পর্ব-২
তাকদীর বা আল্লাহর নির্ধারণে বিশ্বাস
………………………………………………….
মুমিন আরো বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বের সবকিছু একমাত্র আল্লাহরই সৃষ্টি। তিনি ছাড়া সবই তাঁর সৃষ্ট। মানুষের কর্মও আল্লাহর সৃষ্টি। বিশ্বে যাকিছু সংঘটিত হয় সবই মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞানের মধ্যে। তাঁর ইচ্ছা ও জ্ঞানের বাইরে এই মহাবিশ্বের কোথাও সামান্যতম কোনো কিছুই ঘটে না।
সর্বোপরি মুমিন বিশ্বাস করেন যে, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা রয়েছে। মানুষকে আল্লাহ বিবেক, বিচারশক্তি ও জ্ঞান দান করেছেন। মানুষ তার নিজের জ্ঞান ও ইচ্ছা অনুসারে কর্ম করে। তবে তার কর্ম আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার মধ্যে সংঘটিত হয়। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষের ইচ্ছা হরণ করতে পারেন। কিন্তু সাধারণত তিনি তা করেন না। তিনি মানুষকে তার স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা ব্যবহারের জন্য পুরস্কার বা শাস্তি প্রদান করবেন। তিনি তাঁর সৃষ্টিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। তিনি কখনোই কাউকে যুলুম করবেন না। তিনি মহাকরুণাময় ও শ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারক।
একটি উদাহারণ দেখুন। আল্লাহর নির্ধারণ হল, বিষ মৃত্যু আনে। আল্লাহ মানুষকে বিবেক ও জ্ঞান দিয়েছেন। সে জানে যে, বিষপানে মৃত্যু আসে। সে আরো জানে যে, এভাবে মৃত্যুকে গ্রহণ করা কঠিন পাপ। এরপরও কেউ বিষপান করলে সে মৃত্যুবরণ করবে এবং তা হবে আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞানের মধ্যে।
সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর অসীম অনন্ত জ্ঞানে জানেন যে, অমুক ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে বাধ্য না হয়ে, তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও জ্ঞান প্রয়োগ করে মৃত্যু হবে জেনে ও এভাবে মৃত্যু পাপ জেনেও বিষপান করে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহর জ্ঞান ও ইচ্ছার মধ্যেই বিষপানকারীর মৃত্যু হবে এবং সে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার ব্যবহার অনুসারে শাস্তি পাবে।
মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে ওই ব্যক্তির ইচ্ছাশক্তি হরণ করে তাকে বিষপান থেকে বিরত রাখতে পারেন। আবার তিনি ইচ্ছা করলে বিষের ক্ষমতা নষ্ট করে বিষপানকারীকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করতে পারেন। তবে সাধারণত তিনি তা করেন না। তিনি মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে অন্য সকল সৃষ্টি থেকে সম্মানিত ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। এই ইচ্ছাকে তিনি হরণ করেন না বা বাধা দেন না।
ইসলামি তাকদীরে বিশ্বাস ও অনৈসলামিক ভাগ্যে বিশ্বাসকে অনেকে এক করে ফেলেন। অনেকে মনে করেন ভাগ্য অনুসারেই যখন সবকিছু হবে তখন কর্মের কী দরকার! এটি পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী বিশ্বাস। কুরআন কারীমের বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই যে, মক্কার কাফিরগণ এ ধরণের বিশ্বাস পোষণ করত।1দেখুন: সূরা: (৬) আনআম, আয়াত: ১৪৮—১৪৯; সূরা: (৭) আ’রাফ, আয়াত: ২৮।
যে অবিশ্বাসী তাকদীর নিয়ে বিবাদ করে, তাকদীরের দোহাই দিয়ে কর্ম ছেড়ে দেয় সে মূলত নিজেকে আল্লাহর কর্মের পরিদর্শক ও বিচারক নিয়োগ করেছে। সে বলতে চায়, কর্ম করা আমার দায়িত্ব নয়। আমার কাজ হল, আল্লাহর জ্ঞানের ও কর্মের বিচার করা! আল্লাহ কেন তা জানলেন বা করলেন তা হিসাব করে বের করা!!
অপরদিকে মুমিন সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন যে, স্রষ্টার কর্মের বিচার করা মানুষের কর্ম বা দায়িত্ব নয়। তিনি কী জানেন, কী লেখেছেন, কীভাবে লেখেছেন, কী মুছেন আর কী রেখে দেন— কিছুই মানুষকে জানান নি। কারণ এসব জানা মানুষের কোনো কল্যাণে লাগবে না। এ সবকিছুই তাঁর মহান প্রতিপালন বা রুবুবিয়্যাতের অংশ। মানুষের কাজ হল, আল্লাহর দয়া, ভালোবাসা ও ন্যায় বিচারের উপর অবিচল আস্থা রেখে তাঁর নির্দেশ মতো কর্ম করা ও ফলাফলের জন্য কোনো প্রকারের উৎকন্ঠা বা উদ্বেগ মনে স্থান না দেওয়া।
ইসলামের তাকদীরে বিশ্বাস মুসলিমকে কর্মময় করে তোলে, কখনোই কর্মবিমুখ করে না। তাকদীরে বিশ্বাসের ফলে মানুষ সকল হতাশা, অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পায়। তাকদীরে বিশ্বাসী মুসলিম জানে যে, তার দায়িত্ব হল কর্ম করা, ফলাফলের জন্য দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা তার জীবনে অর্থহীন। কারণ ফলাফলের দায়িত্ব এমন এক সত্তার হাতে যিনি তাকে তার নিজের চেয়েও ভালোবাসেন, ভালো জানেন, যিনি দয়াময়, যিনি কাউকে যুলুম করেন না। যিনি তাঁর বান্দাকে কর্মের চেয়ে বেশি পুরস্কার দান করেন। এজন্য প্রকৃত মুমিনের অন্তর সর্বদা দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা মুক্ত।
তাকদীরে বিশ্বাস মানুষকে সকল অহঙ্কার, অতি উল্লাস ও হতাশা থেকে রক্ষা করে। সফলতা বা নিআমতে সে অহঙ্কারী হয় না। কারণ সে জানে যে, আল্লাহর ইচ্ছা ও রহমতেই তার সফলতা এসেছে। তার হৃদয় কানায় কানায় ভরে উঠে কৃতজ্ঞতায়। কৃতজ্ঞ হৃদয় আর অহঙ্কারী হৃদয়ের পার্থক্য হল, মানবিক ও পাশবিক হৃদয়ের পার্থক্য।
অপরদিকে মুমিন ব্যর্থতা ও পরাজয়ে হতাশ হয় না। সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুযায়ী সে ফল পেয়েছে। প্রেমময় করুণাময় প্রভু চাইলে এই ফল পরিবর্তন করতে পারবেন। নিশ্চয় এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এছাড়া বিশ্বাসীর জীবনে মূলত ব্যর্থতা বা পরাজয় বলে কোনো শব্দই নেই। কারণ সে জানে যে, কোনো কর্মের জাগতিক ফলাফলের হিসাবে সে ব্যর্থ হলেও আল্লাহর কাছে তার প্রচেষ্টা, কর্ম ও ধৈর্যের অফুরন্ত পুরস্কার সংরক্ষিত রয়েছে। জাগতিক বরকত ও আখিরাতের সাওয়াব হিসাবে সে তা লাভ করবে।
বই : মুসলমানী নেসাব
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহ.।