প্রশ্নটি করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। নিম্নে আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত বিষয়ে আলোচনা করা হল। আশা করি আপনি তাতে আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন। ইনশাল্লাহ। মহান আল্লাহ সমস্ত মাখলুকাতের মধ্য হতে মানুষকে সবচেয়ে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ লাভ করেছে সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুকাতের সুমহান মর্যাদা। উদ্দেশ্য একটাই, মানুষ তাঁর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর ইবাদত করবে। সবসময় সবক্ষেত্রে তাঁর এবং তাঁর রাসূল সাঃ এর দিকনির্দেশনা মেনে চলবে। সর্বাত্নক চেষ্টা করবে নিজেকে জান্নাতিদের সফলকাম কাঁতারে শামিল করার জন্য। শতচেষ্টার পরেও প্রকাশ্য দুশমন শয়তানের প্ররোচনায়, প্রবৃত্তির তাড়নায় কখন কখন মানুষ তার প্রতিপালককে ভুলে যায়। বিচ্যুত হয় সঠিক পথ থেকে, আর লিপ্ত হয় নানা রকম অপকর্মে। হাতছাড়া করে ফেলে শ্রেষ্ঠত্যের মহান গুন। তারপরেও ইসলাম চাই মানুষ তার পাপ কর্মের ব্যাপারে লজ্জিত আর অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসুক আল্লাহর দিকে। তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে পাক তার হারানো সম্মান। আর তার পাপকর্মটি গোপন থাকুক অন্যান্য মানুষের নিকট। কেউ যদি তার দোষত্রুটি জেনে ফেলে তাকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে উক্ত দোষ গোপন রাখতে। উপরোন্ত তা গোপন রাখার ব্যাপারে হাদীস শরীফে ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে। এক হাদীসে তিনি বলেন:
مَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَة
যে ব্যাক্তি কোন মুসলমানের দোষ গোপন করবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন। বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ২৪৪২। মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ৬৭৪৩। পাশাপাশি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে দোষচর্চা করতে। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলে কারীম সাঃ বলেন:
فَإِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ
অর্থঃ তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান পরষ্পরের জন্য হারাম (সম্মানিত)। বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ৬৭। মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ৪৪৭৮। কোরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ কারো দোষচর্চা বা গীবত করাকে মৃতভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছে।এরশাদ হয়েছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ
অর্থঃ হে মুমিনগণ ! তোমরা অধিকাংশ ধারনা থেকে বিরত থাক ; কারণ কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা একে অপরের দোষ তালাশ করনা। আর কেউ যেন কারো পশ্চাতে দোষচর্চা না করে। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? বস্তুত তোমরা তো এটাকে অপছন্দই করো। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর ; আল্লাহ তাওবা কবুল কারী, পরম দয়ালু। সূরা-হুজরাত, আয়াত-১২। অনুরুপভাবে অযৌক্তিক বা বিনা কারনে কাউকে হত্যা করার ব্যাপারে ইসলাম ঘোর বিরোধী। কোরআনে কারীমে বিনা কারনে একজনের হত্যাকে সমস্ত মানুষকে হত্যা করার সাথে তুলনা করেছে। মহান আল্লাহ বলেন:
مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا
অর্থঃ যে ব্যাক্তি কোন হত্যাকান্ড ছাড়া বা দুনিয়ায় কোন ধবংসাত্ম ক কাজ করা ছাড়া কাউকে হত্যা করল সে যেন সকল মানুষকেই হত্যা করল। সূরা মায়িদা, আয়াত নং ৩২। কোন অপরাধ অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোন বিচারকাজ সম্পাদন করার জন্য ইসলাম উক্ত বিষয়ে নিশ্চিত হতে বা শক্তিশালী করতে সাক্ষীর ব্যাবস্থা করেছে। সকল ক্ষেত্রে এক, দুই বা তিনজন সাক্ষী নির্ধারণ করলেও যিনার ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষীর শর্তরোপ করা হয়েছে। কোরআনে কারীমে এরশাদ হয়েছে :
وَاللَّاتِي يَأْتِينَ الْفَاحِشَةَ مِنْ نِسَائِكُمْ فَاسْتَشْهِدُوا عَلَيْهِنَّ أَرْبَعَةً مِنْكُمْ
অর্থঃ তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচার করে তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য হতে চারজন সাক্ষী তলব কর। সূরা নিসা, আয়াত-১৫। চারজনের কম হলে উক্ত সাক্ষ্য গ্রহনযগ্য তো হবেই না, উল্টা তাদের উপরই অপবাদের শাস্তি হিসাবে আশিবার বেত্রাঘাতের বিধান দিয়েছে ইসলাম । এপ্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক এরশাদ করেন:
لَوْلَا جَاءُوا عَلَيْهِ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَإِذْ لَمْ يَأْتُوا بِالشُّهَدَاءِ فَأُولَئِكَ عِنْدَ اللَّهِ هُمُ الْكَاذِبُونَ
অর্থঃ তারা কেন এব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি সে কারনে তারা আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদী। সূরা নূর,আয়াত-১৩। অপর একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً وَلَا تَقْبَلُوا لَهُمْ شَهَادَةً أَبَدًا وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
অর্থঃ যাহার সাধ্ববী নারীদের ব্যাপারে অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনা, তাদেরবে আশিটি বেত্রঘাত করবে এবং কখন তাদের সাক্ষ্য গ্রহন করবে না । মুমিনের জন্য এটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সূরা নূর, আয়াত-৪। হযরত আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণীত একটি হাদীসে আছে
سعد بن عبادة قال لرسول الله صلى الله عليه وسلم: يا رسول الله، أرأيت إن وجدت مع امرأتي رجلا، أمهل حتى آتي بأربعة شهداء؟ قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: نعم হযরত সাদ ইবনে উবাদাহ রাঃ রাসূল সাঃ কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাঃ আমি যদি আমার স্ত্রীর সাথে কাউকে দেখি তাহলে আমি কি চারজন সাক্ষী উপস্থিত করা পর্যন্ত ছেড়ে দিব? উত্তরে রাসূল সাঃ বললেন : হা।শায়েখ শুয়াইব আরনাউত বলেন; হাদীসের সনদটি সহীহ। সহী ইবনে হিব্বান, তাহকীক, শুয়াইব আরনাউত, হাদীস নং ৪৪০৯। মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৪৯৮। কাউকে কোন অপরাধে লিপ্ত দেখে তাকে বিচারকের নিকট সোপর্দ করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আতপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে বিচার ছাড়া কেউ শাস্তি দিতে পারবে না। এ প্রক্রিয়ার বাইরে স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধান বিচারপতিও কাউকে শাস্তি দিতে পারবে না । খলীফা উমার রাঃ আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাঃ কে বলেন:
لَوْ رَأَيْتَ رَجُلاً عَلَى حَدٍّ زِنًا ، أَوْ سَرِقَةٍ وَأَنْتَ أَمِيرٌ فَقَالَ شَهَادَتُكَ شَهَادَةُ رَجُلٍ مِنَ الْمُسْلِمِينَ قَالَ صَدَقْتَ
অর্থঃ আপনি শাসক থাকা অবস্থায় যদি কাউক ব্যভিচারের অপরাধে বা চুরির অপরাধে রত দেখতে পান তাহলে তার বিচারের বিধান কী? ( নিজের দেখাতেই কি বিচার করতে পারবেন?) আব্দুর রহমান রাঃ বললেন, আপনার সাক্ষ্যও একজন সাধারন মুসলিমের সাক্ষ্যের সমান। উমার রাঃ বলেন,আপনি ঠিকই বলেছেন। বুখারী আস-সহীহ, কিতাবুল ফিতান, বাব, আশ্ শাহাাদাত তাকুনু ইনদাল হাকীম। অর্থৎ রাষ্ট্রপ্রধান নিজের হাতে বিচার তুলে নিতে পারবেন না । এমনকি তার সাক্ষ্যের অতিরিক্ত কোন মূল্যও নেই। রাষ্ট্রপ্রধানের একার সাক্ষ্যে কোন বিচার হবে না । বিধিমোতাবেক দুই জন বা চারজন সাক্ষীর কমে বিচারক কারো বিচার করতে পারবেন না। অন্য ঘটনায় উমার রাঃ রাত্রে মদীনায় ঘোরাফেরা করার সময় একব্যাক্তিকে ব্যভিচারে লিপ্ত দেখতে পান। তিনি পরদিন সাহাবীগণকে জিজ্ঞাসা করেন, যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাউকে ব্যভিচারে লিপ্ত দেখতে পান তাহলে তিনি কি শাস্তি প্রদান করতে পারবেন? তখন আলী রাঃ বলেন, কখনই না। আপনি ছাড়া আরো তিনজন প্রত্যক্ষ্য সাক্ষী যদি অপরাধের সাক্ষ্য না দেয় তাহলে আপনার উপরের মিথ্যা অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। আল কানযুল আকবার ১/২২৭ । এটা স্পষ্ট বিষয় যে, চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্যর ভিত্তিতে জিনা প্রমাণীত হওয়া এক বিরাট কঠিন বিষয়। একারনেই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহঃ বলেন:ইসলামের শুরু থেকে এপর্যন্ত সাক্ষ্যর ভিত্তিতে জিনা প্রমাণীত হয়নি। যা হয়েছে তা স্বীকরোক্তির ভিত্তিতে হয়েছে। এব্যাপারে ইসলামের সর্বোচ্চ এ সতর্কতা গ্রহন বা কঠিন শর্তারোপের কারন হল, মানুষের জীবন অতি মূল্যাবান। আর ইসলামের উদ্দে্শ্য হল, অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করা, অপরাধীকে নির্মুল করা নয়। বিচারকের ভুলে অপরাধী বেচে যাক কিন্তু তার ভুলে যেন নিরাপরাধ শাস্তি না পাই এবং কম অপরাধী বেশি শাস্তি না পাই। এজন্য ইসলামে হুদুদকে কঠিন করা হয়েছে এবং হুদুদের ব্যাবস্থাপনা আরো বেশি কঠিন করা হেয়েছে। বিচারক সর্বাত্নক চেষ্টা করবে মৃত্যুদন্ড না দেয়ার জন্য। ফুক্বাহায়ে কেরাম এব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে, অপরাধের পূর্ণতার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহ থাকলেও আর মৃত্যুদন্ড দেয়া যাবে না। কারন, বিচারকের ভুলে নিরাপরাধের বা কম অপরাধীর বেশি শাস্তি হওয়ার চেয়ে অপরাধীর মুক্তি বা বেশি অপরাধের জন্য কম শাস্তি বাঞ্চনীয়। তারপরেও যখন এই জঘণ্য কর্মটি চারজন ব্যাক্তি প্রত্যক্ষ্য করতে সক্ষম হয় তাহলে বুঝতে হবে সে ব্যাক্তি অধঃপতনের সর্বনিম্ম পর্যয়ে পৌছে গেছে এবং এই কর্মটি প্রকাশ্যে করেছে। এই অবস্থায় ব্যাপক স্বার্থে ইসলাম তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় দেয়ার অনুমতি প্রদান করে। আল্লাহ আমাদেরকে পরিপূর্ণ তাকওয়া অর্জন করার তাওফীক দান করুন।