ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট

সামনে ঈদুল ফিতর।
সকল মাসের ন্যায় শাওয়ালের নতুন চাঁদ দেখে চাঁদ দেখার মাসনূন দোয়া করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা. হেলাল বা নতুন চাঁদ দেখলে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করতেন:
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ [باليمن] وَالإِيمَانِ وَالسَّلامَةِ وَالإِسْلامِ وَالتَّوْفِيقِ لِمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى رَبُّنَا [ربي] وَرَبُّكَ اللَّهُ
“আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। হে আল্লাহ, আপনি এই নতুন চাঁদের (নতুন মাসের) সূচনা করুন কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ঈমানের সাথে, শান্তি ও ইসলামরে সাথে {এবং আমাদের প্রভু যা ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন তা পালনের তাওফীকসহ।} (হে নতুন চাঁদ), আমাদের ও তোমার প্রভু আল্লাহ।”1তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫০৪, নং ৩৪৫১, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৩১৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩৯। হাদীসটি হাসান।

এরপর থেকে তাকবীর বলতে হয়। ঈদুল আযহার সময় পাঠের প্রসিদ্ধ ‘তাকবীর’ প্রত্যেকে নিজের মত মনে মনে বা মৃদু শব্দে তাকবীর বলতে হবে। সালাতুল ঈদ পর্যন্ত তাকবীর বলতে হয়।

রামাদানের সিয়ামের হুকুম দিয়ে আল্লাহ বলেন:
وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
“যেন তোমরা (রামাদানের সিয়ামের) সংখ্যা পূরণ কর, এবং আল্লাহর তাকবীর ঘোষণা কর; কারণ তিনি তেমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।”2সূরা বাকারা ১৮৫ আয়াত।

ঈদুল ফিতরের অন্যতম ইবাদত যাকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা। যদি ইতোপূর্বে ফিতরা আদায় করা না হয় তবে অবশ্যই ঈদুল ফিতরের দিন সকালে সালাতুল ঈদের আগেই তা আদায় করতে হবে। ঈদের দিনে সকালে গোসল করা, নতুন বা সুন্দর পোশাক পরা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত নির্দেশিত আদব। ঈদুল ফিতরের দিনে সালাতুল ঈদে গমনের পূর্বে কিছু খাদ্য গ্রহণ করা সুন্নাত। বুখারী সংকলিত হাদসে আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. কয়েকটি খেজুর না খেয়ে ঈদুল ফিতরের জন্য বের হতে না।… আর তিনি বেজোড় সংখ্যায় খেজুর খেতেন।”

অন্য হাদীসে বুরাইদা (রা) বলেন, “রাসূলুল্লাহ সা. ঈদুল ফিতরের দিনে খাদ্য গ্রহণ না করে বের হতেন না। আর তিনি ঈদুল আযহার দিনে ফিরে আসার আগে কিছুই খেতেন না। ফিরে এসে তার কুরবানীর পশুর গোশত থেকে ভক্ষণ করতেন।”3হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৪৩৩; তিরমিযী, আস-সুনান ২/৪২৬। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সালাতুল ঈদের অন্যতম সুন্নাত হলো, প্রশস্ত মাঠে তা আদায় করতে হবে।

রাসূলুল্লাহ সা. সর্বদা মাঠে যেয়ে সালাতুল ঈদ আদায় করতেন। মসজিদে নববীতে সালাত আদায় করার ফযীলত অনেক বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনো মসজিদের নববীতে সালাতুল ঈদ আদায় করতেন না। শধু একবার বৃষ্টির কারণে তিনি মসজিদে নববীতে সালাতুল ঈদ আদায় করেন। মদীনায় আরো অনেক মসজিদ ছিল যেগুলিতে জুমুআর সালাত আদায় করা হতো, কিন্তু তিনি সেগুলিতে ঈদের সালাত আদায় করার অনুমতি দেন নি। একই শহরে অনেক জুমআ মসজিদ থাকলেও রাসূলুল্লাহ সা. -এর যুগে, সাহাবীগণের যুগে ও ইসলামের সোনালী যুগে সালাতুল ঈদ একাধিক স্থানে আদায় করতে অনুমতি দেওয়া হতো না।

একই শহরে বা একই এলাকায় একাধিক স্থানে ঈদের সালাত আদায় করলে তা আদায় হবে কি না সে বিষয়ে ফকীহদের মতভেদ রয়েছে। আজকাল শহরগুলিতে বিশেষ করে প্রত্যেক মহল্লার মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করা হয়। এ কাজটি ইসলামী চেতনার পরিপন্থী, সুন্নাতের খেলাফ এবং মাকরূহ। ওযর ছাড়া মসজিদে সালাতুল ঈদ আদায় করা মাকরূহ বলে ফকীহগণ উল্লেখ করেছেন।

সালাতুল ঈদ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য ও ভালবাসার প্রতীক। এই সালাতে শহরের বা গ্রামের সকল মানুষ একটি বড় মাঠে একত্রিত হয়ে সালাত আদায় করবেন। সারা শহরের বা এলাকার সকলেই একস্থানে সমবেত হবেন, দেখা সাক্ষাত, সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। সারা বৎসর যাদের সাথে সাক্ষাত হয় না তাদের সাথেও এই উপলক্ষ্যে সাক্ষাত হবে। ছোটবড় সকলেই আনন্দ ও প্রাণচাঞ্চল্যে উদ্বেলিত হবেন।

আর এই সব উৎসব, আনন্দ ও প্রাণচাঞ্চল্যের মূল কেন্দ্র হবে ঈদের মাঠ ও সালাতুল ঈদ আদায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের যুগে ও মুসলিম উম্মাহর সোনালী দিনগুলিতে এই অবস্থায় ছিল। আধুনিক সভ্যতার স্বার্থপর মানসিকতার প্রভাবিত হয়ে আমরা ঈদের এই তাৎপর্যটি হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। এখন আমরা অন্যান্য পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের মতই ‘ঈদের সালাত’ আদায় করি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক!

ঈদের মাঠে হেঁটে যাওয়া সুন্নাত। এছাড়া এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া ও অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা সুন্নাত। কারণ এতে সকলের সাথে দেখা সাক্ষাত হয়, সাম্য ও ভালবাসা প্রকাশ পায়।
সূর্য পুরোপুরি উদিত হওয়ার প্রায় আধ ঘন্টা পর থেকে দুপুরের আগ পর্যন্ত ঈদুল ফিত্র-এর সালাত আদায় করা যায়। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বুঝতে পরি যে, রাসূলুল্লাহ সা. সূর্য উদিত হওয়ার ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে ঈদুল ফিতর এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যে ঈদুল আযহার সালাত আদায় করতেন।

সালাতুল ঈদ আদায়ে রাসূলুল্লাহ সা. -এর সুন্নাত ছিল ঈদের মাঠে পৌঁছে প্রথমে ঈদের সালাত আদায় করা। এরপর তিনি সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে খুতবা বা বক্তৃতা প্রদান করতেন। মহিলা মুসল্লীগণ যেহেতু মাঠের শেষ প্রান্তে বসতেন এজন্য সাধারণ খুতবার পর তিনি মহিলা মুসল্লীদের কাছে যেয়ে পৃথকভাবে তাদেরকে কিছু নসীহত করতেন। এরপর তিনি ঈদের মাঠ ত্যাগ করতেন।

বিভিন্ন হাদীসে ঈদের দিনে শরীরচর্চা ও বিনোদনের জন্য খেলাধুলা ও আনন্দে উৎসাহ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। বর্তমানে শরীরচর্চামূলক খেলাধুলার স্থান দখল করছে অলস বিনোদন। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, ঈদের দিনে এবং অন্যান্য সময়ে বিনোদনের নামে, খেলাধুলার নামে বেহায়াপনা, বেল্লেলপনা ও অশ্লীলতা সমাজকে গ্রাস করছে। ঈদ উপলক্ষ্যে বেড়ানোর নামে আমাদের মেয়েরা অর্ধ উলঙ্গ হয়ে দেহ, পোশাক ও অলঙ্কার প্রদর্শন করে বেড়ায়।

মেয়েদের জন্য বাইরে বোরোতে পুরো দেহ আবৃত করা আল্লাহ কুরআনে ফরয করেছেন। একজন মহিলার জন্য মাথা, চুল, কান, ঘাঢ়, গলা, বা দেহের যে কোনে অংশ অনাবৃত করে বাইরে যাওয়ার অর্থ প্রতি মুহূর্তে ব্যভিচারের মত একটি কঠিন কবীরা গোনাহে লিপ্ত হওয়া। এরূপ মহিলাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিশাপ দেওয়া হয় বলে হাদীসে বলা হয়েছে। ঈদের দিনে যারা এভাবে বের হয় তাদের অনেকেই রামাদানে কষ্ট করে রোযা রেখেছে। এদের অধিকাংশের পিতামাতা রোযাদার মুসলমান।

কিভাবে তারা এরূপ ভয়ঙ্কর পাপে লিপ্ত হন তা আমরা বুঝতে পারি না। আমরা যদি সত্যিই আল্লাহকে ভয় করি এবং আল্লাহর গযব থেকে বাঁচতে চাই তাহলে আমাদের সন্তানদেরকে এরূপ পাপ থেকে বাঁচাতে হবে।