্ভব প্রচার করেছেন। কিন্তু কিয়ামত যেহেতু খুবই সন্নিকট সেহেতু ধর্মগ্রন্থ লিখে রাখা অবান্তর বলে মনে করেছেন। নিজেরা প্রচারের জন্য যা কিছু প্রয়োজন লিখেছেন।

দ্বিতীয়ত: প্রথম শতাব্দীর খৃস্টানগণ নিজেদেরকে ইহূদী বলেই বিশ্বাস করতেন। ইহূদী ধর্মগ্রন্থকেই তাঁদের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ বলে বিশ্বাস করতেন। পৃথক ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থের চিন্তাই তারা করেন নি। মূলত দ্বিতীয় খৃস্টীয় শতকের শেষ দিকে সেন্ট আরিয়ানূস খৃস্টধর্মকে পৃথক কিতাবী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু করেন।

এজন্য খৃস্টীয় প্রথম প্রায় ২০০ বৎসরে প্রথম তিন/চার প্রজন্মের খৃস্টানগণ অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে বিভিন্ন দেশে যীশুর বাণী ও বিশ্বাস প্রচার করেছেন, কিন্তু কেউই যীশুর শিক্ষা বা সুসমাচারের কোনো লিখিত রূপ সংরক্ষণ করেন নি বা সাথে রাখেন নি। সবাই যা শুনেছেন বা বুঝেছেন তাই নিজের মনমত প্রচার করেছেন। প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই যিরুশালেম, রোম, আলেকজেন্দ্রিয়া, এন্টিয়ক ইত্যাদি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে খৃস্টান চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিশপ নিযুক্ত হয়েছে। স্বভাবতই প্রত্যেক চার্চে অন্তত কয়েক কপি ‘সুসমাচার’ থাকার কথা ছিল, প্রত্যেক খৃস্টানের নিকট না হলেও হাজার হাজার খৃস্টানের মধ্যে অনেকের কাছেই ধর্মগ্রন্থ থাকার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃত বিষয় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ সকল বিশপের অনেকের অনেক চিঠি বা বই এখনো সংরক্ষিত আছে। তাতে অনেক উপদেশ রয়েছে। কিন্তু তাতে এ সকল সুসমাচারের কোনো উল্লেখ নেই।

এ সময়ের মধ্যে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন, অনেক কথা লিখেছেন, সবই ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিল। কেউই তাকে ঐশ্বরিক প্রেরণা নির্ভর বলে মনে করেন নি। নইলে প্রথম শতকের শেষভাগে মথি, মার্ক, লূক বা যোহন তার সুসমাচার লিখে সকল বিশপের নিকট পাঠিয়ে দিতে পারতেন এই বলে যে, ইশ্বরের প্রেরণায় আমি এ সুসামাচর লিখলাম। একে মান্য করতে হবে।… কখনোই তারা তা করেন নি। ৩০০ বৎসর পরে এ সব অগণিত পুস্তকের মধ্য থেকে তৎকালীন ধর্মগুরুগণ নিজেদের মর্জি মাফিক কিছু পুস্তক পছন্দ করে তাকে বিশুদ্ধ বা ক্যাননিক্যাল বলে মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এগুলোর মধ্যেও সংযোজন বিয়োজন অব্যাহত থেকেছে।

১. ৭. ২. পল ও ক্লিমেন্ট ইঞ্জিলীয় যীশু সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন

আরেকটি বিষয় নিশ্চিত করে যে, প্রথম শতাব্দীদে ইঞ্জিল তো দূরের কথা ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশু বিষয়ক তথ্যগুলোও প্রচলিত ছিল না। খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সাধু পল এবং খৃস্টধর্মের অন্য প্রাণপুরুষ সাধু প্রথম ক্লিমেন্ট ইঞ্জিলে বর্ণিত যীশু বিষয়ক তথ্য, যীশুর শিক্ষা ও বক্তব্যগুলো কিছুই জানতেন না। যাকোব, পিতর ও অন্যদের পত্র থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, তাঁরা ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর শিক্ষা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না।

আমরা দেখেছি, নতুন নিয়মের ২৭ পুস্তকের মধ্যে ১৪টিই সাধু পল (Saint Paul)-এর রচিত। সাধু পল ৬৭ খৃস্টাব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। খৃস্টধর্মের অন্য প্রাণপুরুষ সাধু প্রথম ক্লিমেন্ট (Saint Clement I)। এনকার্টা বিশ্বকোষ প্রদত্ত সাধু প্রথম ক্লিমেন্টের জীবনী ও পোপগণের তালিকা অনুসারে ক্লিমেন্ট ৯২-১০১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত রোমের বিশপ বা পোপ ছিলেন এবং ১০১ খৃস্টাব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পত্রাবলির গুরুত্ব সম্পর্কে সকল খৃস্টান সম্প্রদায় একমত। তবে তার পত্রাবলিকে নতুন নিয়মের অন্তুর্ভুক্ত করার বিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। নতুন নিয়মের অনেক পা-ুলিপি ও সংস্করণে তার পত্রগুলো সংযোজিত। সাধু পল ও সাধু ক্লিমেন্টের লিখনি প্রমাণ করে যে, প্রথম শতাব্দীতে প্রচলিত চার ই্িঞ্জলের কোনোটিই বিদ্যমান ছিল না। এ সকল ইঞ্জিলে বিদ্যমান গল্প, কাহিনী ও যীশুর জীবনী এ সাধুদ্বয় কিছুই জানতেন না। এমনকি যীশুর বক্তব্য এবং সাধু পলের পত্রকে ক্লিমেন্ট ধর্মগ্রন্থ বা ঐশী গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করতেন না।
উইকিপিডিয়া নতুন নিয়মের বিবর্তন (Development of the New Testament canon) প্রসঙ্গে লিখেছে:

“By the end of the 1st century, some letters of Paul were known to Clement of Rome …, together with some form of the “words of Jesus”; but while Clement valued these highly, he did not regard them as “Scripture” (“graphe”), a term he reserved for the Septuagint. ..”

“প্রথম শতকের শেষ প্রান্তে রোমের ক্লিমেন্ট … পলের কিছু পত্রের সাথে পরিচিত ছিলেন। পাশাপাশি ‘যীশুর বাক্যাবালি’ জাতীয় কিছুর সাথেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ক্লিমেন্ট এগুলোকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করেছেন। তবে তিনি এগুলোকে ‘পাক কিতাব’, শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করেন নি। ‘ঐশী গ্রন্থ’ বা ‘ধর্মগ্রন্থ’ পরিভাষাটি শুধু সেপ্টুআজিন্ট বা গ্রীক পুরাতন নিয়মের জন্যই সংরক্ষিত ছিল।”

The Christianity General forumএর রবার্ট বয়ড (Robert Boyd) লিখেছেন:

Paul’s letters, written around 55-65 CE, fail to mention any Gospel miracle, act or major event concerning Christ’s life, apart from the Eucharist and some vague references to the crucifixion and resurrection. He also fails to accurately quote any of Christ’s teachings, as depicted in the Gospels. Clement, writing some 30 years later, does little better than Paul. While quoting extensively from the Old Testament, and offering numerous examples to illustrate his points from the lives of OT prophets and saints, Clement, like Paul, ignores the amazing life of Jesus Christ. Yet some 60 years later, Justin Martyr quotes extensive passages from the Gospels, including many of Christ’s miracles, birth details etc  (but fails to attribute such passages to any of the named Gospels). It was not until 180 CE that Iraeneus finally put names to all four Gospels, a full 150 years after Christ’s death. This pattern is not what would be expected if in fact the gospel accounts had been written by the named authors, early after Christ’s death and based on actual events. I suggest that the progressive and increasingly elaborate revelation of Christ, as witnessed through the letters of the church fathers, is more consistent with an evolving myth than with a story based on an actual, living Christ. The silence by Paul and Clement on the life of Christ is difficult to explain, apart from the possibility that they were ignorant of any such life. ……

From Clement, we glean nothing about the historical Christ or any of the events associated with him. We learn only that Christ shed his blood as a sacrifice. There are a few hints at Christ’s teachings, but nothing accurately quoted from any named Gospels. Numerous examples are cited from the OT and from the lives of the apostles in order to illustrate principles of faith, love, persecution etc, but not one example from Christ’s life whatsoever, apart from aspects concerning his death and resurrection. The only rational explanation is that Clement, like Paul, was ignorant of the life of any historical Christ


“পলের পত্রগুলো ৫৫ থেকে ৬৫ খৃস্টাব্দের মধ্যে রচিত। এ সকল পত্র ইঞ্জিলের মধ্যে উল্লেখ-কৃত যীশুর কোনো অলৌকিক কর্ম, কার্যাবলি বা যীশুর জীবনের বড় কোনো ঘটনা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু নৈশভোজ, ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ও পুনরুত্থান সম্পর্কে সাধারণ কিছু কথা এগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে যীশুর শিক্ষা যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার কোনো কিছু সঠিকভাবে উদ্ধৃত করতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ক্লিমেন্ট তার পত্রগুলো আরো ত্রিশ বছর পরে লিখেছেন। তিনি পলের চেয়ে মোটেও ভাল করতে পারেন নি। ক্লিমেন্ট পুরাতন নিয়ম থেকে ব্যাপক উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। তিনি তার বক্তব্যগুলো উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করার জন্য পুরাতন নিয়মের নবীগণ ও সাধুগণের জীবন থেকে অনেক দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। অথচ তিনি যীশু খৃস্টের বিস্ময়কর জীবন পুরোপুরিই অগ্রাহ্য ও উপেক্ষা করেছেন। সাধু পলও এরূপই করেছেন। অথচ ৬০ বছর পর জাস্টিন মার্টার (মৃত্যু ১৬৫ খৃ) ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বিষয়াদি ব্যাপকভাবে উদ্ধৃতি প্রদান করছেন। খৃস্টের অনেক অলৌকিক কর্ম, জন্ম বৃত্তান্ত ইত্যাদি তিনি উল্লেখ করছেন (তবে তিনি এ সকল তথ্যের সূত্র হিসেবে ‘নাম-বিশিষ্ট’ কোনো ইঞ্জিলের কথা উল্লেখ করেন নি)। খৃস্টের মৃত্যুর পরে পূর্ণ ১৫০ বৎসর অতিবাহিত হওয়ার পরে ১৮০ খৃস্টাব্দে সর্বপ্রথম আরিয়ানুস চারটি ইঞ্জিলের নাম উল্লেখ করেন।

প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো যাদের নামে প্রচলিত, যদি এগুলো সত্যই তাদের লেখা হতো, খৃস্টের মৃত্যুর অল্প সময় পরে লেখা হতো এবং সত্য ঘটনার উপর নির্ভর করে লেখা হতো তবে কখনোই বিষয়টি এরূপ হতো বলে ধারণা করা যায় না।

প্রথম যুগের ধর্মগুরুগণের পত্রের মধ্যে খৃস্ট সম্পর্কীয় বর্ণনার ক্রমবর্ধমান বিবর্তন ও উত্তরোত্তর বিস্তৃতি ঘটেছে। আমি মনে করি, তাদের বর্ণনাগুলোর সাথে প্রকৃত ঘটনা এবং বাস্তব খৃস্টের মিল নেই। বরং এগুলো ক্রম বিবর্তনশীল কল্পকাহিনী বা রূপকথার সাথেই অধিক মিল সম্পন্ন।

খৃস্টের জীবন সম্পর্কে পল ও ক্লিামেন্টের নীরবতার ব্যখ্যা করা কঠিন। একটি সম্ভাবনা মেনে নিলেই শুধু এর ব্যাখ্যা হয়। সেটি হলো তারা এরূপ কোনো জীবনী সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন। …..

ক্লিমেন্টের বক্তব্যের তলানি কুড়িয়েও আমরা যীশুর ঐতিহাসিক জীবনীর কিছই খুঁজে পাই না। তাঁর জীবনের সাথে জড়িত কোনো ঘটনাও পাওয়া যায় না। ক্লিমেন্ট থেকে আমরা শুধু এতটুকই জানতে পারি যে, যীশু উৎসর্গ হিসেবে তাঁর রক্তপাত করেছেন। খৃস্টের শিক্ষা বিষয়ে সামান্য কিছু ইঙ্গিত বিদ্যমান। কিন্তু প্রচলিত ‘নাম-বিশিষ্ট’ ইঞ্জিলগুলোর কোনোটি থেকে কোনো নির্ভুল উদ্ধৃুতি দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ধর্মবিশ্বাসের মূলনীতি, প্রেম, যন্ত্রণা, জুলুম ইত্যাদি ব্যাখ্যা করার জন্য পুরাতন নিয়ম থেকে অগণিত দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। শিষ্যদের জীবন থেকেও এরূপ দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। কিন্তু খৃস্টের জীবন থেকে একটিও দৃষ্টান্ত পেশ করা হয় নি, শুধু তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থান সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া। এর একটিমাত্রই যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। তা হলো পলের মতই ক্লিমেন্টও ঐতিহাসিক কোনো যীশুর জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।”((দেখুন: A Brief History of the Bible http://liberalslikechrist.org/about/biblestats.html))

১. ৭. ৩. মথি, মার্ক, পিতর, যাকোব ও অন্যান্য শিষ্যের অবস্থা

নতুন নিয়মের মধ্যে বিদ্যমান প্রেরিতদের কার্যবিবরণ ও শিষ্যদের পত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অন্যান্য শিষ্যের অবস্থাও একইরূপ ছিল। প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো লেখা না হলেও ইঞ্জিলে উদ্ধৃত যীশুর বক্তব্যগুলো তো প্রেরিতগণ ও শিষ্যগণের মধ্যে প্রচলিত থাকার কথা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রেরিতগণ, শিষ্যগণ ও প্রথম প্রজন্মের খৃস্টানগণ অনেক বিতর্ক করছেন, পুরাতন নিয়ম থেকে প্রমাণ পেশ করছেন, কিন্তু তাঁদের ত্রাণকর্তা যীশুর একটি বক্তব্যও উদ্ধৃত করছেন না। কয়েকটি নমুনা দেখুন:

(ক) অ-ইহূদীদের খৃস্টধর্মে দীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে অত্যন্ত উত্তপ্ত বিতর্ক হচ্ছে। পিতর ও পল পুরাতন নিয়ম থেকে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য উদ্ধৃত করে অ-ইহূদীদের খৃস্টধর্মে দীক্ষা দেওয়ার বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। কিন্তু ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান যীশুর সর্বশেষ ও সর্বাধিক প্রসিদ্ধ নির্দেশের কথা কেউই বলছেন না।

ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনা অনুসারে যীশু মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের পর তাঁর ১১ জন প্রেরিতকে নির্দেশ দেন, “তোমরা গিয়া সমুদয় জাতিকে শিষ্য কর; পিতার, পুত্রের ও পবিত্র আত্মার নামে তাহাদিগকে বাপ্তাইজ কর। আমি তোমাদিগকে যাহা যাহা আজ্ঞা করিয়াছি, সে সমস্ত পালন করিতে তাহাদিগকে নির্দেশ দাও” (মথি ২৮/১৯-২০। আরো দেখুন: মার্ক ১৬/১৫; লূক ২৪/৪৭-৪৯)

প্রেরিতদের কার্যবিবরণের ১০ অধ্যায়ে আমরা দেখি যে, একটি স্বপ্নের ভিত্তিতে পিতর অ-ইহূদীদের মধ্যে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। এ পুস্তকের ১১ অধ্যায়ে আমরা দেখি যে, যিরুশালেমের খৃস্টধর্মীয় প্রধানগণ পিতরের কর্মে আপত্তি করলে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা ও অলৌকিক কর্মের কথা জানান। এ পুস্তকের ১৫ অধ্যায়ে আমরা দেখি যে, এ বিষয়ে ‘প্রেরিতগণ ও খৃস্টধর্মীয় প্রাচীনবর্গে’ সম্মেলনে পিতর পুরাতন নিয়ম থেকে উদ্ধৃতি প্রদান করে নিজের মত সমর্থনের চেষ্টা করছেন। রোমীয় ও অন্যান্য পুস্তকে পল পুরাতন নিয়মের অনেক বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন অ-ইহূদীদের মধ্যে খৃস্টধর্ম প্রচারের পক্ষে। কিন্তু সম্মেলনে উপস্থিত ১২ শিষ্য, পল, বার্নাবা বা অন্য কেউই ইঞ্জিলের মধ্যে উদ্ধৃত যীশুর এ বক্তব্যগুলোর কথা উল্লেখ করছেন না। মথি ও মার্ক ১২ প্রেরিতের দুজন। তাঁরা তাঁদের ইঞ্জিলের মধ্যে যীশুর এ বক্তব্য লিখলেন, কিন্তু প্রেরিতগণের সম্মেলনে এ বিষয়ে একটি শব্দও বললেন না! এর স্বাভাবিক ব্যাখ্যা এই যে, ইঞ্জিলগুলো অনেক পরে অজ্ঞাত লেখকদের দ্বারা কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তিতে লেখা। প্রেরিতগণ ও খৃস্টধর্মের প্রথম প্রজন্মের ‘প্রাচীনবর্গ’ কেউই ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান এ সকল কথা কিছুই জানতেন না।

(খ) পবিত্র-অপবিত্র সকল প্রকার প্রাণী ও খাদ্য ভক্ষণের পক্ষে অনেক যুক্তি পেশ করেছেন পল। কিন্তু যীশুর প্রসিদ্ধ বক্তব্য: “মুখের ভিতরে যাহা যায়, তাহা যে মনুষ্যকে অশুচি করে, এমন নয়, কিন্তু মুখ হইতে যাহা বাহির হয়, তাহাই মনুষ্যকে অশুচি করে। (মথি ১৫/১১-২০) পল কোথাও উল্লেখ করছেন না।

(গ) পরবর্তী আলোচনায় আমরা দেখব যে, সাধু পল মূসা (আ)Ñএর শরীয়ত ও তাওরাত পালনের বিরোধী ছিলেন। তিনি তাঁর মতের পক্ষে অনেক যুক্তি পেশ করেছেন এবং পুরাতন নিয়মের অনেক বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। যাকোব তাঁর পত্রে শরীয়ত ও তাওরাত পালনের পক্ষে অনেক যুক্তি দিয়েছেন এবং পলের দলিল খ-ন করেছেন। তবে যীশুর অতি প্রসিদ্ধ বক্তব্যগুলো একটিও উল্লেখ করেন নি। মথির ইঞ্জিলের বর্ণনায় যীশু বলেন: “মনে করিও না যে, আমি ব্যবস্থা (তাওরাত) কি ভাববাদিগ্রন্থ লোপ করিতে আসিয়াছি; আমি লোপ করিতে আসি নাই, কিন্তু পূর্ণ করিতে আসিয়াছি। … অতএব যে কেহ এই সকল ক্ষুদ্রতম আজ্ঞার মধ্যে কোন একটি আজ্ঞা লঙ্ঘন (break) করে, ও লোকদিগকে সেইরূপ শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গরাজ্যে অতি ক্ষুদ্র বলা যাইবে; কিন্তু যে কেহ সে সকল পালন করে ও শিক্ষা দেয়, তাহাকে স্বর্গ-রাজ্যে মহান বলা যাইবে। কেননা আমি তোমাদিগকে কহিতেছি, অধ্যাপক ও ফরীশীদের অপেক্ষা তোমাদের ধার্মিকতা যদি অধিক না হয় তবে তোমরা কোন মতে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পাইবে না।” (মথি ৫/১৭-২০)

লূকের বর্ণনায় তিনি বলেন: “কিন্তু ব্যবস্থার (তাওরাতের) এক বিন্দু পড়িয়া যাওয়া অপেক্ষা বরং আকশের ও পৃথিবীর লোপ হওয়া সহজ।” (লূক ১৬/১৭)
এ সকল বক্তব্য যাকোবের জানা থাকলে তিনি কি তা উদ্ধৃত না করে পুরাতন নিয়ম ও নানাবিধ যুক্তিতর্কের আশ্রয় নিতেন? যাকোবের বক্তব্য থেকে সুস্পষ্ট যে, তিনি এ সকল বক্তব্য যীশুর মুখ থেকে বা অন্য কারো মুখ থেকে কখনো শুনেন নি।

১. ৭. ৪. দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে নতুন নিয়ম গঠনে মতভেদ

খৃস্টান পণ্ডিতগণ অনেক সময় সুসমাচারগুলির বিশুদ্ধতার প্রমাণ হিসেবে বলেন যে, ১০৪ খৃস্টাব্দে মৃত রোমের বিশপ ক্লীমেন্ট (Clement) ও ১০৭ বা ১১০ খৃস্টাব্দে নিহত এন্টিয়কের দ্বিতীয় বিশপ ইগনাটিয়াস (Ignatius)-এর চিঠিপত্রের মধ্যে দু-একটি বাক্য রয়েছে, যে বাক্যগুলি এ সকল সুসমাচারের মধ্যে বিদ্যমান। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ সকল সুসমাচার তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল! প্রমাণটি সত্যই অদ্ভুত! ক্লিমেন্ট বা ইগনাটিয়াস কোনোভাবে এ সকল সুসমাচারের নাম উল্লেখ করেন নি, এগুলো থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলেও জানান নি, তারা কোনো লিখিত সূত্রের উপর নির্ভর করেছেন, না মৌখিক শ্রুতি থেকে লিখেছেন তাও বলেন নি। কাজেই তাদের এরূপ উদ্ধৃতি তাদের সময়ে কোনো ইঞ্জিল বা গসপেলের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ নয়।

দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি এশিয়া মাইনরের বিশপ সিনোপের মারসিওন (Marcion of Sinope) সর্বপ্রথম খৃস্টধর্মের জন্য একটি ধর্মগ্রন্থ নির্ধারণ করেন। তিনি লুকের নামে প্রচারিত ইঞ্জিল ও সাধু পলের ১০টি পত্র একত্রে খৃস্টধর্মের জন্য প্রথম ‘নতুন নিয়ম’ সংকলন করেন। তার কর্মই মূলত খৃস্টান প-িতদেরকে একটি নতুন নিয়ম তৈরির সংগ্রামে লিপ্ত করে। নতুন নিয়মের উৎস (Origin of the New Testament) গ্রন্থে এডলফ ভন হারনাক (Adolf von Harnack) উল্লেখ করেছেন যে, মারসিওন দেখেন যে, তার সময়ের চার্চ ছিল মূলতই ‘পুরাতন নিয়মের চার্চ। তখন চার্চের কোনো বিধিবদ্ধ নতুন নিয়ম ছিল না। আর মারসিওনের এ কর্মের চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করতেই খৃস্টীয় চার্চ ক্রমান্বয়ে নতুন নিয়ম তৈরি করে।((উইকিপিডিয়া: Development of the New Testament canon, Marcion of Sinope))

খৃস্টান চার্চ মার্সিওনকে ধর্মদ্রোহী বলে বহিষ্কার করে। মার্সিওনের কর্ম খৃস্টান ধর্মগুরুদেরকে একটি নতুন নিয়ম ও তার বিশুদ্ধ গ্রন্থাবলি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে উদ্বুদ্ধ করে। দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ প্রান্তে সাধু আরিয়ানুস (মৃত্যু ২০২ খৃ) সর্বপ্রথম চার ইঞ্জিলের কথা উল্লেখ করেন এবং এগুলোকেই একমাত্র বিশুদ্ধ ইঞ্জিল বলে গণ্য করার দাবি করেন। এছাড়া নতুন নিয়মের অন্যান্য গ্রন্থের বিষয়েও তিনি মত প্রকাশ করেন।

নতুন নিয়ম গঠনের পরবর্তী আরেকটি প্রচেষ্টার সন্ধান পাওয়া যায় মুরাটোরিয়ান ক্যানন (Muratorian Canon) বা মুরাটোয়িান বিশুদ্ধ বাইবেল নামক পা-ুলিপিতে। খুস্টান গবেষকগণ তালিকাটির প্রণয়নকাল বিষয়ে মতভেদ করেছেন। তারা ধারণা করেন তালিকাটি ২০০ খৃস্টাব্দ থেকে ৪০০ খৃস্টাব্দের মধ্যে রচিত। এতে নতুন নিয়মের ৫টি পুস্তক বাদ দেওয়া হয়েছে: (১) ইব্্রীয় (Hebrews), (২) যাকোবের পত্র (James), (৩) পিতরের ১ম পত্র (1 Peter), (৪) পিতরের ২য় পত্র (2 Peter), (৫) যোহনের ৩য় পত্র। অপরদিকে এ তালিকায় প্রচলিত নতুন নিয়মের পুস্তকগুলোর বাইরে পিতরের নিকট প্রকাশিত বাক্য (Apocalypse of Peter) নামক পুস্তক সংযোজিত।((উইকিপিডিয়া: Muratorian Canon))

পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত নতুন নিয়মের গ্রন্থাবলি বিষয়ে মতভেদ চলতে থাকে। আমরা দেখেছি যে, বর্তমানে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের নতুন নিয়মের পুস্তক সংখ্য ২৭ হলেও বর্তমানে প্রচলিত সিরিয় বাইবেলে ২২ পুস্তকের উপর নির্ভর করা হয় এবং বর্তমানে প্রচলিত ইথিওপিয় বাইদবেলে ৩৫ টি পুস্তক বিদ্যমান।

বর্তমানে বিদ্যমান বিভিন্ন খৃস্টান সম্প্রদায়ের বাইবেলের পুরাতন নিয়মের পুস্তক সংখ্যা ৩৯ থেকে ৫৩: ১৪ টি পুস্তকের পার্থক্য। আর নতুন নিয়মের পুস্তক সংখ্য ২২ থেকে ৩৫। ১৩ টি পুস্তকের পার্থক্য। মোট ২৭ টি পুস্তকের হেরফের। আর এ ২৭ টি পুস্তক ও অন্যান্য পুস্তক বিষয়ে খৃস্টান ধর্মগুরুদের মতভেদ অনেক। পাঠক এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার (biblical literature) প্রবন্ধের (The history of canonization) পরিচ্ছেদ, উইকিপিডিয়ায়: Development of the New Testament canon,  Development of the Hebrew Bible canon, Development of the Old Testament canon ইত্যাদি আর্টিকেল অধ্যয়ন করলে জানতে পারবেন যে, বিগত প্রায় দু হাজার বছর ধরে খৃস্টান ধর্মগুরুগণ কয়েক ডজন যাজকীয় সম্মেলন করেছেন বাইবেলের পুস্তকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। কিন্তু বারবারই তারা পূর্ববর্তী সম্মেলনের সিদ্ধান্ত পরের সম্মেলনে পরিবর্তন করেছেন।

১. ৭. ৫. সংকলনের ভিত্তি ও গ্রহণ-বর্জনের মানদ-

আমরা দেখি যে, সংকলনের এ বিবর্তনে গ্রহণ ও বর্জনের ক্ষেত্রে মূলত পছন্দ বা প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক যুক্তির উপর নির্ভর করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় খৃস্টীয় শতকে যীশু খৃস্ট ও তাঁর শিষ্যদের নামে কয়েকশত পুস্তক প্রচারিত হয়। দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত এগুলো গ্রহণ বা বর্জনের ধারা চলতে থাকে। উইকিপিডিয়ায় (Development of the New Testament canon) এবং এ জাতীয় যে কোনো গ্রন্থ বা প্রবন্ধ পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, মার্সিওন (Marcion of Sinope: 165 CE), আরিয়ানুস (Irenaeus: 102 CE) এবং পরবর্তী ধর্মগুরুগণ নতুন নিয়মের গ্রন্থগুলো নির্ধারণ, গ্রহণ বা বর্জনের জন্য অনেক যুক্তি দিয়েছেন, কিন্তু কোথাও দাবি করেন নি যে, তিনি অমুক পুস্তককে বিশুদ্ধ বলে গ্রহণ করছেন কারণ তিনি এগুলো মূল লেখকের বা তার কোনো শিষ্যের লেখা পা-ুলিপি দেখেছেন বা পড়েছেন। আরিয়ানূস দাবি করেছেন যে, পৃথিবীর চার কোণ, বায়ু চার প্রকার, ঈশ্বরের সিংহাসনের বাহক চার জন, কাজেই ইঞ্জিল চারটির বেশি বা কম হতে পারে না। কিন্তু তিনি দাবি করেন নি যে, এ চারটি ইঞ্জিলের লেখকদেরে লেখা পা-ুলিপিগুলো বিদ্যমান বা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত, কাজেই এগুলো গ্রহণ করতে হবে আর অমুক ইঞ্জিল বা পত্রের মূল পা-ুলিপি পাওয়া যায় না, কাজেই তা গ্রহণ করা যাবে না।