ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া ওয়া রহমাতুল্লাহ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এপ্রশ্নটি করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার প্রশ্নে উল্লেখিত বিষয়ে নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল। আশা করি তাতে আপনি আপনার উত্তর খুঁজে পাবেন। ইসলাম আমাদেরকে এমন একটি জীবন পদ্ধতি প্রদান করেছে যে, যদি কোনো মানুষ ইসলামের এ নিয়মগুলো ন্যূনতমভাবেও মেনে চলে তবে সাধারণভাবে সে সুস্বাস্থ্য লাভ ও রক্ষা করতে পারবে। পরিমিত পানাহার, পরিচ্ছন্নতা, অলসতা, অশ্লীলতা ও পাপ বর্জন, পরিমিত পরিশ্রম, বিশ্রাম, বিনোদন, ঘুম, স্বাস্থ্য সতর্কতা, পরিবার ও অন্যান্য মানুষের অধিকার পালন, নিয়মিত ইবাদত ও যিকর-দুআর মাধ্যমে আমরা দৈহিক ও মানসিক সুস্থতাময় একটি সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ জীবন লাভ করতে পারি। এরপরও রোগব্যাধি বা অসুস্থতা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজেদের বা আপনজনদের অসুস্থতা আমাদের প্রায়ই আক্রান্ত করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসুস্থতার কারণ আমাদের অনিয়ম বা অন্যায়। তবে অনেক সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা হিসেবেও মানুষ সাময়িক রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। অসুস্থতার সাথে দুআ ও যিকরের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সুস্থতা অর্জনে চিকিৎসার পাশাপাশি দুআর কার্যকরিতা পরীক্ষিত। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ অপারগ হওয়ার পর দুআর মাধ্যমে মানুষ সুস্থতা লাভ করেন। বিশেষত জিন বা যাদু সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা এবং মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে যিকর ও দুআর উপরেই নির্ভর করা হয়। এক্ষেত্রে কুসংস্কার, অস্পষ্টতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেক মুমিন শিরক ও অন্যান্য পাপে জড়িয়ে পড়েন। এজন্য এখানে এ বিষয়ক কয়েকটি মূলনীতি অতি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। ১. অসুস্থতার মধ্যেও মুমিনের কল্যাণ
অসুস্থতার ক্ষেত্রে মুমিনের সর্বপ্রথম করণীয় অস্থিরতা ও হতাশা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা। মুমিন বিশ্বাস করেন যে, সকল বিপদ, কষ্ট মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈমানী পরীক্ষা, গোনাহের ক্ষমা বা মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আসে। আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা যে, মুমিন দেহ, মন, সম্পদ ও পরিজনের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও সুস্থতার জন্য সকল প্রকারের সতর্কতা ও নিয়মনীতি পালন করবেন। পাশাপাশি তিনি সর্বদা সর্বান্তকরণে সার্বক্ষণিক সুস্থতা ও সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য দুআ করবেন। এরপরও কোনো রোগব্যধিতে আক্রান্ত হলে বা কোনোরূপ বিপদাপদে নিপতিত হলে তাকে নিজের জন্য কল্যাণকর বলে সাধ্যমত প্রশান্তির সাথে গ্রহণ করবেন। দ্রুতই অসুস্থতা বা বিপদ কেটে যাবে বলে প্রত্যয়ের সাথে বিশ্বাস করবেন। জাগতিক জীবনের সামান্য কয়েক দিনের একটু কষ্টের পরীক্ষায় ধৈর্য ও প্রশান্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, প্রেম ও অনন্ত জীবনের অভাবনীয় মর্যাদা লাভ করা মুমিনের জন্য বড় নিয়ামত বলে গণ্য। অধৈর্য মূল অসুস্থতা বা বিপদের কষ্ট কমায় না। উপরন্তু অধৈর্যজনিত হতাশা, অস্থিরতা ও বিলাপের কারণে কষ্ট বৃদ্ধি পায়, মুমিন অফুরন্ত সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়ে পাপে নিপতিত হয়। সর্বোপরি হতাশা ও অস্থিরতার কারণে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে ধৈর্য ও সাওয়াবের আশা মূল বিপদের কষ্ট না কমালেও কষ্টকে সহনীয় করে তোলে, মুমিন অফুরন্ত সাওয়াব ও বরকত লাভ করেন এবং বিপদ থেকে বের হওয়ার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়। মহান আল্লাহ বলেন:
وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ
আমি তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করব। আপনি সুসংবাদ প্রদান করুন ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের উপর বিপদ আসলে বলে, আমরা তো আল্লাহ্রই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্র্তনকারী। এরাই তো তারা যাদের প্রতি তাদের রবের কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং রহমত বর্ষিত হয়, আর এরা সৎপথে পরিচালিত। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُصِبْ مِنْهُ
আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে কিছু বিপদ-কষ্ট প্রদান করেন। সুহাইব (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ মুমিনের বিষয়টি বড়ই আজব! তার সকল অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কেউই এ অবস্থা অর্জন করতে পারে না। যদি সে আনন্দ-কল্যাণ লাভ করে তবে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং এর ফলে সে কল্যাণ লাভ করে। আর যদি সে বিপদ-কষ্টে পতিত হয় তবে সে ধৈর্য্যধারণ করে এবং এভাবে সে কল্যাণ লাভ করে। আবূ সাঈদ খুদরী ও আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
مَا يُصِيبُ الْمُسْلِمَ مِنْ نَصَبٍ وَلا وَصَبٍ وَلا هَمٍّ وَلا حُزْنٍ وَلا أَذًى وَلا غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةِ يُشَاكُهَا إِلاَّ كَفَّرَ اللَّهُ بِهَا مِنْ خَطَايَاهُ
যে কোনো ক্লান্তি, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, মনোবেদনা, কষ্ট, উৎকণ্ঠা যাই মুসলিমকে স্পর্শ করুক না কেন, এমনকি যদি একটি কাঁটাও তাকে আঘাত করে, তবে তার বিনিময়ে আল্লাহ তার গোনাহ থেকে কিছু ক্ষমা করবেন। আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জ্বর সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। তখন এক ব্যক্তি জ্বরকে গালি দেয় বা জ্বর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
لا تَسُبَّهَا فَإِنَّهَا تَنْفِي الذُّنُوبَ كَمَا تَنْفِي النَّارُ خَبَثَ الْحَدِيدِ
তুমি জ্বর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করো না; কারণ আগুন যেমন লোহার ময়লা দূর করে তেমনি জ্বর পাপ দূরীভূত করে। হাদীসটি সহীহ। আবূ মূসা আশআরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
إِذَا مَرِضَ الْعَبْدُ أَوْ سَافَرَ، كُتِبَ لَهُ مِثْلُ مَا كَانَ يَعْمَلُ مُقِيمًا صَحِيحًا
মানুষ সুস্থ অবস্থায় নিজ বাড়ি বা শহরে অবস্থান কালে যত নেক আমল করে তার অসুস্থতা বা সফরের অবস্থায়ও তার আমলনামায় অনুরূপ সাওয়াব লেখা হয়। রোগমুক্তি আমাদের কাম্য। এরপরও অনেক সময় মুমিন অসুস্থতার অফুরন্ত সাওয়াবের দিকে তাকিয়ে দুনিয়ার অস্থায়ী অসুস্থতাকেই বেছে নেন। তাবিয়ী আতা বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) আমাকে বলেন:
أَلا أُرِيكَ امْرَأَةً مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ قُلْتُ بَلَى قَالَ هَذِهِ الْمَرْأَةُ السَّوْدَاءُ (امْرَأَةٌ طَوِيلَةٌ سَوْدَاءُ عَلَى سِتْرِ الْكَعْبَةِ) أَتَتْ النَّبِيَّ r فَقَالَتْ إِنِّي أُصْرَعُ وَإِنِّي أَتَكَشَّفُ فَادْعُ اللَّهَ لِي قَالَ إِنْ شِئْتِ صَبَرْتِ وَلَكِ الْجَنَّةُ وَإِنْ شِئْتِ دَعَوْتُ اللَّهَ أَنْ يُعَافِيَكِ فَقَالَتْ أَصْبِرُ فَقَالَتْ إِنِّي أَتَكَشَّفُ فَادْعُ اللَّهَ لِي أَنْ لا أَتَكَشَّفَ فَدَعَا لَهَا
আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতী মহিলা দেখাব না? আমি বললাম: হ্যাঁ, অবশ্যই দেখাবেন। তিনি বলেন: এ কাল মহিলা (কাবা ঘরের গিলাফ সংলগ্ন লম্বা কাল এ মহিলা)। সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমি অজ্ঞান হয়ে যায় (বঢ়রষবঢ়ংু মুর্ছারোগ/মৃগীরোগ আক্রান্ত) এবং অচেতন অবস্থায় আমার কাপড়চোপড় সরে যায়। আল্লাহর কাছে আমার জন্য দুআ করুন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: তুমি যদি চাও তবে ধৈর্য ধারণ কর, তাহলে তুমি জান্নাত লাভ করবে। আর তুমি যদি চাও তবে আমি তোমার জন্য আল্লাহর কাছে সুস্থতার দুআ করব। তখন মহিলা বলেন, আমি ধৈর্য ধরব; তবে অচেতন অবস্থায় আমার কাপড় সরে যায়, আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন যেন আমার কাপড় সরে না যায়। তখন তিনি তার জন্য দুআ করেন। এখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) এ মহিলাকে দুনিয়ার সাময়িক কষ্টের বিনিময়ে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদ লাভের জন্য উৎসাহ দেন এবং মহিলাও সে পরামর্শ গ্রহণ করেন। তবে বিষয়টি ইচ্ছাধীন; কোনো মুমিন যদি ঈমানের এরূপ শক্তি অনুভব না করেন, অথবা সুস্থতার মাধ্যমে অন্যান্য ইবাদত করার সুদৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করেন তবে তিনি অবশ্যই চিকিৎসার চেষ্টা করবেন। সর্বাবস্থায় হতাশা বা অতীত নিয়ে মনোকষ্ট অনুভব করা যাবে না। কখনোই মনে করা যাবে না যে, যদি আমি এরূপ করতাম তাহলে হয়ত এরূপ হতো, অথবা এরূপ না করলে হয়ত এরূপ হতো না। এ ধরনের আফসোস মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ। বিপদ এসে যাওয়ার পর মুমিন আর অতীতকে নিয়ে আফসোস করবেন না। বরং আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। রাসূলুল্লাহ সা. এভাবেই নির্দেশনা দিয়েছেন। ২. চিকিৎসা ও ঝাড়ফুঁক
অসুস্থতার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব চিকিৎসার চেষ্টা করা। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বারবার চিকিৎসার নির্দেশ ও উৎসাহ প্রদান করেছেন, ঝাড়ফুঁক অনুমোদন করেছেন এবং তাবিজ-তাগা ইত্যাদি নিষেধ করেছেন। এক হাদীসে উসামা ইবন শারীক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
يَا عِبَادَ اللَّهِ تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَمْ يَضَعْ دَاءً إِلاَّ وَضَعَ لَهُ شِفَاءً أَوْ قَالَ دَوَاءً إِلاَّ دَاءً وَاحِدًا …. الْهَرَمُ
হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা ঔষধ ব্যবহার কর। আল্লাহ যত রোগ সৃষ্টি করেছেন সকল রোগেরই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন, একটিমাত্র ব্যধি ছাড়া … সেটি বার্ধক্য। হাদীসটি হাসান সহীহ। অন্য হাদীসে জাবির (রা) বলেন, রাসূলূল্লাহ সা. বলেন:
لِكُلِّ دَاءٍ دَوَاءٌ فَإِذَا أُصِيبَ دَوَاءُ الدَّاءِ بَرَأَ بِإِذْنِ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
প্রত্যেক রোগেরই ঔষধ বিদ্যমান। যদি কোনো রোগের সঠিক ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তবে আল্লাহর অনুমতিতে রোগমুক্তি লাভ হয়। এ অর্থে আবূ দারদা (রা), আবূ খুযামা (রা), কাইস ইবন মুসলিম (রা), আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা), আবূ হুরাইরা (রা) ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে অনেকগুলো হাদীস বর্ণিত। চিকিৎসা গ্রহণ ও প্রদানের পাশাপাশি তিনি নিজে মাঝে মাঝে ঝাড়-ফুঁক প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যবহৃত বা অনুমোদিত কিছু দুআ আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ। এছাড়া তিনি শিরকমুক্ত সকল দুআ ও ঝাড়ফুঁক অনুমোদন করেছেন। আউফ ইবন মালিক (রা) বলেন, আমরা জাহিলী যুগে ঝাড়ফুঁক করতাম। আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, এ সকল ঝাড়ফুঁকের বিষয়ে আপনার মত কী? তিনি বলেন
اعْرِضُوا عَلَيَّ رُقَاكُمْ لَا بَأْسَ بِالرُّقَى مَا لَمْ يَكُنْ فِيهِ شِرْكٌ
তোমাদের ঝাড়ফুঁকগুলো আমার সামনে পেশ কর। যতক্ষণ না কোনো ঝাড়ফুঁকের মধ্যে শিরক থাকবে ততক্ষণ তাতে কোনো অসুবিধা নেই। জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা) বলেন:
لَدَغَتْ رَجُلا مِنَّا عَقْرَبٌ وَنَحْنُ جُلُوسٌ مَعَ رَسُولِ اللَّه ِ rفَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَرْقِي قَالَ مَنْ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يَنْفَعَ أَخَاهُ فَلْيَفْعَلْ
আমরা রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তিকে একটি বিচ্ছু (ংপড়ৎঢ়রড়হ) কামড় দেয়। তখন এক ব্যক্তি বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমি কি একে ঝাড়ফুঁক প্রদান করব? তিনি বলেন: তোমাদের কেউ যদি তার ভাইয়ের উপকার করতে পারে তবে সে যেন তা করে। অন্য হাদীসে আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তার ঘরে প্রবেশ করেন। এ সময় একজন মহিলা তাঁকে ঝাড়ফুঁক করছিলেন। তখন তিনি বলেন:
عَالِجِيهَا بِكِتَابِ الله
তাকে কুরআন দিয়ে চিকিৎসা-ঝাড়ফুঁক কর। হাদীসটি সহীহ। উপরের হাদীসগুলোর আলোকে আমরা দেখছি যে, ঝাড়ফুঁকের দুটি পর্যায় রয়েছে: মাসনূন ও জায়েয বা মুবাহ। আমরা ইতোপূর্বে সুন্নাত ও জায়েযের পার্থক্য জেনেছি। ঝাড়ফুঁক একদিকে দুআ হিসেবে ইবাদত। অন্যদিকে চিকিৎসা হিসেবে জাগতিক কর্ম। রাসূলুল্লাহ সা. যে সকল দুআ ব্যবহার করেছেন বা অনুমোদন করেছেন তা মাসনূন ঝাড়ফুঁক হিসেবে গণ্য। এছাড়া যে কোনো ভাষার শিরক-মুক্ত যে কোনো বাক্য বা কথা দ্বারা ঝাড়ফুঁক দেওয়া বৈধ বলে তাঁর নির্দেশনা থেকে আমরা জানতে পারি। মাসনূন ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে সর্বদা ফুঁক দেওয়া প্রমাণিত নয় এবং জরুরীও নয়। রাসূলুল্লাহ সা. কর্ম ও অনুমোদন থেকে আমরা দেখি যে, তিনি ঝাড়ফুঁক-এর ক্ষেত্রে কখনো শুধু মুখে দুআটি পাঠ করেছেন, ফুঁক দেন নি। কখনো তিনি দুআ পাঠ করে ফুঁক দিয়েছেন, কখনো লালা মিশ্রিত ফুঁক দিয়েছেন, কখনো ফুঁক দেওয়া ছাড়াই রোগীর গায়ে হাত দিয়ে দুআ পাঠ করেছেন, অথবা দুআ পাঠের সময়ে বা দুআ পাঠের পরে রোগীর গায়ে বা ব্যাথ্যার স্থানে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন এবং কখনো ব্যাথা বা ক্ষতের স্থানে মুখের লালা বা মাটি মিশ্রিত লালা লাগিয়ে দুআ পাঠ করেছেন, অথবা তিনি এরূপ করতে শিক্ষা দিয়েছেন। সকল ক্ষেত্রে তিনি সশব্দে দুআ পাঠ করতেন বলেই প্রতীয়মান হয়। এজন্য ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে দুআটি জোরে বা সশব্দে পাঠ করাই সুন্নাত। ঝাড়ফুঁকের আয়াত বা দুআ সশব্দে পাঠের মাধ্যমে সুন্নাত পালন ছাড়াও অন্যান্য কল্যাণ বিদ্যমান। মনে মনে পড়লে অনেক সময় দ্রুততার আগ্রহে দুআর বাক্যগুলো বিশুদ্ধভাবে পড়া হয় না, আর সশব্দে পড়লে পাঠের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত হয়। এছাড়া রোগী ও উপস্থিত মানুষেরা আয়াত বা দুআ শ্রবণের বরকত লাভ করেন এবং তা নিজেরা শিখতে পারেন। আল্লাহর যিকর শ্রবণের মাধ্যমে রোগীর হৃদয়ের প্রশান্তি বাড়ে। সর্বোপরি শিরকযুক্ত বা দুর্বোধ্য-অবোধ্য দুআ পাঠের প্রবণতা রোধ হয়। কুরআনের আয়াত বা দুআ লিখে তা ধুয়ে পানি পান করার বিষয়ে সহীহ বা গ্রহণযোগ্য কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। তবে সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগ থেকে অনেক আলিম তা করেছেন। অধিকাংশ ফকীহ এরূপ করা জায়েয বলে গণ্য করেছেন। তবে শর্ত হলো পবিত্র কালি দিয়ে পবিত্র দ্রব্যে এরূপ আয়াত বা দুআ লিখে তা পানি দিয়ে ধুয়ে পান করা। গোসলের বিষয়ে অনেকে আপত্তি করেছেন। অনেকে মূল বিষয়টিকেই না-জায়েয বলে গণ্য করেছেন। পানি পড়া, তেল পড়া ইত্যাদি বিষয় সুন্নাতে পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ সা. রোগীকে ফুঁক দিয়েছেন বা রোগীর সামনে দুআ পাঠ করেছেন। দুআ পড়ে পানি, তেল, কালজিরা, মধু বা অন্য কিছুতে ফুঁক দিয়ে সেগুলো ব্যবহার করার কোনো নমুনা আমরা হাদীসে পাই না। তবে কোনো কোনো সাহাবী থেকে এরূপ কর্ম বর্ণিত। তাবিয়ীগণের যুগেও তা বহুল প্রচলিত ছিল। এজন্য প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ফকীহগণ-সহ প্রায় সকল আলিম ও ফকীহ তা বৈধ বলেছেন। ৩. তাবিজ ও সূতা
ঝাড়ফুঁক ও দুআর মাধ্যমে চিকিৎসা অনুমোদন করলেও তাবিজ, রশি, সুতা ইত্যাদির ব্যবহার রাসূলুল্লাহ সা. বারবার নিষেধ করেছেন। এক হাদীসে উকবা ইবনু আমির আল-জুহানী (রা) বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ r أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ فَبَايَعَ تِسْعَةً وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ بَايَعْتَ تِسْعَةً وَتَرَكْتَ هَذَا قَالَ إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيمَةً فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا فَبَايَعَهُ وَقَالَ مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ
একদল মানুষ রাসূলুল্লাহ সা. -এর কাছে আগমন করেন। তিনি তাদের নয় জনের বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং একজনের বাইয়াত গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তারা বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি নয় জনের বাইয়াত গ্রহণ করলেন কিন্তু একে পরিত্যাগ করলেন? তিনি বলেন, এর দেহে একটি তাবিজ আছে। তখন তিনি তার হাত ঢুকিয়ে তাবিজটি ছিড়ে ফেলেন। এরপর তিনি তার বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং বলেন: যে তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করল। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা)-এর স্ত্রী যাইনাব (রা) বলেন,
انَ عَبْدُ اللَّهِ إِذَا جَاءَ مِنْ حَاجَةٍ فَانْتَهَى إِلَى الْبَابِ تَنَحْنَحَ … وَإِنَّهُ جَاءَ ذَاتَ يَوْمٍ فَتَنَحْنَحَ قَالَتْ وَعِنْدِي عَجُوزٌ تَرْقِينِي مِنْ الْحُمْرَةِ فَأَدْخَلْتُهَا تَحْتَ السَّرِيرِ فَدَخَلَ فَجَلَسَ إِلَى جَنْبِي فَرَأَى فِي عُنُقِي خَيْطًا قَالَ مَا هَذَا الْخَيْطُ قَالَتْ قُلْتُ خَيْطٌ أُرْقِيَ لِي فِيهِ قَالَتْ فَأَخَذَهُ فَقَطَعَهُ ثُمَّ قَالَ إِنَّ آلَ عَبْدِ اللَّهِ لأَغْنِيَاءُ عَنْ الشِّرْكِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ r يَقُولُ: إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ قَالَتْ قُلْتُ لِمَ تَقُولُ هَذَا وَاللَّهِ لَقَدْ كَانَتْ عَيْنِي تَقْذِفُ وَكُنْتُ أَخْتَلِفُ إِلَى فُلانٍ الْيَهُودِيِّ يَرْقِينِي فَإِذَا رَقَانِي سَكَنَتْ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ إِنَّمَا ذَاكَ عَمَلُ الشَّيْطَانِ كَانَ يَنْخُسُهَا بِيَدِهِ فَإِذَا رَقَاهَا كَفَّ عَنْهَا إِنَّمَا كَانَ يَكْفِيكِ أَنْ تَقُولِي كَمَا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ r يَقُولُ: أَذْهِبْ الْبَأْسَ رَبَّ النَّاسِ اشْفِ أَنْتَ الشَّافِي لا شِفَاءَ إِلا شِفَاؤُكَ شِفَاءً لا يُغَادِرُ سَقَمًا
ইবনু মাসঊদ (রা) যখন বাড়িতে আসতেন তখন আওয়াজ দিয়ে আসতেন। … একদিন তিনি এসে আওয়াজ দিলেন।তখন আমার ঘরে একজন বৃদ্ধা আমাকে ঝাড়ফুঁক করছিল। আমি বৃদ্ধাকে চৌকির নিচে লুকিয়ে রাখি। ইবনু মাসঊদ (রা) ঘরে ঢুকে আমার পাশে বসেন। এমতাবস্থায় তিনি আমার গলায় একটি সুতা দেখতে পান। তিন বলেন, এ কিসের সুতা? আমি বললাম, এ ফুঁক দেওয়া সুতা। যাইনাব বলেন, তখন তিনি সুতাটি ধরে ছিড়ে ফেলেন এবং বলেন, আব্দুল্লাহর পরিবারের শিরক করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি: ঝাড়-ফুঁক, তাবীজ-কবজ এবং মিল-মহব্বতের তাবীজ শিরক। যাইনাব বলেন, তখন আমি আমার স্বামী ইবনু মাসঊদকে বললাম, আপনি এ কথা কেন বলছেন? আল্লাহর কসম, আমার চক্ষু থেকে পানি পড়ত। আমি অমুক ইহূদীর কাছে যেতাম। সে যখন ঝেড়ে দিত তখন চোখে আরাম বোধ করতাম। তখন ইবনু মাসঊদ (রা) বলেন: এ হলো শয়তানের কর্ম। শয়তান নিজ হাতে তোমার চক্ষু খোচাতে থাকে। এরপর যখন ফুঁক দেওয়া হয় তখন সে খোচানো বন্ধ করে। তোমার জন্য তো যথেষ্ট ছিল যে, রাসূলুল্লাহ সা. যা বলতেন তা বলবে। তিনি বলতেন: অসুবিধা দূর করুন, হে মানুষের প্রতিপালক, সুস্থতা দান করুন, আপনিই শিফা বা সুস্থতা দানকারী, আপনার শিফা (সুস্থতা প্রদান বা রোগ নিরাময়) ছাড়া আর কোনো শিফা নেই, এমনভাবে শিফা বা সুস্থতা দান করুন যার পরে আর কোনো অসুস্থতা-রোগব্যাধি অবশিষ্ট থাকবে না। তাবিয়ী ঈসা ইবনু আবি লাইলা বলেন,
دخلنا على عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُكَيْمٍ وَهُوَ مَرِيضٌ نَعُودُهُ فَقِيلَ لَهُ لَوْ تَعَلَّقْتَ شَيْئًا فَقَالَ أَتَعَلَّقُ شَيْئًا وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ r مَنْ تَعَلَّقَ شَيْئًا وُكِلَ إِلَيْهِ
আমরা সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উকাইম আবূ মাবাদ জুহানীকে (রা) অসুস্থ অবস্থায় দেখতে গেলাম। আমরা বললাম, আপনি কোনো তাবিজ ব্যবহার করেন না কেন? তিনি বলেন: আমি তাবিজ নেব? অথচ রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: যদি কেউ দেহে (তাবিজ জাতীয়) কোনো কিছু লটকায় তবে তাকে উক্ত তাবিজের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়। হাদীসটি হাসান। তাবিয়ী উরওয়া ইবনুয যুবাইর বলেন:
دَخَلَ حُذَيْفَةُ t عَلَى مَرِيْضٍ فَرَأَى فِيْ عَضُدِهِ سَيْراً فَقَطَعَهُ أَو انْتَزَعَهُ ثُمَّ قَالَ: وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُمْ مُشْرِكُوْنَ
সাহাবী হুযাইফা (রা) একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে যান। তিনি লোকটির বাজুতে একটি রশি দেখতে পান। তিনি রশিটি কেটে দেন বা টেনে ছিড়ে ফেলেন এবং বলেন : অধিকাংশ মানুষই আল্লাহর উপর ঈমান আনে এবং তারা শিরকে লিপ্ত থাকে। আবূ বাশীর আনসারী (রা) বলেন, আমরা এক সফরে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে ছিলাম। মানুষেরা সবাই যখন বিশ্রামরত ছিল তখন তিনি এক দূত পাঠিয়ে ঘোষণা করেন:
لا يَبْقَيَنَّ فِي رَقَبَةِ بَعِيرٍ قِلادَةٌ مِنْ وَتَرٍ أَوْ قِلادَةٌ إِلاَّ قُطِعَتْ
কোনো উটের গলায় কোনো রশি, ধনুকের রশি (ংঃৎরহম, নড়ংিঃৎরহম) বা মালা থাকলে তা অবশ্যই কেটে ফেলতে হবে। ইমাম মালিক হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন: বদ-নযর থেকে রক্ষা পেতে এরূপ সুতা ব্যবহার করা হতো। রুআইফি ইবন সাবিত (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে বলেন:
يَا رُوَيْفِعُ لَعَلَّ الْحَيَاةَ سَتَطُولُ بِكَ بَعْدِي فَأَخْبِرْ النَّاسَ أَنَّهُ مَنْ عَقَدَ لِحْيَتَهُ أَوْ تَقَلَّدَ وَتَرًا أَوْ اسْتَنْجَى بِرَجِيعِ دَابَّةٍ أَوْ عَظْمٍ فَإِنَّ مُحَمَّدًا r مِنْهُ بَرِيءٌ
হে রুআইফি, হয়ত তুমি আমার পরেও জীবিত থাকবে। তুমি মানুষদেরকে জানাবে যে, যদি কোনো ব্যক্তি তার দাড়ি বক্র করে বা গিট দেয়, সুতা, রশি বা ধনুকের রশি লটকায় অথবা গোবর বা হাড় দিয়ে ইসতিনজা করে তবে আমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। হাদীসটি সহীহ। কূফার প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ফকীহ ইবরাহীম নাখয়ী বলেন:
كَانُوا يَكْرَهُونَ التَّمَائِمَ كُلَّهَا ، مِنَ الْقُرْآنِ وَغَيْرِ الْقُرْآنِ.
তাঁরা (সাহাবীগণ) সকল তাবিজই মাকরূহ বা অপছন্দনীয় বলে গণ্য করতেন, কুরআনের তাবিজ হোক আর কুরআন ছাড়া অন্য কিছু হোক। এ সকল হাদীস থেকে জানা যায় যে, লিখিত কোনো কাগজ বা দ্রব্য তাবিজ হিসেবে লটকানো, দুআ বা মন্ত্রপূত কোনো সুতা শরীরে ব্যবহার, সাধারণ কোনো সুতা বদ-নযর কাটাতে মানুষ বা প্রাণীর দেহে লটকানো বা মনোবাসনা পূরণ করতে কোথাও সুতা বাঁধা বা লটকে রাখ সবই নিষিদ্ধ ও শিরক। এ বিষয়ক একটি অতি প্রাচীন শিরক মনোবাসনা পূরণের জন্য ইচ্ছা বা নিয়েত (রিংয) করে সুতা বেঁধে রাখা। বিশ্বের সকল দেশেই এরূপ কর্ম দেখা যায়। কোনো গাছ, মূর্তি, মন্দির, মাযার, দরগা, জলাশয় বা অনুরূপ স্থানে মনোবাঞ্চনা প্রকাশ করে (রিংয করে) সুতা বাঁধা, টাকা ফেলা, নাম বা ইচ্ছা লিখে কাগজ লিখে রাখা ইত্যাদি এ জাতীয় শিরক। আরবের কাফিরদের মধ্যেও এরূপ কর্ম প্রচলিত ছিল। এর একটি দিক ছিল তারা যাত আনওয়াত নামক একটি বৃক্ষে তাদের অস্ত্রাদি টাঙিয়ে রেখে দিত। এ প্রসঙ্গে আবু ওয়াকিদ লাইসি (রা) বলেন: মক্কা বিজয়ের পরে আমরা রাসূলুল্লাহ সা. -এর সাথে হুনাইনের যুদ্ধের জন্য যাত্রা করি। তখন আমরা নও মুসলিম। চলার পথে তিনি মুশরিকদের একটি (বরই) গাছের কাছ দিয়ে যান, যে গাছটির নাম ছিল যাত আনওয়াত। মুশরিকগণ এ গাছের কাছে বরকতের জন্য ভক্তিভরে অবস্থান করত এবং তাদের অস্ত্রাদি বরকতের জন্য ঝুলিয়ে রাখত। আমাদের কিছু মানুষ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, মুশরিকদের যেমন যাতু আনওয়াত আছে আমাদেরও অনুরূপ একটি যাতু আনওয়াত নির্ধারণ করে দেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন,
سُبْحَانَ اللَّهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ
সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর কসম, মূসার কওম যেরূপ বলেছিল: মুশরিকদের মূর্তির মতো আমাদেরও মূর্তির দেবতা দাও, তোমরাও সেরূপ বললে। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের সুন্নাত (শিরক ও অবক্ষয়ের পথ ও পদ্ধতি) অনুসরণ করবে। হাদীসটি সহীহ। মুসলিম, হিন্দু, খৃস্টান ও সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেই এ শিরক প্রচলিত। চার্চ, মন্দির বা দরগার খাদিমগণ দুবার সেখানে যাওয়ার রীতি প্রচলন করে থাকেন। একবার মনোবাঞ্চনা বলে সুতা বেঁধে আসতে হবে। এরপর বাসনা পূর্ণ হলে দ্বিতীয়বার যে কোনো একটি সুতা খুলে আসতে হবে। এভাবে ভক্ত দুবারই কিছু হাদিয়া-নৈবদ্য নিয়ে যান। এতে পুরোহিত বা খাদিমগণ উপকৃত হন। আলিম ও ফকীগণ তাবিজের বিষয়ে কিছু মতভেদ করেছেন। তাঁদের মতে তাবিজ দু প্রকারের। প্রথমত: যে তাবিজে দুর্বোধ্য বা অবোধ্য কোনো নাম, শব্দ বা বাক্য, কোনো প্রকারের বৃত্ত, দাগ, আঁক অথবা বিভিন্ন সংখ্যা লেখা হয়। এগুলির সাথে অনেক সময় কুরআনের আয়াত বা হাদীস লেখা হয়। এ প্রকারের তাবিজ ফকীহগণের সর্বসম্মত মতে হারাম। এগুলোতে শিরক থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি। কারণ এ সকল দুর্বোধ্য নাম, শব্দ, দাগ বা সংখ্যা শয়তানের নাম, প্রতীক বা শয়তানকে সন্তুষ্ট করার জন্য ব্যবহৃত বলেই বুঝা যায়। তা না হলে এ সকল অর্থহীন বিষয় তাবিজে সংযুক্ত করার দরকার কী?
দ্বিতীয় প্রকারের তাবিজ যে তাবিজে কুরআনের আয়াত, হাদীসের বাক্য অথবা সুস্পষ্ট অর্থের শিরকমুক্ত কোনো বাক্য লিখে দেওয়া হয়। এ ধরনের তাবিজ ব্যবহার কোনো কোনো সাহাবী-তাবিয়ী ও পরবর্তী অনেক আলিম ও ফকীহ জায়েয বলেছেন। তাঁরা তাবিজকে ঝাড়ফুঁকের মত একই বিধানের বলে গণ্য করেছেন। বিশেষত অমুসলিম গণক, সন্যাসী ও কবিরাজদের সুস্পষ্ট শিরক থেকে মুসলিমদেরকে রক্ষা করতে কুরআন ও হাদীসের দুআ দিয়ে তাবিজ ব্যবহার অনেক প্রসিদ্ধ আলিম বৈধ বলে গণ্য করেছেন। অন্যান্য অনেক আলিম দ্বিতীয় প্রকারের তাবিজকেও হারাম বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের হাদীসগুলোতে এরূপ কোনো পার্থক্য ছাড়াই তাবিজ ব্যবহার নিষেধ করা হয়েছে। ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে যেরূপ অনুমোদন তিনি প্রদান করেছেন সেরূপ কোনো অনুমোদন তাবিজের ক্ষেত্রে কোনো হাদীসে পাওয়া যায় না। কাজেই কুরআন, হাদীস বা সুস্পষ্ট অর্থবোধক শিরকমুক্ত বাক্য দ্বারা ঝাড়ফুঁক বৈধ হলেও এগুলো দ্বারা তাবিজ ব্যবহার বৈধ নয়। সামগ্রিক বিবেচনায় তাবিজ ব্যবহার বর্জন করা এবং শুধু ঝাড়ফুঁক ও দুআর উপর নির্ভর করাই মুমিনের জন্য উত্তম ও নিরাপদ। কারণ:
(১) এতে শিরকে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যায়। যে বিষয়টি শিরক অথবা জায়েয হতে পারে তা বর্জন করা নিরাপদ। (২) রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের সুন্নাত পালন করা হয়। তাঁরা ঝাড়ফুঁক করেছেন, কিন্তু তাবিজ ব্যবহার করেছেন বলে সহীহ বর্ণনা নেই। (৩) ঝাড়ফুঁক ও দুআর মাধ্যমে মুমিনের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক গভীর হয়। মুমিন নিজে কুরআনের আয়াত বা দুআ পাঠ করেন অথবা শুনেন। এতে অফুরন্ত সাওয়াব ছাড়াও আল্লাহর যিকরের মাধ্যমে আত্মার শক্তি অর্জিত হয়, যা জিন, যাদু ও মনোদৈহিক রোগ দূরীকরণে খুবই সহায়ক। ঝাড়ফুঁক বা দুআর অর্থ চিকিৎসা পরিত্যাগ নয়। যেহেতু চিকিৎসা গ্রহণ সুন্নাতের বিশেষ নির্দেশনা সেহেতু চিকিৎসার পাশাপাশি দুআ করতে হবে। দুআর মাধ্যমে সঠিক ঔষধ প্রয়োগের তাওফীক লাভ হতে পারে। আল্লাহ আমাদেরকে সর্বক্ষেত্রে কল্যাণ দান করুন। আমীন। আরো বিস্তারিত জানতে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রচিত রাহে বেলায়াত বইটি পড়ার জন্য অনুরোধ করছি।