As-Sunnah Trust

সাম্প্রতিক সংবাদ

আল্লাহর পথের পথিকদের পাপ (৩)

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

সৃষ্টির অধিকার নষ্ট ও চোগলখুরী

আল্লাহর পথে চলতে সচেষ্ট ও ধর্ম-সচেতন অনেক মানুষ অনেক সময় এসব ইবাদত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যান। অনেক সচেতন মুসলিম ব্যভিচার, মিথ্যা, মদপান, সালাত বা সিয়াম পরিত্যাগ ইত্যাদি পাপে কখনোই লিপ্ত হন না। কখনো এরূপ কিছু করলে সকতরে তাওবা-ইসতিগফার করতে থাকেন। কিন্তু জেনে অথবা না জেনে তাঁরা র্শিক, কুফ্র, বিদ‘আত, হিংসা, অহঙ্কার, লোভ, আত্মতুষ্টি, গীবত ইত্যাদি পাপের মধ্যে লিপ্ত হচ্ছেন।

এর কারণ, কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই শয়তান কখনো নিরাশ হয় না। প্রত্যেক মানুষকেই কোনো না কোনোভাবে বিভ্রান্ত করতে সে সদা সচেষ্ট। সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য তার নিজস্ব পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচী রয়েছে। সবাইকেই সে পরিপূর্ণ ধর্মহীন অবিশ্বাসী করতে চায়। যাদের ক্ষেত্রে সে তা করতে সক্ষম না হয় তাদেরকে সে ‘ধর্মের আবরণে’ পাপের মধ্যে লিপ্ত করে।

অথবা বিভিন্ন প্রকার ‘অন্তরের পাপে’ লিপ্ত করে, যেগুলো নেককার মানুষের নেক-আমল নষ্ট করে দেয়, অথচ সেগুলোকে অনুধাবন করা অনেক সময় ধার্মিক মানুষের জন্যও কষ্টকর হয়ে যায়। এ জাতীয় কিছু পাপের কথা ইতিপূর্বে কয়েকটি প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আরো কিছু আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

সৃষ্টির অধিকার বা পাওনা নষ্ট করা

মহান আল্লাহ মানুষকে ভালবাসেন ও মানুষকে করুণা করতে চান। সাথে সাথে তিনি ন্যয়বিচারক মহাবিচারের প্রভু। তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন তিনি। কোনো মানুষ যদি অন্য কোনো মানুষ, সৃষ্টি বা জীব জানোয়ারের অধিকার বা প্রাপ্য নষ্ট করে বা কম দেয় এবং জীবদ্দশায় তার অধিকার বুঝিয়ে দিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে না পারে মহাবিচারের দিনে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত সৃষ্টির অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায় করে দেবেন।

সেদিন কোনো টাকাপয়সা বা সম্পদ দিয়ে ক্ষতিপূরণ দানের সুযোগ থাকবে না। তখন যালিম, ক্ষতিকারী বা অধিকার হরণকারী ব্যক্তির নেককর্ম বা সাওয়াব নিয়ে মাযলূমকে প্রদান করা হবে। যদি যাকির এ বিষয়ে সতর্ক না থাকেন তাহলে তার কষ্টার্জিত সাওয়াব ও নেক কর্ম অন্য মানুষ ভোগ করবেন, আর তিনি বঞ্চিত হয়ে শাস্তি ভোগ করবেন।

কুরআন-হাদীসে পরস্পরের অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত শিক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এগুলো শিক্ষা ও পালন করা যাকিরের জন্য বিশেষ জরুরি। আমাদের সমাজে অনেক ধার্মিক ব্যক্তি স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশী, সহকর্মী, কর্মদাতা, কর্মী বা কর্মচারী, আত্মীয়স্বজন, বিধবা, এতিম, দরিদ্র ও সমাজের অন্যান্য মানুষের অধিকার, সমাজের অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার, পশুপাখির অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে খুবই অসচেতন।

আমরা বেদনার সাথে লক্ষ্য করি যে, ধার্মিক মানুষদের মধ্যে অনেকেই অন্যের অধিকার নষ্ট করার কঠিন পাপে লিপ্ত থাকেন। হয়ত তাহাজ্জুদ, যিক্র, নফল সিয়াম, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় ও প্রচারে রত রয়েছেন ; কিন্ত স্ত্রী, সন্তান, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, কর্মস্থল, সেবা গ্রহণে আগত ব্যক্তি, কর্মদাতা ও অন্য অনেকের অধিকার লঙ্ঘন ও নষ্ট করেন। এগুলোকে অনেকে খুবই হালকা ভাবেন বা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তাদের কঠিন অন্যায়কে যুক্তিসঙ্গত করতে চেষ্টা করেন। যাকিরকে এসকল বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

নামীমাহ বা চোগলখুরী:

গীবতের একটি পর্যায় ‘নামীমাহ’, ‘চোগলখুরী’ অর্থাৎ কানভাঙ্গানো বা কথা লাগান। একজনের কাছে অনুপস্থিত কারো দোষত্র“টি আলোচনা গীবত। আর যদি এমন দোষত্র“টি আলোচনা করা হয় যাতে দু ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হয় তাহলে একে আরবীতে ‘নামীমাহ’ বলা হয়। এটি গীবতের চেয়েও মারাত্মক অপরাধ ও জঘন্যতম কবীরা গোনাহের একটি। সত্য কথা লাগানোও নামীমাহ, যেমন সত্য দোষ বলা গীবত। রাসূলুল্লাহ সিা. বলেছেন:
لاَ يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ

“চোগলখোর (কানভাঙ্গানিতে লিপ্ত) ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।”1বুখারী (৮১-কিতাবুল আদাব, ৫০- বাব মা ইউকরাহু মিনান নামীমা) ৫/২২৫০; মুসলিম (১-কিতাবুল ঈমান, ৪৭-বাব বায়ান গিলাযি তাহরীমিন নামিমা) ১/১০১, নং ১০৫ (ভারতীয় ১/৭০)।

মনে করুন ‘ক’ ‘খ’-এর কাছে ‘গ’ সম্পর্কে কিছু গীবত বা খারাপ মন্তব্য করেছে। ‘খ’ ‘ক’-এর মুখ থেকে সেগুলো শুনে কোনো প্রতিবাদ না করে গীবত শোনার পাপে পাপী হয়েছে। এখন এ পাপকে বহুগুণে বৃদ্ধি করার জন্য সে ‘গ’-এর নিকট এসে ‘ক’-এর কথাগুলো সব বলে দিল। এভাবে ‘খ’ গীবত শোনা, গীবত করা ও নামীমাহ করার পাপে লিপ্ত হলো। এ দুর্বল ঈমান ব্যক্তি ‘গ’-এর প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য আল্লাহর অসন্তুষ্টি, গজব ও শাস্তি চেয়ে নিল।

মুহতারাম পাঠক, মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য মিথ্য কথা বলা জায়েয, কিন্তু সম্পর্ক নষ্টকারী সত্য কথা জায়েয নয়। এছাড়া এসকল গীবত ও নামীমায় লিপ্ত মানুষদের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। যদি কেউ আপনার কাছে এসে আপনার কোনো ভাই সম্পর্কে এধরনের কথা বলে তাহলে তাকে থামিয়ে দিন। এই লোকটি চোগলখোর। সে সত্যবাদী হলেও আপনার শত্রু। আপনার হৃদয়ের প্রশান্তি, প্রবিত্রতা ও আপনার ভাইয়ের সাথে আপনার সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়। আল্লাহ আমাদেরকে চোগলখোরী ও চোগলখোর থেকে হেফাযত করুন; আমীন।

সম্মানিত পাঠক, অহঙ্কার, পরশ্রীকাতরতা, হিংসা, গীবত, নামীমা ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক হৃদয়জাত অনুভূতি থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম উপায় যথাসম্ভব সর্বদা নিজের জাগতিক ও পারলৌকিক উন্নতি, নিজের দোষত্র“টি সংশোধন ও তাওবার চিন্তায় মনকে মগ্ন রাখা। আত্মপ্রশংসার প্রবণতা রোধ করে আত্মসমালোচনার প্রবণতা বৃদ্ধি করা। ‘আমার ভালগুণ তো আছেই। সেগুলোর প্রশংসা করে বা শুনে কি লাভ। আমার ভুলত্র“টি কি আছে তা জেনে এবং সংশোধিত করে আরো ভাল হতে হবে’ এ চিন্তাকে মনের মধ্যে বদ্ধমূল করতে হবে।

অন্য কোনো মানুষের কথা মনে হলে, আলোচনা হলে বা কেউ তাঁর প্রশংসা করলে মনের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা, হিংসা বা অহংকার আসতে পারে। এজন্য এ সকল ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে নিজের মনে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে ভাল ধারণা বদ্ধমূল করা, তার প্রশংসা যৌক্তিক ও উচিত বলে নিজের মনকে বিশ্বাস করানো, তার ভাল গুণাবলীর কথা মনে করে তাকে শ্রদ্ধা করতে নিজের মনকে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। ক্রমান্বয়ে এভাবে আমরা এ সকল কঠিন ও ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারব।

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published.