As-Sunnah Trust

সাম্প্রতিক সংবাদ

শিরকের পরিচয় ও কারণ

আজ সফর মাসের ৩য় জুমুআ। আজকের খুতবায় আমরা শিরক বিষয়ে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। কিন্তু তার আগে আমরা এ সপ্তাহের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলির বিষয়ে সংক্ষেপ আলোকপাত করি।
…………………………………………………………………………………………………..

বিগত খুতবায় আমরা কুফর সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, কুফরের একটি প্রকার হলো শিরক। আজ আমরা শিরক বিষয়ে আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

র্শিক অর্থ অংশীদার হওয়া, অংশীদার করা বা সহযোগী বানানো। কুরআনের ভাষায় শিরক হলো কাউকে আল্লাহর সমতূল্য, সমকক্ষ বা তুলনীয় বলে মনে করা। মহান আল্লাহ বলেন:
فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ
অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।”1সূরা (২) বাকারা: ২২ আয়াত।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন,
سَأَلْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم أَيُّ الذَّنْبِ عِنْدَ اللَّهِ أَكْبَرُ قَالَ أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ
“আমি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে প্রশ্ন করলাম, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে কঠিন পাপ কী? তিনি বলেন: সবচেয়ে কঠিন পাপ এই যে, তুমি আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।”2বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬২৬, ৫/২২৩৬, ৬/২৪৯৭, ২৭৩৯; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯০-৯১।

আল্লাহর কোনো ক্ষমতায়,

গুণে বা ইবাদতে অন্য কাউকে অংশীদার করাই শিরক। বিশ্ব সৃষ্টি, পরিচালনা, জীবনদান, মৃত্যুদান, বৃষ্টিদান, অলৌকিক সাহায্য, কল্যাণ, অকল্যাণ ইত্যাদি সকল ক্ষমতা আল্লাহর। অন্য কারো এরূপ কোনো ক্ষমতা বা অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক। অনুরূপভাবে আল্লাহর মহান গুণাবলীর মধ্যে রয়েছে তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বদ্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, অদৃশ্য জ্ঞানের মালিক। অন্য কারো এরূপ গুণ আছে বলে মনে করা শিরক। অনুরূপভাবে সাজদা, দোয়া, মানত, জবাই, তাওয়াক্কুল, ভরসা, নির্ভরতা, অলৌকিক ভয়, আশা ইত্যাদি সকল ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য। অন্য কারো জন্য এগুলি করা অর্থ এগুলিতে তাকে আল্লাহর অংশীদার বানানো।

এখানে আমাদের মনে হতে পারে, আমরা তো মুসলিম, আমাদের তো র্শিক এর কোনো ভয় নেই। বেঈমানগণ শিরক বা কুফ্রীতে লিপ্ত। মুমিন তো র্শিক থেকে মুক্ত। কিন্তু কুরআন কারীমে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশ ঈমানদারই শিরক-এর মধ্যে লিপ্ত। আল্লাহ বলেন:
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُونَ
“অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করে এবং সেই অবস্থায় তারা র্শিকে লিপ্ত থাকে।”3সূরা ইউসূফ ১০৬ আয়াত।

কুফরীর অন্যতম প্রকাশ শিরক।

সাধারণত যুগে যুগে কাফিরগণ আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর গুণাবলি, রুবূবিয়্যাত বা প্রতিপলকত্ব, মা’বুদিয়্যাত বা উপাস্যত্ব অস্বীকার করে কুফরী করে নি, বরং এগুলিতে তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করেই কুফরী করেছে। ইহূদী, খৃস্টান আরবের কাফিরগণ ও অন্যান্য অনেক জাতি নবী, রাসূল ও আসমানী কিতাব পাওয়ার পরেও আল্লাহর উপর ঈমান থাকা সত্ত্বেও শিরক করেছে। আমরা দেখেছি যে, মক্কার কাফিররা এবং কুরআনে বর্ণিত অন্যান্য কাফির জাতি আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান প্রতিপালক হিসাবে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও শ্রিক-এ লিপ্ত হতো এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ইবাদত করতো। এজন্য র্শিক-এর কারণ এবং প্রকার ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করা আমাদের জন্য অতীব জরুরী, যেন আমরা শিরক থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি।

ইহূদী, খৃস্টান ও মুশরিকগণ ফিরিশতাগণ, বিভিন্ন নবী এবং সত্যিকার ওলী বা কাল্পনিক ওলীদের ভক্তির নামে ইবাদত করত। এদের ইবাদতের পিছনে তাদের দুটি যুক্তি ছিল। প্রথমত এরা আল্লাহর প্রিয়, কাজেই এদের ডাকলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। দ্বিতীয়ত: এরা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে বিপদ কাটিয়েদেন প্রয়োজন মেটান। এজন্য তারা এদের মূর্তি বানিয়ে, বা এদের কবরের কাছে বা এদের স্মৃতি বিজড়িত স্থান, গাছ, পাথর ইত্যাদির কাছে এসে এদের কাছে প্রার্থনা করত, এদের নামে মানত করত, এদের নামে পশু জবাই করত, এদের নামে ফসল উৎসর্গ করত, এদেরকে সাজদা করত।

এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন:

وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
‘‘আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য আউলিয়া (অভিভাবক বা বন্ধু) গ্রহন করেছে তারা বলে, আমরা তো এদের শুধু এজন্যই ইবাদাত করি যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেবে। তারা যে বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত রয়েছে আল্লাহ তার ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী কাফির আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’’((সূরা (৩৯) যুমার:৩ আয়াত।)) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

এভাবে আমরা দেখছি যে, আল্লাহর অবাধ্যতার উদ্দেশ্যে নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য, সন্তুষ্টি ও দয়া লাভের আশাতেই তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্যের ইবাদত করত। অন্যত্র আল্লাহ বলেন:
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلا فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করে তারা তাদের কোনো ক্ষতিও করতে পারে না উপকারও করতে পারে না। তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী (শাফায়াতকারী)। বল, তোমরা কি আল্লাহকে এমন কিছু জানাচছ যা তিনি জানেন না আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে? সুবহানাল্ল­াহ! তিনি সুমহান, সুপবিত্র এবং তোমাদের শিরক থেকে তিনি উর্ধ্বে।”4সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত।

এখানেও আমরা দেখছি যে,

আল্লাহর অবাধ্যতার উদ্দেশ্যে নয়, এদের সুপারিশ-এর মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভের উদ্দেশ্যে তারা এসকল উপাস্যের ইবাদত করত। তারা স্বীকার করত যে, সকল ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। তারপরও তারা মনে করত যে, আল্লাহর এ সকল মাহবূব বান্দাকে আল্লাহ কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। এদের বন্দনা না করে সরাসরি আল্লাহর বন্দনা করলে বা এদের ভক্তি-পূজা করা যাবে না বললে এরা বদদোয়া করে ধ্বংস করে দেবেন। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِنْ دُونِهِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُضِلٍّ أَلَيْسَ اللَّهُ بِعَزِيزٍ ذِي انْتِقَامٍ وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ

“আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে যারা তাদের ভয় দেখায়। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার জন্য কোনো পথ-প্রদর্শক নেই। এবং আল্লাহ যাকে হিদায়াত করেন তার জন্য কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই। আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, দ-বিধায়ক নন? তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আকাশম-লী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ তুমি বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ নির্ভরকারিগণ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করে।”5সূরা (৩৯) যুমার: ৩৬-৩৮ আয়াত।

এখানে আমরা দেখছি যে,

কাফিররা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ভয় দেখাচ্ছে যে, তিনি যদি তাদের মা’বূদদের -জিবরাঈল, ইসরাফীল, ইবরাহীম, ইসমাঈল, মূসা, ঈসা, ওয়াদ্দ, ইয়াগূস, লাত, মানাত ইত্যাদি উপাস্যদের- বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার কথা বলেন তবে এরা তাঁর ক্ষতি করবে। আবার তারা একথাও স্বীকার করছে যে, চূড়ান্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহরই, আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু করার ক্ষমতা এদের নেই। তারা ভাবত যে, আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত, তবে আল্লাহ ইচ্ছা করে এবং দয়া করে এদেরকে যে ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন তাতে তিনি সাধারণত বাধা দেন না।

এদের বিভ্রন্তির দুটি কারণ কুরআন থেকে জানা যায়। প্রথমত শয়তানের প্রতারণা। আল্লাহ বলেন:
وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ يَقُولُ لِلْمَلائِكَةِ أَهَؤُلاءِ إِيَّاكُمْ كَانُوا يَعْبُدُونَ قَالُوا سُبْحَانَكَ أَنْتَ وَلِيُّنَا مِنْ دُونِهِمْ بَلْ كَانُوا يَعْبُدُونَ الْجِنَّ أَكْثَرُهُمْ بِهِمْ مُؤْمِنُونَ
“যেদিন তিনি এদেরকে সকলকে একত্রিত করবেন এবং ফিরিশতাদেরকে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘এরা কি তোমাদেরকেই ইবাদত করত?’ ফিরিশতারা বলবে, ‘তুমি পবিত্র, মহান! আমাদের সম্পর্ক তোমারই সাথে, তাদের সাথে নয়। তারা তো ইবাদত করত জিন্নদের এবং এদের অধিকাংশই ছিল তাদের প্রতি বিশ্বাসী।”6সূরা (৩৪) সাবা: ৪০-৪১ আয়াত।

কুরআনে এ অর্থে আরো আয়াত রয়েছে। এ সকল আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, জিন্ন শয়তানগণ এ সকল উপাস্যের বেশ ধরে এদের নিকট প্রকাশিত হতো, এদেরকে স্বপ্ন, কাশফ, অলৌকিক দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করত, বিভিন্ন অলৌকিক কার্য করিয়ে দিত। এভাবে এ সকল মুশরিক মনে করত যে, তারা ফিরিশতাদেরই ইবাদত করছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা শয়তানের ইবাদত করত।

শিরকের আরেকটি কারণ ছিল

বিভ্রান্ত ধর্মগুরুদের অন্ধ অনুকরণ। আল্লাহ বলেন:
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ
“বল, হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না এবং যে সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের মনগড়া মত ও খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।”7সূরা (৫) মায়িদা: ৭৭ আয়াত।

এ সকল পথভ্রষ্ট মানুষদের মনগড়া মতের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল দুটি: প্রথমত আল্লাহর কালামের অপব্যাখ্যা করা এবং দ্বিতীয়ত, বানোয়াট মিথ্যা কথার মাধ্যমে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করা। এদের অন্যতম উদাহরণ প্রচলিত ত্রিত্ববাদী খৃস্টধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ইহূদী পৌল। তিনি ঈসা (আ)-এর মর্যাদা বৃদ্ধি ও ভক্তির নামে তাওরাত, যাবূর ও ইঞ্জিলের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করে এবং ইঞ্জিলের নামে জাল ও মিথ্যা কথা বলে খৃস্টধর্ম বিকৃত করেন। তিনি নিজে সগৌরবে স্বীকার করেছেন যে, তিনি মিথ্যা বলেন। তিনি বলেন: “For if the truth of God hath more abounded through my lie unto his glory; why yet am I also judged as a sinner? কিন্তু আমার মিথ্যায় যদি ঈশ্বরের সত্য তাঁহার গৌরবার্থে উপচিয়া পড়ে, তবে আমিও বা এখন পাপী বলিয়া আর বিচারিত হইতেছি কেন?”8রোমান ৩/৭।

মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শিরক

প্রচারের ক্ষেত্রেও ইহূদী ষড়যন্ত্র ছিল মূল। আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা নামক ইহূদী নিজেকে মুসলিম দাবি করে মক্কা-মদীনা থেকে দূববর্তী ইরাক, মিসর ইত্যাদি এলাকায় নও মুসলিমদের মধ্যে নবী-বংশের ভালবাসা, ভক্তি ও মর্যাদার নামে শিরকী বিশ্বাস প্রচার করতে থাকে। মুসলিম উম্মাহর সকল শিরক-এর উৎস আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা এবং তার প্রচারিত শীয়া মতবাদ। দ্বাদশ ইমাম পন্থী শীয়া এবং বিশেষ করে বাতিনী শীয়া. কারামিতা, নুসাইরিয়্যাহ, দুরুয ইত্যাদি সম্প্রদায় অগণিত শিরক-কুফর মুসলিম সমাজে ছাড়িয়েছে।

বিশেষত ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দী গত হওয়ার পরে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এ সকল বিভ্রান্ত দল রাষ্টীয় ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। বাগদাদে মূল কেন্দ্রে বনূ বুওয়াইহিয়া শীয়াগণ ক্ষমতা দখল করে। কারামাতিয়্যা, বাতিনীয়া, হাশাশিয়া, ফাতিমীয়া বিভিন্ন শীয়া সম্প্রদায় মিসর, তিউনিসিয়া, মরক্কো, ইয়ামান, কূফা, বসরা, নজদ, খুরাসান, ভারত, বাংলা ইত্যাদি অঞ্চলে রাষ্ট ক্ষমতা দখল করে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। এরা সাধারণ সরলপ্রাণ ‘সুন্নী’ মুসলিম, সূফী, দরবেশ ও ইলম-হীন নেককার মানুষদের মধ্যেও এদের শিরক প্রসার করতে সক্ষম হয়। মুসলিম উম্মাহর সকল শিরকের উৎস মূলত এখানেই।

পৌলের মত এরাও ব্যাখ্যা ও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। কুরআন ও হাদীসের অপব্যাখ্যা এবং তার পাশাপাশি অগণিত মিথ্যা গল্প-কাহিনী রটনা করে এরা সমাজে শিরক ছড়িয়ে দেয়।

এভাবে আমরা দেখেছি যে, বিভিন্ন তাওহীদ-পন্থী উম্মাত ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে শিরকে লিপ্ত হয়েছে। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কিছু সঠিক বিশ্বাসের বিকৃতির মাধ্যমেই শিরকের উৎপত্তি। আমরা এখানে বিশেষ করে দুটি বিষয় উল্লে­খ করতে পারি।

প্রথমত, মুজিজা ও কারামতের বিষয়।

নবীগণের মু’জিজা, ওলীদের কারামত এবং তাদের দোয়া কবুল হওয়ার বিষয় সকল ধর্মে স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ। মুজিজা-কারামতকে নবী বা ওলীদের ক্ষমতা ও অধিকার ভেবে তারা শিরক করেছে। খৃস্টানগণ দাবি করেছে, ঈসা (আ) মৃতকে জীবিত করতেন, আর মৃতকে জীবিত তো আল্লাহ ছাড়া কেউ করতে পারেন না, কাজেই এতে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর ক্ষমতা ভা-ার বা কিছু ক্ষমতা ঈসা (আ)-কে দিয়েছেন। এখন আমরা তার কাছেই সাহায্য, দয়া, হায়াত, সম্পদ ইত্যাদি চাইব। সরাসরি আল্লাহর কাছে চাইলে আল্লাহও বিরক্ত হবেন এবং ঈসা (আ)-এর সাথেও বেয়াদবী হবে। অন্য সকল মুশরিক সম্প্রদায়ও এরূপ দাবি করত।

দ্বিতীয়ত, দোয়া, শাফা‘আত ও দায়িত্বের বিষয়।

ফিরিশতা, নবী ও ওলীরা শাফায়াত করবেন বলে আসমানী ধর্মগুলিতে বলা হয়েছে। দোয়া ও শাফা‘আতকে তাদের ক্ষমতা ভেবে তারা শিরক করেছে। এছাড়া আল্লাহ ফিরিশতাগণকে বিভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করেছেন, যেমন মৃত্যুর ফিরিশতা, বৃষ্টির ফিরিশতা ইত্যাদি। এদের কোনো ক্ষমতা নেই। একান্তই আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে এরা দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু মুশরিকগণ এদের দায়িত্বকে ক্ষমতা মনে করে এদের কাছে প্রার্থনা করে শিরক করেছে।

কুরআন কারীমে বিভিন্নভাবে এ সকল বিভ্রান্তি অপনোদন করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, মুজিযা-কারামত বা অলৌকিক কর্ম কোনো নবী-ওলীর ক্ষমতা নয়। একান্তই আল্লাহর ক্ষমতা ও অধিকার। আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিতেই শুধু নবীগণ মুজিযা দেখাতে পারেন। আল্লাহ বলেন:
وَمَا كَانَ لِرَسُولٍ أَنْ يَأْتِيَ بِآَيَةٍ إِلاَّ بِإِذْنِ اللَّهِ
“কোনো রাসূলের জন্য সম্ভব ছিল না যে, তিনি কোনো মুজিজা বা অলৌকিক বিষয় নিয়ে আসবেন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া।”((সূরা গাফির: ৭৮ আয়াত)) কুরআন কারীমের অনেক স্থানে বিষয়টি বলা হয়েছে।

শাফাআত, দুআ ও দায়িত্বের বিষয়ে

আল্লাহ তা’লা কুরআন কারীমে বারংবার জানিয়েছেন যে, আল্লাহ কাউকে কোনো ক্ষমতা দেন নি। কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা কারো নেই। মহান আল্লাহ বলেন:
قُلْ أَتَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَلا نَفْعًا وَاللَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
“বল, তোমরা কি আল্লাহ ছাড়া এমন কারো ইবাদত করছ যে তোমাদের জন্য কোনো প্রকারের ক্ষতির মালিক নয় এবং কোনো প্রকার উপকারেরও মালিক নয়? আর আল্লাহ সর্ব-শ্রোতা এবং সর্ব-জ্ঞানী।9সূরা মায়েদ: ৭৬ আয়ত

আল্লাহ আরো জানিয়েছেন যে, শাফাআতের মালিকানা আল্লাহ। বান্দারা শুধু তাঁর অনুমতিক্রমে তিনি যার উপর সন্তুষ্ট তার জন্য শাফাআত করবেন। এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত শুনুন:

ليْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلا شَفِيعٌ
“তিনি ব্যতীত তাদের কোনো অভিভাবক নেই এবং কোনো সুপারিশকারী নেই।”10সূরা (৬) আন‘আম: ৫১ আয়াত।

قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا
“বল, সকল শাফাআত-সুপারিশ আল্লাহরই ইখতিয়ারে, তাঁরই মালিকানা। ”11সূরা (৩৯) যুমার: ৪৪ আয়াত।

وَلا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ
“যাকে অনুমতি দেয়া হয় সে ব্যতীত আল্লাহর নিকট কারো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।”12সূরা (৩৪) সাবা: ২৩ আয়াত।

وَلا يَشْفَعُونَ إِلا لِمَنِ ارْتَضَى
“তিনি যাদের প্রতি সন্তুষ্ট তাদের ছাড়া আর কারো জন্য তারা সুপারিশ করে না।”13সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৮ আয়াত।

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى
“আকাশে কত ফিরিশ্তা রয়েছে! তাদের কোনো সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন।”14সূরা (৫৩) নাজম: ২৬ আয়াত।

বিভিন্ন মিথ্যা গল্প, কাহিনী, ব্যাখ্যা ইত্যাদির ভিত্তিতে শিরকের যে দর্শন তারা তৈরি করেছিল তার মূল হলো মহান আল্লাহকে মানুষের মত কল্পনা করা। এরা আল্লাহকে দুনিয়ার রাজাবাদশাহর মত কল্পনা করত। পৃথিবীর একজন সাধারণ শাসক প্রসাশকের কাছে সরাসরি যাওয়া যায় না; তাহলে রাজাধিরাজ মহান আল্লাহর কাছে কিভাবে সরাসরি যাওয়া যায়। অবশ্যই আল্লাহর মাহবূব বান্দাদের মাধ্যমে যেতে হবে। তাদের ভক্তি অর্চনা করে খুশি করলেই আল্লাহকে পাওয়া যাবে।

তারা দাবি করত,

একজন মহারাজ তার প্রিয় দাসদেরকে তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় কিছু ছোটখাট দায়িত্ব পালনের জন্য প্রেরণ করেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসকল ছোটখাট বিষয় নিজেদের ইচ্ছামত পরিচালনা করার ক্ষমতা তাদেরকে প্রদান করেন। মহারাজ তার প্রজাগণের খুটিনাটি বিষয় নিজে পরিচালনা করেন না, বরং অধীনস্থ প্রশাসক ও কর্মকর্তাদেরকে এ সকল বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এ সকল কর্মকর্তার অধীনে যারা কর্ম করেন বা তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখেন তাদের বিষয়ে এ সকল কর্মকর্তার সুপারিশ তিনি গ্রহণ করেন। সকল রাজার মহারাজা রাজাধিরাজ মহান আল্লাহও অনুরূপভাবে তাঁর কিছু নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাকে এরূপ ঐশ্বরিক ক্ষমতা দান করেছেন।

কুরআনে অগণিত স্থানে মুশরিকদের এ সকল বিভ্রান্তির অপনোদন করা হয়েছে। আমরা পরবর্তী খুতবায় কিছু বিষয় আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ। সর্বোচ্চ বিভ্রান্তি হলো মহান আল্লাহকে মানুষের মত বলে কল্পনা করা। একজন মানুষ মহারাজা তার সেনাপতি, খাদেম, সামন্ত শাসক বা কর্মকর্তাদের সহযোগিতার মুখাপেক্ষী, তিনি নিজে সবকিছু দেখতে, শুনতে বা জানতে পারেন না।

তিনি অনেক সময়

নিজের ইচ্ছা না থাকলেও তাদের সুপারিশ গ্রহণ করেন, অথবা মূল বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না, তাই সংশ্লিষ্ট অফিসারের সুপারিশের ভিত্তিতেই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সব কিছু নিজে জানা ও বিচার করা তো তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ সবকিছু জানেন, শুনেন, দেখেন, তিনি প্রতিটি বান্দার নিকটবর্তী ও প্রিয়জন। মহান আল্লাহকে এরূপ মানুষ মহারাজার সাথে তুলনা করার অর্থ তার রুবূবিয়্যাতের সাথে কুফরী করা ও তাঁর বিষয়ে ‘কু-ধারণা’ পোষণ করা। আল্লাহ বলেন:

فَلا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ
“সুতরাং আল্লাহর জন্য কোনো তুলনা-উদাহরণ স্থাপন করো না। আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।”15সূরা (১৬) নাহল: ৭৪ আয়াত।
মহান আল্লাহ আমাদের ঈমানকে সকল প্রকার শিরক ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, রাহিমাহুল্লাহ, বই: খুতবাতুল ইসলাম, পৃ. ১১১-১১৮।

ইসলামী আকীদার উৎস ও ভিত্তি ওহীর ইলম, ঘুষ হারাম। কেউ যদি আমার হক কাজের জন্য জোর করে ঘুষ আদায়, তাওহীদুল ঈমান (৬) শিরক থেকে আশ্রয়লাভের দু‘আ

Facebook
Twitter
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published.