ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া সাবেক চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট
আল্লাহ মানুষের জীবনে জাগতিক যত নেয়ামত প্রদান করেছেন তার অন্যতম নেয়ামত স্বাধীনতা। আমাদের স্বাধীনতার সাথে জড়িত অন্যতম দিবসগুলি হলো ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। কুরআন ও হাদীসের আলোকে স্বাধীনতা ও বিজয় উপলক্ষে আমাদের দায়িত্বের বিষয়ে আমরা আজ আলোচনা করব। মহান আল্লাহ সকল মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করেছেন। ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল বা অন্য কোনো কারণে কোনো জনগোষ্ঠীকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বা শোষণ করার অধিকার কারো নেই। জুলুম, বঞ্চনা বা শোষণ থেকে আত্মরক্ষা করা এবং নিজের অধিকার আদায় করার জন্য সক্রিয় ও সচেষ্ট হওয়া মুমিনের দায়িত্ব ও অধিকার বলে কুরআন কারীমের ঘোষণা করা হয়েছে। মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন:
وَالَّذِينَ إِذَا أَصَابَهُمُ الْبَغْيُ هُمْ يَنْتَصِرُونَ
“এবং যারা অত্যাচারিত হলে প্রতিরোধ করেন।”((সূরা শূরা: ৩৯ আয়াত।))
এখানে আরবীতে “ইনতিসার” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ নিজেকে সাহায্য করা, জুলুম প্রতিরোধ করা জালিমের উপর বিজয়ী হওয়া বা নায়সঙ্গত প্রতিশোধ গ্রহণ করা। হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, নিজের অধিকার, প্রাপ্য, সম্পদ বা প্রাণ রক্ষা করতে যদি কেউ নিহত হন তবে তিনি শহীদ বলে গণ্য হন। সাঈদ ইবনু যাইদ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেন,
مَنْ قُتِلَ دُونَ مَالِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ وَمَنْ قُتِلَ دُونَ أَهْلِهِ أَوْ دُونَ دَمِهِ أَوْ دُونَ دِينِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ.
“নিজের সম্পদ রক্ষা করতে যেয়ে যে নিহত হয় সে শহীদ, নিজের পরিবার-পরিজন রক্ষা করতে যে নিহত হয় সে শহীদ, নিজের প্রাণ বা ধর্ম রক্ষা করতে যে নিহত হয় সে শহীদ।”((তিরমিযী, আস—সুনান ৪/৩০; আবু দাউদ, আস—সুনান ৪/২৪৬। হাদীসটি সহীহ। সমার্থক হাদীস দেখুন: বুখারী ২/৮৭৭; মুসলিম ১/১২৪।))
অন্য হাদীসে ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَنْ قُتِلَ دُونَ مَظْلَمَتِهِ فَهُوَ شَهِيدٌ
“যে ব্যক্তি নিজের অধিকার রক্ষা করতে নিহত হয় সে শহীদ।”(( নাসাঈ, আস—সুনান ৭/১১৬, ১১৭; হাইসামী, মাজামউয যাওয়ায়িদ ৬/২৪৪; আলবানী, সহীহুত তারগীব ২/৭৬। হাদীসটির সনদ সহীহ।))
অন্য হাদীসে সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
نِعْمَ الْمِيتَةُ أَنْ يَمُوتَ الرَّجُلُ دُونَ حَقِّهِ
“ব্যক্তি নিজের অধিকার বা হক্ক প্রতিষ্ঠা বা রক্ষা করতে মৃত্যুবরণ করে তার মৃত্যু খুবই ভাল মৃত্যু।”((আহমদ, আল—মুসনাদ ১/১৮৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৬/২৪৪। হাদীসটির সনদের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য।))
মহান আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতার নেয়ামত দান করেছেন। এ স্বাধীনতার ইতিহাস দীর্ঘ। অতি প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী অনার্য বা দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী বসবাস করত। অনেক গবেষক এদেরকে নূহ (আ)-এর পূত্র সামের বংশধর ‘আবূ ফীরের” বংশধর বলে গণ্য করেছেন। আবূ ফীরের নামই বিকৃত হয়ে দ্রাবীড় রূপ ধারণ করে বলে তারা দাবি করেছেন। খৃস্টপূর্ব সময়ের প্রাচীন গ্রীক ও ল্যাটিন ইতিহাসে এদেরকে “গঙ্গারিডাই” (এধহমধৎরফধব) বলা হয়েছে এবং এদের শক্তি ও সভ্যতার কথা উলেখ করা হয়েছে। এরা ছিলেন অনার্য এবং ভারতের হিন্দুধর্মের প্রবর্তক আর্য ব্রাহ্মণদের শত্র“। এদের ধর্ম, সভ্যতা ও কৃষ্টি ছিল আর্যদের থেকে পৃথক। এজন্য মহাভারত ও পুরাণে বাঙালীদেরকে ম্লেচ্ছ, সর্প, দাস, অসুর ইত্যাদি বলা হয়েছে।
পরবর্তী কালে আর্যরা ক্রমান্বয়ে এদেশ দখল করে। তবে বাংলার সাধারণ মানুষদের সাথে তাদের দূরত্ব থেকে যায়। বিশেষত বর্ণবাদী হিন্দু ধর্মের রীতি অনুসারে সাধারণ বাঙালী অচ্ছ্যুৎ, অস্পৃশ্য নিম্নজাতি বলে গণ্য হতেন। এদের ভাষাও আর্যদের কাছে নিন্দিত ছিল। নবম খৃস্টীয় শতকে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লাভ করে। নবম খৃস্টীয় শতকে সেন বংশের শাসকগণ বাংলায় গোঁড়া হিন্দু বর্ণবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার করেন। এ সময়ে এদেশে অনেক মুসলিম ওলী-আউলিয়ার আগমন ঘটে। অনেক বাঙালী এদের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ১২০৪ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মাদ বখতিয়ার বাংলায় প্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। ক্রমান্বয়ে বাংলায় অনেক স্বাধীন মুসলিম সুলতান রাজত্ব করেন। মাঝে মাঝে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন হলেও, অধিকাংশ সময় বাংলা স্বাধীন ছিল। অনার্য “গঙ্গারিডাই” জাতি আর্য ধর্ম প্রত্যাখ্যান করে দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সাথে সৌহার্দ ও শান্তিতে বসবাস করেন।((বাংলাপিডিয়া দেখুন এবং আখতার ফারুকের বাঙ্গালীর ইতিকথা পড়–ন।))
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রে ১৭৫৭ খৃস্টাব্দের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গের মানুষদেরকে অধিকতর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ দানের জন্য ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর বৃটিশ শাসকরা বাংলা ভেঙ্গে পূর্ব বাংলা ও আসাম রাজ্য গঠন করে এবং ঢাকা পূর্ববাংলার রাজধানী হয়। এতে পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশের জনগণের জন্য অধিকার লাভের সুযোগ ঘটে। কিন্তু উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদী হিন্দু নেতৃবৃন্দ বাংলা মায়ের খণ্ডিতকরণ রোধে “বন্দেমাতরম” বা “মা তোমার বন্দান বা পূজা করি” শ্লোগান দিয়ে জোরালো আন্দোলন করেন। একপর্যায়ে তারা সন্ত্রাস ও উগ্রতার পথ বেছে নেন। ৩০ শে এপ্রিল ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল চাকী বড়লাটকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে। পরে প্রফুল আাত্মহত্যা করে এবং ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। এক পর্যায়ে ১৯১১ সালে বৃটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে। তবে এ বঙ্গভঙ্গের ধারাবাহিকতাতেই পূর্ববঙ্গের মুসলিম প্রধান বাঙালী জনগোষ্ঠী রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তার ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে আমরা বৃটিষ উপনিবেশের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা লাভ করি। পরবর্তীতে পাকিস্তানী শাসকবর্গের শোষণ, বঞ্চনা ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ধারায় এদেশের মানুষ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের মাধ্যমে অর্জিত ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যেই আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। ১৯৪৭ সালে সে স্বাধীনতার শুরু হয়েছিল ১৯৭১ সালে সে নিয়ামত পূর্ণতা লাভ করে।
এ নেয়ামতের প্রতি আমাদের বহুমুখি দায়িত্ব রয়েছে। প্রথম দায়িত্ব আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যে কোনো নেয়ামতের স্থায়িত্বের এবং বৃদ্ধির প্রথম শর্ত মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলদেরকে ফেরাউনের শোষণ ও নিপীড়ন থেকে স্বাধীনতা প্রদান করেন। এ কথা উলেখ করে তিনি বলেন:
وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكُمْ لَئِنْ شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ وَلَئِنْ كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ
“এবং যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে বাড়িয়ে দিব। আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর।”((সূরা ১৪—ইবরাহীম ৭ আয়াত))
নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। প্রথম পর্যায় হলো সর্বান্তকরণে এ নেয়ামত উপলব্ধি করা। মানবীয় প্রকৃতির একটি দুর্বল দিক যে, আল্লাহর নেয়ামত লাভ করার পরে তা নিজেদের যোগ্যতায় অর্জিত বলে দাবি করা। মহান আল্লাহ বলেন:
فَإِذَا مَسَّ الإِنْسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ثُمَّ إِذَا خَوَّلْنَاهُ نِعْمَةً مِنَّا قَالَ إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ بَلْ هِيَ فِتْنَةٌ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لا يَعْلَمُونَ
“যখন কষ্ট-দৈন্য মানুষকে স্পর্শ করে তখন সে আমাকে ডাকে। অতঃপর যখন আমি তাকে কোনো নিয়ামত প্রদান করি তখন সে বলে, ‘আমি তো তা লাভ করেছি নিজের জ্ঞানের মাধ্যমে।’ বস্তুত এ একটি পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।”((সূরা ৩৯—যুমার: ৪৯ আয়াত।))
জীবনের সকল নিয়ামত ও সফলতাই মহান আল্লাহর দান। আবার প্রত্যেক নিয়ামত, সৌভাগ্য ও সফলতার পিছনে ব্যক্তির নিজের ও অন্য অনেক মানুষের অবদান থাকে। সকলের অবদানের স্বীকৃতি অত্যাবশ্যকীয়। তবে আমাদের সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, নিজের যোগ্যতা, শ্রম বা অন্যান্য সকলের কষ্ট সবই ব্যর্থ হতো যদি আল্লাহর দয়া না হতো। স্বাধীনতার কথাই ভাবুন। আমাদের চোখের সামনে স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের অনেক জনগোষ্ঠী যুগযুগ ধরে সংগ্রাম করছেন, আত্মাহূতি দিচ্ছেন, সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু স্বাধীনতা লাভ করতে পারছেন না। অথচ আল্লাহ সীমিত সময়ের মধ্যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সফলতা দান করেছেন। আমাদরেকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে যে, এ সফলতা একান্তভাবেই আল্লাহর দান। এ উপলব্ধি না থাকা বা নেয়ামতটি নিজেদের ত্যাগ, কষ্ট বা বুদ্ধি-কৌশলের মাধ্যমেই অর্জিত বলে বিশ্বাস করার অর্থ মহান আল্লাহর প্রতি কঠিনতম অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন যে, অকৃতজ্ঞতার শাস্তি বড় কঠিন।
মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দ্বিতীয় পর্যায় হৃদয়, মন ও মুখ দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। উপরের উপলব্ধি থেকেই প্রকাশ আসে। নিজেদের সকল আলোচনা, বক্তব্য ও কর্মের মাধ্যমে আমাদের সদা সর্বদা মহান আল্লাহর এ নেয়ামতের কথা স্মরণ ও প্রকাশ করতে হবে।
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অংশ হলো যে সকল মানুষের মাধ্যমে নেয়ামত অর্জিত হয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাদের অবদানের কথা স্মরণ ও আলোচনা করা, তাদের প্রশংসা করা এবং তাদের জন্য দোয়া করা। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদীস শুনুন:
مَنْ لَمْ يَشْكُرْ النَّاسَ لَمْ يَشْكُرْ اللَّهَ. وفي لفظ: إِنَّ أَشْكَرَ النَّاسِ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ أَشْكَرُهُمْ لِلنَّاسِ
“যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ নয় সে আল্লাহর প্রতিও অকৃতজ্ঞ।” অন্য বর্ণনায়: “সেই আল্লাহর প্রতি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ যে মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ।”((তিরমিযী, আস—সুনান ৪/৩৩৯; আহমদ, আল—মুসনদা ৫/২১২; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৮০—১৮১।হাদীসটি সহীহ।))
وَمَنْ صَنَعَ إِلَيْكُمْ مَعْرُوفًا فَكَافِئُوهُ فَإِنْ لَمْ تَجِدُوا مَا تُكَافِئُونَهُ فَادْعُوا لَهُ حَتَّى تَرَوْا أَنَّكُمْ قَدْ كَافَأْتُمُوهُ
“যদি কেউ তোমাদের কোনো উপকার করে তবে তাকে প্রতিদান দিবে। প্রতিদান দিতে না পারলে তার জন্য এমনভাবে দুআ করবে যেন তোমরা অনুভব কর যে, তোমরা তার প্রতিদান দিয়েছ।”((আবূ দাঊদ, আস—সুনান ২/১২৮, ৪/৩২৮; নাসাঈ, আস—সুনান ৫/৮২; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২০৮, ২৩৪। হাদীসটি সহীহ।))
مَنْ أُعْطِيَ عَطَاءً فَوَجَدَ فَلْيَجْزِ بِهِ فَإِنْ لَمْ يَجِدْ فَلْيُثْنِ بِهِ فَمَنْ أَثْنَى بِهِ فَقَدْ شَكَرَهُ وَمَنْ كَتَمَهُ فَقَدْ كَفَرَهُ
“কাউকে যদি কিছু প্রদান করা হয় তবে সে যেন তাকে প্রতিদান দেয়। যদি প্রতিদান দিতে না পারে তবে সে যেন তার গুণকীর্তন ও প্রশংসা করে। যে ব্যক্তি উপকারীর গুণকীর্তন ও প্রশংসা করল সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল। আর যে উপকারীর উপকারের কথা গোপন করল সে অকৃতজ্ঞ।((আবূ দাউদ, আস—সুনান ৪/২৫৫; তিরমিযী, আস—সুনান ৪/৩৭৯; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৩৪। হাদীসটি হাসান।))
مَنْ أَتَى إِلَيْهِ مَعْرُوفٌ فَلْيُكَافِئْ بِهِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَلْيَذْكُرْهُ فَمَنْ ذَكَرَهُ فَقَدْ شَكَرَهُ
“যদি কাউকে কোনোভাবে উপকার করা হয় তবে সে যেন উপকারকারীকে প্রতিদান দেয়। যদি প্রতিদান দিতে না পারে তবে সে যেন তার কথা স্মরণ করে ও উলেখ করে, এতে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে।”((আহমদ, আল—মুসনাদ ৬/৯০; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/১৮১। হাদীসটির সনদ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়।))
কোনো অমুসলিম কাফির কোনো কল্যাণ করলে রাসূলুল্লাহ (সা.)তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন, প্রশংসা করতেন এবং তাকে যথাযোগ্য মর্যদার সাথে স্মরণ করতেন।
এ সকল হাদীসের আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে স্বাধীনতা অর্জনের পিছনে যাদেরই অবদান রয়েছে তাদের সকলের প্রতি ব্যক্তিগত ও জাতীয়ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, তাদের অবদানের সঠিক তথ্য উলেখ করা, স্মরণ করা, আলোচনা করা, লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণ করা, তাদের মধ্যে যারা জীবিত রয়েছেন তাদের প্রতিদান প্রদানের চেষ্টা করা ও তাদের কল্যাণের জন্য দুআ করা এবং তাদের মধ্যে যারা তাওহীদ ও রিসালাতের ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে আশা করা যায় তাদের জন্য আখিরাতের মুক্তি ও কল্যাণের দুআ করা আমাদের ঈমানী ও দীনী দায়িত্ব। পূর্ববর্তী বা পরবর্তীকালে সৃষ্ট কোনো মতভেদ, দলভেদ, শত্রুতা বা অন্য কোনো কারণে কারো অবদান অস্বীকার করা, গোপন করা বা অবমূল্যায়ন করা কঠিন পাপ ও আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতার অপরাধ, যা আমাদের ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে আল্লাহর শাস্তি এবং আখিরাতের অকল্যাণ বয়ে আনবে।
স্বাধীনতার এ নিয়ামত বা সৌভাগ্যের প্রতি আমাদের অন্যতম দায়িত্ব তা সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট থাকা। আমারা দেখেছি যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় নেয়ামত স্থায়িত্ব ও বৃদ্ধি লাভ করে এবং অকৃতজ্ঞতায় তা ধ্বংস হয়। আর মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চূড়ান্ত পর্যায় হলো, আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে ব্যবহার করা। জীবনের প্রতিটি নেয়ামতকেই আল্লাহর নির্দেশিত ও তাঁরই সন্তুষ্টির পথে ব্যবহার করতে হবে। যেমন, সুস্থতাকে ইবাদত ও সেবায়, সম্পদকে মানব সেবায়, ক্ষমতাকে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে ব্যবহার করাই মহান আল্লাহর প্রতি প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। স্বাধীনতার নেয়ামতকে এভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখি সেবা ও উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন:
الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ
আমি যদি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি তবে তারা সালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, ন্যায়কাজে আদেশ করে এবং অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে।((সূরা ২২—হাজ্জ, ৪১ আয়াত।))
এখানে আল্লাহ স্বাধীনতা বা প্রতিষ্টা লাভকারীদের জন্য চারটি মৌলিক দায়িত্বের কথা উলেখ করেছেন: প্রথমত, সালাত কায়েম করা। সালাতের মাধ্যমেই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে আলাহর ভয়, আখিরাতে জবাবদিহিতার সচেতনতা, নৈতিক মূল্যবোধ ও দুর্নীতির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, যাকাত প্রদান করা। সম্পদের বৈষম্য, সচ্ছল ও অভাবী মানুষদের মধ্যকার দূরত্ব ও বিদ্বেষ এবং দারিদ্র্য দূরীভূত করে পারস্পরিক সহমর্মিতামূলক মানব সমাজ গঠনে যাকাতের চেয়ে বড় মাধ্যম আর কিছুই নেই।
তৃতীয় ও চতুর্থ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ, তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। বস্তুত, সমাজের অধিকাংশ মানুষই সততা পছন্দ করেন এবং ঝামেলা, দুর্নীতি, অন্যায় ও জুলমু থেকে দুরে থাকতে চান। কিন্তু সমাজে যদি আইনের শাসন না থাকে, দুষ্ট ব্যক্তি তার অন্যায় কর্মের শাস্তি না পেয়ে অন্যায়ের মাধ্যমে লাভবান হতে থাকেন, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি তার যোগ্যতার মূল্যায়ন ও পুরস্কার না পান তবে সে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও দুর্নীতি মুখিতা সৃষ্টি হয়। আর দেশ ও সমাজের ধ্বংসের এটি বড় পথ। এজন্য স্বাধীনতা লাভকারী জনগোষ্ঠীর অন্যতম দায়িত্ব সমাজের সর্বস্তরে আইনের শাসন, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের শক্তিশালী ধারা তৈরি করা। এটি সকল নাগরিকের দায়িত্ব। এ বিষয়ে অবহেলা করা, অবহেলার পরিবেশ তৈরি করা বা অবহেলা মেনে নেওয়া সবই আমাদেরকে জাগতিক ক্ষতি ও আখিরাতের শাস্তির মুখোমুখি করবে। মহান আলাহ ঘোষণা করেছেন:
إِنَّ اللَّهَ لا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ
“কোনো জাতি যতক্ষণ না তাদের অবস্থার পরিবর্তন করে ততক্ষণ আলাহ তাদের অবস্থার পরিবর্তন করেন না।”((সূরা ১৩—রা’দ: ১১ আয়াত।))
কাজেই আমাদেরকে আমাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। শিক্ষা, কর্ম, সততা, দায়িত্ববোধ ইত্যাদির মাধ্যমে জাতির উন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে। এভাবে আমরা আল্লাহর রহমত লাভে সক্ষম হবো। জাগতিক উন্নতি ও বরকত লাভের জন্য আল্লাহ দুটি বিষয় অর্জনের কথা বলেছেন:
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ
“যদি কোনো জনপদের মানুষ ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তবে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।”((সূরা ৭—আ’রাফ: ৯৬ আয়াত।))
আমরা ইতোপূর্বে ঈমান ও বিশ্বাসের অর্থ আলোচনা করেছি। আর তাকওয়া হলো আলাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষার অনুভূতি। দুর্নীতি, অসততা, অবৈধ উপার্জন, মানুষের ক্ষতি, জনগণের বা রাষ্ট্রের সম্পদ অপব্যবহার বা অপচয়, মানুষের অধিকার নষ্ট করা, অশ্লীলতা, মাদকতা ও অন্যান্য সকল হারাম কর্ম বর্জন করা এবং সকল ফরয ইবাদত ও দয়িত্ব পালন করাই তাকওয়া। এ বিষয়ে অবহেলা যদি ব্যপকতা লাভ করে তবে স্বাধীনতা বিপন্ন হয়, বিজাতীয় শত্র“তরা জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং জাগতিক শাস্তি ও কষ্ট পাওনা হয় বলে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
لَمْ تَظْهَرْ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا إِلا فَشَا فِيهِمْ الطَّاعُونُ وَالأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلافِهِمْ الَّذِينَ مَضَوْا وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ إِلا أُخِذُوا بِالسِّنِينَ وَشِدَّةِ الْمَئُونَةِ وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ إِلا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنْ السَّمَاءِ وَلَوْلا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللَّهِ وَعَهْدَ رَسُولِهِ إِلا سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ وَيَتَخَيَّرُوا مِمَّا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلا جَعَلَ اللَّهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ
“যখন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে অশ্লীলতা এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে তারা প্রকাশ্যে অশ্লীলতায় লিপ্ত হতে থাকে, তখন তাদের মধ্যে এমন সব রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে যা তাদের পুর্বপুরুষদের মধ্যে দেখা যায় নি। যখন কোনো সম্প্রদায়ের মানুষেরা ওজনে কম বা ভেজাল দিতে থাকে, তখন তারা দুর্ভিক্ষ, জীবনযাত্রার কাঠিন্য ও প্রশাসনের বা ক্ষমতাশীলদের অত্যাচারের শিকার হয়। যদি কোনো সম্প্রদায়ের মানুষেরা যাকাত প্রদান না করে, তাহলে তারা অনাবৃষ্টির শিকার হয়। যদি পশুপাখি না থাকতো তাহলে তারা বৃষ্টি থেকে একেবারেই বঞ্চিত হতো। যখন কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের ওয়াদা বা আল্লাহর নামে প্রদত্ত ওয়াদা ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের কোনো বিজাতীয় শত্র“কে তাদের উপর ক্ষমতাবান করে দেন, যারা তাদের কিছু সম্পদ নিয়ে যায়। আর যদি কোনো সম্প্রদায়ের শাসকবর্গ ও নেতাগণ আল্লাহর কিতাব (পবিত্র কুরআন) অনুযায়ী বিচার শাসন না করে এবং আল্লাহর বিধানের সঠিক ও ন্যায়ানুগ প্রয়োগের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা না করে, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে শত্র“তা ও সংঘর্ষ বাধিয়ে দেন।”((ইবনু মাজাহ, আস—সুনান ২/১৩৩২; হাকিম, আল—মুস্তাদরাক ৪/৫৮৩, আলবানী, সহীহুল জামি ২/১৩২১, সাহীহাহ ১/২১৬—২১৮।))
স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে তাকে সঠিক মর্যাদা দিতে হবে। স্বাধীনতা যেন স্বেচ্ছাচারিতায় পর্যবসিত না হয়। মহান আল্লাহ বলেন:
وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلا قَرْيَةً كَانَتْ آَمِنَةً مُطْمَئِنَّةً يَأْتِيهَا رِزْقُهَا رَغَدًا مِنْ كُلِّ مَكَانٍ فَكَفَرَتْ بِأَنْعُمِ اللَّهِ فَأَذَاقَهَا اللَّهُ لِبَاسَ الْجُوعِ وَالْخَوْفِ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ
“ আল্লাহ দৃষ্টান্ত দিচ্ছেন এক জনপদের যা ছিল নিরাপদ ও নিশ্চিত, যেথায় আসত সবদিক থেকে প্রচুর জীবনোপকরণ, অতপর তারা আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল, ফলে তারা যা করত তার কারণে আল্লাহ তাদেরক আস্বাদ গ্রহণ করালেন ক্ষুধা ও ভীতির আচ্ছাদনের।”((সূরা ১৬—নাহল: ১১২ আয়াত।))
এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, জীবন, সম্পদ ও ইজ্জত-আবরুর নিরাপত্তা এবং জীবনোপকরণে সহজলভ্যতা বা সচ্ছলতা একটি স্বাধীন জনগোষ্ঠীর জন্য মহান আল্লাহর অন্যতম নিয়ামত। আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞ হলে এর বিপরীতে ক্ষুধা, অসচ্ছলতা, ও নিরাপত্তাহীনতার পোশাক আল্লাহ পরিধান করান। এদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। হৃদয়ের অনুভব দিয়ে, নিয়ামতকে আল্লাহর দয়ার দান বলে বিশ্বাস করে, স্বাধীনতা অর্জনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, স্বাধীনতাকে আল্লাহর নির্দেশমত পরিচালনা করে, সালাত, যাকাত, তাকওয়া ও আইনের শাসনের পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা করে আমাদেরকে এ নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে ও অকৃতজ্ঞতা থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দিন। আমীন!!