পোশাকী অনুকরণের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিভ্রান্তি
সুন্নাতের নামে সুন্নাত বিরোধিতা বা সুন্নাতসম্মত পোশাক সুন্নাত বিরোধী পদ্ধতিতে ব্যবহার করা।
সকল বিষয়ের ন্যায় পোশাক পরিচ্ছদের ক্ষেত্রেও অনুকরণের পর্যায় ও গুরুত্ব সুন্নাতের আলোকে বুঝতে হবে। তিনি যে বিষয়কে কম গুরুত্ব দিয়েছেন তাকে বেশি গুরুত্ব দিলে বা তিনি যা কখনো কখনো করেছেন তা সর্বদা করলে তাঁর সুন্নাতের বিরোধিতা করা হয়। পদ্ধতিগত বা গুরুত্বগত ব্যতিক্রম বা বিরোধিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে কঠিনভাবে আপত্তি করেছেন এবং একে ‘তাঁর সুন্নাত অপছন্দ করা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। “এহইয়াউস সুনান” গ্রন্থে আমি এবিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
পোশাকের ক্ষেত্রে সাধাসিধে হওয়া, চাকচিক্যময় না হওয়া, পরিচ্ছন্ন হওয়া, দুর্গন্ধমুক্ত হওয়া, সকল প্রকার পোশাক পায়ের টাখনুর ঊর্ধ্বে থাকা, অহংকার প্রকাশক না হওয়া, প্রসিদ্ধি প্রকাশক না হওয়া, বিলাসী না হওয়া ইত্যাদি বিষয়ের উপর তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি আজীবন সকল প্রকার পোশাকের ক্ষেত্রে এগুলি অনুসরণ করেছেন, অগণিত হাদীসে এগুলির উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং এর ব্যতিক্রম করতে নিষেধ করেছেন।
অপরদিকে খোলা লুঙ্গি, চাদর, জোব্বা, টুপি, পাগড়ি, মাথার রুমাল, চাদর ইত্যাদি তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিধান করেছেন। একেক সময় একেক প্রকার পোশাক ব্যবহার করেছেন। এগুলির জন্য কোনো তাকিদ প্রদান করেননি বা ব্যতিক্রমের জন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা জানাননি। উপরের সবগুলি বিষয়ই তাঁর সুন্নাত। কিন্তু প্রথম বিষয়ের চেয়ে দ্বিতীয় বিষয়কে বেশি গুরুত্ব প্রদান করলে সুন্নাতের নামে সুন্নাতের বিরোধিতা করা হবে।
পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখব যে
শরীরের নিম্নাংশ ও ঊর্ধ্বাংশ আবৃত করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খোলা লুঙ্গি, চাদর, পিরহান, পাজামা ইত্যাদি ব্যবহার করেছেন বা অনুমোদন করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাত যখন যা পাওয়া যায় তা ব্যবহার করা। জামা, পাজামা ইত্যাদি থাকলেও ইচ্ছাকৃতভাবে খোলা লুঙ্গি ও চাদর পরা বা সর্বদা এরূপ লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করা সুন্নাতের খেলাফ। আর যদি কেউ এভাবে সুন্নাতের খেলাফ চলাকে সুন্নাত মত ‘যখন যা পাওয়া যায় তা পরিধান করার’ চেয়ে উত্তম মনে করেন তবে তিনি ‘সুন্নাত অপছন্দ করার’ পাপে লিপ্ত।
অনুরূপভাবে আমরা কামীস ও পাজামা ব্যবহারের উৎসাহ প্রদান মূলক বা ফযীলত মূলক হাদীস দেখতে পাই। কিন্তু লুঙ্গি ও চাদর পরিধানের ফযীলত জ্ঞাপক কোনো হাদীস আমরা পাই না। এখন কেউ যদি পাজামা, পিরহান ইত্যাদির চেয়ে খোলা লুঙ্গি ও চাদর ব্যবহার করাকে বেশি ফযীলত মনে করেন তাহলে তিনি সুন্নাত বিরোধিতায় ও সুন্নাত অপছন্দ করায় লিপ্ত।
আমরা দেখব যে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথা আবৃত করার জন্য টুপি, পাগড়ি, রুমাল ইত্যাদি ব্যবহার করতেন। কখনো শুধু টুপি, কখনো শুধু পাগড়ি, কখনো টুপি ও পাগড়ি এবং কখনো কখনো রুমাল ব্যবহার করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর স্পষ্ট সুন্নাত যখন যা সহজলভ্য তা ব্যবহার করা। কাজেই এ তিন প্রকার পোশাককে একত্রে সর্বদা ব্যবহার করতে হবে বলে মনে করা বা গুরুত্ব দেওয়া খেলাফে সুন্নাত।
আমরা দেখব যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগে অধিকাংশ সময় কামীস পরিধান করলে তার নিচে লুঙ্গি বা পাজামা পরিধান করা হতো না। এর কারণ ছিল কাপড়ের স্বল্পতা। এখন কেউ যদি কাপড় পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও একটি কাপড় পরিধান করা সুন্নাত মনে করেন তবে তা সুন্নাতের বিরোধিতা হবে; কারণ সাহাবীগণ সম্ভব হলে একাধিক কাপড় পরিধান করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
যে সকল পোশাক মাঝেমাঝে পরেছেন সেগুলিকে সর্বদা পরা ইবাদত, তাকওয়া বা আল্লাহর নৈকট্যের মাধ্যম মনে করা বা উত্তম মনে করার অর্থ সুন্নাত অপছন্দ করা। যেমন, তিনি কখনো খোলা লুঙ্গি ও চাদর ব্যবহার করতেন, কখনো পিরহান বা জোব্বা ব্যবহার করতেন। হজ্জ ছাড়া কখনোই তিনি সর্বদা খোলা লুঙ্গি ও চাদর ব্যবহার করেননি। এছাড়া তিনি এগুলির জন্য বিশেষ কোনো রং নির্দিষ্ট করে নেননি।
এখন যদি কেউ সর্বদা খোলা লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করাকে উত্তম মনে করে বা সর্বাবস্থায় বা সর্বদা সালাত আদায়ের জন্য সাদা রঙের বা গেরুয়া রঙের বা সবুজ রঙের বা কোনো নির্দিষ্ট রঙের একটি খোলা লুঙি ও চাদর পরিধান করাকে নিজের রীতিতে পরিণত করেন তাহলে তাতে সুন্নাত অপছন্দ করা হবে এবং তা বিদ‘আত বলে গণ্য হবে।
ঐ ব্যক্তি হয়ত নিজেকে সুন্নাতের
খাঁটি অনুসারী বলে দাবি করবেন। তিনি হয়ত বিভিন্ন হাদীস থেকে প্রমাণ করবেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উক্ত পোশাক পরিধান করেছেন। এছাড়া তিনি হয়ত আরো দাবি করবেন যে, হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ পোশাক নির্ধারিত করে দিয়েছেন, এতে এ পোশাকের গুরুত্ব ও ফযীলত বুঝা যায়।
এজন্য সর্বদা এ পোশাক পরিধান করা উত্তম। এতে সুন্নাত পালন ছাড়াও মৃত্যুর কথা মনে হয়, কাফনের কথা মনে হয়, আরাফাতের কথা মনে হয়… ইত্যাদি অনেক যুক্তি তিনি প্রদান করতে পারবেন। তবে তাঁর সকল যুক্তির সারমর্ম এই যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে হেয় প্রতিপন্ন করছেন, নাঊযু বিল্লাহ! তিনি দাবি করছেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পোশাক পরিধান করার চেয়ে সর্বদা এ নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করা বেশি সাওয়াবের।
এর অর্থ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করেছেন তার চেয়ে এ লোকটি নিজের কাজকে উত্তম ও বেশি সাওয়াবের বলে দাবি করছেন। তিনি বলছেন যে, তিনি এমন একটি সাওয়াবের কর্ম আবিষ্কার করেছেন যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন না ও পালন করতে পারেননি।
কেউ যদি নিজের রুচি,
সুবিধা বা সমস্যার কারণে সর্বদা সুন্নাতসম্মত বা জায়েয কোনো এক প্রকারের বা এক রঙের পোশাক পরিধান করেন তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু তিনি যদি এ পদ্ধতিকে সাওয়াব, তাকওয়ার অংশ বলে মনে করেন তাহলেই তাতে সুন্নাতে নববী অপছন্দ করা হবে।
যে বিষয়কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যতটুকু গুরুত্ব দিয়ে পালন বা বর্জন করেছেন তাকে ততটুকু গুরুত্ব দিয়ে পালন বা বর্জন করাই সুন্নাত। ফরয সালাতকে নফল মনে করে আদায় করা ও নফল সালাতকে ফরয বিশ্বাস করে আদায় করা যেমন সুন্নাতের বিরোধিতা ও বিদ‘আত, আমাদের উপরের বিষয়গুলিও অনুরূপ বিদ‘আত। পালনের ক্ষেত্রে যেমন সুন্নাত অনুসারে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে, পালনে উৎসাহ প্রদান ও পরিত্যাগ করলে প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও এভাবে সুন্নাতের স্তর ঠিক রাখতে হবে।
সুন্নাতের নামে সুন্নাত বিরোধিতার
একটি নগ্ন প্রকাশ নফল-মুস্তাহাব পোশাকী অনুকরণকে তাকওয়ার মূল বিষয় বলে মনে করা। পোশাকী অনুকরণ বা ‘সুন্নাতী পোশাক’ ব্যবহার করা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুস্তাহাব পর্যায়ের। এগুলি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও সাওয়াবের বিষয়। কিন্তু এগুলি কখনই তাকওয়ার মাপকাঠি নয়। তাকওয়ার মাপকাঠি গোনাহ বর্জন করা। মুস্তাহাব কাজে প্রতিযোগিতা চলে, কিন্তু মুস্তাহাব পরিত্যাগের জন্য ঝগড়া, ঘৃণা বা অবজ্ঞা নিঃসন্দেহে সুন্নাত বিরোধী।
এ মূলনীতি অনেকেই স্বীকার করলেও উপরের কয়েকটি বিভ্রান্তি আমাদের মনে এমনভাবে আসন গেড়ে বসেছে যে, প্রকৃত মুসলিমের ব্যক্তিত্ব, বেলায়েত ও বুজুর্গি সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারেই উল্টো হয়ে গিয়েছে। আমরা পাগড়ি, টুপি, পিরহান, রুমাল ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। কিন্তু ঈমান, বান্দার হক, হালাল উপার্জন, মানব সেবা সম্পর্কে উদাসীন। কেউ হয়ত গীবত, অহংকার, বান্দার হক নষ্ট, হারাম উপার্জন ইত্যাদিতে লিপ্ত, কিন্তু টুপি, পাগড়ি, রুমাল, দস্তরখান, পিরহান ইত্যাদি পোশাকী সুন্নাত পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান।
আমরা এ ব্যক্তিকে মুত্তাকী
পরহেযগার বা ধার্মিক মুসলিম বলে মনে করি। এমনকি আল্লাহর ওলী বা পীর-মাশায়েখ বলেও বিশ্বাস করি। অপর দিকে যদি কেউ ফরয-ওয়াজিব পালন, হারাম বর্জন, হালাল উপার্জন, বান্দার হক্ক আদায়, মানব সেবা, সমাজ-কল্যাণ ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকেন কিন্তু মুস্তাহাব পর্যায়ের পোশাকী অনুকরণে ত্রুটি করেন তবে তাকে আমরা আল্লাহর ওলী বলা তো দূরের কথা ধার্মিক বলেই মানতে রাজি হব না।
অনেক ধার্মিক মানুষ রুমাল, টুপি বা পাগড়ি নিয়ে অতি ব্যস্ত হলেও হালাল মালের পোশাক কি না তা বিবেচনা করছেন না। লোকটির টুপি, পাগড়ি বা জামা কোন্ কাটিং-এর তা খুব যতœ সহকারে বিবেচনা করলেও তিনি বান্দার হক নষ্ট করছেন কি না, ফরযসমূহ পালন করছেন কি না, মানুষের ক্ষতি বা অকল্যাণ থেকে বিরত আছেন কি না, কবীরা গোনাহগুলি থেকে বিরত আছেন কি না ইত্যাদি বিষয় আমরা বিবেচনায় আনছি না।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় এই যে, আমরা একান্ত নফল-মুস্তাহাব পোশাকী অনুকরণকে অনেক সময় দলাদলি ও ভ্রাতৃত্বের মানদ- হিসাবে গ্রহণ করেছি। মূলত সকল মুমিন একে অপরকে ভালবাসবেন। বিশেষত যাঁরা ফরয, ওয়াজিব বা সুন্নাত মুআক্কাদাহ পালন করছেন এবং হারাম ও মাকরুহ তাহরীমী বর্জন করছেন তাঁদেরকে আল্লাহর ওলী বা প্রিয় বান্দা হিসাবে ভালবাসা আমাদের ঈমানের দাবী। নফল মুস্তাহাব বিষয় কম-বেশি যে যেভাবে পারেন করবেন। এ সকল বিষয়ে প্রতিযোগিতা হবে, কিন্তু দলাদলি হবে না।
কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা দেখতে পাই যে
আমরা টুপি, জামা, পাগড়ি, দস্তরখান ইত্যাদির আকৃতি, প্রকৃতি, রং, যিকির, দোয়া, দরুদ সালাম ইত্যাদির পদ্ধতি ও প্রকরণকেই দলাদলির ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করি। ফলে যিনি হারামে লিপ্ত, গীবত করছেন, মানুষের হক নষ্ট করছেন, ফরয ওয়াজিব নষ্ট করছেন কিন্তু পোশাকের কাটিং-এ বা যিকর-দরুদের ‘পদ্ধতিতে’ আমাদের সাথে মিল রাখেন তাঁকে আমরা আপন মনে করে দ্বীনি ভাই বা মহব্বতের ভাই বলে মনে করি।
আর যার মধ্যে ফরয-ওয়াজিব বিরাজমান, অথচ নফল-মুস্তাহাব পর্যায়ে আমার সাথে ভিন্নতা রয়েছে তাঁকে আমরা কাফির মুশরিকের মতো ঘৃণা করি বা বর্জন করি। এভাবে আমরা ইসলামের মূল মানদ- উল্টে ফেলেছি। আমরা ইসলামের জামা উল্টে পরেছি।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ
জাদু দিয়ে জাদু কাটানোর বিধান, মীলাদুন্নবী (সা.), তারাবীহ: আকীদা, সুন্নাত ও বিদ‘আত, আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ